আজ সকালে বাসা থেকে বেড়িয়ে খুব হেলেদুলে কাজে যাচ্ছেন। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে । মোড়ের জব্বারের চা দোকানে বরাবরের মতোই ভীড় । কাজের জায়গায় ঢোকার আগে এককাপ চা’য়ের সাথে সিগ্রেটের ধোঁয়া উড়িয়ে খানিকটা জম্পেশ আড্ডা মেরে গেলেন । অফিসে গাধার খাটুনি খাটার আগে একটু রিফুয়েলিঙ আর কি !
কিন্তু দেখলেন না , বুঝলেন না কি ঘটনা ঘটে গেছে সবার অজান্তে। আপনি জানলেন না , দশ-বারো কি বিশ জনের ভীড় থেকে ছড়িয়ে গেছে নিরব কোনও ঘাতক ! ঠাঁই নিয়েছে আপনার ঘাড়ে । যাদের আপনি খালি চোখে দেখছেন না । আপনার হয়তো জানা নেই যে , আপনার চারপাশের এইসব পরিবেশে সুন্দরের মুখোশ এঁটে লক্ষ কোটি নিরব ঘাতক কিলবিল করছে ।
এইসব ঘাতকদের চেহারা সুরৎ “তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ” এর মতো ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি মার্কা সব মুখ । সুন্দর সুন্দর এইসব মুখ দেখেই আপনার ইচ্ছে হবে এদের খপ্পরে পড়তে । কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ভুলে জাননি, যতো বেশী সুন্দরীর খপ্পরে পড়বেন ছ্যাকা খাওয়ার সম্ভাবনাও ততো বেশী আর সেই ছ্যাকার ব্যথাটাও যে কতো বেশী ভয়ঙ্কর তা ও মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে হয়তো !
এই “সুন্দর” এর মুখোশের আড়ালে “ অসুন্দর” এর কতো যে আয়োজন, ভয়ঙ্কর সুন্দরতার আড়ালে লুকানো মৃত্যুর যে কতো হরেক পরোয়ানা ; তারই কেচ্ছা এখানে ।
অপরূপ আর ভয়ঙ্কর সব সুন্দরতার মাঝে অমঙ্গলের যে অশনি-সংকেত কালবৈশাখীর আকাশ চিরে বিজলীর মতো আমাদের জীবনাকাশেও যে ঝিলিক দিয়ে যায়, তারই টুকরো গল্প লিখতে বসেছি আমি। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে সুন্দর-অসুন্দরের যতো টানাপোড়েন, তার দূতিয়ালীতে সদা ব্যস্ত সব সুন্দর-সুন্দরীদের নিয়ে এই কাহিনী --------------------
অনুজীব তথা ইনফেকটিভ এজেন্টগুলো মানুষের শরীরে সংক্রমন ঘটায়, এটা আমরা সবাই জানি। আপনার বুকের নিউমোনিয়া থেকে শুরু করে ত্বকে ফোঁড়া হওয়া সবই এই অনুজীব বা ইনফেকটিভ এজেন্টগুলোর কাজ । এইসব ছোটখাটো রোগ আপনার জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলে নিঃসন্দেহে । তেমনি আবার ডায়রিয়া, কলেরায় আপনার লাইফের “ওয়ারেন্টি” কার্ডের মেয়াদ এক ঝটকায় বাতিল হয়েও যেতে পারে ।
এইসব রোগগুলোকে আমরা জানি, চিনি । শুধু জানিনে এইসব হলিউড – বলিউড সুন্দর কিম্বা সুন্দরীদের কার কার কারনে আমাদের শরীরে ঘুণ পোকাদের এই বাসা ।
দেখি নাই , জানি নাই তাহারে
তুলিয়া আনিয়াছি শুধু ভুল করে,
তবুও কেন সে মোর প্রানসংহারে…………….
--------হেপাটাইটিস – বি ভাইরাস । ক্রায়োইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপির ৩ডি রিকন্সট্রাকশানে খোলতাই তার রূপ....
