somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রূপকথার এক অভিশপ্ত রানী... সুন্দরী শ্রেষ্ঠা...

১৬ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
রূপকথার এক অভিশপ্ত রানীর গল্পো......

মিশরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে ক্লিওপাত্রার নাম এবং কাহিনী কমবেশী জানিনা এমোন কেউ সম্ভবত আমাদের মধ্যে নেই । মিশরে জন্ম না হলেও ক্লিওপাত্রা মিশরের ফারাওয়ের রানী হয়েছিলেন , হয়েছিলেন কিংবদন্তী । ক্লিওপাত্রা যতো না রূপে তারো চেয়ে বেশী আলোচিত তার ছলনার জন্যে । কিন্তু কিংবদন্তীর আর একজনের কথা হয়তো আমাদের মনেও নেই যিনি রূপে ছিলেন অদ্বিতীয়া, ক্ষমতায় সর্বোচ্য । প্রায় তিন হাযার তিনশত বছর আগে ইতিহাস যেমন তাকে নিঃশব্দে চাপা দিয়েছে মিশরের বালুরাশির নীচে তেমনি সেইজন আমাদের মনের আড়ালেও চাপা পড়ে আছেন আজো । ক্লিওপাত্রার ও হাযার বছর আগে যিনি ছিলেন “লেডি অব অল ওম্যান”, “লেডি অব গ্রেস” , “লেডি অব অল বিউটি” ।

নামটি তার “নেফারতিতি” ।

পৃথিবী জুড়ে যে ফারাও সম্রাজ্ঞীর প্রহেলিকাময় আবক্ষ মুর্তিটি (বাস্ট) তার মরালী গ্রীবা নিয়ে বিখ্যাত “আইকন” হয়ে আছেন আজো, তিনিই “নেফারতিতি” যার শাব্দিক অর্থ “সুন্দরীতমা এসেছেন” ।

মিশরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে, এমোন কি তখনকার মিশরবাসীদের মধ্যেও তার রূপ ছিলো কিংবদন্তীর মতো । যীশুখ্রীষ্টের জন্মেরও ১৩৭০ থেকে ১৩৩০ বছর আগ পর্য্যন্ত নেফারতিতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেছে আর ঠিক তার পর থেকেই মিশরের সব ঐতিহাসিক দলিল, দস্তাবেজ থেকে তার নাম মূছে ফেলা হয়েছে । প্রত্নতাত্বিক জিনিষপত্রে তার আর কোনও চিহ্ন রক্ষিত হয়নি যেমন রক্ষিত রয়েছে অন্যান্য ফারাও আর তাদের সম্রাজ্ঞীদের স্মৃতি ।

কেন ? উত্তর খুঁজছে মানুষ ।

রূপকথার দুঃখিনী রানীর মতো, নেফারতিতি গর্ভে ছয় ছয়টি রাজকন্যের জন্ম দিলেও রাজ্যরক্ষায় কোনও উত্তরাধিকারী রাজপুত্রের জন্ম দিতে পারেননি । ফারাও “আখেনাতেন” ভাবলেন নেফারতিতির গর্ভে আর কোনদিন ভবিষ্যত ফারাওয়ের জন্ম হবেনা তাই পরিত্যাজ্য । রাজার ইচ্ছে, তাই রানী পরিত্যক্ত হলেন । ইতিহাসের করাল গর্ভে নেফারতিতি হারিয়ে গেলেন চিরদিনের জন্যে ।
এ হলো নেফারতিতির রহস্যময় নিরবতার পক্ষে একশ্রেনীর প্রত্নত্বাত্তিকদের বিশ্লেষন ।

কেউ কেউ বলেন, বারোটি বছর ১৮তম ফারাও “আখেনাতেন” আর নেফারতিতির গড়ে তোলা বিশাল ফারাও সাম্রাজ্য “এল-আমারনা” (El-Amarna) শাসন করে নেফারতিতির রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যাওয়া সম্ভবত কোনও কঠিন রোগে তার মৃত্যু । ঐ সময় মিশর জুড়ে যে ভয়াবহ প্লেগ হয়েছিলো তাতেই মারা গেছেন নেফারতিতি ।

