somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে এলাম

১৪ ই জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আসসালামু আলাইকুম।

কেমন আছেন সবাই? অনেকদিন পরে হাজির হলাম সামুর দুয়ারে। মনে আছে কি আমার কথা?

ঘটনা হয়েছে যেটা তা হলো, আমি পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুতেই তা উদ্ধার করতে না পেরে পরিবর্তন করতে গেলাম। সেখানেও ঘাপলা বাঁধল। সেই ঘাপলা নিয়েই বসে ছিলাম এতদিন। উদ্ধার করার উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি।
আজ অনেকটা আশাতীতভাবেই বদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। তাই আমিও হাজির হলাম :) এতদিন পরে ঠিক কী পোস্ট দিয়ে নিজের আগমনীবার্তা জানাব, সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লাম।
ভেবেচিন্তে মনে হলো, একটা গল্পই পোস্ট করে ফেলি না কেন! সবাই না হোক, কেউ কেউ নিশ্চয়ই আমার গল্প একটু হলেও মিস করেছেন!

.....................

ছোটগল্প- মনের দেনা

****

ফুল্লুরী মন দিয়ে মুড়ি ভাজছিল। তাকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থির হয়ে আছে। মুড়িভাজা শেষ করেই শাশুড়িকে বিকেলের চা আর নাস্তা দিতে হবে। বেশি দেরি হয়ে গেলেই শাশুড়ি মুখ গোমড়া করে আউলফাউল প্যাঁচাল জুড়ে দিবে। সেইসব প্যাঁচাল শুনতে কোনোদিনও ভালো লাগে না তার।

‘আবাগীর বেটি! খাইয়া খাইয়া ঢাউশ শরীর বানাইছে! হেই শরীর নিয়া নড়বার পারে না! জলদি জলদি একটা কাম করবার পারে না! আমার পোলার খাইয়া হের মায়েরই অযত্ন করে! আল্লাহয় বেবাক কিছু দ্যাখতাছে!...’

মনে মনে সেই কথাগুলোর তীব্রতা স্মরণ করতে করতে কাজে জোর লাগায় ফুল্লুরী। মুড়িগুলো পুরোপুরি ফুটে ওঠার আগেই ঝাঁজরি দিয়ে বালু থেকে চেঁছে চেঁছে তোলে। কিছু কিছু চালও আস্ত থেকে যায়। সেইদিকে তাকিয়েও একটু চিন্তা লাগে। এই মুড়ি তো আবার শাশুড়িকেই খেতে দিতে হবে। নড়বড়ে দাঁতের নিচে চাল পড়ে দাঁতটাকে আরও নাড়িয়ে দিবে আর শাশুড়ির মুখের তুফান মেইল তড়বড়িয়ে ছুটে চলবে।


ফুল্লুরীর শাশুড়ির পয়সা আছে। পয়সার উৎস তার ছেলে রায়সুল। ছেলের পয়সার জোরে তার শাশুড়ির মাটিতে পা পড়তে চায় না। এই বয়সেও গলায় হাতে সোনার ঝিলিক ঝিকমিক করে রোশনাই দেয়। ফুল্লুরীর শ্বশুর মারা গেছে আজ প্রায় বছর ত্রিশেক হয়ে গেল। একা হাতে ছেলেকে মানুষ করে পয়সা বানানোর যোগ্য বানিয়েছে, এই গর্বে তার বুক সবসময়ই ফুলে থাকে। গ্রামে বাস করলেও তাদের আদবকায়দা শহুরে। প্রতিদিন চা খেয়ে দিন শুরু, বিকেলে চায়ের সাথে টা... কিছু একটা ব্যবস্থা রাখতেই হয়।

