somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নস্টালজিয়া (প্রথম পর্ব)

২৩ শে আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(আমার মতো যারা নব্বই দশকের তরুণ অথবা কিশোর, তাদের জীবনের সেই নস্টালজিয়াগুলোকে কি মণে পড়ে? ফেসবুকের একটা গ্রুপের জন্য কয়েক পর্বে এইসব নস্টালজিয়ার গল্প বলেছিলাম। পর্বে পর্বে শেয়ার করছি সামুর পাঠকদের সাথে।)

#নস্টালজিয়া
#প্রথম_পর্ব
#ফেরির দিনগুলো

পদ্মা সেতু দেখে এলাম সেদিন। এর আগে অবশ্য সেতুর ওপর দিয়ে প্রমত্তা পদ্মাকে অতিক্রম করে খুলনা থেকে ঘুরে এসেছি। কিন্তু সেতুর নীচ দিয়ে নৌকায় করে প্রাণভরে সেতুকে সেদিনই প্রথম দেখলাম। মাওয়াঘাটের বিখ্যাত ইলিশভাজা আর ভর্তা সহযোগে ধোঁয়া ওঠা ভাত খেলাম। অন্যরকম অনুভূতি।

আমি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নই। পদ্মা পার হতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীপথের যাতনার কথা আমার জানা নেই। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষ হওয়ার সুবাদে সেই একই কষ্ট আমিও ভোগ করেছি অনেককাল… যমুনা পার হতে গিয়ে। তারপর যেদিন যমুনা ব্রিজ উদ্বোধন করা হলো সেদিন আমাদের সে কী আনন্দ! আহা! দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ আর ভোগান্তি থেকে এক নিমেষে ছুটি! এখন বাড়ি চলে যাব ফুড়ুত করে! বাসে উঠব আর ব্রিজ পার হলেই বাড়ি... মায়ের স্নিগ্ধ আঁচলঘেরা শ্যামল বাড়ি!


যমুনা ব্রিজের মাইলফলকটা ছুঁয়ে ফেলার পরে সত্যি সত্যি আমরা মহাসুখে বাড়ি যেতে শুরু করলাম। সালটা ছিল ১৯৯৮। আমি তখন গ্র্যাজুয়েশন করছি বুয়েটে। যানজটের তীব্র যন্ত্রণাতে কী যে ভয়াবহ সব দিন পার করেছি! এমনও হয়েছে, সকাল সাড়ে সাতটায় বাসে উঠে বসেছি। বাড়ি পৌঁছেছি পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায়। চব্বিশটা ঘণ্টা কাটিয়েছি বাসে। এই ঘটনাগুলো বেশি ঘটত ঈদের সময়। তখন আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে বাসে উঠে বসতাম। নামব কখন ঠিক নাই। এছাড়া অন্য সময়েও যাত্রা মোটেও সুখের হতো না। বাসে বসে থাকতে থাকতে অস্থির লাগত একেকটা সময়। বেশি রাত হয়ে গেলে বাড়িতে মা-বাবা চিন্তায় অস্থির হতেন। জয়পুরহাটে নেমে ভ্যানগাড়ি, রিক্সা কিংবা অটো নিয়ে আরও প্রায় মিনিট কুড়ির পথ।
সেই তরুণ বয়সে কোথা থেকে যে এত সাহস পেয়েছি জানি না। হয়ত বাড়ি যাওয়ার প্রবল আনন্দে পথের কষ্টকে কষ্ট বলেই মনে হয়নি। উত্তরবঙ্গের আরও ক’জন বন্ধুবান্ধব একসাথে মিলে বাড়ি গিয়েছি। কেউ নেমে পড়েছে বগুড়া, কেউ সিরাজগঞ্জ। আমি গিয়েছি সেই প্রত্যন্ত জয়পুরহাট। যমুনা ব্রিজ হওয়ার পরে সেই যাতনার অবসান হলো। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