কেউ বলেন- না ; নেফারতিতি মিশরীয়দের সনাতন ধর্মবিশ্বাস বাতিল করে সূর্য্যদেবতা “রে” (Re)র পুঁজায় “আতেন” নামে যে সূর্য্যচাকতির পুঁজোকে মিশরবাসীদের জন্যে বাধ্যতামূলক করেন তারই বিষ্যোদগার ঘটে নেফারতিতির মৃত্যুর সাথে সাথে তার সমস্ত মূর্তি, স্তম্ভ, প্রাসাদ অর্থাৎ নেফারতিতির বানানো সকল সভ্যতার চিহ্নকে ধংশ করার মধ্যে দিয়ে । এই ধংশযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন পুরোহিতরা কারন “আতেন” কে পেতে হলে ফারাও আর তার স্ত্রীকে (নেফারতিতি) পুঁজো করাও ছিলো বাধ্যতামূলক এটা তারা মেনে নিতে পারেননি । তাই ইতিহাসে নেফারতিতির কোনও উল্লেখ নেই সেই দিন থেকে, যেদিন তার মৃত্যু ঘটে ।

কেউ বলেন, ১৮তম ফারাও “আখেনাতেন” (যিনি বিখ্যাত কিশোর ফারাও রহস্যময় “তুতেনখামেন” এর পিতা) এর প্রতি প্রজারা সন্তুষ্ট ছিলেননা মোটেও । একে তো পুরোনো ধর্মবিশ্বাস নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার উপর রাজধানী “মেমফিস” থেকে সরিয়ে মরুভুমির মাঝে বালুর শহর “ আমারনা”য় স্থাপন করেন এবং পরে নিজের নামে “আখেনাতেন” রাখেন । তাই “আখেনাতেন” এর মৃত্যুর সাথে সাথে নেফারতিতির ভাগ্যও নির্নিত হয়ে যায় ।“আখেনাতেন” এর সৃষ্ট সকল কিছু মিশরের বালুতে পুঁতে ফেলার পাশাপাশি নেফারতিতিরও সমাধি ঘটে যায় ইতিহাসে ।

যদিও এসব বিশ্লেষনের জন্যে পর্যাপ্ত প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শন নেই তথাপিও যে কিছু কিছু শিলালিপির ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে নেফারতিতির উপরে লেখা , তা বিশ্লেষন থেকেই এত্তো এত্তো কাহিনীর জন্ম হয়েছে । এ নিদর্শনগুলি আপনি দেখতে পাবেন বর্তমানের “ল্যুভর” আর “ব্রুকলিন” জাদুঘরে ।


।। ব্রুকলিন মিউজিয়ম ।।

মাত্র পনের বছর বয়সে নেফারতিতি বিয়ে করেন চতুর্থ অ্যামেনোফিস (Amenophis IV) মতান্তরে “অ্যামেনহোটেপ”( Amenhotep IV) কে যিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৫৩ অব্দে ফারাও হিসাবে মিশরের সিংহাসনে বসেছেন মাত্র আর নিজের নাম পাল্টে রেখেছেন “আখেনাতেন” ।

।। ফারাও আখেনাতেন ।।

বিশেষজ্ঞরা নেফারতিতির জন্ম এবং তার নিজ দেশটি আসলে কোথায় এ ব্যাপারে দ্বিধা বিভক্ত । কারো সন্দেহ, যেহেতু নেফারতিতি শব্দের অর্থ “সুন্দরীতমা এসেছেন” তাই আদপেই তিনি মিশরীয় নন, তিনি এসেছেন ভিন কোনও দেশ থেকে ।আবার কারো মতে তিনি মিশরেরই বিখ্যাত ব্যক্তি “আই” এর কন্যা যিনি পরে ফারাও ও হয়েছিলেন । জন্ম বা বংশ বৃত্তান্ত যা ই থাক তিনি যে সুন্দরী হিসেবে কিংবদন্তী ছিলেন তাতে দ্বিমত ছিলোনা কারো ।
সুন্দরীদের প্রভাব পুরুষকে যে নাচাতে পারে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি । রাজ্যশাসনে ফারাওয়ের পাশাপাশি নেফারতিতিও সমানতালে রাজ্য শাসণ করেছেন । শুধু তা ই নয়, যে নতুন ধর্ম দু’জনে প্রবর্তন করেছেন তার মধ্যমনি ছিলেন নেফারতিতি । দু’জনেই পুঁজিত হতেন দেবতা আর দেবী রূপে ।
প্রত্নতত্ববিদ আর ঈজিপ্টোলজিষ্টরা থেমে নেই এইসব ইতিহাস উদ্ঘাটনে । তারা “কারনাক” আর “ল্যুক্সর” এর মন্দিরগুলিতে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এর স্বপক্ষের নিদর্শন ।