----------------------হেপাটাইটিস – সি ভাইরাস । মরনঘাতী সুন্দরী ধরা পড়েছে ইলেক্টোমাইক্রোগ্রাফিতে ।
আপনি প্রাচীন মিশরীয় সুন্দরী ফারাও “হাটসেপসুত” এর নাম নাও শুনে থাকতে পারেন কিন্তু সুন্দরী “হেপাটাইটিস” জগৎজোড়া যার নাম; সে নামটি শোনেননি, তা হতে পারেনা !
স্ফটিক স্বচ্ছ , রঙীন এই সুন্দরীরা এতো চুপিচুপি আপনাকে জাপটে ধরবে যে প্রথম প্রথম আপনি কিছুই টের পাবেন না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে আপনি এই ধরাতলে না এলেও ক্ষতি নেই । এই সুন্দরীরা আপনাকে সোনার বরনে সাজিয়ে দেবে । গায়ের চামড়া থেকে শুরু করে চোখ পর্য্যন্ত সোনা রঙে রাঙিয়ে দিয়ে মায় আপনার মূত্রকে পর্য্যন্ত স্বর্নালী করে তুলবে । এতো ভালোবাসা পেয়ে আপনার কলিজা ( লিভার ) বড় হয়ে উঠবে । তবে এ সুখ সইবেনা বেশীদিন । ওপারের টিকিট কেটে ফেলতে পারেন ।
আপনার প্রতিবেশী খালাম্মা আৎকে উঠে বলবেন , ওমমা....বাছা তোমার গায়ে তো দেখি বদ-হাওয়া লেগেছে । হলদে-পালঙ হয়েছে তোমার। ওঝা ডেকে ঝারিয়ে নাও শিগগির।
খবরদার , এমন কাজটি করবেন না । করলে আপনার কলিজাটিকে ( লিভার ) আর অক্ষত পাবেন না । সুন্দরী বলে কথা ! গায়ের লেখাপড়া না জানা মূখ্যুসুখ্য ওঝাকে কি মানায় তার ধারে কাছে আসার ? পাশ করা ডাক্তারের কাছে ধর্ণা দেবেন । আপনার এমন সোনার বরন দেখে ডাক্তার বলবেন, “হেপাটাইটিসের কারনে আপনার জন্ডিস হয়েছে । বিশ্রাম .. বিশ্রাম.... আর বিশ্রাম. সাথে ঘন ঘন মিষ্টি তরল খেয়ে যান অবিরাম............................”।
সাথে এই পরীক্ষা সেই পরীক্ষা । জীবনটা জেরবার ।
------------------------------------------সোনালী চোখ নিয়ে হেপাটাইটিস রোগিনী...................
-----------------------------------------মুখের লালাও হতে পারে মরনঘাতী বাহক .... অতএব সাবধান !
বুঝতেই পারছেন, জব্বারের চা’য়ের দোকান থেকেই এই সুন্দরীরা আপনার পিছু নিয়েছে । এমন সুন্দরের পাল্লায় পড়লে এমন ঝক্কি ঝামেলায় তো পড়তেই হবে ! আর দ্রুত চিকিৎসা না হলে মৃত্যু যে বেশী দূরে নয়, তা হয়তো আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা ।
তোমার ঐ আবির রাঙা অধর পাড়ে
চোরকাঁটাতে বিঁধিয়ে দিলাম মন
আমার এই টুকরো কথা, টুকরো হাসি
পড়বে মনে ঘরে ফিরে,
একটু একটু করে.......
---------------------------------------------অনিন্দ্য সুন্দর হারপিস সিমপ্লেক্স...
------------------------হারপিস লেবিয়ালিস ভাইরাস। হীরকদ্যুতির মতো ছড়ায় ব্যথার মায়াজাল .............
চুম্বন ভালোবাসার প্রতীক । আনন্দদায়ক ও স্বর্গীয়। তা যদি আবার কোনও সুন্দরীর চুমু হয় তো কথাই নেই ! মধুও তার চেয়ে মধুর নয় !
