somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হলুদ গেঞ্জির হিমু [ গল্প ]

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পার্কের যে জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি রোদ পড়েছে, ঠিক সেখানেই বসে আছে রুদ্র । পরনে একটি ঢোলা হলুদ গেঞ্জী আর কালো প্যান্ট ।

রোদে দরদর করে ঘাম ঝরছে রুদ্রর কপাল বেয়ে । কিন্তু সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । বেঞ্চে বসে পা দুলিয়ে কি যেন ভাবছে সে ।

হঠাৎ করেই পা দোলানো বন্ধ করে দিল । মুখে বেশ গাম্ভীর্য । একটি ছোট্ট লাফ দিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে পড়ল ।

দুহাত দুপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে সবকিছু বের করে বেঞ্চে রাখল । তেমন কিছু নেই । শুধু একটি দুমড়ানো মুচড়ানো চিরকুট আর একশ টাকার একটি নোট ।

নোটটির দিকে চোখ পড়তেই বেশ বিরক্ত হয়ে গেল রুদ্র । কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল তার । এলো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বেঞ্চের চারদিকে ঘুরতে লাগল সে ।

এরই মধ্যে একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো ।হাতে অনেকগুলো শিউলি ফুলের মালা ।

— স্যার, মালা নেবেন ?

একদৃষ্টে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র ।
মেয়েটি একটু জোরে আবার বলল, "স্যার, ফুলের মালা নেবেন ?"
রুদ্র কিছুটা আনমনে হয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোর নাম কি রে ?"
"স্যার, পারভিন"
" থাকিস কোথায় ?"
"এই তো পার্কের পাশের বস্তিতে"
"শোন, তোর সব মালা আমি নিব । তবে একটা শর্ত আছে", রুদ্র বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো ।
"কিসের শর্ত স্যার ?", একটু হতাশ হয়ে বলল মেয়েটি ।
"তোর নাম আজ থেকে শিউলি ।কেউ তোর নাম জিজ্ঞেস করলে বলবি শিউলি !"
মেয়েটি অবাক হয়ে গেল । রুদ্রর চোখে চোখ রেখে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল ।

রুদ্র মেয়েটিকে একশটাকা দিয়ে মালাগুলো হাতে নিল । মালাগুলো একসাথে করে মেয়েটির হাতে পড়িয়ে দিল রুদ্র ।

শিউলি কিছু না বলেই এক দৌঁড় দিল । বাতাসে কিছু ফুল পড়ে গেল রাস্তায় ।

এবার বেঞ্চে বসে চিরকুটটির ভাঁজ খুলল । তাতে লিখা, "বাবা-মা, ভালো থেকো তোমরা !"

চিরকুট থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল । আনমনে হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল । হঠাৎই কি যেন মনে হতেই চিরকুটটি টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দিল ।

রুদ্র নির্বাক চেয়ে আছে ছেঁড়া টুকরোগুলোর দিকে । বাতাসে কি সুন্দর দোল খেতে খেতে টুকরোগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল !

রাত প্রায় দুইটা বাজে ।
রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হাঁটছে রুদ্র ।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পুরো রাস্তা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে । রুদ্রর হলুদ গেঞ্জিটি আরো উজ্জ্বল হয়ে গেছে এই আলোয় ।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার চোখ পড়ল পায়ে । পায়ের জুতোজোড়া দেখেই কেমন যেন চিন্তিত হয়ে গেল সে । জুতোজোড়া খুলে রাস্তায় রেখে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল ।

সকাল প্রায় আটটা ।
গাড়ির তীব্র হর্ণে রুদ্রর ঘুম ভেঙে গেল । ঘুমের রেশ কাটতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল গতকালের পার্কের সেই বেঞ্চটিতে ।

আশেপাশে সবাই ব্যায়াম করছে ।কেউ বা দলবেঁধে হাঁটছে, কেউ বা আবার ধ্যান করছে । অনেকে পরিবার নিয়েও চলে এসেছে ।

খুব সুন্দর বাতাস বইছে । রুদ্র যে বেঞ্চটিতে বসে আছে তার ঠিক সামনেই একটি শান বাঁধানো পুকুর । তাই বাতাসে অন্যরকম একটা অনুভূতি পাচ্ছে রুদ্র ।

চোখ বুজে সে কল্পনা করতে লাগল এই বাতাসে সে পুরো আকাশ জুড়ে ভাসছে । ভাসতে ভাসতে হঠাৎই একদল সাদা মেঘ হয়ে গেল সে ।

"এই যে মিঃ এখানে এভাবে বসে আছেন কেনো ?", শাসনের সুরে বলল শ্রায়ন্তিকা ।

রুদ্র চমকে উঠল । চোখ খুলে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির দিকে ।

শ্রায়ন্তিকার বয়স পাঁচ বছর । প্রতিদিন বাবা-মার সাথে এখানে বেড়াতে আছে সে । খেলতে খেলতে তার বলটি এসে পড়ে রুদ্রর বেঞ্চের কাছে ।

"কি হল, আমার কথার উত্তর দিন" শাসনের সুরে বলে উঠল শ্রায়ন্তিকা ।

চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে রুদ্র । সে অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় । এতটুকু মেয়ে কিনা তাকে শাসাচ্ছে ! এই মুহূর্তে আসলে কি করা দরকার, রুদ্র তা ঠাওর করতে পারছে না ।