খ্রীষ্টপূর্ব ১৪শ শতকে নিজ রাজত্বকালে আখেনাতেন সূর্য্যদেব আতেন এর উদ্দেশ্যে তার রাজ্যে যে অসংখ্য মন্দির গড়ে তুলেছিলেন, প্রতিহিংসার রোষানলে তা সবই ধংশ করা হয়েছিলো তার মৃত্যুর ঠিক পরে পরেই । কারন এগুলো ছিলো মিশরবাসীর পুরোনো ধর্মের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন । এই সব ভগ্ন মন্দিরের পাথরগুলি আবার পরবর্তী ফারাওরা ব্যবহার করেছেন নতুন নতুন মন্দির নির্মানে । প্রত্নতত্ববিদ আর ঈজিপ্টোলজিষ্টরা এখোন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন সেগুলোকে, যদি কোনও অজানা তথ্য পাওয়া যায় সম্রাজ্ঞী নেফারতিতির ।
ধারনা করা হয়, প্রাচীনকালের কারনাকের মন্দিরের পূর্বদিকে যে বিশাল প্রবেশপথ ছিলো তার পাশের দেয়ালের পাথরের বর্তমান ধংশাবশেষ থেকে ১০০র মতো শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের পূর্ণচিত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব । এসব ভাঙ্গা ভাঙ্গা চিত্রে নেফারতিতিকে দেখা যায় বিভিন্ন শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হিসেবে । প্রাচীন মিশরে এ জাতীয় আচার অনুষ্ঠানের ক্ষমতা রাখতেন কেবলমাত্র একজন ফারাও অথবা মিশরীয়দের প্রচলিত বিশ্বাস মতে “ওয়াইফ এন্ড কনসোর্ট অব দ্য গড” ।

এই ফ্রেসকোগুলি স্বাক্ষ্য দেয় , নেফারতিতি নিজেকে একজন ‘দেবী’র পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এমোনকি ফারাওয়েরও সমকক্ষ । একযুগের ও বেশী সময় ধরে নেফারতিতিই ছিলেন প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী আর ক্ষমতাশালী নারী । যা আর কোনও ফারাওদের স্ত্রীর ভাগ্যে জোটেনি ।
কম্পিয়্যুটার এনিমেশন ।

একটি খন্ডিত পাথরের লিপি উদ্ধার হলে দেখা যায়, সেখানে নেফারতিতির নাম রয়েছে । যেখানে তার নামের পাশে উৎকীর্ন রয়েছে “গ্রেট রয়্যাল ওয়াইফ” শব্দটি যা তার সামাজিক মর্যাদা প্রকাশ করছে । এমোন বেশ কিছু পাথর চিত্রে দেখা যায় নেফারতিতি যুদ্ধরথে চড়ে একটি দন্ড উঁচিয়ে আছেন ।
এ থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন তিনি ছিলেন “সুপ্রীম অথরিটি অব দ্য ষ্টেট” । অন্য চিত্রে তাকে দেখা যায় তরবারী হাতে মিশরের শত্রুদের নিধনে ব্যস্ত ।এছাড়াও রয়েছে সভ্রান্তদের মাঝে স্বর্নপদক বিতরনের চিত্র । সব মিলিয়ে এসকল “ফ্রেসকো” থেকে যে ছবি পাওয়া যায় তা নেফারতিতিকে চিত্রিত করেছে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মিশর অধীশ্বরী হিসেবে । এ পর্য্যন্ত মিশরের মাটি খুঁড়ে আর কোনও রাজকীয় মহিলার এমোনতর ছবি পাওয়া যায়নি । কিংবদন্তীর ক্লিওপাত্রাকেও এমোন বেশে দেখা যায়নি ।