রায়সুল সৌদি আরব থাকে। প্রতি বছরে একবার দেশে এসে ঘুরে যায়। প্রবাসী হলেও রায়সুলের স্বভাব চরিত্র ভালো। ফুল্লুরীকে ছাড়া আর কোনও মেয়ের প্রতি তার আসক্তি হয়নি। বউয়ের টানে রায়সুলের বিদেশে পড়ে থাকা শক্ত দায়। তবু রুটি রোজগার বলে কথা! সবকিছু ফেলেফুলে দেশে চলে এলে তো আর দিন চলবে না!
ছেলে বছর বছর দেশে আসে দেখেও ফুল্লুরীর শাশুড়ি বড় গলায় মানুষকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘এমুন পোলা লাখে একটা জন্মায়! আমার পোলার কতা কই গো! মায়েরে না দেইখা থাগবার পারে না! বচ্ছর বচ্ছর দ্যাশে আইসা পড়ে!
ফুল্লুরী আঁচলে মুখ টিপে হাসে। স্বামীর বছর বছর দেশে আসার মাশুল তাকেই তো বইতে হয়! এই চব্বিশ বছরেই সে দুই বাচ্চার মা। কোলেরটা এখনো দুধ ছাড়তে পারেনি, এদিকে আরেকজন আগমনী বার্তা জানান দিতে শুরু করেছে।

রায়সুল আসার সময় ফুল্লুরীর জন্য সাজগোজের জিনিসপাতি, সংসারের শতেকটা দরকারি জিনিস সবকিছুই সঙ্গে করে নিয়ে আসে। শহরের লোকজন যেসব হাঁড়িতে রান্না করে... ফুল্লুরী ভালো করে সেটার নামও বলতে পারে না। ননইসটীক না কী জানি বলে... এই জিনিসও তার স্বামী সৌদি থেকে টেনে আনে। চা কফি বিদেশি চারকোনা চিনির ঢেলা... কিছুই বাদ নাই। কাজেই এইসব শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করার পেছনেও ফুল্লুরীর স্বামীরই অবদান বেশি!

মায়ের জন্য দামি জায়নামাজ তসবিহ, ফুল্লুরীর জন্য দামি সৌদি বোরখা... এসবও নিয়ে এসেছে রায়সুল। যখন যেটা লাগছে এর ওর হাতে পাঠানো তো আছেই! এছাড়াও প্রতি বছর দেশ থেকে ফেরার সময় মায়ের হাতে টাকার বাণ্ডিল দিয়ে আসে। প্রথম প্রথম বউয়ের হাতে দিত। কিন্তু একবার শাশুড়ি জানতে পেরে অনেক বড় হুলুস্থুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে ফুল্লুরীই স্বামীকে বলেছে, তার টাকা পয়সা লাগবে না। ওটা মায়ের হাতে দিলেই সে খুশি।
সৌদিতে গাড়ি চালায় রায়সুল। রোজগারপাতি ভালো। ফুল্লুরীর শাশুড়ি নাকের নথ দুলিয়ে দুলিয়ে গ্রামবাসীর কাছে গল্প শোনায়, ‘আইজ মরলেও চিন্তা কী! পোলায় আমার পুরা গেরামের মাইনষেরে খাওয়াইব! আল্লাহ্‌য় খাস রহমত নাজিল করব! চ্যালচ্যালাইয়া বেহেশতে চইলা যামু!’
গ্রামের লোকে ভেংচি কেটে বলে, ‘বুড়ির মুখের কথা শুইনা মইরা যাই! বেহেশতের ফেরেশতা পক্ষীরাজ ঘোড়া লইয়া খাড়াইয়া আছে হের লাইগা!’


এসব কথাবার্তা শুনে ফুল্লুরীর কাছেও ভালো লাগে না। তবু সে কিছু বলে না। মুরুব্বী মানুষ, আজ আছে কাল নাই। ছেলের জন্য একটু গর্ব অনুভব করে, তা তো করতেই পারে! ফুল্লুরীর নিজের ছেলে সবে পাঁচ বছরের। সেদিন বিল একাই সাঁতরে এপার ওপার করেছে। ফুল্লুরীর বুক কেঁপে উঠেছে ভয়ে। আবার অজানা এক গর্বও অনুভব করেছে সে। আহা! ওর ছেলের এত সাহস!
কাজেই শাশুড়ি যদি তার রোজগারক্ষম ছেলেকে নিয়ে একটু গুলগাপ্পি মারে তাতে মানুষের এত চোখ টাটানো ভালো নয়!

