যখনই পথেঘাটে বের হতে হয় তখনই পরিবহনের অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী-ছেলেমেয়ে সহ নাকাল পাবলিকদের অবস্থা দেখে "মাথায় কতো প্রশ্ন আসে দিচ্ছেনা কেউ জবাব তার" এর মতো একটা বেকুবীয় প্রশ্ন মাথায় এসে যায় - এদের কাছে একটি নিজস্ব পরিবহন মানে একটি গাড়ী কি এখন বিলাসী পণ্য নাকি অতি প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন একটি ভোগ্যপণ্য? জবাব পাইনে!
প্রশ্নটি কে কিভাবে নেবেন জানিনে তবে এই বেকুবের কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় বড় শহরগুলোতে যারা থাকেন তাদের কাছে একটি নিজস্ব পরিবহন মানে একটি গাড়ী, অত্যাবশ্যকীয় একটি নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু। স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালতের জন্যে যা অপরিহার্য্য বা চাল-ডাল-তেল-নুনের মতোই যা প্রতিদিনের ব্যবহার্য্য। এই অপরিহার্য্যতা দিন দিন আরো অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে ইদানীং। পরিবহনে নাকানি-চুবানী খাওয়া প্রায় প্রতিটি পথচলতি মানুষের মনে একটি ইচ্ছেই শুধু ঘুরপাক খায়- যদি আমার এখন একটি গাড়ী থাকতো!
এই বেকুবেরও তেমন ইচ্ছে হয় , ইচ্ছে হয় আপনারও!
আবার এর যৌক্তিকতা মোটেও হিসেব না করে কেউ কেউ হয়তো মহা বেকুবের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে বলেই বসবেন - আরে বেকুব গাড়ী বিলাসী পণ্য না তো কি?
এদের মতো আমাদের অর্থমন্ত্রীর ধারনাও তাই। তিনি বোধহয় " হাম ভি কাঠাল খায়া, তুম ভি কাঠাল খায়া ?" চুটকি গল্পটি মুখস্থ করে রেখেছেন। তার ধারনা , তার মতো আম পাবলিকরাও সবাই কোটিপতি। গাড়ী থাকা মানেই তার মতোই কোটিপতি । তার কাছে গাড়ী (যেহেতু তার প্রাডো, মার্সিডিস সহ একাধিক গাড়ী রয়েছে সম্ভবত!) একটি বিলাসী পণ্য হতেই পারে। কিন্তু পাঁচ ছয় সদস্যের একটি পরিবারের কাছে একটি রিকন্ডসনড বা সেকেন্ডহ্যান্ড টয়েটা বা কম দামী গাড়ী একেবারেই অপরিহার্য্য। এটা বাস্তবতার নিরিখে মোটেই বিলাস নয়, নেসেসিটি। বর্তমানে পরিবহনের দুর্ভোগের কারনে দেশে বিশেষ করে ঢাকায় থাকা একাধিক সদস্যভুক্ত পরিবারের কাছে একটা গাড়ী রাখা ফরজ না হলেও ওয়াজিব তো বটেই! আপনার নিজের কথাই ধরুন না কেন ! আপনি নিজে সহ পরিবারের স্কুল-কলেজ-অফিস- বাজার-আমন্ত্রন রক্ষা- আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ খবর- আপৎকালীন সহায়তা ( অসুস্থ্য হয়ে পড়াতে হাসপাতালে যাওয়া)ইত্যাদি নানা কারনেই আপনার একটি ব্যক্তিগত পরিবহন কী একান্ত প্রয়োজনীয় নয়? আপনি যদি ঢাকাতেই থাকেন তবে এর প্রয়োজনীয়তা আপনি মূহুর্তে মূহুর্তে অনুভব করতে পারছেন নিশ্চয়ই? আর গাড়ী না থাকার কারনে চুল ছিড়ছেন!
আপনি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত হলেও এটাকে বিলাস ভাবছেন কি? আমার মতো বেকুব না হলে আপনি এটাকে বিলাস ভাবতেই পারেন! আর আপনি বিত্তশালী হলে একাধিক গাড়ী ক্রয়েচ্ছা যে আপনার বিলাসিতা তা আমার মতো সব বেকুবও বোঝে!
