আমি তখন আশুলিয়ায় ছিলাম।ছোট একটা জবও করতাম।মাইনে যা পেতাম তাতে আমার একলার সংসার ভালই চলত। অফিস, আড্ডা আর নীরুকে নিয়ে বেশ ভাল সময় কেটে যেতো।
নীরু হচ্ছেন আমার তিনি। তিনি মানে যাকে নিয়ে আমি দুচোখে স্বপ্নের জাল বুনি।যার চোখে নিজেকে খুঁজে পাই। কষ্ট পেলে যার বুকে মুখ লুকাই। তিনি হচ্ছেন আমার নীরু।আমার ভাবনার দেয়ালের রঙ তুলি। সময় পেলেই রঙ তুলি নিয়ে বসে যাই। নানান রঙে সাজিয়ে তুলি দুচোখে আঁকা স্বপ্ন গুলোকে।
নীরুর জীবনের বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।তখন থেকেই নীরু বেশ চুপচাপ।নিজেকে অন্য সব কিছু থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো সে।
.
নীরু তখন ক্লাস নাইনে পড়তো।আরশাদ নামের এক শিক্ষক ওকে বাড়ি এসে পড়িয়ে যেতো।ঝড়-বৃষ্টির এক রাতে নীরু বাড়িতে একাই ছিলো।নীরুর বাবা তখনও অফিস থেকে ফিরতে পারেননি। আরশাদ পড়াতে এসে আটকে যায়।প্রচন্ড বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোর কোন সুযোগ ছিল না।তাই সে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিলো।
কিন্তু পুরুষ মানুষ নারীকে একলা পেলে জঘন্য হয়ে ওঠে। আরশাদের মনেও তখন বদ মতলব খেলা করছিল।ফাঁকা বাড়িতে নীরু কে একলা পেয়ে হিংস্র জানোয়ারের মত নীরুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।অসহায় মেয়েটি নিজেকে বাঁচানোর জন্য বুক ফাটা চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু তাতে আরশাদ শান্ত হয় না।বরং ওর পশুত্ব আরো বেড়ে যায়।দ্বিগুণ উল্লাসে ছিঁড়তে থাকে নীরুর শরীর।
একসময় চিৎকার করতে করতে নীরু অজ্ঞান হয়ে যায়। আরশাদ তখন মনের ক্ষুধা মিটিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ে।
নীরুর যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে রক্তাক্ত অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে। এই ঘটনা নীরু কাউকে জানাতে পারেনি।দিনের পর দিন কষ্টটাকে নিজের ভেতর পুষে রেখে সে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল।আর হারিয়ে ফেলেছিল ওর কৈশোরের আনন্দ, উচ্ছলতা।
.
তারপর নীরুর সাথে আমার দেখা হলো।ওর চোখে চোখ রাখলাম।দেখলাম সে চোখে তীব্র ঘৃণা।পুরুষ জাতিটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে।আমি খুব আহত হলাম। নীরুর সাথে মেশার চেষ্টা করলাম।একদিন নীরুকে জয় করে ফেললাম। নীরু তখন আমাকে ওর অতীত নিয়ে বলেছিল।সেই নিষ্ঠুর রাতের কথা মনে করে নিরবে দুচোখ ভরে অশ্রু ঝরিয়েছিল।আর আমি পুরুষ নামের কলংক নিয়ে মুখ লুকিয়েছিলাম।
.
নীরুর মা নেই।ভাইও নেই।শুধু বড় একটা বোন আছে।ওনি সংসারের ঘানি টানতেই ব্যস্ত। নীরুর খবর নেয়ার সময় খুব একটা পান না। নীরুর বাবা সোনালী ব্যাংকের ক্যাশ শাখায় বসেন। অফিস বাদে পুরো সময়টা তিনি নীরুকে নিয়েই মেতে থাকেন। খুবই আমুদে মানুষ। আমাকে বেশ পছন্দ করেন। অবশ্য ওনার সুপারিশেই আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম। আর সেই সুবাদেই নীরুদের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর আমিও নীরুর চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নীরুর বাবা অবশ্য এসবের কিছুই জানতেন না। আমরাও জানাই নি।সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।কিন্তু সেই সময়টাই যে কখনও আসবে না সেটা কে জানত!