দ্রুত হাতে মুড়ি ভেজে একটু চানাচুর আর পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মেখে একটা বাটিতে রাখল ফুল্লুরী। আরেকটা বাটিতে একটা ক্ষীরা লম্বা লম্বা করে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল। তারপর একটা ট্রেতে করে সবকিছু গুছিয়ে শাশুড়িকে দিতে গেল। স্বামী ট্রে কিনে এনে বলেছে, ‘এইসব ঘরে ফালাইয়া থুইও না! ব্যবহার করোনের লাইগাই কিইন্যা আনি, বুঝবার পারছ?’

ট্রে টা শাশুড়ির কাছে নামিয়ে রেখেই চা বানাতে আবার পাকের ঘরে ঢোকে ফুল্লুরী। পাকের ঘরের দোরটা একটু উঁচুতে। বর্ষার সময় উঠানে পানি উঠলে পাকেরঘর ডুবে যায় দেখেই গতবছর থেকে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। দোরটা যে উঁচু করা হয়েছে, এই কথাটা ফুল্লুরীর প্রায়ই মনে থাকে না। বার কয়েক অসাবধানে হোঁচট খেয়েছে। তার চার মাস চলছে এখন। এভাবে বারবার দৌড়াদৌড়ি করে ওঠানামা করতে সদরের ডাক্তার আপা কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছে ফুল্লুরীকে। ভাগ্যিস, তার স্বামী এখন দেশে নাই। থাকলে তাকে কিছুতেই এভাবে কাজ করতে দিত না! কিন্তু বাসায় সে ছাড়া আছেই তো তার শাশুড়ি! তিনি কি এই বুড়ো বয়সে এভাবে দৌড়াদৌড়ি করে রান্নাবান্না করতে পারবেন?

ফুল্লুরীর আরেকবার পোয়াতি হওয়ার কথা শুনে অবশ্য শাশুড়ি মনে মনে বেজায় খুশি। ছেলে দুই হাতে টাকা কামাচ্ছে। সব কি ঐ আবাগীর বেটির ভোগে লাগার জন্য? নাতিপুতি দিয়ে ঘর ভরে না উঠলে ঘরের শোভা বাড়ে নাকি?
ফুল্লুরী যেন এই সুযোগে কাজকর্মে ফাঁকি না দেয়, সেজন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেও দিয়েছে, ‘আমরা কইলাম বাচ্চা প্যাটেত নিয়াই ধান ভানছি, লাকড়ি ফাঁড়ছি! কত ভারি ভারি কাম করছি! অহন তো মাইয়াগো পেট ভরতে না ভরতেই বেবাকের আগে কামকাইজ বন্ধ হয়! পরে হাতপায়ে পানি আইসা শরীরের আর হাল থাকে না! বুঝলা বউ, কামের মইদ্দে থাকগে ভালা থাকে মানুষ... এইডা সবাই বুঝে না!’

ফুল্লুরী পাতিলে চায়ের পানি বসায়। ঘর থেকে শাশুড়ির হাঁকডাক শোনা যায়, ‘খালি চানাচুর দিয়া এই শক্ত মুড়ি চাবাইবার পারি আমি? একটু বুট রান্না কইরা দিলে কি হাত খইসা পড়ত তুমার? কই ও বউ মরলা নাকি?’

শাশুড়ির ডাকে সাড়া দিবার আগেই ফুল্লুরীর কোলের ছেলেটা চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে পাকেরঘরে ঢুকেছিল ফুল্লুরী। আরও অন্তত দুই ঘণ্টা ঘুমায় তার ছেলে। আজ এত জলদি উঠে গেল! তার মানে বাকিটা সময় তাকে আর কাজ করতে দিবে না! ছেলেটা খুবই যন্ত্রণা করে। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। আজকে অসময়ে উঠে পড়ল। সারাক্ষণই খ্যান খ্যান করবে এখন।

