somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোয়ের্নিকা .......মন্দভাগ্য নিয়েই যে ছবির যাত্রা শুরু

০৬ ই অক্টোবর, ২০১১ সকাল ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গোয়ের্নিকা .......মন্দভাগ্য নিয়েই যে ছবির যাত্রা শুরু
ঘরবাড়ী বেশ শুনশান । বেশীর ভাগ পুরুষরাই বাড়ীতে নেই । আজ সাপ্তাহিক হাটবার । পুরনারীকুল যথারীতি গৃহকর্মে ব্যস্ত । শিশুরা নিমগ্ন খেলায় । ১৯৩৭ সালের শেষ এপ্রিলের সুন্দর একটি বিকেল । যেখানে যেমন থাকার স্পেনের বাস্ক প্রদেশের ছিমছাম ছোট্ট শহর গোয়ের্নিকাতে ছিলো তাই ই । হঠাৎ কেঁপে উঠলো গোয়ের্নিকার আকাশ-বাতাস । আকাশ ছেয়ে গেল ডানা মেলা ক্ষুধার্থ শকুনের মতো একপাল বিমানে । মৃত্যুর পরোয়ানা প্রসব হলো বিমানের পেট থেকে, নির্বিচারে । তাৎক্ষনিক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যে নারী আর শিশুকুল বাঁচার শেষ চেষ্টায় রাস্তা কিম্বা খোলা মাঠে পলায়নপর; বিমানের মেশিনগানের গুলি তাদের পাখির মতো শুইয়ে দিলো মাটিতে ।

।।গোয়ের্নিকা শহরের ধংশস্তুপ ।।

গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত স্পেনের গোয়ের্নিকার সেই ধংশস্তুপ থেকে ডানা মেললো এক ফিনিক্স পাখি “গোয়ের্নিকা” । একটি ছবি ।

