নিগম্ব থেকে অনুরাধাপুরার দূরত্ব একশ পঁচাত্তর কিলোমিটার। উত্তর পশ্চিমের জেলা শহর পুত্তালাম পর্যন্ত প্রায় পুরোটা পথের পশ্চিম পাশ জুড়ে সমুদ্র। এই একশ কিলোমিটার চলার পথে মাঝে মাঝেই সমুদ্র দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। এরপরে পুত্তালাম থেকে পথ ঘুরে গেছে উত্তর-পূর্ব দিকে। একটানা ঘণ্টা দুয়েক চলার পরে আমাদের মনে হলো এবারে কোথাও থামা দরকার, কিছুটা নিজেদের প্রয়োজনে আর কিছুটা ড্রাইভারকে হাত পা ছড়াবার সুযোগ দেবার জন্যে। একটু ডাইনে ঢুকে ভাণ্ডারি যেখাখন গাড়ি পার্ক করলো সেটি একটি রিসর্ট কাম রেস্তোরা। মহাসড়কের খুব কাছে গাছ পালায় ঘেরা এই পান্থ নিবাসে একেবারেই লোকজন নেই দেখে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। তবে পরে এই রহস্যজনক নির্জনতার একটা কারণ খুঁজে বের করা গেছে। এই আপাত হাইফাই রিসর্টটি তেমন বিলাশবহুল না হলেও যথেষ্ট ব্যয় বহুল। এখানে এককাপ সাধারণ চায়ের মূল্য দুশ রূপি, যা কলম্বো অথবা ক্যান্ডির যে কোনো ভালো রেস্তোরায় পঞ্চাশ থেকে ষাট রূপির বেশি নয়। তার চেয়ে বড় কথা এখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্যেও দিতে হলো জনপ্রতি পঞ্চাশ রূপি। দু একজন ভুলবশত টয়লেটে ঢুকে পড়লেও মহামূল্যবান চা পানের অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমরা দ্রুত এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম। আমাদের বেরিয়ে যাবার গতির চেয়েও দ্রুততার সাথে ফ্যানের সুইচগুলো অফ করার দৃশ্যটিও বেশ অবাক হবার মতো একটি ব্যাপার। সারা শ্রীলঙ্কায় এই একটি ঘটনা ছাড়া এদেশের মানুষ সম্পর্কে আমাদের কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নেই।
মহাসড়কে উঠে পুত্তালাম শহরে ঢুকবার ঠিক আগেই সমুদ্রের তীরে একটা বিচপার্ক জাতীয় জায়গায় আর একবার গাড়ি থেকে নামলাম। এখানে সাগরের পাড় ঘেসে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। মাথার উপরে লাল টালির ছাউনি দেয়া বসার জায়গাও রয়েছে গোটা কয়েক। বিকেল বেলাটা এখানে কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। আমাদের হাতে কয়েকটা ছবি তোলার চেয়ে বেশি সময় নেই। যাদের এখন অফুরন্ত সময় তেমনি কয়েক জোড়া তরুণ তরুণী বেলা এগারোটার কড়া রোদে বেলাভূমির আসন আলো করে বসে আছে। আমরা যখন বিচপার্কে ছবি তোলায় ব্যস্ত তখন আমাদের অর্থ ও খাদ্য ব্যবস্থাপক নয়ন অনূঢ়ার সাথে আলোচনা করে তাকে তার কর্তব্য কর্ম মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছে। কোথায় কী ধরণের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং কোথায় কখন চা বিরতি দিলে চলবে, এ সব বুঝতে অনূঢ়ার মোটেও সমস্যা হয়নি। ফলে পুত্তালাম শহরে ঢোকার মুখেই রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামালো ভাণ্ডারি। এখানে ত্রিশ রূপিতে বেশ বড় এককাপ চা খেয়ে বলতেই হলো, ‘চমৎকার!’