ফুল্লুরী শাশুড়িকে কোনোমতে চা টা দিয়েই বাচ্চাকে সামলাতে দৌড় দেয়। দৌড়াতে গিয়ে আজকেও একটা মস্ত অঘটন ঘটিয়ে বসে। শাড়ির নিচের অংশ আলগা হয়ে পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ফুল্লুরী হুড়মুড়িয়ে শাশুড়ির ঘরের দোরেই উল্টে পড়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, আজ কিছু একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। পেটের মধ্যে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। হঠাৎ চোখেমুখে কেমন জানি অন্ধকার দেখতে শুরু করে ফুল্লুরী। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে একসময়।

জ্ঞান ফিরতেই বুঝতে পারে, তাকে একটা ভ্যানে চড়িয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিয়রের কাছে বসে আছে পাশের বাড়ির রহিমা খালা। চেতন অবচেতনের মাঝখানে ফুল্লুরী নিজের ছেলেদুটোকে খুঁজতে থাকে। আজ কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়ানো হয়নি। বড় ছেলেটা মাঠ থেকে ফিরে এসেছে এতক্ষণ। সেও নিশ্চয়ই আকুল হয়ে মাকে খুঁজছে। আর তার শাশুড়িই বা একা একা কী করবে? ফুল্লুরী তো রাতের রান্নাটাও আজ চড়াতে পারেনি।
অস্ফুটে কিছু একটা বলে ওঠে ফুল্লুরী। রহিমা খালা বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন। মাথা নেড়ে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলেন তাকে। ফুল্লুরীর পেটের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু একটা বুঝি খসে গেছে বাঁধন ছিঁড়ে। বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে ফুল্লুরীর। অস্ফূট উচ্চারণে সেও বিড়বিড় করে ওঠে, ‘আহারে সোনা আমার... কইলজার টুকরা আমার... তুই আইলি না আমার বুকে...!’


প্রায় সপ্তাহখানেক সদরের হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি হলো ফুল্লুরীকে নিয়ে। শরীর থেকে অনেকখানি রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। ভ্রূণটা শরীর থেকে খসে পড়ার আগে তার না হতে পারা জন্মদাত্রীকেও বুঝি সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
এই সাতদিন দুই নাতিকে সামলিয়ে, রান্নাবান্না আর ঘরের কাজকর্ম সব এক হাতে করে ফুল্লুরীর শাশুড়ির মেজাজমর্জি সপ্তমে চড়ে গেছে। ছেলেকে ফোন করে ছেলের বউয়ের নামে এক গাদা ঝাল ঝেড়েছে মনের সাধ মিটিয়ে।
‘আবাগীর বেটি... নড়তে চড়তে পারে না! বাচ্চা প্যাটে ক্যামনে থুইতে হয় হেইডাও বুঝে আসে না! আমার নাতিডারে খাইল! কত্ত আরামে আয়েশে থুইছিলাম হ্যারে! দুইডা রান্না করতে কী এমন কষ্ট লাগে! ভাব দেইখা মনে হইতাছে দুইনায় খালি হেই বুঝি পোয়াতি হইছিল!...’
ফুল্লুরীর স্বামী রায়সুল মাত্র কয়েক মাস আগেই দেশে এসে ঘুরে গেছে। তবু নিজের বউয়ের এমন নাজুক অবস্থায় সে আরেকবার ছুটির দরখাস্ত করে বসে। তার মালিক বড় ভালোমানুষ। একটু আবেগঘণ ভাষায় অবস্থা বয়ান করতেই একেবারে এক মাসের ছুটি মনজুর করে দিয়েছে!

ছেলেকে কাছে পেয়ে ফুল্লুরীর শাশুড়ির পোয়াবারো হয়। মনের সুখে নিজের সাতদিন কাজ করার জ্বালা মেটায়। এই কদিন তিনি বুড়ো মানুষ কত কষ্ট করে দুইটা নাতিকে সামলে সবকিছু নিজের হাতে করেছেন সেই কথা বলতে বলতে দিনের মধ্যে একশবার কান্নাকাটি করতে থাকেন! ওদিকে ফুল্লুরীও তার গর্ভের অনাগত সন্তানকে হারিয়ে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে। কখনো মুখে মুখে কথা না বলা ফুল্লুরী এবারে শাশুড়ির দুই একটা কথার বেশ উত্তরও দিয়ে দেয়। ব্যস! তাতেই ঘি পড়ে আগুনে! শাশুড়ির মাথায় একেবারে আগুন চড়ে যায়। সারা পাড়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফুল্লুরীর মা-বাপ ভাইবোনের নাম নিয়ে মাতম তুলে ফেলে।