পিকাসোর ভুবন বিখ্যাত তেল রংয়ের ছবি “গোয়ের্নিকা”র সাথে পরিচয় নেই এমোন শিল্পরসিক কিম্বা ছবি সম্পর্কে সামান্যতম ধারনা আছে এমোন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার । কেবল ১১ ফুট উচ্চতা আর ২৫.৬ ফুট প্রস্থ নিয়েই ছবিটি ব্যাপ্ত নয় । সকল দেশ-কাল-পাত্রকে ছাড়িয়ে গেছে এর ব্যাপ্তি । গোয়ের্নিকা শুধু ছবি নয়, তাবৎ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক সবল প্রতিবাদ । পাবলো পিকাসোকে না জানলেও বা না চিনলেও ছবিটি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে - “দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ….” এমনিই গোয়ের্নিকার বাস্তবতা । চিত্রকার নয় , চিত্রের বৈচিত্রময় আর ধ্রুপদী আবেদন দেশে দেশে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে একটিই মাত্র মন্ত্রে – “যুদ্ধ নয়” ।
অথচ এরকমটা আঁকার কথা ছিলনা পিকাসোর নিজেরও । ফ্রান্সে স্বনির্বাসিত পিকাসো তখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ১৯৩৭ সালের “ওয়র্ল্ড’স ফেয়ার”এ “প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশান” এর জন্যে স্পেনের নব নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকারের অনুরোধে । নাগরিক হবার সুবাদে স্পেনের পক্ষে একটি ম্যুরাল করে দিতে হবে তাকে উৎসবের জন্যে, যা হবে স্পেন প্যাভেলিয়নের সেন্টার পীস । উৎসবের মূল উদ্দোক্তাদের অফিসিয়াল থীম ছিলো, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সুফল তুলে ধরে ত্রিশ দশকের অর্থনৈতিক মন্দা আর সামাজিক অস্থিরতা থেকে ফ্রান্সবাসীদের দৃষ্টি সরিয়ে সামনে উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো । তিন মাস ধরে চেষ্টা করেও পিকাসো একটি ম্যুরাল আঁকার জন্যে উৎসাহ তৈরী করতে পারছিলেন না নিজের মধ্যে । ব্যক্তিগত জীবনের ঝঞ্ঝা থেকে হতাশায় ডুবে মনখানা তার গোমড়া হয়ে আছে । নিজের কাজের প্রতিও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না তিনি । আবার রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর গৃহযুদ্ধে তার নিজ দেশ স্পেনের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিলো না মোটেও । তার পছন্দের নব নির্বাচিত সরকারের প্রতি অনুগত রিপাবলিকান সেনাবাহিনী বিধ্ধস্ত হচ্ছিলো ক্যুদেতা জেনারেলিসিমো ফ্রান্সিকো ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর হাতে । ফ্রাঙ্কো প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছিলেন স্পেনবাসীদের জন্যে উন্নয়ন আর নিশ্চয়তা বিধানের অথচ ডেকে আনছিলেন শুধু মৃত্যু আর ধংশ ।
নব নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে পিকাসোর সতীর্থরা আর সরকারী লোকেরা তার প্যারিসের বাড়ীতে ধর্ণা দিয়ে আশা করছিলেন, আয়োজকদের থীম নয়, পিকাসো যেন ফ্রান্সিকো ফ্রাঙ্কোর স্বরূপ তুলে ধরে একটি রাজনৈতিক ম্যুরাল আঁকেন । নতুন সরকারের প্রতি পিকাসোর সহানুভুতি থাকলেও রাজনীতিতে জড়াতে চাননি তিনি নিজেকে । আর একটি রাজনৈতিক ছবি তো তার কাছে ঘৃনার বস্তু । পিকাসোর মন বসছিলো না কিছুতেই । তবুও দেশের জন্যে কাজ । উত্তেজনাহীন ভাবে তিনি মাসাধিক কাল ধরে খসড়া করে যাচ্ছিলেন কি আঁকা যেতে পারে তারই । আর তখনি তার চোখ আটকে গেল ফ্রেঞ্চ ক্যমিয়্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র L'Humanité নামের একটি দৈনিকের পাতায় । ২৯শে এপ্রিল’১৯৩৭ এর এই সংখ্যায় লন্ডন টাইমসের সাংবাদিক জর্জ ষ্টিয়ার এর জবানীতে গোয়ের্নিকা হত্যাকান্ডের হৃদয়বিদারী বর্ণনা ছাপা হয়েছিলো সেখানে । পিকাসো জানলেন, প্রিয় স্বদেশের মাটিতে নিরীহ রক্ত ঝরেছে কি নির্মম ভাবে । জানলেন, জার্মান কর্নেল উলফ্রাম রিখথোফেন এর পরিচালনায় জার্মান কন্ডোর লিজিয়ন এর বিমানবহর দু’ঘন্টা ধরে একনাগারে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার দেশের নিরীহ মানুষগুলোর উপর । ক্ষমার অযোগ্য যে কাজটি করেছেন ফ্রাঙ্কো, তা হলো হিটলারের সাহায্য চাওয়া । ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিষ্ট সরকারের অনুরোধে হিটলার মেটেরিয়াল সাপোর্ট দিয়েছেন এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে যে এতে ফ্রাঙ্কোর অনুরোধ যেমন রাখা হবে তেমনি এই সুযোগে তার নব আবিষ্কৃত সমরাস্ত্র আর “ওয়র ট্যাকটিক্স” এর সফলতাও পরীক্ষিত হয়ে যাবে । হয়েছেও তাই। আর এই একাধারে এরিয়াল বোম্বার্ডমেন্ট এর সফলতা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় “ব্লিৎজক্রীগ” ট্যাকটিক্স এর জন্ম ।
ফ্রান্সিকো ফ্রাঙ্কোর প্রতি ঘৃনায় বিষিয়ে উঠলো পিকাসোর অন্তরাত্মা । ১৯৩৭ সালের ১লা মে তার সে ঘৃনা তিনি উগরে দিতে শুরু করলেন ক্যানভাসে, স্বপ্রনোদিতভাবে । অন্ধকারের কোনও রঙ থাকেনা । মানবতার ইতিহাসে মাইলাই হত্যাকান্ডের মতো গোয়ের্নিকা হত্যাকান্ডও তো এক অন্ধকারের নাম । তাই তিনি বেছে নিলেন কালো, সাদা আর ধুসর তেল রঙ । ক্যানভাসে ফুঁটে উঠতে থাকলো নারী, শিশু, সৈনিক, ষাঁড় আর ঘোড়ার মুখ । এক একটি যন্ত্রনার ছবি ।