এমন সময় দূর থেকে দৌঁড়ে আসলেন শ্রায়ন্তিকার বাবা-মা ।

— সরি ইয়াং ম্যান ! ও কি কিছু বলেছে আপনাকে ? আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না । ও এমনই, সারাদিন খালি বকবক করে ।

— না না, ইট'স ওকে । ও কিন্তু অনেক মিষ্টি করে কথা বলে ।

আনমনে হয়ে উত্তর দেয় রুদ্র ।

"বাবা বাবা, উনি আমার সাথে কোন কথা বলছেন না কেনো ?আমি ওনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই । বাবা বাবা.....ওনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে চল না", এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শ্রায়ন্তিকা ।

শ্রায়ন্তিকার বাবা ভালো করেই জানেন যে তার মেয়েকে এখন কোনভাবেই বোঝানো যাবে না ।

তাই বাধ্য হয়েই রুদ্রকে রিকোয়েস্ট করলেন তাদের বাসায় সকালের নাস্তাটা করতে । রুদ্রকে না বলারই সুযোগ দিলেন না ।

রুদ্র যেই না পা বাড়াল, অমনি লক্ষ্য করল তার পায়ে তো জুতো নেই । বিষয়টি শ্রায়ন্তিকার বাবারও চোখ আড়াল করতে পারল না ।

রুদ্র শ্রায়ন্তিকাদের বাসায় নাস্তা করল । শ্রায়ন্তিকা বায়না ধরেছে আজ স্কুল যাবে না । সারাদিন রুদ্রর সাথে থাকবে ।

রুদ্রর সাথে শ্রায়ন্তিকার বেশ ভাব জমে গেল । তবু রুদ্র বেশি কথা বলে না । মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্রায়ন্তিকার দিকে ।

মেয়েটা এতো মিষ্টি করে কথা বলে যে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে । ছোট্ট মাথা ভর্তি ইয়া লম্বা লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে যখন ও কথা বলে, তখন কেউই তার থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না ।

দুপুরের খাবারের পর শ্রায়ন্তিকার বাবা জোর করে রুদ্রকে মার্কেটে নিয়ে গেলেন । এক জোড়া দামী জুতো আর একটি সুন্দর টিশার্ট গিফট করলেন ।

বিকালে শ্রায়ন্তিকাদের বাসার ছাদে রুদ্র আর শ্রায়ন্তিকা খেলছে ।

— এই যে মিঃ আপনি এতো কম কথা বলেন কেনো ? হুম ?

— জানি না

— কি জানেন আপনি ?

— কিছুই না ।

মুখ গোমরা করে থাকে শ্রায়ন্তিকা । রুদ্র কবিতা আবৃত্তি করে ।

"শ্রায়ন্তিকা সোনার মন খারাপ
গাল ফুলেছে অভিমানে,
আমার সোনার মন খারাপ
কান ধরেছি দুহাতে......."

শ্রায়ন্তিকা এক গাল হেসে রুদ্রর কোলে উঠে । রুদ্র আবার চুপ হয়ে যায় । এই মিষ্টি মেয়েটি কি পেল তার মধ্যে— ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ।

শ্রায়ন্তিকার মা তাকে পড়তে যেতে বলছে । কিন্তু সে রুদ্রর কাছ থেকে যেতেই চাইছে না ।
অগত্যা বাধ্য হয়ে রুদ্র বই নিয়ে এলো শ্রায়ন্তিকাকে পড়াতে ।

রুদ্র সারাদিনে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটবারের মত চলে যেতে চেয়েছে । কিন্তু প্রতিবারই তাকে শ্রায়ন্তিকার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে ।

শ্রায়ন্তিকা ঘুমিয়ে পড়েছে ।

রুদ্রর হাতে শ্রায়ন্তিকার সবচেয়ে প্রয় পুতুলটি । আজও রাস্তার সেই হলুদ আলো গায়ে মেখে রুদ্র হাঁটছে । আর থেকে থেকেই পুতুলটির গালে আদর করে দিচ্ছে ।

কাল সকালে যখন শ্রায়ন্তিকার বাবা-মা ঘুম থেকে উঠবে তখন তারা শ্রায়ন্তিকার বিছানার পাশে দেখতে পাবে নতুন জুতোজোড়া, আর টি-শার্টটি । সাথে একটি চিরকুট । তাতে লেখা থাকবে,

"হিমুর বেশে আজ একলা এই পথে,
নেই কোন পিছুটান—
শ্রায়ন্তিকা বুড়ি রাগ করে না,
করবে না অভিমান.........."

হলুদ আলো অনুসরণ করে এগুচ্ছে রুদ্র ।

আনমনে হয়ে খালি গলায় গান ধরে________

".......মরিলে কান্দিস না আমার দায় ।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়,
মরিলে কান্দিস না আমার দায়......."

হঠাৎ করেই থেমে যায় রুদ্র । নিজেকে প্রশ্ন করে, "আচ্ছা, হিমুরা কি গান গায় ?"


________মোঃ মেহেদী হাসান গালিব
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×