তবে হীরক সুন্দরী লেবিয়ালিস এর চুম্বন কিন্তু সে চুম্বন নয় । এ চুম্বন নরকের । লেবিয়ালিস আপনার রক্তিম ঠোটে শুধু চুমু নয় কামড়ও দিয়ে বসবে । আনন্দ নয় তীব্র ব্যথার লজ্জায় আপনার মাথা ছিঁড়ে পড়তে চাইবে । গায়ে উত্তাপ ছড়াবে । এমন চুমুতে আপনার ঠোট জ্বলতে থাকবে । আপনার দিনগুলোর আনন্দ মিশে যাবে মাটিতে। সুন্দরী লেবিয়ালিস যে তার মনখানা আপনার অধরে বিঁধিয়ে রেখে গেছে চোরকাঁটার মতো ,তাতে সারাক্ষন তার কথাই আপনার মনে পড়বে ।
----------------------------------------হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস।
-------------------------------------হারপিস লেবিয়ালিস ভাইরাস। হারপিস সিমপ্লেক্স এর ছানাপোনা !
লেবিয়ালিস এর চুম্বন গাঢ় হলে আপনার অধরে বড়-ছোটো ফোস্কা ( ব্লিষ্টার) পড়ে যাবে । পুঁজ জমবে সেখানে আর তা ফেটে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি ঘা দেখা দেবে । এটা আপনার ঠোটেই শুধু নয় ছড়িয়ে পড়তে পারে মুখের ভেতরেও ।
এমন চুমু আপনি কামনা করেন কিনা এখন ভেবে দেখতে পারেন ! কামনা করেন কি করেন না , এটা কোনও ব্যাপার না ! না চাইলেও সুন্দরী লেবিয়ালিস বছরে বারকয়েক আপনাদের অনেককে চুমু খেয়ে যাবেই ............
------------------------------------------যন্ত্রনার আর এক নাম ...............
----------------------------------------কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে .....................
আমি যে ভয়ঙ্কর এক সুন্দর
তার কাছে আসি, সর্বনাশী
কেড়ে নেই দুরন্ত কৈশোর
শিশুর মুখের হাসি ,
আমি যে অন্যরকম ভালোবাসি
তাকে -
---------------------------------------------------পোলিও ভাইরাস ।
---------------------------------------------------ইলেক্টোমাইক্রোগ্রাফিতে ।
পোলিওর নামটি শোনেননি এমন কেউ নেই হয়তো এখানে । আতঙ্কের একটি নাম । ঠিকঠাক চিকিৎসা না হলে সারাজনমের মতো পঙ্গু হয়ে থাকতে হতে পারে আপনার আদরের সন্তানটিকে । আপনার এ রোগটি হবার সম্ভাবনা প্রায় একেবারেই নেই । আপনাকে তাদের পছন্দ নয় , পছন্দ বাচ্চাকাচ্চা । চেহারা সুন্দর এমন কেউ কেন যে বেছে বেছে কেবল শিশুদেরই আঁকড়ে ধরে তাকে অসহায় করে তুলতে চায় তা কে জানে ! হয়তো শিশুরা যা পায় তাই-ই মুখে দিয়ে ফেলে তাই তাদের পাকড়াও করা সহজ !
ফিকাল ওরাল রুট । কারন মানুষের “মল” এর মতো অসুন্দর কিছুতেই যে এমন সুন্দরের বসবাস । আর তা থেকে মুখে। এমন আদরে সে মাথায় চড়ে বসবেই । মুখ থেকে পেটে , সেখান থেকে রক্তে মিশে স্নায়ুরজ্জুকে কাবু করে ফেলবে ধীরে ধীরে । হাত-পা অবশ হয়ে যাবে । প্রথমে বুঝতে দেবেনা কিছুতেই যে সে ভর করেছে কোনও শিশুর উপর । শুধু জ্বর আর জ্বর । তারপর একদিন .................
