somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারভার্ট – ৭

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাত বাড়লে সবচেয়ে বেশী লাভ কার? এর উত্তরে চোর-ছ্যাঁচোড়দেরও আগে আসবে ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের নাম। এতো রাতে ট্যাক্সি ক্যাব পাওয়া যেমন সৌভাগ্যের, ঠিক তেমনি, দ্বিগুণ না, তিনগুণ না, চারগুণ ভাড়া গুণতে হওয়াটা মোটামুটি ততটাই দুর্ভাগ্যের। তবে লাভ লোকসানের হিসেবটা আপাততঃ পার্থকে খুব বেশী ভাবাচ্ছেনা। প্রায় রকেট হয়ে ওঠা গাড়ীতে বসে মগজে প্রশ্নের চক্রব্যূহ ভেদ করতেই এখন পার্থর মনের যোগ এবং ঝোঁকটা বেশী।

পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্যরকমের ঘটনাগুলোর একটা আজ রাতে ঘটে গেছে। মাঝ রাত্তিরে হুট করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসা – আর যার পক্ষেই হোক, অনন্যার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় – এই স্থির এবং পোক্ত বিশ্বাস, শুধু পার্থর একার নয়, যারা মোটামুটি অনন্যাকে চেনে এবং জানে, তাদের সবার। বাদলের ফোন পেয়ে কাঁচা ঘুম ভেঙে মেজাজটাই খিঁচড়ে গিয়েছিল পার্থর। “যত্তোসব পিরীত-পয়জার” – বিরক্তিটুকু কর্পূর হয় নিমেষেই, ফোনের অন্যপাশ থেকে বাদলের কিছুটা অসংলগ্ন হয়ে পড়া বকবকানির ধাক্কায়। ধারণার ধারাপাত চিরে ব্যত্যয় যখন ঘটনার অবয়ব নিয়ে যাপিত জীবনে ভূমিষ্ঠ হয়, ধাক্কাটা লাগে তখনি। পার্থ নিজের সর্বোচ্চ কল্পনা আর অনুমানশক্তি দিয়েও কোন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বা তার কাছাকাছি কিছু একটার সন্ধান না পেয়ে, অনন্যাতে আরও বেশী তলিয়ে যেতে থাকে।



নিখুঁত নিকেশী ছকে সাঁটা অন্তর্মুখী অনন্যা ছিল সবসময় পাশে থেকেও বহুদূরের কিম্বা বহুদূরে থেকেও যেন আশেপাশেই কোথাও থাকা আধো আলো আধো ছায়া আধো বুলি আধো শুনসান একটা অস্তিত্ব – আছে ঠিকই, কিন্তু কখনো নিজের উপস্থিতি প্রবলভাবে প্রকাশ না করা মানুষ একটা। নিজের বি বি এ পড়ুয়া সহপাঠীদের সাথে তার কখনো না ঘোচা মানসিক দূরত্ব কতটুকু তার অন্তর্মুখীতার জন্য, কতটুকু তার সংষ্কারাচ্ছন্নতার জন্য, আর কতটুকু স্রেফ দুর্ভাগ্য – নির্ণয় দুরূহ। তবে ওদিককার অনাসক্তি এবং কিয়ৎসম্পৃক্ততা তাকে বেশ জায়গা করে দিয়েছিল কয়েকটা ক্ষ্যাপাটে প্রাণের স্রোতের তোড়ে ভাসতে। বন্ধুত্বটা সেখানেই পোক্ত হয়, যেখানে উপস্থিতির অনিবার্যতার চাইতে অনুপস্থিতির অসহনীয়তা তীব্রতর।

