ব্যক্তি ও স্বাধীনতা : একটি সোনার শেকল...
শিরোনামের বক্তব্যটি বুঝতে কষ্ট হবারই কথা । স্বাধীনতা নিয়ে আমরা কতো কথাই তো বলি । বলি দেশের স্বাধীনতার কথা , কথা বলার স্বাধীনতার কথা, ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা , অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা ইত্যাদি ইত্যাদি সহ মানুষের সর্বপ্রকার স্বাধীনতার কথা বলি । আসলে আমি -আপনি বলেই খালাস । কিন্তু স্বাধীনতা বলতে আসলে আমি -আপনি কিছু বুঝি কি ? স্বাধীনতা আসলে কি ?
বাংলা একাডেমীর “ব্যবহারিক বাংলা অভিধান”য়ে “স্বাধীনতা” শব্দটির অর্থ দেয়া হয়েছে এভাবে -
১ ) স্বচ্ছন্দতা ।
২ ) বাধাহীনতা ।
৩ ) আজাদি । আজাদির অর্থে বলা হয়েছে - মুক্ত, নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত ।
http://www.dictionary.com/ এ স্বাধীনতা বা independence এর অর্থ করা হয়েছে এমনটা - ফ্রীডম ফ্রম কন্ট্রোল, ইনফ্লুয়েন্স, সাপোর্ট, এইড, অর দ্য লাইক, অব আদারস ।
http://dictionary.cambridge.org/ স্বাধীনতার অর্থে বলেছে - দ্য এ্যাবিলিটি টু লিভ ইয়োর লাইফ উইদাউট বিয়িং হেল্পড অর ইনফ্লুয়েন্সড বাই আদার পিপল ।
আর যদি স্বাধীনতার ইংরেজী Freedom বা Liberty ধরি তবে সব খানেই আপনি এ রকম ধারনা পাবেন -----
দ্য পাওয়ার অর রাইট টু এ্যাক্ট, স্পিক, অর থিংক এ্যাজ ওয়ান ওয়ান্টস উইদাইট হিন্ডারেন্স অর রেসট্রেইন্ট ।
অথবা -
ইগজেম্পশন ফ্রম এক্সটার্নাল কন্ট্রোল, ইন্টারফারেন্স , রেগুলেশান এটসেটরা ....
এগুলো দিয়েও কিন্তু Freedom বা Liberty বা স্বাধীনতার স্বাদ ঠিকঠাক চেখে দেখা দুঃষ্কর । কারন, পৃথিবীর হাতে এ পর্যন্ত স্বাধীনতার একটিও ভালো সংজ্ঞা নেই ।
এ তো গেলো বই পুস্তকের কঠিন কঠিন সব কথা ! আর আমরা আমজনতা সোজা কথায় স্বাধীনতা বলতে যা বুঝি তা হলো নিজের ইচ্ছে মতো চলা । এ চলায় যেন কেউ বাঁধা না দেয় । এই তো ? আমরা সবাই স্বাধীন । আমি স্বাধীন , তুমি স্বাধীন , আপনি স্বাধীন, সে স্বাধীন, জব্বার স্বাধীন , সুকুমার স্বাধীন, মনোয়ারা স্বাধীন , জয়া স্বাধীন মায় রিক্সাওয়ালা, ফেরীওয়ালা, মাছওয়ালা এমনি করে সতের কোটি লোকই স্বাধীন । এমনকি কোলের শিশুটি পর্যন্ত স্বাধীন । কেউ কারো স্বাধীনতায় হাত দেয়ার প্রশ্নই আসেনা । এটাই আমরা বুঝি মোটা দাগে ।
দেশ-কাল-পাত্রে ব্যক্তিই তো মূখ্য, তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসঙ্গেই বলি । দেখা যাক, আমি- আপনি স্বাধীন বলে যে বগল বাজাই তা কতোখানি আর কি রকম শব্দ করে ।
আপনার ইচ্ছে হলো আপনি এখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটবেন । একে তো আপনি এই দেশের একজন মালিক তার উপরে স্বাধীন । আপনাকে ঠেকায় কে ? কিন্তু বাস্তবে আপনি তা করেন না । কেন করেন না ? রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেটে গেলে যানবাহনের চলাচলে আপনি যে একটি বাঁধা এবং আপনি যানবাহনের চলাচলের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেন , সেটা ভেবে নিশ্চয়ই আপনি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটা বন্ধ করেন না । রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটা বন্ধ করেন এই কারনে যে, আপনি গাড়ীঘোড়ার নীচে পড়ে ভবলীলা সাঙ্গ করতে চান না । বউ বিধবা এবং ছেলেমেয়েরা এতিম হতে পারে ভেবে। নিজের স্বার্থটাকে বা ভালোটাকে আগে দেখেন । ঠিক তো ?