এই সব টুকরো টাকরা লিপি থেকে পাওয়া তথ্যে নেফারতিতির সম্পর্কে গল্পের শেষ নেই ।

অনেক বিশ্লেষকেরাই মনে করেন রোগে শোকে নেফারতিতির মৃত্যু হয়নি । বরং এসব চিন্তাকারীদের ধারনা, ফারাও আখেনাতেন এর মৃত্যুর পরে নেফারতিতি চেষ্টা করে থাকবেন রাজ্যকে ধরে রাখতে । তাই তিনি বিদেশী কাউকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যা উৎকীর্ণ আছে একটি পাথরের শিলালিপিতে । শিলালিপিটি পাঠানো হয়েছিলো “হিতিস” সম্রাটের কাছে । শিলালিপিটিতে ফারাওয়ের মৃত্যু সংবাদ উল্লেখের পাশাপাশি একজন রাজপুত্রকে মিশরে পাঠানোর অনুরোধ ছিলো ।“হিতিস” সম্রাট কথামতো একজন যুবরাজকে পাঠিয়েও নাকি ছিলেন যিনি পথিমধ্যে আততায়ীর হাতে নিহত হন । উদ্ধারকৃত পাথর খন্ডের এই লিপির লেখা কাহিনী বা “থিওরি” নেফারতিতির নামের সাথে যুক্ত করেছেন এ ধরনের গবেষকরা । তাদের ধারনা সত্যিকার নেফারতিতির মমি কোনওদিনই খুঁজে পাওয়া যাবেনা । সম্ভবত তার মরদেহকে মিশরের পুরোহিতরা এমোন সমাধিতে সমাহিত করেছেন যা সহজে খুঁজে পাওয়া হবে দুষ্কর ।

কল্পনার ফানুস শেষমেশ ঠেকেছে উর্দ্ধ আকাশে – ঐতিহাসিক দলিলপত্রে নেফারতিতির অনুপস্থিতির পরপরই আর একজনের নাম পাওয়া গেছে “ সামেনখারে” (Smenkhare) যিনি আখেনাতেন এর সাথে একত্রে রাজ্য শাসন করেছেন । প্রাপ্ত কিছু শিলাচিত্রে আখেনাতেনের পাশাপাশি “সামেনখারে” কে ও দেখা গেছে । অনেকেরই ধারনা “সামেনখারে” আর কেউ নন, পুরুষবেশী “নেফারতিতি” যিনি “হাটসেপসুট”(Hatshepsut) এর মতো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছেন “ফারাও” হতে । “হাটসেপসুট” ছিলেন তৃতীয় “তুথমোসিস” এর প্রধান মহিষী ।
এ ঘটনা আপনাদেরকে মনে করিয়ে দেবে “লেডী ম্যাকড্যালেন” এর কাহিনী । যীশুখ্রীষ্টের সহচরী, মতান্তরে স্ত্রী হিসাবে যাকে অনেকেই ধারনা করে থাকেন । এ্যাঞ্জেলোর আঁকা বিশ্ববিখ্যাত “লাষ্ট সাপার” তৈলচিত্রের সিরিজের কয়েকটিতে যীশুর ঠিক পেছনেই যে কাপড়ে মাথা ঢাকা পুরুষটিকে বারে বারে দেখা গেছে অনেক গবেষক মনে করেন তিনিই “লেডী ম্যাকড্যালেন” । যীশুর কাছাকাছিই ঘনিষ্ট একজন বন্ধুর বেশে ছিলেন যাতে তিনি আমৃত্যু যীশুর সাথে সাথেই থাকতে পারেন । এ আবার আর এক কাহিনী । ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলেছি হয়তো ।

তাহলে সুন্দরী নেফারতিতি কি চিরকালই রহস্যময়ী থেকে যাবেন ?
না তা হয়নি ।
নেফারতিতির যে সৌন্দর্য্যের কথা আমরা বলি বা দেখি তার অনেকগুলিই এসেছে “এল-আমারনা” য় প্রাপ্ত ধংশাবশেষ থেকে ।বার্লিনের ঈজিপসিয়ান মিউজিয়ামে ১৯২৪ সাল থেকে প্রদশিত “জেরী’স শো” তে নেফারতিতির যে আবক্ষ (বাস্ট) মূর্তিটি দেখা যায় তা শ্রেষ্ঠ শিল্পের এক অপূর্ব নমুনা ।