অধুনা ফুটবলের সাডেন ডেথই বলা চলে অনন্যার বিয়েটাকে। পাত্র দেখাদেখি নেই, কথা চালাচালি নেই, এংগেজমেন্ট বা ফোনালাপ দূরে থাক, কিছুমাত্র পূর্বাভাস ছাড়াই, হঠাৎ একদিন ক্লাশ শেষে বাবার ফোন – বাড়ীতে যাওয়া – তিনদিনের জন্য হাপিশ – তারপর যথারীতি আড্ডায় হাজির। নীপুরই প্রথম চোখে পড়েছিল, “কিরে, আংটিটা কিসের? ফেসিয়ালও করসস মনে হয়! ঘটনা কি?” আওয়াজে আমোদ মেশানো সন্দেহ মোটেও অযৌক্তিক ছিলনা, অসুন্দর অবয়বের অনন্যার এসবের প্রতি চিরকেলে অবহেলা।
“বিয়ের আংটি” – অনন্যা বরাবরের মতই নির্লিপ্ত, শুধু তার চোখ দুটোয় সম্ভাব্য বোম ফাটানোর হাসির আভাস।
“কস কি?” ... “কখন?” ... “কার সাথে?” ... “কিরে, তোর পেটটা মানুষের, না অজগরের?” ... “এতক্ষণ ধইরা ...” – বাদল, পার্থ, মৌসুমীর প্রশ্নগুলো প্রত্যাশিতভাবেই হামলে পড়ে। নীপু একটু শান্তভাবে বলে, “জাস্ট এইটা বল, বিয়া কবে? আর ডাকাইতটা কিডা?”
ওদের মুখের দিকে তাকালে অনন্যার পক্ষে হাসি আটকানো আর সম্ভব হবে না। হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে, অন্য হাতের আঙুল দিয়ে আংটিটাকে আঙুলের চারপাশে ঘোরাতে থাকে অনন্যা, “ডাকাতটা হইল সফটু কায়সার হোসেন। আর বিয়ে, গত পরশু হই গেসে!” অনন্যার খিকখিকানো হাসিটা না থাকলে পরের কয়েকটা মুহুর্তকে বলা যেত ‘পিন পতন নীরবতা’! একটু পরই ভালবাসাময় অভিশম্পাতে অনন্যাকে আপ্লুত করতে থাকা, হুল্লোড় এবং হট্টগোল করতে থাকা বন্ধু চারটি জানতই না, সেদিন ক্লাশ থেকে বেরিয়ে বাবার ফোন পাওয়ার পর, ওটাই ছিল অনন্যার প্রথম সত্যিকার হাসি।



“তুই কি বি বি সি’তে খবর দিসস?” রাজ্যের বিরক্তি অনন্যার প্রশ্নে – ট্যাক্সি ক্যাব থেকে বেরিয়ে পার্থকে এগিয়ে আসতে দেখে।
“না রে, এখন আর ওইসব বালছালের বেইল আসে নি? ইউটিওবে দিসে।” পার্থর উত্তর যতটা নির্ভার, সে নিজে কিন্তু অতটা নয়। অনন্যার ওপর কতটুকু ঝড় বয়ে গেছে, দেখে আঁচ করার চেষ্টা করে পার্থ। একটা মিউনিসিপ্যালটির পানির কলের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে অনন্যা – তাড়াহুড়োয় বাঁধা এলোমেলো চুলের কয়েকটা পেছনের হেয়ার ব্যান্ড থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে কাকভেজা হয়ে এখন আপাতত মুখের এপাশে ওপাশে লেপ্টে, চোখ দুটো বেশ লাল, ঠোঁট দুটই ক্ষত-বিক্ষত, দু’পাশের সামান্য স্ফীত গালে বেশ কিছু দাগ, ডান চোখের নীচটা বেশ ফুলে উঠেছে, চিবুকের ক্ষতটা গলা পর্যন্ত নেমেছে কিনা – অন্ধকারে ঠিকমত ঠাহর করা যাচ্ছে না। পার্থ মনে মনে একটা সমীকরণে পৌঁছে যায়। বিচার-বিবেচনা-বোধ-বুদ্ধি বিলোপ করে দেয়া রাগের সাথে অনেক, অনেকদিন পর সাক্ষাৎ হল পার্থর।
“জানোয়ারটা কোথায়?” পার্থ তখনও দাঁড়িয়ে, বাদল অনন্যার পাশে বসে অনন্যাকে ধরে রেখেছে – আবার পড়ে না যায়!
“কোন জানোয়ার?” বাদল কথার খেই ধরতে পারেনি। আসার পর থেকে অনন্যা একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেয়নি। অনন্যা এমনই! এখন বাদলের সমস্ত চিন্তা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, এত রাতে এই মেয়েকে এই অবস্থায় হোস্টেলে কিভাবে নিয়ে যাবে? হোস্টেলেই নেবে, নাকি হাসপাতালে?