শুরু থেকেই গোয়ের্নিকার বিভীষিকাকে বাস্তবসম্মত অথবা রোমান্টিক করে আঁকার ইচ্ছে ছিলোনা তার । ছবিটির মূল বিষয়বস্তু – প্রসারিত হাতের এক নারী, একটি ষাঁড়, একটি যন্ত্রনাকাতর ঘোড়া কে বার বার স্কেচ করতে হয়েছে তাকে । আবার মুছে ফেলতে হয়েছে আরো পরিশুদ্ধ করতে । সব স্কেচকে আবার মূল ক্যানভাসে বসিয়েছেন । তাতেও সন্তুষ্ট হননি পিকাসো । কয়েকবারই তিনি তাতে রি-টাচ করেছেন । শেষমেশ ১৯৩৭ সালের জুনের মাঝামাঝি একটি দিনে সমাপ্ত হয়েছে ম্যুরাল পেইন্টিংটি ।


একটি হযপচ তৈলচিত্র ।
হ্যাঁ, এমোনটিই মন্তব্য ছিলো মেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত জার্মান ফেয়ার গাইডের । তারা এটিকে শুধু হযপচ বলেই ছেড়ে দেয়নি, বলেছে – এটি যেনতেন করে আঁকা মানুষের হাত-পা, যা চার বছরের বাচ্চারাও আঁকতে পারে । আপনারও মনে হবে তাই-ই ।
তারা ম্যুরালটিকে এককথায় বাতিল করে দিয়েছে এই মন্তব্যটি দিয়ে - পাগলের আঁকা ।
এমোনকি পিকাসোর পছন্দের রিপাবলিকান সরকারের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়াও মুখ বুজে থেকেছে ছবিটি সম্পর্কে । ছবিটি তাদের মনঃপুত হয়নি একারনে যে, রিয়ালিষ্টিক না হবার জন্যে ছবিটি রাজনৈতিক আর সামাজিক আবেদনটি হারিয়ে ফেলবে ।
এরকম মন্দভাগ্য নিয়েই যাত্রা শুরু পৃথিবীখ্যাত গোয়ের্নিকা ছবিটির । ছবিটি সম্পর্কে পিকাসোর নিজের মন্তব্যও আপনাকে চিন্তায় ফেলতে পারে । তিনি বলেছেন, “ একটি ছবি আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে ভেবেচিন্তে আঁকা হয়না । যখন ছবি আঁকার কাজটি চলতে থাকে তখন চিত্রকরের চিন্তাভাবনার তালে তালে ছবির মেজাজও বদল হয় । এবং আঁকা যখন শেষ তখন ছবিটি নিরন্তর বদলাতে থাকে যিনি দেখেন তার মন-মেজাজের উপর ভিত্তি করে ।”