৩২০০ বছরের পুরোনো এই মূর্তিটি জার্মান আর্কিওলজিষ্ট Ludwig Borjardt ১৯১২ সালের ৬ই ডিসেম্বর “এল-আমারনা”র ধংশাবশেষ থেকে উদ্ধার করেন । মূর্তিটি ২০ ইঞ্চির বেশী লম্বা নয় । এখোন পর্যন্ত আসলেই মুর্তিটি নেফারতিতির কিনা নিশ্চিত প্রমান করা যায়নি । বিভ্রান্তি রয়েছে এটি নেফারতিতির কন্যা “ইতমোসিস” এর কিনা ।

এককালের সুন্দরী শ্রেষ্ঠা আর মিশরের সর্বোচ্য ক্ষমতার অধিকারী নারীটির রহস্যময়ভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যা্ওয়ার কাহিনী আর তার দেহাবশেষ নিয়ে বিভ্রান্তি কাটেনি আজো ।

।।মমির সামনে ডঃ ফ্লেচার আর নেফারতিতির কম্প্যুটারাইজড ছবি ।।
২০০৩ সালের জুন মাসে ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নত্বাত্তিক জোয়ান ফ্লেচার দাবী করে বসলেন, তিনি নেফারতিতির “মমি” খুঁজে পেয়েছেন ।
লুক্সর এর “ভ্যালী আব কিংস” খুঁড়ে ৩৫ নম্বর সিমেট্রির মধ্যে এক কোনে “মমি নম্বর – ৬১০৭২” এর ভেতরে তিনি অন্য এক নারী ও শিশুর মমির পাশে সনাক্ত করেছেন কিংবদন্তীর নেফারতিতিকে । অনেক স্বাক্ষ্য প্রমান হাজির করেছেন । নেফারতিতির মাথার বিখ্যাত নীল রংয়ের ব্যান্ড সহ লম্বা “ফ্লাট টপ” মুকুটটি যা “ক্রাউন অব ওয়র অব আখেনাতেন” এর স্বারক চিহ্ন, পাওয়া গিয়েছিলো মমি নম্বর ৬১০৭২ এর পাশে ফ্লেচারের খনন কালের অনেক আগে, উনিশ শতকে । ফ্রেঞ্চ আর্কিওলজিষ্ট ভিক্টর লোরে উনিশ শতকের শেষের দিকে নাকি এই মমি নম্বর ৬১০৭২ খুঁজে পেয়েছিলেন কিন্তু মমিগুলির শোচনীয় অবস্থা দেখে তা উদ্ধারে আগ্রহী হননি এবং এভাবেই ফ্লেচারের আগ পর্য্যন্ত তা অজানাই থেকে গেছে । ১৮৯৮ সালে এটি খনন করা হয় প্রথম তার পরে পরেই আবার ১৯০৭ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয় ।
ফ্লেচার দাবী করছেন, বার্লিনের ঈজিপসিয়ান মিউজিয়ামে নেফারতিতির যে আবক্ষ (বাস্ট) মূর্তিটি দেখা যায় মাথায় বিখ্যাত “ফ্লাট টপ”মুকুট সহ, সেই মুকুটটি এই মমি নম্বর ৬১০৭২ এর কাছাকাছি জায়গা থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিলো এবং এল–আমারনায় প্রাপ্ত দেয়ালচিত্রেও এর স্বাক্ষ্য আছে বলে মমিটি নেফারতিতিরই । এছাড়া বার্লিনের আবক্ষ মূর্তিটির সাথে মমিটির “মরালী গ্রীবা”, চোয়ালের গড়ন ইত্যাদির মিলও রয়েছে । ফ্লেচারের এই “কনক্লুসান” বাতিল করে দিয়েছেন ঈজিপ্টোলজিষ্টরা । তারা দাবী করছেন, যে মমিটির কথা ফ্লেচার বলছেন তা একটি ১৫ বছর বয়েসী