ওদিকে রায়সুল পড়ে মহাবিপাকে। স্ত্রীকে সে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু মায়ের কথাও তো অন্যায্য নয়! পোয়াতিকে তো আরেকটু সতর্ক হয়েই কাজ করতে হয়। অসতর্ক হয়ে কত বড় অঘটনটা ঘটিয়ে বসল! আর তার মাকেও এই বয়সে পাকেরঘরে যেতে হলো!

বহুদিন পরে নিজের মা-বাবাকে মনে করে চোখের পানি ফেলল ফুল্লুরী। জায়নামাজে বসে চোখের পানি আজ তার প্লাবন নামাল। আজ এই দুর্দিনে স্বামীও তাকে চিনতে পারল না! সে আর কাউকেই কিছু বলতে যাবে না! সব কথা হবে আল্লাহর সাথে। উঠতে বসতে শাশুড়ির তীক্ষ্ণ জিভের ধারওয়ালা সব কথা শুনতে শুনতে তার মনের ভেতরটা ফালাফালা হয়ে গেছে। সেই ক্ষতবিক্ষত মনটাকে সে তার প্রভুর কাছেই পেশ করবে।

পরদিন ভোর হতেই ঘটে গেল আরেক অঘটন। গতকাল রাতের ঐ ঝগড়াঝাঁটির পরেই নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিল রায়সুলের মা। প্রতিদিন কাকভোরে যার ঘুম ভাঙে, সেই মানুষ আজ আটটা নয়টা অব্দি ঘরের দোর খোলে না দেখে চিন্তায় আকুল হয় রায়সুল। পরে অনেক ডাকাডাকির পরেও যখন দরজা খোলা হয় না, তখন দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢোকে রায়সুল আর ফুল্লুরী। ঢুকে দেখে বিছানায় অর্ধেক শরীর আর মেঝেতে অর্ধেক শরীর এলিয়ে পড়ে আছে তার... প্রাণবায়ু চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই!
মৃতা শাশুড়িকে পাশে রেখেই আরেকদফা গালাগালি চলে ফুল্লুরীর ওপরে। এবারে গালাগাল বর্ষণ করে ফুল্লুরীর স্বামী রায়সুল।


রায়সুল মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে কোনো ত্রুটি রাখে না। পুরো গ্রামের সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। মসজিদ মাদ্রাসায় দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। গ্রামের এতিমখানার বাচ্চাদের পেটপুরে দুই দিন ধরে খাওয়ায়। গ্রামের মানুষকে ডেকে ডেকে হাত ধরে নিজের মায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়। মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে কেউ যেন মনে না রাখে। তার মৃতা মাকে যেন ক্ষমা করে দেয় গ্রামের সবাই।
ফুল্লুরী আড়াল থেকে সবকিছুই দেখে। স্বামী সেদিনের পর থেকে তার সাথে আর ভালোভাবে কথাও বলে না!


ছুটি ফুরালে রায়সুল সৌদি ফিরে যায়। যাওয়ার আগে রাগতগলায় বউকে বলে, ‘মায়ে মরছে আমার! এইবার আরাম কইরা থাকো। মায়ে ঠিকই কইত! আবাগীর বেটি তুমি! বেবাক কিছু খাইতে আইছ! খাও অহন বইসা বইসা! দিয়া গ্যালাম!’


তার স্বামীকে নিয়ে ভ্যানগাড়ি অদৃশ্য হয় সদরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে বাসে করে ঢাকা। ফুল্লুরীর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

ফুল্লুরীর মনের কাছেও যে কিছু দেনা ছিল তার মায়ের, এটা তো রায়সুল জানতেও পারল না! সে তো মায়ের জন্য কেঁদেকেটে সবার দেনাই শোধ করিয়ে নিলো!
ফুল্লুরীর দেনাটা যে পাওনা রয়ে গেল!


#ফাহ্‌মিদা_ বারী

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৭
১৩টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×