somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেয়াল

২০ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝমঝমিয়ে বৃস্টি হচ্ছে। স্যাতস্যাতে দেয়াল ভিজে আরো কদর্যরুপ ধারন করেছে। এই দেয়ালটি দুটি বাড়িকে আলাদা করে রেখেছে। সিনেমায় যেমন দুটি পরিবারের কলহের কারনে দেয়াল দেয়া হোতো এখানে অবশ্য এমন কোনো কারন নেই। প্রাচীর ঘেরা নিমিত্তেই দেয়াল। নিরিবিলি এক মহল্লার এক গলিতে দেয়ালটির অবস্থান। এই মহল্লার সবচেয়ে বড় বাড়ি আসমানি ভিলা। সেই ভিলার সীমানার প্রাচীরের দেয়াল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই এই দেয়ালের শুরু। জীর্নশীর্ন বাড়ির, জীর্নশীর্ন দেয়াল। ঝকমকে কোনো বস্তুর পাশে সাধারন যে কোন কিছুকেই ব্ড্ড মলিন ই দেখায়। যেমনটা বলা যেতে পারে সাদা একটা ক্যানভাসের পাশে যদি লাল একটা ক্যানভাস রাখা যায় তবে কেন জানি ওই লাল ক্যানভাস ই সব মনোযোগ কেড়ে নেয়। সাদা রঙ কে তাই মাঝে মাঝে মহান বলে মনে হয়, যেন নিজে কোন বাগানের জমি, নিজের আঙ্গিনায় ফুটিয়ে তোলা সবাই কে, নেই কোনো অহংকার। এ কারনেই মনে হয় সাদা কে শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। আমার ও ইচ্ছে ছিল আমাকে যেন সাদা রঙ ই করা হয়। মন থেকে চাইলে কি না মেলে! আমাকে সাদা রঙ ই করা হয়েছিল। রাজমিস্ত্রি বড্ড ভালো ছিল। আমার ভীত গড়ে তুলেছিল বেশ শক্ত করে। ইটের পর ইট সাজিয়ে, দুই ইটের মাঝে মশলা মিশিয়ে পোক্ত করে তুলেছিল। সারাদিন ই গান গাইত সে। তার সেই গড়ে দেয়া শক্ত ভীতের উপর ই দাঁড়িয়ে আছি এখন ও।

সাদা রঙ দিয়ে পরিপাটি করে যেদিন আমায় তৈরী করা সম্পূর্ন হয়ে গেল সেদিন আমার খুশি দেখে কে! আমি তখন পরিপূর্ন একটি মজবুত দেয়াল। এই দেয়াল ই কখনও নিরাপত্তার প্রতীক আবার কখনো বা দূরত্তের প্রতীক, আমার ক্ষেত্রে কোনটা প্রযোয্য তা অবশ্য আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। সে না হয় পরে দেখা যাবে। কিছুদিন পরেই সীমানার মালিক আমার থেকে খানিক দূরে একটা আম গাছের চারা এনে লাগিয়ে দিলেন। প্রায় আমার গা ঘেষেই। এই আম গাছই সময়ের ফেরে আমার সংগী হয়ে যায়। আমরা একজন আরেকজনের নাম দেই। আমি দেয়াল, তাই আমার নাম দেলু, আর ও আমগাছ তাই ওর নাম আমু। আমাদের দুজনের দিন কেটে যায় ভালোই। আমু দিনে দিনে বড় হয় আর আমি দিনে দিনে পুরোনো হই। উচ্চতায় আমু একসময় আমাকে ছাড়িয়ে যায় ,তাতে কি? আমাদের বন্ধনের কমতি হয় না তাতে। বরং বাড়ে। শেষ দুপুরে বা বিকেলবেলায় স্কুল কলেজের পালানো ছেলের দল আমুর আড়ালে গিয়ে আমার গায়ে ঠেস দিয়ে সিগারেট খায় লুকিয়ে লুকিয়ে, কৈশরের এই অবাধ্যতা আমাদের ভালো লাগে । ফুসফুসে ক্ষত বানিয়ে মনের সুখ মেটায় আর চলে যাবার সময় আমুর গায়ে আগুন নেভায়,আমার গায়ে ছাইটূকু ঘষে দিয়ে যায়।

আমুর বাকল কালো খসখসে, ওর চিৎকারবিহীন আর্তনাদের কোনো চিহ্ন থাকে না, কিন্তু আমি তো সাদা দেয়াল, আমার গায়ে ওই পোড়ানো ছাইয়ের কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। কালিমা লেপে যায় আমার গায়ে। দাগ বাড়তে থাকে, প্রতিদিন ই। যেন একটা কালিমা আরো শত শত কালিমা কে আহবান জানায়। দিন কেটে যায়, আড্ডা বাড়ে, বাড়ে দাগের পরিমান, তবুও দেয়াল পেতে রই, আমু ছায়া বিলায়, আমাদের গায়ে ঠেশ দিয়ে কেউ গান গায়, কেউ দূর্নাম করে, কেউ প্রতিশ্রুতি দেয়।

বছরের মধ্যেই আমি এলাকার সবচেয়ে নোংরা দেয়ালে পরিনত হই। তাচ্ছিল্য পাওয়া শুরু করি। আমু তাও আমাকে তাচ্ছিল্য করে না, খোটা দেয় না। বলে “ রুপে কি পরিচয়” , আমি পালটা উত্তর করি, “ আগে দর্শনদারী পরে গুনবিচারি। দু’জনেই হেসে উঠি।