কিশোরের এবং ফ্লেচারের থিওরীকে জোড়ালো করার মতো তেমন কোনও প্রমান উনি দেখাতে পারেননি । যা দেখিয়েছেন তা “ইন্যাডিকোয়েট” আর “সারকাম্সটেনশিয়াল এভিডেন্স” মাত্র । অবশ্য যে ডিএনএ টেষ্টের কথা বলা হয়েছে তা কতোখানি গ্রহন যোগ্য তা নিয়ে বিতর্ক আছে । বহুল ভাবে নাড়াচাড়া করা হয়েছে এমোন জিনিষ এবং অতীব লম্বা সময়কাল ধরে মাটির নীচের উষ্ণতাপমাত্রায় থাকা কোনও জিনিষের ডিএনএ টেষ্ট কতোখানি নির্ভরযোগ্য, বিতর্ক তাই নিয়ে ।অবশ্য ১৯১২ সালে প্রকাশিত এক নিবদ্ধে এ্যানাটমীর অধ্যাপক স্যার গ্রাফটন ইলিয়ট স্মিথ এই মমিটিকেই এবং এর সাথে থাকা অপর মমিটিকেও পরীক্ষা করে দুটোই যে তরুনী নারী দেহ তা উল্লেখ করেছিলেন । এও বলেছিলেন যে, খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত এই মমিটি পরীক্ষা করে এটি যে একজন নারীর তা বোঝার জন্যে এ্যানাটমীর পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই । এটি প্রকাশিত হয় সেই সময়, যখোন এই মমিটির আইডেন্টিটি নিয়ে তেমন উৎসাহ জন্ম হয়নি খননকারীদের মধ্যে । পরবর্তীকালে রেডিওলজিষ্ট এবং ফিজিক্যাল এ্যান্ত্রোপলজিস্টদের পরীক্ষায়ও একই তথ্য পাওয়া যায় ।এইভাবে মমিটির পরিষ্কার সেক্স আইডেন্টিটি থাকার পরেও সেক্স নির্ণয়ে ডিএনএ টেষ্ট যা “কন্টামিনেশান” এর কারনে নির্ভর যোগ্য নাও হতে পারে সেই টেষ্টের জন্যে বসে থাকা বাহুল্যমাত্র ।
ডঃ জাহি হাওয়াস, মিশরীয় “সুপ্রীম কাউন্সিল অব এ্যান্টিকুইটিস” এর প্রধান ব্যক্তি অবশ্য একবার এই তরুনী নারীর মমিটিকে মধ্যবয়সী মহিলার বলে জানিয়েছিলেন । তার মতে মমিটি সম্রাট তৃতীয় তুথমোসিস এর প্রধানা মহিষী “ম্যারীতার-হাপসেতসুত” এর । আবার হাওয়াস এক ডকুমেন্টারীতে ফ্লেচারের সাথে তাল মিলিয়ে বলেছিলেন, সিমেট্রি নম্বর -৩৫ এ যে মমিটি পাওয়া গেছে তা নেফারতিতির হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী । আবার হালের ২০১০ সালের প্রথমদিকে প্রকাশিত ডিএনএ টেষ্ট এর রিপোর্ট প্রমান করে যে এটি সম্রাট আখেনাতেন এর বোন এর যিনি আবার রহস্যময় ফারাও তুতেনখামেন এর মা “কিয়া” র ।এই রিপোর্টের সহযোগী লেখক আবার ডঃ জাহি হাওয়াস ।

তাই আপনি নেফারতিতিকে খুঁজে পেতে কোনদিকে যে যাবেন এমোন একটি গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে আছেন ।

।। মিশরের কায়রো মিউজিয়মে নেফারতিতি । এই ছবির টুপিটি দেখে কেউ কেউ এটি "তেফনাত" এর বলে দাবী করেন ।।

