সপ্তম অধ্যায় / ( দ্বিতীয় অংশ )
মানুষের কিছু কিছু দুঃখ থাকে যাকে কেউই মুছিয়ে দিতে পারেনা । গভীর ভালোবাসা পেলেও তা মুছে যাবার, ধুঁয়ে যাবার নয় । শীলার কথা মতো আমি শুধু তাকে নিয়ে হেটেই যাচ্ছি জীবনময় কোনও এক অন্যিন্দলোকে । একজন খুব কাছের বন্ধুর মতোনই ধরে আছি তার হাতখানি একাকী । খেয়ালের বশে যে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের বাড়ানো হাতখানি সরে গেছে আমার থেকে আমি তার ছায়া এড়াতে পারিনি । ছায়াটাকেই ধরে রেখেছি । কায়ার সাথে ছায়া যেমন লেপ্টে থাকে তেমনি শীলাও জুড়ে আছে আমার দিনমানে । ধুঁ-ধুঁ বালিয়ারীতে যার তেষ্টার প্রতিটি প্রহর কেটেছে মরীচিকার পেছনে দৌঁড়ে, একদিন ক্লান্ত অবসন্ন প্রাতে আরাধনার মরুদ্যানটি হঠাৎ করেই যদি তার সামনে এসে দাঁড়ায় তবে এক আঁজলা জলে তার তৃষ্ণা মেটে কি ! তার তৃষ্ণা তো তখন অফুরান । শীলা যে আমার তৃষ্ণার এক দীঘি জল ।
অথচ সে আমাকে অবলীলায় মিথ্যে বলে গেছে । তা জেনেও আমি শুধু তাকে ফেরাতে, তার গড়ে তোলা ছলনার ভুবন থেকে তাকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসতে চেয়েছি বড় যত্ন করে । চেয়েছি, তার হটকারী খেলার যুপকাষ্ঠে আর কেউ যেন বলি না হয় - কেউ যেন একজন শীলা কবিরের জন্যে সব নারীদের প্রতি ঘৃনার চোখে না তাকায় । হয়তো এ আমার হার মানা হারের এক নতুন খেলা । বোকা পুরুষেরা, নারীর হৃদয় নিয়ে তবুও কবিতা লেখে । চিরদিনই লিখে গেছে । আমিও লিখছি – অবুঝ মন যে আমার !
বন্ধু অনেক রকম হয় । কোনও বন্ধুকে কাছে টানা যায় – বিশ্বাস করা যায় কিন্তু বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরা যায় না, ভালোবাসা যায় না । কোনও বন্ধুকে শুধু ভালোবাসা যায়-কাছে টানা যায় না । কোনও বন্ধুকে শুধু সঙ্গী ভাবা যায় আর কিছু নয় । কিন্তু খুব কম বন্ধুই থাকে, যাকে সঙ্গী ভাবা যায়, যাকে ভালোবাসা যায় - কাছে টানা যায় - বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরা যায় – আপন করা যায় - বিশ্বাস করা যায় ।
একথা জানিয়ে শীলাকে আমি একদিন লিখেছিলাম, ‘আমাকে তুমি কি চোখে দেখ আমি জানিনে । কিন্তু তুমি যে আমার শেষের জন । হিন্দু শাস্ত্রে একটি কথা আছে, উপনয়নের সময় যদি দু’জনে একত্রে সাত পা হাটে তবে অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব হয় । আমি তোমাকে নিয়ে অনেক পা হেটেছি আমি জানি । আমার সাথে তুমি যদি এক পা’ও হেটে থাকো তবে বাকী পথটুকু হাটার শক্তি যেন ঈশ্বর তোমাকে দেন ।’
এটুকুর উত্তর মেলেনি । উত্তর মেলেনি আরো অনেক কিছুর । রহস্যময় আলো ছড়িয়ে দিয়ে শীলা তখোন অস্তগামী সূর্য্যের মতো আমার আকাশের ওপারে ।
