চোখ ধাঁধানো প্রচ্ছদ আর দারুণ সব লেখার সমন্বয়। এক মলাটে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকজন উদীয়মান লেখকের ভাবনা। নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া, অনুগল্প, রম্যগল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ; কি নেই এতে? একটি ফুলের তোড়ায় যেমন স্থান করে নেয় নানান ফুল, তেমনি এই সংকলনটি নানান ভাবনার সমাবেশে সমৃদ্ধ। বলছিলাম "লেখাজোকা সংকলন" বইয়ের কথা। কেমন হলো বইটি? একজন পাঠক হিসেবে তারই মতামত তোলে ধরবো এই লেখায়।
=== নিবন্ধ ===
১. সার্টিফিকেট নয়, প্রয়োজন মেধা ও প্রতিভার মূল্যায়ন- কাওসার চৌধুরী।
"আমরা গরু দেখে দেখে বড় হয়েছি। তারপরও গাইড বই পড়ে গরুর রচনা মুখস্থ করি। একজন ছাত্রকে যদি বলা হত তুমি যেভাবে গরু দেখেছ সেভাবে গরুর বর্ণনা কর। তাহলে তার মধ্যে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটত। গরু নিয়ে ভাবত। অন্যের লেখা গরুর বর্ণনা কষ্ট করে মুখস্থ করতে হত না। আর এটাই ছাত্রদের থিংকার বানায়, গবেষক হওয়ার পথ প্রসারিত করে। এজন্য নোট বইয়ের বিরুদ্ধে আমার কঠোর অবস্থান। অন্যের লেখা পড়ে ভাবটা নিজের মধ্যে ধারণ করা যায় না। এজন্য গাইড বই মুখস্থ করতে হয়। মুখস্থ করা শিক্ষা হচ্ছে তলা বিহীন ঝুড়ি।"
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এভাবেই তোলে ধরেছেন চিন্তাশীল লেখক কাওসার চৌধুরী। প্রবন্ধের মূল কথা হলো, শুধু ভালো রেজাল্টই মেধা যাচাইয়ের একমাত্র পদ্ধতি হতে পারে না। সেই তো প্রকৃত মেধাবী যে নতুন কিছু চিন্তা করতে পারে।
"সার্টিফিকেট তো আমাদের আছে.........
তাহলে আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি; মেধায়? প্রতিভায়? জ্ঞানে?
নাকি, তিনটিতেই!"
এমন প্রশ্ন আমার, আমাদের সকলের।
যে সব ভুল সহজেই ধরা পড়ে চোখে:
(১) বেশ কিছু ভুল বানান: সুচক (সূচক), কিন্ডার গার্ডেন (কিন্ডার গার্টেন), হৃদয়াঙ্গম (হৃদয়ঙ্গম), খেলাধুলা (খেলাধূলা), মুখস্ত (মুখস্থ), সেক্সপিয়ার (শেক্সপিয়ার), মার্জ জুকারবার্গ (মার্ক জুকারবার্গ), খরছ (খরচ), মাওলানা ভাসানি (মাওলানা ভাসানী)।
(২) কিছু বাক্য গঠনে আরো যত্নবান হওয়া যেত। যেমন: "একটি ছাত্র যদি স্কুলে পড়ার পরও...." (একজন ছাত্র যদি স্কুলে পড়ার পরও.......),
"ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি শিশুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় না, তার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো স্কুলে থাকে। তার পড়াশুনার পাঠ স্কুলেই শুরু, স্কুলেই শেষ।" (ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি শিশুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় না, তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ স্কুলেই থাকে। তাদের পড়াশুনার পাঠ স্কুলেই শুরু, স্কুলেই শেষ।)
সব মিলিয়ে ভালো ছিলো নিবন্ধটি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সময়ের দাবী।
২. ফিবোনাচ্চি সিরিজ এবং সোনালী অনুপাত- শাহানা ইয়াসমিন
ফিবোনাচ্চি সিরিজ এবং সোনালী অনুপাত নিয়ে চমৎকার একটি লেখা। লেখাটি পড়ে জানতে পারলাম "মোনালিসা" চিত্রকর্মটি সোনালী অনুপাত মেনে বানানো হয়েছে। সূর্যমূখী বীজের বিন্যাস এবং আনারসের চোখগুলোও নাকি ফিবোনাচ্চি সিরিজ মেনে চলে। কি মজার বিষয় তাই না? এমনই সব অজানা আর মজার বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে এই লেখায়।
চমৎকার লেখাটিতে কিছু অংশ বুঝতে পারলাম না। যেমন: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪, ২৩৩, ৩৩৭........
এটি একটি ফিচোনাচ্চি সিরিজ। বলা হয়েছে, এই সিরিজের যে কোন সংখ্যার বর্গ তার দুই ধাপ আগের সংখ্যার বর্গের বিয়োগ ফল একটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যা। কথা বুঝলাম। কিন্তু উদাহরণ দেয়া হয়েছে এইভাবে:
৮২- ৩২= ৬৪- ৯= ৫৫
১৩২- ৫২= ১৬৯- ২৫= ১৪৪ (কিছুই বুঝলাম না!)
আবার বলা হয়েছে, ফিবোনাচ্চি সিরিজের বর্গ করলে এই সিরিজ পাওয়া যায়: ১২, ১২, ২২, ৩২, ৫২, ৮২, ১৩২, ২১২..... ( কেউ কি বলবেন কোন সংখ্যাকে বর্গ করলে এই সিরিজ মিলবে?)
আবার বলা হয়েছে, এই সিরিজের সংখ্যাগুলো যদি এভাবে যোগ করি তাহলে
১২+১২+২২=৬= ৩×২
১২+১২+২২+৩২= ১৫= ৩ ×৫ ( কেমনে হলো, কিছুই বুঝলাম না!!!)