শুধু এইগুলোই নয় গোলক ধাঁধা আরো আছে । নেফারতিতির উপর কোনও লিখিত সরকারী দলিল পাওয়া যায়নি তার রহস্যময় অর্ন্তধানের পরে । কারন কি ?
নেফারতিতির যে মমিটি পাওয়া গেছে বলে ফ্লেচার দাবী করছেন তাতেও চরম নিষ্ঠুরতার চিহ্ন রয়েছে । মমিটির ডান কানটি এবং একটি হাত নিখোঁজ । কুঠার জাতীয় কোনও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তা দেহচ্যুত হয়েছে ।একটি খন্ডিত হাত আবার আর এক বৃটিশ দল তাদের দ্বিতীয় অভিযানে খুঁজে পেয়েছেন পাশ্ববর্তী কফিন থেকে । এখোন এইসব তথ্য একটি পাজল (puzzle) এর মতো খাঁজে খাঁজে মেলাতে বাকী । ফ্লেচার তাই মেলাতে চাইছেন । মেলাতে চাইছেন নতুন ধর্মের প্রবর্তন করে নেফারতিতি জনগণের যে রোষানলে পড়েছিলেন এই নিষ্ঠুরতা তারই পরিনতি । এবং হয়তো নেফারতিতিকে এই নিষ্ঠুরতা দিয়েই খুন করা হয়েছে এমোন ধারনাও তার । কারন নেফারতিতির মুখেও রয়েছে আঘাতের চিহ্ন । মমি আবিষ্কারের পরবর্তী এক পরীক্ষায় এটি জানা গেছে । সম্ভবত ধারালো কোন চাকু দিয়ে এই নারকীয় কাজটি করা হয়েছে ।

এতো সব করতে গিয়ে ফ্লেচার পড়েছেন বিপদে । তাকে মিশরে প্রত্নতত্ব তল্লাশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে । নিষিদ্ধ করেছেন মিশরের “সুপ্রীম কাউন্সিল অব এ্যান্টিকুইটিস” । ডঃ জাহি হাওয়াস বলেছেন, ফ্লেচার তার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছেন । তিনি বলেছেন, "Dr Fletcher has broken the rules. There are more than 300 foreign expeditions currently working in Egypt, and they all follow the same guidelines. We grant concessions to any scholar affiliate to a scientific or educational institution, and it has long been accepted code of ethics that any discovery made during excavations should first be reported to the SCA. By going first to the press with what might be considered a great discovery, Dr. Fletcher broke the bond made by York University with the Egyptian authorities. And by putting out in the popular media what is considered by most scholars to be an unsound theory, Dr. Fletcher has broken the rules and therefore, at least until we have reviewed the situation with her university, she must be banned from working in Egypt.”

একেকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন এক এক কথা । কারো কথা থেকে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই , আসলে মমিটি কার । রহস্য আরো ঘনীভুত যখোন ধারনা করা হলো, ১৯৩৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কিশোর তুতেনখামেন ফারাও পদে বহাল হলে তিনিই তার পিতা আখেনাতেন আর তার স্ত্রী নেফারতিতির গড়া সমস্ত সৌধ, মন্দির সহ যাবতীয় স্মৃতি ধ্বংশ করে ফেলেন । কারন ও আছে । কারো কারো ধারনা, নতুন ধর্ম প্রচার কালে নেফারতিতি প্রাচীন ধর্মের মন্দিরগুলো ভাঙ্গার পাশাপাশি “কিয়া” নামের আখেনাতেন এর বোন এর (মতান্তরে স্ত্রী) গড়া স্তম্ভগুলোও ভেঙ্গে ফেলেন ।আর তুতেনখামেন হলেন কিয়ার সন্তান । আর তাই নেফারতিতির মমিটি ফারাওদের সমাধিস্থলে পাওয়া যাবেনা প্রতিহিংসার কারনেই ।তাহলে নেফারতিতি কোথায় ?

।। সূর্য্যদেব "আতেন" এর পূঁজায় নেফারতিতি ।।

রহস্যময় তুতেনখামেন কি নেফারতিতির এই হারিয়ে যাওয়া নাটকের নেপথ্য রূপকার ? হতেও পারে । কারন, এমোন ধারনাও করছেন ঈজিপ্টোলজিষ্টরা যে ,নেফারতিতির পিতা “আই” যিনি তুতেনখামেনের পরে ফারাও হয়েছিলেন তার নেপথ্য হাত ছিলো তুতেনখামেনের রহস্যময় মৃত্যুতে ।

এসব কি তবে রহস্যময় অকাল মৃত্যুর কাছে পরাজিত তুতেনখামেনের অভিশাপ ? নেফারতিতি কি অভিশপ্ত ?? হতে পারে কারন তুতেনখামেন এক রহস্যের নাম …..


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১১ দুপুর ১২:০১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×