অর্থমন্ত্রী আমার মতো বেকুব নন বলেই তিনিও এটাকে বিলাস ভেবে বসে আছেন। এবারের বাজেটে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যতীত সব ধরনের বিলাসবহুল পণ্যে আয়করের পরিমান বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি বিষয়টিকে। বিলাসী পণ্যের ছাপ মেরে ব্যক্তিগত গাড়ীর বার্ষিক আয়কর ৫০-৬৭% বাড়িয়ে দিয়েছেন। আশ্চর্য্য ! গাড়ীতেও আয়কর তাও অগ্রীম !অথচ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের কাছেই একটি গাড়ী রয়েছে যা তার জীবন -জীবিকার উপায়, পরিবারের দিনেরাতের সকল যাতায়াতের সহায়ক।
একজন গাড়ীর মালিককে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মাধ্যমে প্রতিবছর অগ্রিম আয়কর কর ১৫ হাজার টাকা, ট্যাক্স টোকেন নবায়ন ফি ৫ হাজার ৮০২ টাকা, ফিটনেস সনদ নবায়ন ফি ১০৮৭ টাকা মিলিয়ে ২১ হাজার ৯৮৯ টাকা খরচ করতে হতো। বর্তমানে ১৫০০সিসি গাড়ীর ( যা কেবল মধ্যবিত্তদেরই থাকে ) অগ্রিম কর আরও ১০ হাজার টাকা বৃদ্ধি এবং বিআরটিএর বিভিন্ন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার ফলে সব মিলিয়ে বছরে তাকে দিতে হবে ৩৩ হাজার টাকা। এই বাড়তি ১১ হাযার টাকা নিম্ন আয়ের গাড়ীর মালিক দেবেন কোত্থেকে? রাষ্ট্র কি মধ্যবিত্ত , নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ডাকাতিতে প্ররোচিত করছে? (নিজেই মালিক এমন একজন উবার বা ট্যাক্সিচালকের কথা ভেবে দেখুন বা নিজের কথাই ভাবুন।)
মহাবেকুবের মাথায় আরও হাযারো প্রশ্ন - যারা যারা আয়কর দেয়ার মতো আয় করেন তারা তো রাজস্ব বিভাগে প্রতি বছর আয়কর দিচ্ছেনই তাহলে আবার বিআরটিএ'তে আয়কর জমা কেন ? তাও আবার অগ্রিম কর হিসেবে? একজনের কাছ থেকে দু'বার আয়কর আদায় করার শানে-নযুল কি ? লোকে আয়কর ফাঁকি দেয় বলে ? টাকা হয়তো লুকিয়ে রাখা যায় কিন্তু গাড়ী তো লোকে লুকিয়ে রাখতে পারবেনা। তাকে বছরে একবার হলেও বিআরটিএ'তে গাড়ীসহ হাজিরা দিতে হবে! তখনই তার গলা চেপে ধরার অবাধ সুযোগ আছে বলে এই ব্যবস্থা? সরকারের নীতি নির্দ্ধারকদের মাথায় ঘিলু আছে বলতে হবে!
কিন্তু গাড়ী আছে অথচ আয়কর যোগ্য আয় নেই এমন মানুষও তো আছেন ? অনেকেই আছেন, হয়তো আপনিও! নাকি নেই? অনেকেই আছেন সরকারী - বেসরকারী চাকুরীকালীন সময়ে একটি গাড়ী কিনেছেন (আয়কর দিয়েও) উপযোগীতা হিসেব করে। হয় তিনি ব্যাংক লোন নিয়েছেন, স্ত্রীর গয়না বিক্রি করেছেন বা হাতে থাকা কিছু জমি বিক্রি করে একটি গাড়ীর মালিক হয়েছেন। এখন তিনি চাকুরীহীন বা রিটায়ার্ড বা আয় করতে অক্ষম। আয় নেই কিন্তু গাড়িটি আছে। তিনি কোন সুখে আয়কর দিতে যাবেন ? ছোটখাটো ব্যবসা করে এমন কেউ হয়তো অতীব প্রয়োজনেই একটা গাড়ী কিনেছেন। (ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে) এখন করোনা কালীন সে ব্যবসা কমে গেছে বা ঝুঁকির মুখে তিনি কেন একই করের বোঝা দু'দুবার টানবেন ? কোন যুক্তিতে একজন আয়বিহীন বা আয়করের বর্হিভুক্ত লোককে গলা টিপে বাধ্য করা হবে আয়কর দিতে, তাও অগ্রিম ? এটা তো প্রকারন্তরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই!