“প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশান” এর বিশাল চত্বরের এক কোনে ছোট ছোট দেশগুলোর ভীড়ে পড়ে থাকা স্পেন প্যাভেলিয়নের প্রধান আকর্ষন গোয়ের্নিকা যেন একটি আউট অব দ্য ওয়ে ছবি । সাড়া ফেলতে পারেনি তেমন । অথচ পিকাসোর গোয়ের্নিকা যুদ্ধের বিরূদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে একদিন শতাব্দীর সবচেয়ে বড় একটি অমীমাংসিত দলিল হয়ে উঠবে জানা ছিলোনা কারো ।
প্যারিসে অসফল ছবিখানি এর পরে প্রদর্শিত হলো প্রথমে স্কানডিনেভিযায় সেখান থেকে ১৯৩৮ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারীতে ।এর পরে কিছুদিনের জন্যে ছবিটি ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনা হয় । ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোর বিজয়ের পরে গোয়ের্নিকাকে পাঠানো হয় আমেরিকাতে স্প্যানিস রিফিউজিদের পূণর্বাসনের জন্যে অর্থ সংগ্রহে । সানফ্রানসিস্কো মিয়্যুজিয়ম অব আর্ট সর্বপ্রথম এর বিনামূল্যে প্রদর্শনীর সুযোগ করে দেয় ২৭ শে আগষ্ট থেকে ১৯ শে সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে ।ন্যুইয়র্কের মিয়্যুজিয়ম অব মডার্ন আর্ট তখন পিকাসোর ছবির প্রদর্শনী করছিলেন যেখানে গোয়ের্নিকা স্থান পায় । প্রদর্শনী চলে ১৯৪০ সালের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ জুড়ে ।পরে পিকাসোর অনুরোধে ন্যুইয়র্কের এই মিয়্যুজিয়ম অব মডার্ন আর্ট (মোমা)কে এর সংরক্ষনের দায়িত্ব দেয়া হয় । স্পেনে ফিরে আসার আগে পর্য্যন্ত এই দায়িত্ব মোমা’র উপরেই ন্যস্ত ছিলো ।
১৯৩৯ থেকে ১৯৫২ পর্য্যন্ত সারা আমেরিকাতে এটি প্রদর্শিত হয় আর একটু একটু করে শিল্পবোদ্ধারা, সমালোচকেরা আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এর প্রতি । আলোচনার ঝড় ওঠে আর গোয়ের্নিকাকে দেখতে উৎসাহী মানুষের ঢল নামে । ১৯৫৬ সালে শুরু করে ব্রাজিল, ইতালি সহ বড় বড় য়্যুরোপিয়ান শহরগুলো, ভিয়েতনাম, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া ঘুরে ১৯৮১তে তার স্থিতি হয় মোমা’য় ।ততোদিনে বিশ্ব জেনে গেছে গোয়ের্নিকার কথা ।এমোনকি ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো ও ছবিটি স্পেনে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন । পিকাসো এই ইচ্ছেকে বাতিল করে দিলেন এই বলে যে, যতোদিন না স্পেনবাসী ফ্রাঙ্কোর হাত থেকে মুক্ত হয়ে প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাবে ততোদিন গোয়ের্নিকা ফ্রাঙ্কোর হাতে নির্যাতিত স্পেনে যাবেনা । ১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু ছবিটিকে শিল্পীর নিজ দেশ স্পেনে ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেয় । বিজয়ীর বেশে ফিরে আসা নিজের ছবিকে নিজ চোখে মাতৃভুমিতে দেখে যেতে পারেননি পিকাসো । ততোদিনে (১৯৭৩)তিনি অন্যজগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন ।
শর্ত অনুযায়ী ফ্রাঙ্কো মুক্ত স্পেনে ছবিটি ফিরিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও বিশ্বজোড়া বিতর্কের ঝড় তোলা এই মহামূল্যবান ছবিটি হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না মোমা কর্তৃপক্ষ । বিভিন্ন অজুহাত তুলে মোমা কর্তৃপক্ষ ফেরৎ এর বিষয়টিকে জটিল করে তোলেন । দীর্ঘ তিনটি বছর পরে অধিকারের লড়াইয়ে মোমা হেরে গেলে যে মাটিতে নৃশংসতার প্রতিবাদে পিকাসো ছবিটি এঁকেছিলেন সেই মাটিতেই বিজয়ীর বেশে গোয়ের্নিকা স্বাগত হয় । সালটি ১৯৮১ । পিকাসোর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এ ছবির প্রথম ঠিকানা হয় মাদ্রিদের প্রাডো মিয়্যুজিয়মে ।পরে সংরক্ষনের অসুবিধার কারনে ১৯৮৫ সালে গোয়ের্নিকাকে সরিয়ে আনা হয় পাশের “রেইনা সোফিয়া” মিয়্যুজিয়মে আর আজ গোয়ের্নিকার স্থায়ী ঠিকানা এটাই ।