.
রোজার ঈদে আমি বেশ লম্বা ছুটি পাই।নীরুকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু মায়ের মুখটাও ভীষণ মনে পড়ছিলো। অনেকদিন মাকে দেখি নাই।সে প্রায় বছর খানেক হলো। আমি যে জব করতাম তাতে ছুটিছাটা তেমন পেতাম না। মাকে দেখার সুযোগও হতো না। বাড়ি আসার জন্যেও মনটা কেমন কেমন করছিল।কিন্তু নীরুকে ছেড়ে আসতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। নীরুর জল ভরা চোখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে ছিলাম পুরোটা সময়। কখন যে নীরু সামনে থেকে চলে গিয়েছিলো টেরই পাইনি।
.
ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন আসে।বড় আপু, ছোট আপু দুলাভাই ফুফা ফুপি সবাই আসে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। তবুও নিজেকে খুব একলা মনে হচ্ছিল।মন মরা হয়ে ঘুরছিলাম।মা আমাকে খুব ভাল বুঝতে পারেন। আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। আমি মাকে সবকিছু খুলে বললাম।নীরুর কথা জানালাম।নীরু ছাড়া আমি চলতে পারব না। আমার অস্তিত্বে নীরু মিশে গেছে। নীরুর ভালবাসা আমার জীবনে খুব বেশি প্রয়োজন।মা কে সব বললাম। মা আমাকে বুঝতে পারলেন।সব মা-ই বোধ হয় সন্তানদের বুঝতে পারেন। সন্তানের কিসে খুশি হবে মায়েরা হয়ত সন্তানের চোখ দেখলেই বুঝতে পারেন।
মা আমাকে সান্তনা দিলেন।নীরুকে দেখতে চাইলেন।
তখন নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো।আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম।আমার চোখে তখন খুশির জোয়ার বয়েছিলো।
.
ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরে আসলাম। প্রথমেই গেলাম নীরুর কাছে। নীরুর বাবা বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়েছিলেন। ওনার মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো।আমাকে দেখে বেশ খুশি হলেন।নীরুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।জিজ্ঞেস করলাম, নীরু কই?
নীরু বাবার চোখ ভিজে উঠল।ওনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।আবার বললাম চাচা কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?
ওনি কাঁদতে কাঁদতে সব বললেন।
.
নীরু বাড়ি থেকে খুব একটা বের হয় না।কিন্তু সেদিন বাবা মেয়েতে একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সেই ঘুরতে যাওয়াটাই নীরুর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো। নীরুর বাবা চোখে কম দেখতে পেতেন।চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখতেন।সেদিন ঘুরতে বেরিয়ে অসাবধানে চশমাটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো।মেয়েকে নিয়ে রাস্তার ওপারে চশমার দোকানে যাচ্ছিলেন। নীরু বাবাকে হাত ধরে রাস্তা পার করাচ্ছিল। অপরদিক থেকে ট্রাক এসে ওদের ধাক্কা দিয়েছিল। বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে নীরু নিজেকেই ট্রাকের তলায় সঁপে দেয়। আর সেখানেই নীরুর সলিল সমাধি হয়ে যায়।
.
পুরো ঘটনা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার চারপাশের সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে আসছিল।জীবনে প্রথম যাকে ভালবাসলাম,যার হৃদয়ে হৃদয় রাখলাম,যার চোখে রঙিন স্বপ্ন বুনলাম সেই আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।শুধু অল্প কয়েকদিনের স্মৃতিগুলো আমার বুকে গেঁথে দিয়ে গেলো।