আমাদের গন্তব্য অনুরাধাপুরা। কাজেই উত্তর শ্রীলঙ্কার এই জেলা শহর ঘুরে দেখার সময় ছিল না। তবে জানা ছিল পুত্তালাম শহরের বসবাসকারীদের শতকরা নব্বইজনই মুসলমান। বিভিন্ন স্থাপনা এবং রাস্তাঘাটের নাম থেকে বোঝা যায় কয়েকশ বছর আগে মূরদের যে আধিপত্য এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অবশেষ নিয়ে নয়, রীতিমতো দাপটের সাথে তারা এখনো টিকে আছে। ফাতিমা ওমেন্স কলেজ, আল ফালাহ হাসপাতাল, নূর নগর বাসস্ট্যান্ড এবং গ্রান্ড মসজিদ রোড- এ সব নাম ফলক থেকে কিছুটা হলেও এই শহরের জীবনাচরণ সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ ধর্মের অসংখ্য উপাসনালয়, বিহার এবং স্তুপার মধ্যে অনুরাধাপুরা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তীর্থ। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই প্রাচীন নগরীর ব্যপ্তি ২৬ বর্গ কিলোমিটার, যা বর্তমান কালের অনেক আধুনিক রাজধানী শহরের তুলনায়ও নেহায়েত কম নয়। ৪১১ খ্রিস্টাব্দে এই নগরীর প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন অভয়গিরি বৌদ্ধ বিহারের জাক জমকে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনা অনুসারে ৪০০ ফুট দীর্ঘ এই প্যাগোডার অলঙ্করণে ব্যবহৃত হয়েছে সোনা এবং রূপাসহ নানা মূল্যবান ধাতব পদার্থ। অনুরাধাপুরার প্রাচীন নগর কেন্দ্রে প্রবেশের পথেই এর বিশালত্ব সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করা যায়। মিউজিয়ামসহ পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা পরিদর্শনের জন্য আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম থেকে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এটি ছাড়া অনুরাধাপুরায় রয়েছে আরো দুটি মিউজিয়াম। তবে সময়ের অভাবে সবগুলো মিউজিয়ামে ঘোরা সম্ভব হয়নি।
মিউজিয়াম সংলগ্ন টিকেট কাউন্টার থেকে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেতে হলো। শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের জন্যে প্রবেশ মূল্য ৩০ শ্রীলঙ্কান রুপি হলেও বিদেশিদের জন্যে তা ৩০ ডলার অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার টাকা। তবে সার্ক দেশের অতিথিদের জন্যে ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট। আটজনের আটটি পাসপোর্ট দেখিয়ে টিকেটের গায়ে পাসপোর্ট নাম্বার লিখে কাউন্টারের মহিলাটি যখন জনপ্রতি ১৯৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি গুনে নিলেন তখন হিসাব করে দেখলাম শতকরা পঞ্চাশভাগ ছাড়ের পরেও আটজনের জন্যে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা। যে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন বা ঐতিহাসিক স্থাপনা এক দিনের জন্য পরিদর্শনের ক্ষেত্রে অংকটা যথেষ্ট বেশি বলেই মনে হয়। শ্রীলঙ্কার ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিওলজির মহাপরিচালক মহোদয় অবশ্য টিকেটের গায়ে ভদ্রতা করে লিখে দিয়েছেন ‘বিশ্ব ঐহিত্যের নিদর্শন সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আপনার সহৃদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ’!
শ্রী মহাবোধি মন্দির থেকে শুরু হলো আমাদের তীর্থ দর্শন। আড়াই হাজার বছর আগের রোপিত বোধিবৃক্ষের তলায় এই বিশাল উপাসনালয় এখনও ভক্ত পুরোহিত পূজারি দর্শনার্থী মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর। ভক্তদের হাতে হাতে শ্বেতপদ্মের গুচ্ছ আর অধিকাংশের পোশাকও শ্বেতশুভ্র। সাদা শাড়ি পরিহিতাদর বাদ দিলে মেয়েদের অনেকেই পরেছে সাদা টপস এবং কাল স্কার্ট, সাদা ফ্রক অথবা ব্লাউজের মতো জামা। পুরুষদের পোকাশেও সাদার আধিক্য লক্ষ করা যায়। বিষয়টা জানার পরে দেখলাম আমাদের অনূঢ়া এবং বান্দারা দুজনেই পরেছে সাদা সার্ট এবং কাল প্যান্ট। কোনো কিছু না জেনেই আমি পরেছিলাম সাদা টি-সার্ট এবং কাল প্যান্ট। মহাবোধি মন্দিরে প্রবেশের আগে অনূঢ়া বলে উঠলো, ‘ইওর ড্রেস ইজ পারফেক্ট ফর ওয়ারশিপ ইন দিস টেম্পল।’