বাঁচলাম? হ্যাঁ তা তো বটেই! কিন্তু মানুষের মনের চেয়ে অদ্ভুত কোনো কিছু কি এই পৃথিবীতে আছে? মনের কোন গহীনে ভালোলাগা কিছু টুকরো আবেগের মেঘ এসে জমাট বেঁধেছিল, সেটা জানাই হয়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে মনে পড়ে যায় সেই সময়ের বাস জার্নিকে। মনে পড়ে যায়, বাস জার্নির মাঝের সেই নদী পারাপার বিরতিকে। সেই ফেরির সময়টুকু! সময়টুকু ছিল যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো শিমুল তুলোর মতো একখণ্ড স্বস্তি।
ব্রিজ তো দুই পাড়ের সাথে সংযোগ ঘটিয়েই ছাড়ল, কিন্তু মনের সাথে ফেরির যে কত সুদীর্ঘ সময়ের চেনাজানা আর আত্মিক সংযোগ... সেটাতে যে একেবারে যতিচিহ্ন পড়ে গেল!


প্রতি সেমিস্টার শেষে একবার করে তো বাড়ি যাওয়া হতোই। মাঝে মাঝে সেমিস্টারের মাঝখানে লম্বা ছুটি পেয়ে গেলেও হুট করে বাড়ি চলে যেতাম। প্রতিবারই ফেরিতে কাটত ভালোলাগার কিছু সময়। আব্বা মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে ঢাকা যেতেন। কখনো কখনো আমি একা একাও বাড়ি থেকে ঢাকায় গিয়েছি। তবে শুরুর দিনগুলোতে আব্বা একা ছাড়তে চাইতেন না। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম, জীবনটা ডালপালা ছাড়ছিল। ওড়ার ডানা বুঝি বড় হচ্ছিল। একা একা উড়তেও শিখে গেলাম।

ফেরিতে যখন বাস এসে ঢুকত, সেই সময়টা মনে মনে প্রস্তুতি নিতাম। দীর্ঘ আড়াইটা ঘণ্টা এখন ফেরিতে কাটাতে হবে। একটা বড় ফেরিতে বেশ অনেকগুলো বাস উঠত। ঢাকায় ফেরার পথে দেখতাম, রাজশাহী রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া... হরেক জায়গার বাস এঁটেসেটে জায়গা করে নিত। সেই সময় নানারকম মুখরোচক ঘটনাও ঘটত।


বয়স তো ছিল কাঁচা। সেই কাঁচা বয়সের সবুজ ক্যানভাসে কত শত রঙের প্রলেপ যে পড়ত, সেসব আর এই বয়সে এসে অস্বীকার করি কেমন করে! দুই একটা ঘটনা বলেই ফেলি এই সুযোগে।

একবার ফেরিতে নেমে একটা ম্যাগাজিন কিনে পড়ছিলাম। এখনও সেই ম্যাগাজিনের নামটা মনে আছে। ডা মোহিত কামাল সম্পাদিত ‘মৌচাকে ঢিল’। এত ভালো লাগত পড়তে তখন!
পাশেই এক ডাব বিক্রেতা ডাব বিক্রি করছিল। একটি ছেলে তার কাছ থেকে ডাব কিনে খুব মন দিয়ে সেটা খাচ্ছে আর আড়ে আড়ে আমাকে দেখছে। কেতাদুরস্ত বেশবাস। দেখে ঠিক ছাত্র বলে মনে হয় না। সবে ছাত্রজীবন শেষ করেছে সম্ভবত। আমি ‘কিছুই দেখিনি’ এমন একটা ভাব নিয়ে রাজহংসীর মতো গলা বাঁকিয়ে ‘মৌচাকে ঢিল’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আব্বা এসে ডাকতেই একটু তাড়াহুড়া করে চলে গেলাম। হাতের ম্যাগাজিনটাকে বাসে রেখে এসে আব্বার সাথে ওপরের ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে তখন অনেক যাত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। যমুনার অথই পানি কেটে ছুটে চলা ফেরিতে বাতাস হুটোপুটি খেলছে সবার সাথে। মধুর তারুণ্যের রঙিন সময় তখন। সামনের অদেখা জীবন কী নিয়ে অপেক্ষা করছে তা তখন ভেবে দেখার অবকাশ কোথায়?
ফেরির সময় শেষ হওয়ার পরে বাসে ফিরে গিয়ে আবার ম্যাগাজিনটাকে হাতে তুলে নিলাম। ওমা! কয়েক পাতা উল্টাতেই দেখি একটা ঠিকানা লিখে রাখা। সেই সময় তো আর মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। শুধু কারও কারও বাসাতে ল্যান্ডফোন নামক দুর্লভ জিনিসটার দেখা মিলত। এই ঠিকানাটির নিচে একটা ল্যান্ডফোন নাম্বারও দিয়ে রাখা। ‘ভেজা বেড়াল’ কোন ফাঁকে আমার বাস এমনকি আমার সিটটাও মনে মনে টুকে নিয়েছে, কে জানে!
তখন সত্যিই এক অন্যরকম সময়। বান্ধবীরা নাম্বার গুণে রাখতাম। না না, মোবাইল নাম্বার না। কে কয়টা প্রপোজাল পেলাম সেই নাম্বার! কাজেই সেই ‘ডাব ক্রেতা’ কে চিঠি না দিলেও তার নামটা একটা নাম্বার হয়ে থেকে গেল জীবনে।