রাতের ঘুমটা একটু কেটে কেটে গেল যেন । একপাশে ফুল্লরা । অথচ আমি ওর কথা ভাবছি না । ওর শরীরের গন্ধ, একদিন যাতে মৌতাত ছিলো আজ যেন তা বাসী বাসী । আমাকে টানছে না তেমন । দুঃখ হলো, আমি এতো পাষন্ড হলাম কি করে ! পাশাপাশি শুয়ে আমি ভাবছি আর একটি মেয়ের কথা যে আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেনি । অথচ যার আহ্বান ছিলো বন্ধুত্বের জন্যে । মানুষ কেন যে কথা দিয়ে কথা রাখেনা ! শীলার উপর রাগ হলো খুব । একটি পুরুষ আর নারীর ভেতরে কি এমোন কোনও বন্ধুত্ব হতে পারেনা, যেখানে লোভ নেই – কামনা নেই – পাওয়ার বাসনা নেই ! নিরন্তর ভালোবাসা, অফুরান মঙ্গলাকাঙ্খা ছাড়া যেখানে আর কিছু নেই ! মানুষের গড়ে তোলা মেকী সামাজিক অবয়বে এরকম ধারনার অস্তিত্বই নেই হয়তো । ব্যাপারটি দু’টি বিবাহিত নারীপুরুষের ভেতর গড়ালে সমাজ তো তাকে বলে, অনাচার-পাপ । শীলা কি তাই ভয় পেয়ে দুরে সরে যেতে চাইছে ! অথচ শীলা কি জানে, এরকম ভালোবাসা অন্তরের গভীরে আরো অনেক ভালোবাসার জন্ম দিতে পারে - যে ভালোবাসার, যে প্রেমের জঠরে সিদ্ধার্থ থেকে জন্ম হয় এক গৌতম বুদ্ধের !
আমি যে পাপাচারে নিমজ্জিত নই সেই পরিমিতি বোধ থেকেই ঘুরলাম ফুল্লরার দিকে । বেচারীর প্রতি আমার অবিচার হয়ে যাচ্ছে ভেবে গভীর স্নেহে, প্রিয়তম ভালোবাসার আবেগে দু’হাতে টানলাম তাকে । ভারী শরীর, একটু কষ্ট হলো । ঘুমের ভেতর অজান্তেই সাড়া দিলো সে । কাছে সরে এসে লেপ্টে রইলো বুকের সাথে । রাতটা রাতের মতো হয়ে গেল ।
ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি এক আলোকময় পৃথিবী । অনেক বেলা হয়ে গেছে । আজ ছুটির দিন । একটু বেশী ঘুমানো হয়ে গেছে । রাতের প্রশান্তির জের হয়তো । রাতের কোথা থেকে কি ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা একবার চকিতে মনের পর্দা ছুয়ে গেল । অজান্তেই চোখ গেল পাশে রাখা মুঠোফোনের দিকে । প্রতিদিন সকালে ওখানে একজন কারো পাঠানো মেসেজে গুড মর্ণিং লেখাটি ভেসে উঠতো । শীলা একবার লিখেছিলো – ‘সেইং গুড মর্ণিং ডেইলি ইজ নট জাষ্ট আ ফর্মালিটি অর ডিউ টু ফ্রি এসএমএস । ইট ইজ দ্য আর্ট অব সেইং দ্যাট আই রিমেমবার য়্যু ইন মাই ফার্ষ্ট মিনিট অব দ্য ডে, গুড মর্ণিং ।’
আজ নেই । অনেকদিন হলো নেই । তার দিনের শুরুটিতে শীলার কি এখোনো আমার কথা মনে পরে ! খুব জানতে ইচ্ছে করে ।
ফুল্লরার হাতে বানানো ফুলকো লুচি আর আলুর দম এর গন্ধে সারাটা ঘর যেন মৌ-মৌ । অনেকদিন পরে ফুল্লরা নিজ হাতে আমার জন্যে সকালের নাস্তা বানালো । কাল রাতের মধুর কিছু মনে করে কি ! কে জানে । ঐ একটি অস্ত্রই কি মানুষের সব রাগ-অভিমান, অবহেলা-অনাদর, ঘৃনা-বিতৃষ্ণাকে এক লহমায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে পারে ! এতো কি শক্তি তার ! তাহলে শীলাকে দোষ দিয়ে লাভ কি ! পৃথিবীর কাউকেই বা দোষ দেয়া যাবে ! বৈধ কি অবৈধ প্রশ্নটি পরের । বৈধতার সঙ্গা-ই কি আমাদের জানা আছে । এক সমাজ যাকে বৈধতা দেয় অন্য আর এক সমাজে তা-ই অবৈধ । এমোনকি একই সমাজেও এর রকমফের হয় । তাহলে এই একটি ক্ষেত্রেই এতো নাক শিটকানো কেন ! কেন এতো ঢাক গুড়গুড় ! দু’টি প্রান –মন যদি একে অপরে সমর্পিত হয় স্বেচ্ছায় তবে পৃথিবীর কি ক্ষতি ! সমাজে শৃঙ্খলা থাকেনা, তাই ! কোথায় শৃঙ্খলা আছে ! কোথ্থাও নেই । লুচি ছিড়তে ছিড়তে ভাবনাগুলোও ছিড়ে ছিড়ে যেতে থাকে ।