এই “ নিজের স্বার্থটাকে বা ভালোটাকে আগে দেখা ”র কথা মাথায় রাখুন ।
আবার আপনার ইচ্ছে হলো, ঘরের মধ্যে গলা ছেড়ে গান গাইবেন । আপনার ইচ্ছে । ঠিক আছে, আপনি স্বাধীন তাই কারো কিছু বলার নেই । কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন ঘরে আপনার বাবা-মা - ভাই-বোন- স্ত্রী-সন্তানও আপনার মতোই স্বাধীন ? আপনার গলা ছেড়ে গান গাওয়াতে আপনার বাবার ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে , আপনার বোনটির লেখাপড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে , স্ত্রীর মাথা ধরতে পারে , আপনার সন্তানটির ঘুম চটকে গিয়ে তারস্বরে চীৎকার জুড়ে দিতে পারে ? তারাও তো আপনার মতোই স্বাধীন । তাই আপনি আপনার বাবার ঘুমের স্বাধীনতাকে নষ্ট করতে পারেন না । আপনার বোনটির লেখাপড়ার স্বাধীনতাকে শিকেয় তুলতে পারেন না । না কি তারা কেউই আপনার মতো স্বাধীন নয় ? স্বাধীন শুধু আপনি একা ? আপনি যদি স্বাধীনতাকে অধিকার মনে করেন তবে সবাই সে অধিকার আপনার মতোই সংরক্ষন করেন । তাই আপনি যদি “স্বাধীনতা” য় বিশ্বাস করেন তবে আপনি গলা ছেড়ে কিছুতেই গান গাইতে পারবেন না । আপনাকে একান্ত নিভৃতে গান গাইতে হবে যাতে অন্য কারো স্বাধীনতা বিচ্ছিন্ন না হয় । এর সোজা অর্থ, আপনার গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করলেও তা পারবেন না যদি আপনি অন্যের স্বাধীনতাতেও বিশ্বাসী হন ।
কারন লিবার্টি বা ফ্রিডম শব্দটির এই যে দ্যোতনা “ ইগজেম্পশন ফ্রম এক্সটার্নাল কন্ট্রোল, ইন্টারফারেন্স , রেগুলেশান...” এর সবটাই আপনার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্যে প্রযোজ্য ।
আপনি নিজের স্বার্থটাকে আগে দেখেন বলেই গলা ছেড়ে গান গাইতে আপনার বাঁধেনা ।
এভাবে --------
আপনার ইচ্ছে হলো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকবেন । কিন্তু আপনি তা পারবেন না । কারন, আপনার এই পথ আগলে থাকার কারনে অন্য পথচারীদের চলা বাঁধাপ্রাপ্ত হবে । তারাও আপনার মতো স্বাধীন বলে বাঁধাহীন ভাবে পথ চলতে চাইতে পারেন । ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থেকে পথচারীদের স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতাকে আপনি বাঁধা দিতে পারেন না । এর অর্থ , ইচ্ছে হলেও আপনি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না । অন্যের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানাতে চাইলে আপনি পথ আটকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকবেন না ।
আপনি নিজের স্বার্থটাকে ষোলআনা বোঝেন বলেই পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকেন ।
ইচ্ছে হলেই মাইক বাজিয়ে আপনার পণ্যের প্রচার, গানা-বাজনা বা ওয়াজ-নসিহত করতে পারবেন না । কারন, আপনার এই কাজ বাদবাকীদের নির্বিঘ্ন জীবন যাপনের স্বাধীনতার পরিপন্থী । এভাবে আপনি কিছুতেই শব্দদূষন করতে পারেন না যাতে অন্যের শান্তি বিঘ্নিত হয় । এটা অন্যের জীবনে আপনার সরাসরি ইন্টারফারেন্স । তাই ইচ্ছে হলেই আপনি যখন তখন মাইক বাজাতে পারবেন না ।
আপনি নিজের স্বার্থটাকে আঠারোআনাতে তুলে নেন বলেই দিন রাত্তির মাইক বাজাতে দ্বিধা করেন না ।