পোশাক ঠিক থাকলেও আমার নিয়ত ঠিক ছিল না বলে পূজা দেয়ার জন্যে শ্বেতপদ্ম কেনারও প্রয়োজন হলো না। তবে মূল মন্দির চত্বরে ঢোকার আগে নির্ধারিত ঘরে জুতা স্যান্ডেল জমা দিতে হলো। নগ্নপায়ে বেশ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুদৃশ্য তোরণ পার হয়ে ঢুকে পড়লাম মূল মন্দির চত্বরে। খালি পায়ে হাঁটার শুরু থেকে মূল চত্তরে প্রবেশের আগে পর্যন্ত পথের পাশে পায়ের তলায় ঘাস ছিল, গাছপালার শাখাপ্রশাখায় মাথার উপরে ছায়া ছিল কিন্তু মন্দিরের পা দেয়া মাত্র বোঝা গেল বাধানো চত্বরের প্রস্তর খ- এবং উঠানে ছড়ানো বালি তেতে আগুন হয়ে উঠছে। কোথাও পা রেখে দাঁড়ানোর উপায় নেই। আমরা দ্রুত পা ফেলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাই আর দাঁড়াবার জন্যে গাছের ছায়া অথবা ভবনের আড়াল খোঁজ করি। আমরা যখন প্রতি মুহূর্তে পায়ে ফোস্কা পড়ার আশঙ্কায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছি, তখন আমাদের অবাক করে দিয়ে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ পূণ্যার্থী ধির পায়ে প্রায় ধ্যানমগ্নভাবে হাতে পুষ্পার্ঘ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের পূণ্যের জোরেই হোক আর ভক্ত হৃদয়ের অভিনিবেশের জন্যেই হোক পায়ের তলার উত্তাপ তারা গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে বলে মনে হলো না।
ভগবান তথাগতের চরণতলের বেদীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় পুষ্পার্ঘ অর্পনের দৃশ্য দেখলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। তারপর বেরিয়ে পড়লাম বিস্তৃত চত্বরে। এখানে সেখানে অনেকগুলো সুদৃশ্য তোরণ অধিকাংশই সাদা, কোনো কোনোটিতে সোনালি কারুকাজ, কোথাও ঝুলছে ঘণ্টা। শাখা প্রশাখা বিস্তার করে বিশাল এলাকা জোড়া জ্ঞানবৃক্ষ- সোনালি রেলিং দিয়ে ঘেরা আড়াই হাজার বছরের পুরোনো ডুমুর গাছ। বোধিবৃক্ষ পর্যন্ত উপরে ওঠার পাথরের সিঁড়ি আর সিঁড়ির গোড়ায় পাথরে খোদাই করা মূর্তি। অনেকগুলো মূর্তির সাথে আমাদের দেশের বিষ্ণু অথবা শিব মূর্তির সাদৃশ্য দেখা যায়। এ ছাড়া মকর এবং গড়ুর সাদৃশ্য প্রতিকৃতিও চোখে পড়ে। আর না দেখতে চাইলেও মূর্তিমান উৎপাত হিসাবে মাঝে মধ্যেই উপস্থিত হয়ে যারা তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়, তারা হয়তো আমাদেরই অতি প্রাচীন পূর্ব পুরুষের বর্তমান বংশধর। সারা মন্দির চত্বর জুড়ে মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল বানর।
মহাবোধি থেকে বেরিয়ে পাদুকা সংগ্রহের সময় দেখা গেল জুতা রাখার জন্যে কোনো নির্ধারিত ফি নেই, স্বেচ্ছায় যে যা দেয় তাই সই। আমাদের ব্যবস্থাপক আট জোড়ার বদলে একটা একশ রূপির নোট হাতে ধরিয়ে দিল। এরপর গাড়িতে ওঠার আগে কেনা হলো লবন মরিচ মাখানো কাঁচামিঠা আম। দুপুরের রোদে শ্রীলঙ্কার টক মিষ্টি আমের স্বাদ উত্তাপ এবং ক্লান্তি, বিশেষ করে পা পোড়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিল। এরই মধ্যে সম্ভবত খোকন বলে উঠলো, অনুরাধারাপুরার নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল অনুরাধা পোড়া। কে যেনো তাকে সংশোধন করে বললো ‘অনুরাধা পা পোড়া’ হলে আরও ভালো হয়। শ্রীলঙ্কা সফরের শেষপর্যন্ত অবশ্য অনুরাধাপুরা আমাদের আলোচনায় ‘অনুরাধা পাপুড়া’ হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে রইলো।
অনুরাধাপুরার অবশ্য দর্শনীয় পবিত্র স্থানের তালিকায় রয়েছে ‘ষোলা মাস্থানা’ অর্থাৎ ষোলটি মহাস্থান আর মহাপবিত্র স্থানের তালিকায় রয়েছে ‘আটা মাস্থানা’ অর্থাৎ আটটি মহাস্থান। কিছুটা সময়ের কারণে আর কিছুটা স্তুপা, বিহার এবং মন্দিরে একই ধরণের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির কারণে গোটা পাঁচেক দেখেই আমাদের দিনের সফর শেষ করেছি। তবে পবিত্রভূমি ছাড়াও বাড়তি হিসাবে দেখেছি প্রত্নতাত্ত্কি যাদুঘর, সমাধি বুদ্ধ মূর্তি, মুনস্টোন এলাকা নামে পরিচিত মহাসেন-এর রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এবং অষ্টম শতকের এক জোড়া পুকুর।
চলবে...