‘কি মনে করে আমার পছন্দের খাবার করলে আজ’ ফুল্লরাকে শুধাই ।
‘বা..রে এমোন ভাব করছো যেন আমি তোমার পছন্দের খাবার এই প্রথম বানালাম ।’
‘না.. খুব ভালো হয়েছে তো তাই বলা । কথায় কথায় দোষ ধরছো কেন ?’
‘দোষ ধরলাম কোথায় ? তোমার ভাবখানা কেমন তা-ই বললাম শুধু । নাকি তাও বলতে পারবোনা ?’
‘পারবেনা কেন, লাইসেন্স তো দেয়াই আছে বলার ।’ তরল করতে চেষ্টা করি আবহাওয়া – ‘গ্রামে-গঞ্জে দেখ নাই মেয়েরা রঙীন সুতোয় বুনে ফুল লতাপাতার পাশে লিখে রেখেছে “সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে”। সে গুনটি কি জানো ? একটি মাত্র গুন থাকলেই যথেষ্ট, চুপ থাকা । কেবল রমনীকুল যদি তাদের মুখখানাকে একটু সেলাই করে রাখতে পারতো তবে এর চেয়ে বেশী সুখ-শান্তি বোধহয় স্বর্গেও পাওয়া যেত না ।’ হা হা করে হাসি ।
‘ঢং.. তোমার হয়েছে কি আজকাল ? খুব মুডে আছো মনে হয় ।’ ফুল্লরা চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরে ।
চায়ের কাপে চিনি মেশাতে গিয়ে ওর হাতের চুড়িতে তোলা কিঙ্কিনি ধ্বনি শুনতে শুনতে আমি আনমনা হয়ে যাই । আর একটি সকালের কথা মনে পরে যায় । শীলার দেয়া একটা রৌদ্রকরোজ্বল সকাল । প্রথম আলাপের ঠিক পরেরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গেই পাওয়া তার প্রথম এসএমএস – ‘‘আ কাপ অব হট হ্যালোজ, আ প্লেট অব ক্রিস্পি উইসেজ, আ স্পুন অব সুইট স্মাইলস এ্যান্ড আ স্লাইস অব গ্রেট সাকসেস । হোপ দিস ব্রেকফাষ্ট মেকস ইওর ডে লাভলী । গুড মর্ণিং । লটস অব লভ এ্যান্ড কিসেস ।’’ এই একটা অভ্যেস তৈরী হয়েছে ইদানীং আমার, ঘটে যাওয়া কিছু কিছু জিনিষ হঠাৎ করেই শীলার সাথে মেলাতে ইচ্ছে করে । চায়ের কাপে ফুল্লরার তোলা ঠুংঠাংয়ের সাথে আর একটি মধুর ঝঙ্কার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । কতোখানি প্রবল আবেগের জোয়ারে ভেসে গেলে সেই সাত সকালে শীলা অমোন একটি মেসেজ আমাকে পাঠাতে পেরেছিলো ভেবে অবাক হই ।
“বেলাশেষের পথে কুড়িয়ে পাওয়া এক মেয়েকে আমার এ লিখে যাওয়া । সে মেয়ে আমার এ লেখা পড়বে কিনা জানিনে । তবুও তার জন্যে লিখে যাবো আমি হাযার বছর ধরে । সে যদি জানতো, হায় - যদি সে জানতো ; তাকে ছুতেঁ না পারার ব্যথা আমার কতোটুকু তবে তাকে গানে গানে বলতাম - “বন্দী করা এক পাখীর কাছে জেনে নিও” ।
যে তীর, সে আমার বুকে একপ্রহরের খেলার ছলে বিধিয়েঁ রেখে গেছে, তার যে যাতনা; সেই মেয়ে কি তা জানে ?
