পার্কের যে জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি রোদ পড়েছে, ঠিক সেখানেই বসে আছে রুদ্র । পরনে একটি ঢোলা হলুদ গেঞ্জী আর কালো প্যান্ট ।
রোদে দরদর করে ঘাম ঝরছে রুদ্রর কপাল বেয়ে । কিন্তু সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । বেঞ্চে বসে পা দুলিয়ে কি যেন ভাবছে সে ।
হঠাৎ করেই পা দোলানো বন্ধ করে দিল । মুখে বেশ গাম্ভীর্য । একটি ছোট্ট লাফ দিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে পড়ল ।
দুহাত দুপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে সবকিছু বের করে বেঞ্চে রাখল । তেমন কিছু নেই । শুধু একটি দুমড়ানো মুচড়ানো চিরকুট আর একশ টাকার একটি নোট ।
নোটটির দিকে চোখ পড়তেই বেশ বিরক্ত হয়ে গেল রুদ্র । কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল তার । এলো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বেঞ্চের চারদিকে ঘুরতে লাগল সে ।
এরই মধ্যে একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো ।হাতে অনেকগুলো শিউলি ফুলের মালা ।
— স্যার, মালা নেবেন ?
একদৃষ্টে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র ।
মেয়েটি একটু জোরে আবার বলল, "স্যার, ফুলের মালা নেবেন ?"
রুদ্র কিছুটা আনমনে হয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোর নাম কি রে ?"
"স্যার, পারভিন"
" থাকিস কোথায় ?"
"এই তো পার্কের পাশের বস্তিতে"
"শোন, তোর সব মালা আমি নিব । তবে একটা শর্ত আছে", রুদ্র বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো ।
"কিসের শর্ত স্যার ?", একটু হতাশ হয়ে বলল মেয়েটি ।
"তোর নাম আজ থেকে শিউলি ।কেউ তোর নাম জিজ্ঞেস করলে বলবি শিউলি !"
মেয়েটি অবাক হয়ে গেল । রুদ্রর চোখে চোখ রেখে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল ।
রুদ্র মেয়েটিকে একশটাকা দিয়ে মালাগুলো হাতে নিল । মালাগুলো একসাথে করে মেয়েটির হাতে পড়িয়ে দিল রুদ্র ।
শিউলি কিছু না বলেই এক দৌঁড় দিল । বাতাসে কিছু ফুল পড়ে গেল রাস্তায় ।
এবার বেঞ্চে বসে চিরকুটটির ভাঁজ খুলল । তাতে লিখা, "বাবা-মা, ভালো থেকো তোমরা !"
চিরকুট থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল । আনমনে হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল । হঠাৎই কি যেন মনে হতেই চিরকুটটি টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দিল ।
রুদ্র নির্বাক চেয়ে আছে ছেঁড়া টুকরোগুলোর দিকে । বাতাসে কি সুন্দর দোল খেতে খেতে টুকরোগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল !
রাত প্রায় দুইটা বাজে ।
রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হাঁটছে রুদ্র ।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পুরো রাস্তা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে । রুদ্রর হলুদ গেঞ্জিটি আরো উজ্জ্বল হয়ে গেছে এই আলোয় ।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার চোখ পড়ল পায়ে । পায়ের জুতোজোড়া দেখেই কেমন যেন চিন্তিত হয়ে গেল সে । জুতোজোড়া খুলে রাস্তায় রেখে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল ।
সকাল প্রায় আটটা ।
গাড়ির তীব্র হর্ণে রুদ্রর ঘুম ভেঙে গেল । ঘুমের রেশ কাটতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল গতকালের পার্কের সেই বেঞ্চটিতে ।
আশেপাশে সবাই ব্যায়াম করছে ।কেউ বা দলবেঁধে হাঁটছে, কেউ বা আবার ধ্যান করছে । অনেকে পরিবার নিয়েও চলে এসেছে ।
খুব সুন্দর বাতাস বইছে । রুদ্র যে বেঞ্চটিতে বসে আছে তার ঠিক সামনেই একটি শান বাঁধানো পুকুর । তাই বাতাসে অন্যরকম একটা অনুভূতি পাচ্ছে রুদ্র ।
চোখ বুজে সে কল্পনা করতে লাগল এই বাতাসে সে পুরো আকাশ জুড়ে ভাসছে । ভাসতে ভাসতে হঠাৎই একদল সাদা মেঘ হয়ে গেল সে ।
"এই যে মিঃ এখানে এভাবে বসে আছেন কেনো ?", শাসনের সুরে বলল শ্রায়ন্তিকা ।
রুদ্র চমকে উঠল । চোখ খুলে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির দিকে ।
শ্রায়ন্তিকার বয়স পাঁচ বছর । প্রতিদিন বাবা-মার সাথে এখানে বেড়াতে আছে সে । খেলতে খেলতে তার বলটি এসে পড়ে রুদ্রর বেঞ্চের কাছে ।