একদিন এক ভোর বেলায়, কোনো এক পরিবারের কেউ হয়ত, আমার সামনে ময়লার এক ঝুড়ি রেখে চলে যায়। কালিমার পালক এবার মুকুট পেল। দূপুর না গড়াতেই তার দেখাদেখি আরো এক ঝুড়ি, বিকেলে আর এক, রাতে আরো আরো আরো। দেখতে দেখতে ময়লার স্তুপ হয়ে ওঠে আমাকে ঘিরে, এই স্তুপের ভার আমি আর নিতে পারিনা। এলাকার কুকুর গুলো যখন আমার আর আমুর নিত্য সংগী তে পরিনত হয় তখন আমু আর সইতে পারে না। কস্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় পাতা ঝড়িয়ে। কেউ দেখেনা। যারা শরীরে আগুন পোড়াতো তারা এখন আর ফিরেও তাকায় না। আমি আর সাদা দেয়াল নেই, আমি এক কদর্য দেয়াল এখন।
বর্ষা এলে মাটি খোড়াখুড়ির কাজ শুরু হোলো, আমুর সামনে দিয়ে লোকেরা মাটি খুড়ে গেল, সাথে আরো কি কি যেন করছে। আমুর শেকড়ে আঘাত লাগে। এতদিনে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিতে থাকা মাটির বুকে শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখা সেই শিকড় দূর্ব্ল হতে থাকে দিনে দিনে।
এক বিষন্ন বিকেলে আমু আমায় বলে, আমার ভার নিতে পারবে?
আমি বলি, কেন পারব না?
আমু হাসে, আর বলে , যা সহজে বলা যায়, বাস্তবে তাই এ সবচাইতে কঠিন হয়ে পড়ে। ভার তোলা আর ভার বহন করা কিন্তু এক নয়।
আমি বুঝতে পারি না, বোকার মত জিজ্ঞেস করি পাল্টা,
-আমি বুঝতে পারি নি, বুঝিয়ে বল
আমু আমায় বোঝায়, ভার তোলা মানেই, সামর্থ্যর উপর নির্ভরশীলতা। সামর্থ্য যখন ফুড়িয়ে যাবে, সেই ভার কেও নামিয়ে ফেলা হবে কিন্তু ভার বয়ে চলা কিন্ত সামর্থ্যর উপর নির্ভরশীল নয়। এই বয়ে চলার কোন সময়কাল নেই, হতে পারে সেই সময় অসীম, হয়ত আজীবন ও।
আমি উত্তর দেই, বইব আমি সে ভার। তুমি ভেবো না।
বর্ষার শেষের দিকে খুব ঝড় শুরু হোলো, সেই সাথে বাতাস। আমু শুধু আমায় বলল, তৈরী তো তুমি? আমি আসছি।
ঝড়ে কারেন্টের তার ছিলে গেলে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে পড়ল, কয়েকবাড়ির চাল ও উড়ে গেল আর আমু শেকড় উপড়ে আমার গায়ে হেলে পড়ল।
প্রস্তুত আমি ছিলাম, কিন্তু পর্যাপ্ত সামর্থ্য ছিল না, হেলে পড়ার মূহুর্তে আমি খানিক ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, কয়েকখানি ইট ভেঙ্গে পড়ল। আমি বুঝলাম, সংঘবদ্ধ ভাবে সারি সারি ইট যেমন এক ভারসাম্য ধরে রেখেছিল, সেই ভারসাম্য আমার আর নেই।
দুটি ভারসাম্যহীম বস্তু একে অপরের উপর ভারসাম্য রেখে টিকে রইলাম
পরদিন সকালে, আমাদের একে অপরের এমন সান্নিধ্য লোকালয়ে গ্রহনযোগ্যতা পেল না। আশঙ্কা, কখন কে ভেঙ্গে পড়ে, কখন কি দূর্ঘটনা ঘটে। না, এভাবে রাখা যাবে না। আমি আর আমু খানিক একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বেশ চেনাজানা মানুষ ই। এদের ই কেউ গায়ে হেলান দিত, শিষ বাজাতো। এদের ই কেউ আমুর আড়ালে সিগারেট খেত, পোড়াতো, গায়ে কালি মেখে যেত।
সেদিন রাতে আমি আমুকে বললাম, তোমাকে নিয়ে বোধহয় আর পথ পাড়ি দেয়া হবে না।
আমু প্রতিউত্তরে বলল, আয়ু শেষ মানে শুধু দেহের ই শেষ, কিছু ক্ষন আছে যা এই সীমিত সময় কেও অসীম করে দেয়। পরিনতি কবে, কখন তা জানিনা, তবে কিছু মুহুর্তের প্রাপ্তি আমার জীবনকাল কে পূর্নতা দিয়েছে। আমার অপ্রাপ্তি নেই।

আমি সময় গুনি, শেষ পরিনতির সময়।

বেশ কিছুদিন পরঃ
এলাকাটি বেশ বদলে গেছে। টিনের চালের বাড়ি গুলো এখন কিছু আধাপাকা, কিছু পুরোটাই পাকা, রাস্তাও পিচঢালা। এখানেই একটা আম গাছ আর দেয়াল যে জায়গাটায় ছিল, সেখানে একটি বড় সাইনবোর্ড আর একটা স্টীলের বড় ঝুড়ির মত।

সাইনবোর্ডে লেখা,

“এখানে ময়লা/আবর্জনা ফেলুন”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১:৩০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×