সে যখন এটি পড়বে, তার কি মনে হবে তখন “ ইয়ে ক্যা হুঁয়া ? ক্যায়সে হুঁয়া - ক্যিউ হুঁয়া” ? সে কি জানে, আমি যে ঘুম ভেঙ্গে পথ চেয়ে রই তারই একটি চরনের ধ্বনি শুনবো বলে ? তার চোখও কি একটুখানি জলে ভরে উঠবে তখন ? হায়, আমি যদি জানতাম !
সে কি কোনদিন জানবে, আমি বাতাস হয়ে দক্ষিনে যাবো শুধু তারই জন্যে ? সে বাতাস যদি কোনদিন তার বুকের আঁচল উড়িয়ে নিয়ে যায়, সে কি লজ্জা পাবে ? আমি তো শঙ্খসাদা জ্যোৎস্না রাতেও প্রতীক্ষাতে জেগে থাকি তার, কি জানি যদি সে আসে কোনদিন আর আমায় না পেয়ে ফিরে যায় !
শীলা তুমি এসব জানবেনা কোনদিন । বুঝতে চাইবেনা, আমার এ লেখার প্রতিটি শব্দে কী গভীর এক প্রেম লুকানো । জানতে চাইবে না - সে কি তুমি “পরনারী” বলে ? তুমি কি জানো, সে মেয়েটি যে “একান্তই আপন নারী” আমার ? আমি তাকে দেখি আমার ভুবনে দু’চোখ ভরে । অদৃশ্য তার ছায়া আমাকে নিয়ে যায় এক দারুচিনি দ্বীপে । আমার ভয় হয়, এ ছবি যদি মুছে যায় কোনদিন ! তখন সেদিন, সে মেয়েকে আমি একবার শুধু কানে কানে বলে যাবো -
সুখস্মৃতি-
নাহি কিছু মনে ? যদি আনন্দের গীতি
কোনদিন বেজে থাকে অন্তরে বাহিরে,
যদি কোনও সন্ধ্যাবেলা বেনুমতীতীরে
অধ্যয়ন অবসরে বসি পুষ্পবনে
অপূর্ব পুলকরাশি জেগে থাকে মনে
ফুলের সৌরভসম হৃদয় উচ্ছাস
ব্যাপ্ত করে দিয়ে থাকে সায়াহ্ন আকাশ
ফুটন্ত নিকুঞ্জতল, সেই সুখকথা
মনে রেখো ।”
ফুল্লরা ঘর-গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলে গতরাতের লেখার খাতাটি টেনে নিয়ে একটানা লিখে ফেলি এইটুকু । সম্ভবত শীলাকেও এরকমের কাছাকাছি কিছু লিখে আমি পাঠিয়েছিলাম একবার । শীলাকে তো আমি কতো লেখাই পাঠিয়েছি । কখোনো উত্তর মিলেছে একটি দুটি বাক্যে । বেশীর ভাগই থেকে গেছে উত্তরহীন । কেবল হঠাৎ হঠাৎ একফালি দমকা হাওয়ার মতো তার এক একটি এসএমএস এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে আমার জানালাখানি ....................
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
সপ্তম অধ্যায় / ( প্রথম অংশ )
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০১