সাদা রঙ দিয়ে পরিপাটি করে যেদিন আমায় তৈরী করা সম্পূর্ন হয়ে গেল সেদিন আমার খুশি দেখে কে! আমি তখন পরিপূর্ন একটি মজবুত দেয়াল। এই দেয়াল ই কখনও নিরাপত্তার প্রতীক আবার কখনো বা দূরত্তের প্রতীক, আমার ক্ষেত্রে কোনটা প্রযোয্য তা অবশ্য আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। সে না হয় পরে দেখা যাবে। কিছুদিন পরেই সীমানার মালিক আমার থেকে খানিক দূরে একটা আম গাছের চারা এনে লাগিয়ে দিলেন। প্রায় আমার গা ঘেষেই। এই আম গাছই সময়ের ফেরে আমার সংগী হয়ে যায়। আমরা একজন আরেকজনের নাম দেই। আমি দেয়াল, তাই আমার নাম দেলু, আর ও আমগাছ তাই ওর নাম আমু। আমাদের দুজনের দিন কেটে যায় ভালোই। আমু দিনে দিনে বড় হয় আর আমি দিনে দিনে পুরোনো হই। উচ্চতায় আমু একসময় আমাকে ছাড়িয়ে যায় ,তাতে কি? আমাদের বন্ধনের কমতি হয় না তাতে। বরং বাড়ে। শেষ দুপুরে বা বিকেলবেলায় স্কুল কলেজের পালানো ছেলের দল আমুর আড়ালে গিয়ে আমার গায়ে ঠেস দিয়ে সিগারেট খায় লুকিয়ে লুকিয়ে, কৈশরের এই অবাধ্যতা আমাদের ভালো লাগে । ফুসফুসে ক্ষত বানিয়ে মনের সুখ মেটায় আর চলে যাবার সময় আমুর গায়ে আগুন নেভায়,আমার গায়ে ছাইটূকু ঘষে দিয়ে যায়।
আমুর বাকল কালো খসখসে, ওর চিৎকারবিহীন আর্তনাদের কোনো চিহ্ন থাকে না, কিন্তু আমি তো সাদা দেয়াল, আমার গায়ে ওই পোড়ানো ছাইয়ের কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। কালিমা লেপে যায় আমার গায়ে। দাগ বাড়তে থাকে, প্রতিদিন ই। যেন একটা কালিমা আরো শত শত কালিমা কে আহবান জানায়। দিন কেটে যায়, আড্ডা বাড়ে, বাড়ে দাগের পরিমান, তবুও দেয়াল পেতে রই, আমু ছায়া বিলায়, আমাদের গায়ে ঠেশ দিয়ে কেউ গান গায়, কেউ দূর্নাম করে, কেউ প্রতিশ্রুতি দেয়।
বছরের মধ্যেই আমি এলাকার সবচেয়ে নোংরা দেয়ালে পরিনত হই। তাচ্ছিল্য পাওয়া শুরু করি। আমু তাও আমাকে তাচ্ছিল্য করে না, খোটা দেয় না। বলে “ রুপে কি পরিচয়” , আমি পালটা উত্তর করি, “ আগে দর্শনদারী পরে গুনবিচারি। দু’জনেই হেসে উঠি।
একদিন এক ভোর বেলায়, কোনো এক পরিবারের কেউ হয়ত, আমার সামনে ময়লার এক ঝুড়ি রেখে চলে যায়। কালিমার পালক এবার মুকুট পেল। দূপুর না গড়াতেই তার দেখাদেখি আরো এক ঝুড়ি, বিকেলে আর এক, রাতে আরো আরো আরো। দেখতে দেখতে ময়লার স্তুপ হয়ে ওঠে আমাকে ঘিরে, এই স্তুপের ভার আমি আর নিতে পারিনা। এলাকার কুকুর গুলো যখন আমার আর আমুর নিত্য সংগী তে পরিনত হয় তখন আমু আর সইতে পারে না। কস্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় পাতা ঝড়িয়ে। কেউ দেখেনা। যারা শরীরে আগুন পোড়াতো তারা এখন আর ফিরেও তাকায় না। আমি আর সাদা দেয়াল নেই, আমি এক কদর্য দেয়াল এখন।
বর্ষা এলে মাটি খোড়াখুড়ির কাজ শুরু হোলো, আমুর সামনে দিয়ে লোকেরা মাটি খুড়ে গেল, সাথে আরো কি কি যেন করছে। আমুর শেকড়ে আঘাত লাগে। এতদিনে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিতে থাকা মাটির বুকে শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখা সেই শিকড় দূর্ব্ল হতে থাকে দিনে দিনে।
এক বিষন্ন বিকেলে আমু আমায় বলে, আমার ভার নিতে পারবে?