------------------------------------পোলিওতে কেড়ে নেয়া শৈশবের আনন্দ উল্লাস ।
-------------------------------------এ জীবন বয়ে চলতে হবে এমনিই .............
আশার কথা এই অভিসম্পাৎ থেকে পৃথিবী এখন অনেকটাই মুক্ত । জগৎ জুড়ে পোলিও ভ্যাকসিনেশানের কারনে এই সুন্দর ঘাতক তার কামড় বসাতে পারছেনা আর । প্রতি বছর পাঁচ বছরের শিশুদের জন্যে এমন আয়োজন নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় ।
----------------------ওরাল পোলিও খাওয়ানোর চিরাচরিত দৃশ্য হলেও এই দৃশ্যটি বিরল।
বাতাসে বাতাসে আছি
তোমারই কাছাকাছি ।
টেনে নেবে মোরে, আদরে
রঙ্গনফুলের মতো জড়াবো সাদরে ...
------------------------------------------------- আহালে বাবুলে.................
সন্তানের টুসটুসে গালে একটি দু’টি মশার কামড়ের মতো দাগ দেখে হয়তো গা করবেন না । এরপর আপনার সন্তানটি ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করবে । কোলে তুলে ঠান্ডা করতে চাইলে টের পাবেন যে , গা গরম । একটু একটু কাশি শুরু হবে । চোখ লালচে হয়ে উঠবে । নাক দিয়ে ঝরবে পানি । আহালে বাবুলে.................
মশার কামড়ে এতো কিছু, তাই মশার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়বেন । আসলে সুন্দর দেখতে মিজেলস ভাইরাসের আদর এমনিই । আস্তে আস্তে তার আদর ছড়িয়ে যাবে সারা মুখে, তারপর রঙ্গন ফুলের মতো থোকা থোকা লালরঙে ভরে যাবে আপনার বাচ্চাটির বুকে পিঠ ।
কি হলো বাচ্চাটির ভেবে ভেবে কুল পাবেন না । ভাববেন, কি খেয়েছিলো বাচ্চাটি যে এমন মারাত্মক এলার্জী হলো তার !
এলার্জি হয়নি তার , হয়েছে “হাম” । অতি পরিচিত নাম । আপনিও হয়তো শিশুকালে এই মিজেলস ভাইরাসের আদরের খপ্পরে পড়েছিলেন এক-আধবার । মনে আছে ?
------------------------------ কী অনিন্দ্য সুন্দর মিজেলস ভাইরাস !
------------------------------- মিজেলস একটি প্যারামিক্সো ভাইরাস প্রজাতি । যেন গোলাপের কুঁড়ি ......
বাচ্চাকে কাবু করে ফেলা এই ঝাঁ-সুন্দর ভাইরাসটি বাতাসে ভেসে ভেসে আসবে আপনার সন্তানটির কাছে । তারপরে বাচ্চার সাদরে টেনে নেয়া শ্বাসের সাথে ঢুঁকে পরবে শরীরের অন্দরমহলে । এর কয়েকদিন পরেই যতো বিপত্তি ।
কয়েকদিনেই এই সুন্দরী রঙ্গন লাপাত্তা হয়ে যায় বলে ভাববেন না , ভয়ঙ্কর কিছু নয় । পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন গড়ে তিনশতাধিক শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে আপাত নিরীহ এই রোগটির কারনে । মৃত্যুর প্রধান কারন, ডায়রিয়া ও শরীরে পানিশূণ্যতা, মস্তিষ্কের প্রদাহ (এনকেফালাইটিস) অথবা নিউমোনিয়া। আর বেঁচে গেলেও ক্ষতির দিকটি হলো - অন্ধত্ব ।
-----------------------------------ট্রান্সমিশন ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের চোখে...............
কী বিচিত্র এই সৃষ্টিজগৎ আর প্রতি পরতে পরতে কী এর নান্দনিকতা ! পাশাপাশি কী ভয়ঙ্কর কারো কারো ছোঁয়া !
চলবে………………………..
ছবির কৃতজ্ঞতা - ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১:০০