কি আছে এ ছবিতে ?
হিংস্রতার আঘাত আর বিশৃঙ্খলায় দোমড়ানো মোচড়ানো মানুষ, প্রানী আর আবাসস্থলের বিমুর্ততা । বিশাল ক্যানভাসের বা-পাশের উন্মুক্ত জায়গাটুকুতে মর্মভেদী চীৎকারে শিশুর লাশ নিয়ে প্রসারিত হাতের এক নারীর ঠিক উপরে আছে চোখগরম করা এক ষাঁড়ের প্রতিকৃতি । মাঝখানটি জুড়ে আছে বর্শাবিদ্ধ যন্ত্রনা কাতর এক ঘোড়ার আকুতি । ঘোড়ার শরীরের পার্শ্বদেশে বড়সড় একটি ক্ষত যা আপনার দৃষ্টি কাড়বেই । মানুষের মাথার একটি খুলি ঘোড়াটির শরীরের উপরে প্রচ্ছন্ন রয়েছে । প্রচ্ছন্ন ভাবে আরো আছে, একটি ষাঁড় যেন নীচ থেকে ঘোড়াটিকে ক্ষতবিক্ষত করতে মুখিয়ে আছে । আর ষাঁড়টির মাথা তৈরী হয়েছে মুলত হাটু মুড়ে থাকা ঘোড়াটির সামনের পা জুড়ে । ঘোড়াটির বুকে রয়েছে ষাঁড়ের একটি শিং । ষাঁড়ের লেজটি তৈরী করেছে এক অগ্নিশিখার আকৃতি যা আপনি খুঁজে পাবেন আশেপাশের তুলনায় হালকা ধুসর রংয়ে আঁকা একটি জানালার অবয়বে । মৃতপ্রায় ঘোড়াটির নীচে আপনি দেখতে পাবেন একটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন সৈনিকের দেহ , যে দেহের ছিন্ন হাতটি তখনও ধরে আছে ভাঙ্গা এক তলোয়ার । আর সেই ভাঙ্গা তলোয়ারের ভেতর থেকে উদগ্‌ত হয়েছে একটি ফুল ।
শয়তানের চোখের মতো একটি জ্বলজ্বলে বৈদ্যুতিকবাল্ব দেখতে পাবেন যন্ত্রনাকাতর ঘোড়াটির মাথার উপরে ।
ঘোড়াটির ডানদিকে আর উপরে ভয়ার্ত এক নারীমূর্ত্তি, মনে হবে যেন জানালার ভেতর দিয়ে ভেসে এসেছে আর তাকিয়ে আছে সামনের দৃশ্যপটের দিকে । প্রজ্বলিত এক বাতি নিয়ে তার হাতটিও যেন ভেসে আছে জ্বলজ্বলে বৈদ্যুতিকবাল্ব এর কাছাকাছি এক সাংঘর্সিক অবস্থানে । ভাসমান নারীর নীচে ভয়ার্ত আর এক নারী শুন্যদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে জ্বলজ্বলে বাতিটির দিকে । ষাঁড়টির জিহ্বা আঁকা হয়েছে একটি ছুরি হিসেবে । আরো আছে আর্তনাদকারী এক নারী, ঘোড়া, আতঙ্কিত একটি পাখি সম্ভবত একটি ঘুঘু ।
সর্বডানে রয়েছে আতঙ্কে দু’হাত উত্তোলিত একটি মুর্তি, মনে হবে যেন আবদ্ধ হয়ে পড়েছে আগুনের মাঝে ।
ম্যুরালটির ডান প্রান্তের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজা নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি দেয়াল ।

এই দৃশ্যপট নিয়ে গোয়ের্নিকা ।



ছবি নাকি কথা বলে ! কি কথা বলে গোয়ের্নিকা ?
অনেক কথাই বলে গোয়ের্নিকা । শুরু থেকেই কি বলা হয়েছে ছবিটিতে তা নিয়ে আছে বিতর্ক । এ বিতর্ক ছবির দু’টি মূল বিষয় ঘোড়া আর ষাঁড় নিয়ে । আর্ট হিষ্টোরিয়ান প্যাট্রিসিয়া ফেইলিং এর ধারনা, স্পেনের সংস্কৃতিতে ঘোড়া আর ষাঁড় দু’টি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । পিকাসো বিভিন্ন সময়ে এগুলোর বিভিন্ন ব্যবহার করেছেন তার ছবিতে । তাই এই ছবিতে ঠিক কি অর্থে পিকাসো এদের ব্যবহার করেছেন তা বলা দূরহ হয়ে উঠেছে । কি অর্থে এদের ব্যবহার, জিজ্ঞেস করা হলে রহস্যময় পিকাসো বলেন – “ ঘোড়া হলো একটি ঘোড়া আর ষাঁড় হলো একটি ষাঁড় । আপনি যদি আমার ছবির কিছুতে অর্থ খোঁজেন তবে সেটিই সত্য । কিন্তু এগুলো আমার আরোপিত নয় । আমি ছবির জন্যে ছবিটি এঁকেছি । আমি বিষয়গুলো এঁকেছি তারা যে যা, তার জন্যে।”
অথচ গোয়ের্নিকা ঘটনার আগে আঁকা পিকাসোর “দ্য ড্রীম এন্ড লাই অব ফ্রাঙ্কো” সিরিজে তিনি ফ্রাঙ্কোকে চিত্রিত করেছেন দানব হিসেবে যেখানে দেখানো হয়েছে ফ্রাঙ্কো তার নিজের ঘোড়াকেই খেয়ে ফেলেছেন আর পরে লড়ছেন ক্রুদ্ধ এক ষাঁড়ের সাথে । এই সিরিজের তিন তিনটি প্যানেল পিকাসো সংযোজন করেছেন পরবর্তীতে তার এই গোয়ের্নিকা ছবিতে ।
ছবিটি আঁকতে আঁকতে পিকাসো বলেছেন , “ স্পেনে যা কিছু সংগ্রাম ঘটছে তা জনগণের বিপক্ষে পরিচালিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক লড়াই । একজন চিত্রকর হিসেবে আমার সারাটি জীবন ও, এরকম প্রতিক্রিয়া আর শিল্পের মৃত্যুর বিরূদ্ধে নিরবিচ্ছিন্ন একটি লড়াই । এক মূহুর্তের জন্যে কে এমোন ভাবতে পারেন যে, আমি প্রতিক্রিয়াশীলতা আর মৃত্যুর পক্ষে কথা বলবো ? এই মূহুর্তে যে ছবিটি আমি আঁকছি যার নাম দেবো আমি “গোয়ের্নিকা” এবং আমার সাম্প্রতিক সব কাজে আপনি দেখবেন, আমি স্পেনের সামরিকজান্তার প্রতি আমার ঘৃনা প্রকাশ করেছি কারন তারা আমার স্পেনকে কষ্ট এবং মৃত্যুর এক গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে ।”