আমি বলি, কেন পারব না?
আমু হাসে, আর বলে , যা সহজে বলা যায়, বাস্তবে তাই এ সবচাইতে কঠিন হয়ে পড়ে। ভার তোলা আর ভার বহন করা কিন্তু এক নয়।
আমি বুঝতে পারি না, বোকার মত জিজ্ঞেস করি পাল্টা,
-আমি বুঝতে পারি নি, বুঝিয়ে বল
আমু আমায় বোঝায়, ভার তোলা মানেই, সামর্থ্যর উপর নির্ভরশীলতা। সামর্থ্য যখন ফুড়িয়ে যাবে, সেই ভার কেও নামিয়ে ফেলা হবে কিন্তু ভার বয়ে চলা কিন্ত সামর্থ্যর উপর নির্ভরশীল নয়। এই বয়ে চলার কোন সময়কাল নেই, হতে পারে সেই সময় অসীম, হয়ত আজীবন ও।
আমি উত্তর দেই, বইব আমি সে ভার। তুমি ভেবো না।
বর্ষার শেষের দিকে খুব ঝড় শুরু হোলো, সেই সাথে বাতাস। আমু শুধু আমায় বলল, তৈরী তো তুমি? আমি আসছি।
ঝড়ে কারেন্টের তার ছিলে গেলে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে পড়ল, কয়েকবাড়ির চাল ও উড়ে গেল আর আমু শেকড় উপড়ে আমার গায়ে হেলে পড়ল।
প্রস্তুত আমি ছিলাম, কিন্তু পর্যাপ্ত সামর্থ্য ছিল না, হেলে পড়ার মূহুর্তে আমি খানিক ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, কয়েকখানি ইট ভেঙ্গে পড়ল। আমি বুঝলাম, সংঘবদ্ধ ভাবে সারি সারি ইট যেমন এক ভারসাম্য ধরে রেখেছিল, সেই ভারসাম্য আমার আর নেই।
দুটি ভারসাম্যহীম বস্তু একে অপরের উপর ভারসাম্য রেখে টিকে রইলাম
পরদিন সকালে, আমাদের একে অপরের এমন সান্নিধ্য লোকালয়ে গ্রহনযোগ্যতা পেল না। আশঙ্কা, কখন কে ভেঙ্গে পড়ে, কখন কি দূর্ঘটনা ঘটে। না, এভাবে রাখা যাবে না। আমি আর আমু খানিক একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বেশ চেনাজানা মানুষ ই। এদের ই কেউ গায়ে হেলান দিত, শিষ বাজাতো। এদের ই কেউ আমুর আড়ালে সিগারেট খেত, পোড়াতো, গায়ে কালি মেখে যেত।
সেদিন রাতে আমি আমুকে বললাম, তোমাকে নিয়ে বোধহয় আর পথ পাড়ি দেয়া হবে না।
আমু প্রতিউত্তরে বলল, আয়ু শেষ মানে শুধু দেহের ই শেষ, কিছু ক্ষন আছে যা এই সীমিত সময় কেও অসীম করে দেয়। পরিনতি কবে, কখন তা জানিনা, তবে কিছু মুহুর্তের প্রাপ্তি আমার জীবনকাল কে পূর্নতা দিয়েছে। আমার অপ্রাপ্তি নেই।
আমি সময় গুনি, শেষ পরিনতির সময়।
বেশ কিছুদিন পরঃ
এলাকাটি বেশ বদলে গেছে। টিনের চালের বাড়ি গুলো এখন কিছু আধাপাকা, কিছু পুরোটাই পাকা, রাস্তাও পিচঢালা। এখানেই একটা আম গাছ আর দেয়াল যে জায়গাটায় ছিল, সেখানে একটি বড় সাইনবোর্ড আর একটা স্টীলের বড় ঝুড়ির মত।
সাইনবোর্ডে লেখা,
“এখানে ময়লা/আবর্জনা ফেলুন”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১:৩০