“মারি ফেলসি” অনন্যার নির্বিকার, অথচ চোয়াল ঝোলানো উত্তর।


এক ঝটকা লোডশেডিং – পার্থর চোখের, মাথার ভেতর। আবার সব এলোমেলো!


দাঁড়িয়ে পড়া রোমগুলো বসে পড়ার পর, ভ্যাবাচ্যাকাহত পার্থ শুধু উচ্চারণ করে, “কি?”


বাদল এতক্ষণে কথোপকথনের মর্মার্থ উদ্ধার করে, পাথর বনে যায়।

পার্থ আরও কিছু প্রশ্ন করতে বা হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে যায়। অনন্যার এই চাউনীটা বেশ চেনা, মেসেজ পরিষ্কার, ‘এ নিয়ে আর কোন আলাপ নয়’। পার্থ জানে, এরপর এফ বি আই কিম্বা সি আই এ’র পক্ষেও এ বিষয়ে অনন্যার মুখ খোলানো সম্ভব নয়, সে নিজে তো কোন ছার! দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার বলে, “চল।”

বাদল বলে, “আমার মনে হয় এতরাতে এই অবস্থায় হোস্টেলে না গিয়ে হাসপাতালেই বরং নেয়া উচিৎ। আমার ...”
“বেটার প্লেস, একজন ডাক্তার বন্ধুর বাসা।” পার্থ জবাব দিতে দিতে অনন্যাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
“মানে?” বাদল একটু অবাক।
“মৌসুমীর বাসায়।” অনন্যার একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে পার্থ।
“তোর মাথা ঠিক আছে? এত রাতে বিনা নোটিশে ওদের বাসায় ...” বাদল হতবুদ্ধি। দু’জনে ততক্ষণে অনন্যাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
“উইথ নোটিশ, ব্রাদার! সুমীর সাথে কথা হইসে।”

এবার বাদলের চোয়াল ঝোলার পালা, “ক্যাম্নে?”

“আসার সময় ওরে দুইবার ট্রাই কইরা পাই নাই। তারপর অনিমেষরে ফোন দিলাম। কইল, দশটায় ইভিনিং ডিউটি শেষ হওয়ার কথা, সীজারে আটকায়া নাকি সাড়ে এগারটায় ছাড়া পাইসে, তাই বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই ধপাস গ্যাসে।”

বাদল অনুতপ্ত, খানিকটা অনন্যাও।



“বিড়ি খাবি?”
নিঃশব্দে পার্থর বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে একটা মালবোরো টেনে নেয় বাদল।
অনন্যাকে মৌসুমীর বাসায় পৌঁছে দিয়ে, মাত্রই বেরুলো দুই বন্ধু।
“আজকে জোশ জোছনা হইসে, না রে?” পার্থ প্রশ্নটা বাদলকে করলেও, আসলে এটা একটা আশ্রয়। লুকোচুরি খেলার, নিজের সাথে। বাদলের মনোযোগ মালবোরোতে।


কিছু কিছু রাত বড্ড বেশীই ক্ষ্যাপাটে হয়। একই চাঁদোয়ার আলোয়ান জড়ানো পাঁচটি বন্ধু, পাঁচটি মানুষ; অথচ চোর-পুলিশ খেলায় অস্থির, ত্রস্ত সবাই, সবাই পলায়নপর। প্রত্যেকেই।


... এবং সবচেয়ে বেশী, মানুষ নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়ায় !











(চলবে)
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×