বাক স্বাধীনতা আছে বলে, ইচ্ছে হলেই যাকে তাকে যখন যা খুশি বলবেন ? আপনি তা পারবেন না । আপনার যা খুশি তা বলা অন্যের সম্মানহানী করতে পারে । এটা সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী । সঙ্গত কারন ছাড়া আপনার এরকম স্বাধীনতা কারো মানসিক এবং সামাজিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল । আপনি নিজের স্বাধীনতায় সত্যিকারের বিশ্বাসী ও আস্থাবান হলে অন্যের এমন স্বাধীনতার ব্যাপারেও উদাসীন থাকতে পারেন না ।
আপনার স্বার্থের কারনেই, যাকে তাকে যখন যা খুশি বলা থেকে বিরত থাকেন না ।
হাইফাই মোবাইল কিনবেন বলে বাবার সাথে টাকার জন্যে ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন , তা হবেনা । আপনার নিজের বাবা বলেই যে এমন স্বাধীনতা আপনার আছে , এটা ভাবা স্বেচ্ছাচারিতা । বাবার মাথায় টাকার বোঝা চাপিয়ে আপনি তার জন্যে মানসিক অশান্তি , তার আর্থিক ক্ষমতার উপর চাপ প্রয়োগ কিম্বা পারিবারিক দুঃস্বপ্ন ডেকে আনতে পারেন না ।
তেমনি আপনার বাবাও পারেন না, পড়া থেকে উঠিয়ে আপনাকে ইচ্ছের বিরূদ্ধে বাজারে পাঠাতে ।
আপনাদের নিজস্ব স্বার্থের কারনেই আপনারা এসব করে থাকেন ।
এই যে ক'দিন আগে শুধুমাত্র একজন ফাঁসির আসামী ড্রাইভারকে বাঁচাতে আমাদের পরিবহন শ্রমিকেরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা অধিকারের নামে সারা দেশকে জিম্মি করে রাখলেন , এটা যদি স্বাধীনতার চেহারা হয় তবে এর চেয়ে বড় স্বেচ্ছাচার আর অরাজকতা কোনটি ?
এভাবে আপনি এতোদিন ধরে যা যা করে এসেছেন তার কোনটিই সম্ভবত “ স্বাধীনতা” শব্দটির সত্যিকারের অর্থের সাথে সংঘাতবিহীন নয় । ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে এসব-ই আপনার স্বেচ্ছাচারিতা । হয়তো কেউ কিছু বলেনি । বলেনি, কারন স্বাধীনতার অর্থটিই তাদের জানা নেই । জানা নেই, এর সীমানা কতোটুকু ; এর পরিধিই বা কতোখানি বিস্তৃত ।
আমি বলি - স্বাধীনতা একটি সোনার শেকল । যা আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে চেতনায়, অনুভবে, বিচক্ষনতায়, দায়িত্বশীলতায়, প্রজ্ঞায় । সোজা কথায়, আপনার সকল স্বাধীনতা সম্পর্ণভাবেই পরাধীন আপনার চেতনার কাছে , আপনার বিচক্ষনতার কাছে , আপনার দায়িত্বশীলতার কাছে ।
এই শেকলটি কতোদূরে আপনাকে নিয়ে যেতে পারে তা নির্ভর করে আপনার চেতনাকে বেঁধে রাখা এই শেকলটা লম্বায় কতোটুকু ! আপনি ঠিক ততোখানিই যেতে পারবেন যাতে অন্যের স্বাধীনতার উঠোনে হামলে না পড়েন ।
সিদ্ধান্তে আসার আগে আপনি সত্যিকারের স্বাধীনতার সীমা , পরিধি, ব্যপ্তি সম্পর্কে মনীষীদের এই কথাগুলো একবার ভেবে দেখতে পারেন ........................
এই ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে বা ছাঁচে ফেলে নাগরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি স্বাধীনতার পায়ে শেকল পড়িয়ে দেখুন কতোখানি জায়গা ( স্পেস ) ছেড়ে দেবে তা আপনাকে .......................
কৃতজ্ঞতা - সকল ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া । কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি, এইসব ছবির প্রকৃত দাবীদারদের ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:২৩