একবার বাস ফেরিতে ওঠার পরে জিনিসপাতি গুছিয়ে নিচে নেমে এলাম। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শুনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি আমার কলেজের একজন ক্লাসমেট। ডিএমসিতে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ ছাড়ার পরে সেদিনই প্রথম দেখা তার সাথে। পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ে গেল। কোএডুকেশন কলেজে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে একটা গোপন রেষারেষি ছিল। সেদিন সেই রেষারেষির কথা মনে করে হাসাহাসি হলো। কী করা হয়...কী করা হবে... এসব নিয়ে টুকটাক গল্প হলো। ফেরির সময় পার হতেই আবার যে যার পথে। ওর সঙ্গে কি আর কোনোদিন দেখা হয়েছিল? হ্যাঁ মনে পড়ে, পাশ করার পরে একদিন ঢাকা মেডিকালে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়ের খোঁজ নিতে। সেদিন এপ্রোন পরিহিত তরুণ ডাক্তারটি সামনে এসে দাড়িয়েই ফিক করে হাসি! কিন্তু সে আরেক গল্প।


আব্বা আর আমি মাঝে মাঝে ফেরিতে ভাত খেতাম। এটা ছিল অন্যরকম মজা! নদীর টাটকা বাতাসে চনমনিয়ে ক্ষুধা জেগে উঠত। জানি না কেন, ফেরির এই ভাত মাছ কিংবা সামান্য ভাজি ভর্তা এত যে সুস্বাদু হতো! প্রচুর মশলা দিত তরকারিতে। তবুও খারাপ লাগেনি কখনো। আম্মা সাথে করে লুচি পরোটা মাংসের তরকারি দিয়ে দিত। তাই এই ভাত খাওয়াটা সবসময় হতো না। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে আব্বাই নিজে থেকে আমাকে বলত, ‘মা ভাত খাবা ফেরিতে?’ আমি তো খুশিতে বাকবাকুম করতাম রীতিমত। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে বেশি বেশি তেল নুন আর মশলা সহযোগে রুই মাছের ঝোল খেতে কী যে মজা লাগত! সেই স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে। বড় হোটেলের স্বাদও যার কাছে দিব্বি হেরে বসে থাকে!

পরিমিত নুন ঝালের মিশ্রণে জীবন তো বয়ে চলেছে ছন্দময় গতিতেই। তবু মাঝে মাঝে এত অরুচিতে পেয়ে বসে কেন জানি না! কীসের যেন একটা অভাব বোধ করি। কী যেন নাই! কী যেন হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতো!
জীবনের ক্ষুধাটাও বুঝি ছোট ছোট এই নস্টালজিয়ার টাটকা হাওয়াতেই চনমনে হয়ে ওঠে। এই অনুভূতি এমনই এক ভালোবাসার আবেশ ছড়িয়ে রাখে বুকের ভেতর, যাকে নেড়েচেড়ে দেখার মাঝেও অনাস্বাদিত সুখ!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৫২
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×