ছবিটি সম্পর্কে পিকাসোর আগের মন্তব্যে ফিরে যাই – “......... এবং আঁকা যখন শেষ তখন ছবিটি নিরন্তর বদলাতে থাকে যিনি দেখেন তার মন-মেজাজের উপর ভিত্তি করে ।” আর তাই গোয়ের্নিকা বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে । অবশ্য ছবিটি ব্যাখ্যায় আর্ট হিষ্টোরিয়ানদের সাধারন ঐক্যমতের কিছু চিত্র আপনি পাবেন গবেষক বেভারলী রে’র লেখায় । –
- গোয়ের্নিকায় ব্যবহৃত “শেপ”গুলি এবং তাদের ভঙ্গীমা প্রতিবাদের ।
- ছবিটিতে বিষণ্ণ ভাব আনতে আর যন্ত্রনাকে ফুটিয়ে তুলতে পিকাসো কালো, ধুসর আর সাদা রঙ ব্যবহার করেছেন ।
- ছবিতে প্রজ্বলিত গৃহ এবং দোমড়ানো দেয়াল কেবল মাত্র গোয়ের্নিকার ধংশযজ্ঞ বোঝাতে নয়, এসেছে যুদ্ধের বিধ্বংশী ক্ষমতাকে তুলে ধরতে ।
- ছবিতে ব্যবহৃত সংবাদপত্রের ছবি বুঝিয়েছে কি ভাবে শিল্পী ধংশলীলার খবরটি পেয়েছেন ।
- প্রজ্বলিত বাল্বটি সূর্য্যকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে ।
- ছবির নীচে ভাঙ্গা তলোয়ারটি নির্যাতনকারীদের হাতে পরাজিত মানুষের প্রতীক হয়ে ফুটে আছে ।
আবার Becht-Jördens and Wehmeier নামের দুই শিল্প সমালোচক এ ছবিকে দিয়েগো ভ্যালাকুইজ এর আঁকা “লা মেনিনাস” এর সাথে তুলনা করে বলেছেন, এটি তেমনি একটি আত্ম-প্রশংসিত কম্প্যাজিশন যা শিল্পী তার চিত্রশালায় বসে আঁকেন প্রচলিত ধারা মতে । মূল ছবির মধ্য অঞ্চলে ত্রিভুজাকৃতি শেপটির অস্তিত্ব, পিকাসোর প্রচলিত ধারা মতে আঁকা প্রাথমিক স্কেচগুলো থেকে এনে মূল ছবিতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে বলে এই গন্ধ তারা খুঁজে পেয়েছেন গোয়ের্নিকায় ।
তার “chef d'oevre” লেখায় রাজনৈতিক ক্ষমতা আর সংহিসতার প্রেক্ষাপটে একজন শিল্পী হিসেবে পিকাসো তার নিজের ভুমিকা আর ক্ষমতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন । তারপরেও শুধু একটি রাজনৈতিক ছবি হিসেবে নয়, বরং একটি ছবি মানুষকে স্বাধীনচেতা করতে আর রাজনৈতিক অপরাধ, যুদ্ধ এবং মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে কতোখানি কথা বলে যেতে পারে গোয়ের্নিকাকে সেভাবেই দেখা উচিৎ ।


।।রঙিন রেপ্লিকা।।

কে কি ভাবে বললো, কি আসে যায় ?
পিকাসো যখোন বলেছেন – “ আঁকা যখন শেষ তখন ছবিটি নিরন্তর বদলাতে থাকে যিনি দেখেন তার মন-মেজাজের উপর ভিত্তি করে ।”
গোয়ের্নিকাকে আপনি না হয় আপনার মতো করেই দেখুন ।

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১১ সকাল ১১:৩৮
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×