"কি হল, আমার কথার উত্তর দিন" শাসনের সুরে বলে উঠল শ্রায়ন্তিকা ।
চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে রুদ্র । সে অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় । এতটুকু মেয়ে কিনা তাকে শাসাচ্ছে ! এই মুহূর্তে আসলে কি করা দরকার, রুদ্র তা ঠাওর করতে পারছে না ।
এমন সময় দূর থেকে দৌঁড়ে আসলেন শ্রায়ন্তিকার বাবা-মা ।
— সরি ইয়াং ম্যান ! ও কি কিছু বলেছে আপনাকে ? আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না । ও এমনই, সারাদিন খালি বকবক করে ।
— না না, ইট'স ওকে । ও কিন্তু অনেক মিষ্টি করে কথা বলে ।
আনমনে হয়ে উত্তর দেয় রুদ্র ।
"বাবা বাবা, উনি আমার সাথে কোন কথা বলছেন না কেনো ?আমি ওনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই । বাবা বাবা.....ওনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে চল না", এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শ্রায়ন্তিকা ।
শ্রায়ন্তিকার বাবা ভালো করেই জানেন যে তার মেয়েকে এখন কোনভাবেই বোঝানো যাবে না ।
তাই বাধ্য হয়েই রুদ্রকে রিকোয়েস্ট করলেন তাদের বাসায় সকালের নাস্তাটা করতে । রুদ্রকে না বলারই সুযোগ দিলেন না ।
রুদ্র যেই না পা বাড়াল, অমনি লক্ষ্য করল তার পায়ে তো জুতো নেই । বিষয়টি শ্রায়ন্তিকার বাবারও চোখ আড়াল করতে পারল না ।
রুদ্র শ্রায়ন্তিকাদের বাসায় নাস্তা করল । শ্রায়ন্তিকা বায়না ধরেছে আজ স্কুল যাবে না । সারাদিন রুদ্রর সাথে থাকবে ।
রুদ্রর সাথে শ্রায়ন্তিকার বেশ ভাব জমে গেল । তবু রুদ্র বেশি কথা বলে না । মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্রায়ন্তিকার দিকে ।
মেয়েটা এতো মিষ্টি করে কথা বলে যে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে । ছোট্ট মাথা ভর্তি ইয়া লম্বা লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে যখন ও কথা বলে, তখন কেউই তার থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না ।
দুপুরের খাবারের পর শ্রায়ন্তিকার বাবা জোর করে রুদ্রকে মার্কেটে নিয়ে গেলেন । এক জোড়া দামী জুতো আর একটি সুন্দর টিশার্ট গিফট করলেন ।
বিকালে শ্রায়ন্তিকাদের বাসার ছাদে রুদ্র আর শ্রায়ন্তিকা খেলছে ।
— এই যে মিঃ আপনি এতো কম কথা বলেন কেনো ? হুম ?
— জানি না
— কি জানেন আপনি ?
— কিছুই না ।
মুখ গোমরা করে থাকে শ্রায়ন্তিকা । রুদ্র কবিতা আবৃত্তি করে ।
"শ্রায়ন্তিকা সোনার মন খারাপ
গাল ফুলেছে অভিমানে,
আমার সোনার মন খারাপ
কান ধরেছি দুহাতে......."
শ্রায়ন্তিকা এক গাল হেসে রুদ্রর কোলে উঠে । রুদ্র আবার চুপ হয়ে যায় । এই মিষ্টি মেয়েটি কি পেল তার মধ্যে— ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ।
শ্রায়ন্তিকার মা তাকে পড়তে যেতে বলছে । কিন্তু সে রুদ্রর কাছ থেকে যেতেই চাইছে না ।
অগত্যা বাধ্য হয়ে রুদ্র বই নিয়ে এলো শ্রায়ন্তিকাকে পড়াতে ।
রুদ্র সারাদিনে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটবারের মত চলে যেতে চেয়েছে । কিন্তু প্রতিবারই তাকে শ্রায়ন্তিকার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে ।
শ্রায়ন্তিকা ঘুমিয়ে পড়েছে ।
রুদ্রর হাতে শ্রায়ন্তিকার সবচেয়ে প্রয় পুতুলটি । আজও রাস্তার সেই হলুদ আলো গায়ে মেখে রুদ্র হাঁটছে । আর থেকে থেকেই পুতুলটির গালে আদর করে দিচ্ছে ।
কাল সকালে যখন শ্রায়ন্তিকার বাবা-মা ঘুম থেকে উঠবে তখন তারা শ্রায়ন্তিকার বিছানার পাশে দেখতে পাবে নতুন জুতোজোড়া, আর টি-শার্টটি । সাথে একটি চিরকুট । তাতে লেখা থাকবে,
"হিমুর বেশে আজ একলা এই পথে,
নেই কোন পিছুটান—
শ্রায়ন্তিকা বুড়ি রাগ করে না,
করবে না অভিমান.........."
হলুদ আলো অনুসরণ করে এগুচ্ছে রুদ্র ।
আনমনে হয়ে খালি গলায় গান ধরে________
".......মরিলে কান্দিস না আমার দায় ।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়,
মরিলে কান্দিস না আমার দায়......."
হঠাৎ করেই থেমে যায় রুদ্র । নিজেকে প্রশ্ন করে, "আচ্ছা, হিমুরা কি গান গায় ?"
________মোঃ মেহেদী হাসান গালিব