যদিও সরকারের রাজস্ব বিভাগ বলছে- অগ্রিম কর হিসেবে দেওয়া টাকা বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমার সমন্বয় করা হবে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে গাড়ীওয়ালা যে কেউ আয় না করেও আয়কর দিতে সামর্থ্য রাখেন এবং তিনি তা দিতে বাধ্য? বছরে ৩৩ হাযার টাকা মানে মাসে আড়াই হাযার টাকার বেশী। মাসে যার দুই টাকাও ইনকাম নেই তাকেও এটা দিতে হবে বছর বছর ? নইলে রাস্তায় তার গাড়ী চলতে দেয়া হবেনা, কাগজপত্র আটকে দেয়া হবে ? আর যদি একসময় আয়কর দিয়েছেন কিন্তু এখন আয়বিহীন কোনও গাড়ীর মালিক রাজস্ব বিভাগ থেকে তার আয়কর রহিতের কাগজপত্র নিয়ে আসেন তবে কি তিনি গাড়ীর কাগজপত্র নবায়ন করার সময় বিআরটিএ'র ধার্য্যকৃত এই আয়কর থেকে রেহাই পাবেন ? জানা মতে কেউ পেয়েছেন কিনা জানিনে! সে সিষ্টেম আদৌ আছে কিনা তাও জানা নেই, অন্তত এমনটা শুনিনি। এদের জন্যে সরকারের কোনও মন্ত্রনালয়ের কোনও নির্দেশনাও নেই সম্ভবত।
অবস্থা এমন করে রাখা হয়েছে যে,সবচেয়ে কম দামি গাড়ি থাকলেও বছরে ৩৩ হাজার টাকার মতো বাড়তি খরচ করতে হবে ভেবে মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যটি কিনতে দশবার ভাববেন এবং পেছিয়ে যাবেন । পারিবারিক চলাচল দূরুহ হয়ে পড়বে দিন দিন।
জানতে চাই, এর কোনও সমাধান আছে কিনা! জবাব কে দেবেন ?
বেকুব বলে আরও অনেক বেকুবী জিজ্ঞাসাই মাথায় ভর করে মাঝে মাঝে যার জবাব মেলেনা-
এই যে দেশের লাখ লাখ গাড়ী থেকে রোড ট্যাক্স নামে যে 'ট্যাক্স টোকেন" এর লক্ষকোটি টাকা জমা হয় সরকারী কোষাগারে তা কি কাজে লাগে ? তার গতিই বা কি? রাস্তা ব্যবহার করার মাশুল হিসেবেই তো এই টাকা নেয়া হয় ? তাহলে এই টাকা দিয়ে তো সংবছর রাস্তা করদাতাদের চলাচল উপযোগী করে রাখার কথা! রোড ট্যাক্স তো এজন্যেই নেয়া হয়, না কি? অথচ দেশের রাস্তাঘাট তো মাশা'ল্লা দিনের পরে দিন চাঁন্দের মতো খানা খন্দকে ভরা থাকে! এক পরিসংখ্যানে দেখলুম, বিআরটিএ'তে বাস-ট্রাক বাদে বাকী সকল ধরনের রেজিষ্ট্রিকৃত গাড়ীর সংখ্যা ৪,৪৭১,৬২৫ । এই এতোগুলো গাড়ী থেকেই তো বছরে শুধু রোড ট্যাক্সের টাকাই আসে কমপক্ষে ২৬০০ ( দু'হাযার ছয়'শো ) কোটি। তাহলে এই এতো টাকা যায় কোথায়? বলবেন, যে সব রাস্তাঘাট নতুন করে তৈরী বা মেরামত করা হয় সেখানে এই টাকা লাগে। তাহলে আমরা যে শুনি, সিটি বা পৌর কর্পোরেশানগুলি সব রাস্তা মেরামত বা তৈরী করে থাকে আর রাস্তাঘাট বানাতে বা মেরামতে তাদের নাকি বাজেট ঘাটতি ! গিট্টুটা কোথায়? যদি রোড ট্যাক্সের টাকা দিয়েই সিটি বা পৌর কর্পোরেশানগুলি রাস্তাঘাটের কাজগুলো করে থাকে তবে রাস্তাঘাটের হাল এমনইবা কেন ? যে বিভাগই এসব করুক, প্রতিবছর যতো টাকা এইখাতে আসে এবং এতোদিন ধরে যা এসেছে তা দিয়ে তো রাস্তাঘাট সোনা না হলেও রূপা দিয়ে বাঁধানো থাকার কথা!
জবাব পাবো কই ?????????????
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:৩৬