৩. সপ্রতিভ বক্তব্য, লেকচার, উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশনের ছলাকলা বা কলাকৌশল- শায়মা হক।
" পৃথিবী বদলে দেয়া সিদ্ধান্তগুলোর ঘোষণা হয়েছে কোন না কোনো বক্তৃতার মাধ্যমে। কয়েক মিনিটের বক্তৃতা বদলে দিয়েছে কোন দেশের মানচিত্র; কোন জাতির ভাগ্যাকাশ। সেসব বক্তৃতাতে এক ধরনের যাদুশক্তি ছিলো। কয়েক মিনিটে আবৃত্তি করা সেসব পঙক্তিমালার শক্তি – লক্ষ, বুলেট বোমাকে হার মানিয়েছে। যুগেযুগে আদর্শ প্রচারের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম বক্তৃতা।"
-- বলছিলাম শক্তিমান লেখিকা শায়মা হকের লেখা থেকে। বক্তৃতা দিতে গিয়ে যাদের হাঁটু ধরে রাখার জন্য আলাদা লোকের প্রয়োজন তাদের জন্য লেখাটি টনিক হিসেবে কাজ করবে আশা করি।
যে ভুল ধরা পড়ে সহজেই:
(১) বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিলো। যেমন:
"এই বক্তৃতা বা লেকচার দেওয়াটা যে কতটা কঠিন বা ভয়ংকর হতে পারে, তা মনে হয় যাদের প্রেজেন্টেশন বা স্পিচ ভীতি আছে তারা খুব ভালো করেই জানেন।"
"কিন্তু এই বক্তৃতা বা স্পিচ বা প্রেজেনটেশনে আবার ভয় কিসের!"
" স্পিচ বা বক্তৃতা বা লেকচার বা প্রেজেন্টেশন নিয়ে এববার আর এক সেমিনারে অংশগ্রহনের সুযোগ হয়েছিল"
বাক্য তিনটিতে এতবার "বা" বলেছেন যে, তা ভালো লাগছে না। এরকম আরো কিছু বাক্য রয়েছে।
(২) বানানের দিকে নজর দেয়া উচিত ছিলো: মুল্যায়িত (মূল্যায়িত), অব্যার্থ (অব্যর্থ), পরিছন্ন (পরিচ্ছন্ন)।
=== গল্প===
১. অবয়ব- স.আ. নেওয়াজ
গল্পটি ভালো ভাবে বুঝতে পারিনি। লেখার শুরুটা বেশ আকর্ষণীয় ছিলো, কিন্তু শেষে গিয়ে বুঝলাম না কিছুই। গল্পটি এরকম ছিলো:
ককপিট থেকে বারবার কেউ এ্যানাউন্সমেন্ট করছেন-- দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সবাই যাতে সিট-বেল্ট বেঁধে রাখেন এবং সিট থেকে না উঠেন। আমি আইল সিটে আছি, আর আমার পাশে উইন্ডো সিটে যে ভদ্রলোক ব'সে আছেন, তাকে দেখে মনে হচ্ছে- এ্যালারটিং এ্যানাউন্সমেন্টের চেয়ে বরং সে যে উঠে ওয়াশরুমে যেতে পারছেন না, তা নিয়েই বেশী উদ্বিগ্ন!- কেননা গত একঘণ্টায় কমহলেও সে চারবার ওয়াশরুমে গিয়েছেন। এবার আমাকে পঞ্চমবারের মতো উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে না, এটা ভেবেই ভালো লাগছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সে ভালো লাগা উবে গেল; যখন দেখলাম প্লেনটি প্রচণ্ড-রকমের ঝাঁকাচ্ছে। মনে মনে ভয় পেলেও বাহির থেকে দেখে তা বুঝার উপায় ছিল না। কেননা আমি তখন মুভি দেখায় মগ্ন ছিলাম।
তাও বেশীক্ষণ ধ'রে চললো না। মুভি বন্ধ ক'রে দিয়ে লোকেশন ডিসপ্লে ম্যাপ-এ দেখলাম, প্লেনটি তখন ছত্রিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা-সী অতিক্রম করছিল। আবহাওয়ার অবস্থা এতো-বেশী খারাপের দিকে যাচ্ছিল যে, ককপিট থেকে ইমারজেন্সি ওয়াটার ল্যান্ডিং-এর জন্য প্যাসেঞ্জারদের কী কী প্রিকওশন নিতে হবে তা বারবার জানিয়ে দেয়া হচ্ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে আমি যেমনটি করি তাই করছিলাম। জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্তগুলোর কথা ভাবছিলাম। মনে পড়ছিল, ছেলেবেলায় স্কুল-ছুটির পর গেইটের বাহিরে মা'র ক্লান্ত অথচ মৃদু-হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। জামাল ভাইয়ের দোকানের ছোলাবুট, ঝালমুড়ি ঝাঁকানোর শব্দ, আরও কতো কি...।
ওই মুহূর্তে প্লেনটি আসলে ঝালমুড়ির পটের মতো ক'রেই আমাদের ঝাঁকাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, ট্রাভেল-ব্যাগ থেকে ডাইরি বের ক'রে কথাগুলো লিখে ফেললে ক্যামন হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে কী হতে যাচ্ছে কে জানে...। অন্তত ডাইরিটা যদি কোনভাবে কারো হাতে প'ড়ে যায়; আমার শেষকথাগুলো তো বেঁচে যায়; যেমন ক’রে বেঁচে যায় বিধ্বস্ত প্লেনের ব্ল্যাক-বক্স! ...
.
.
.
মনে হচ্ছে যেন, একটা চিলের একটানা ডাকের শব্দে চোখ খুললো। তীব্র আলোতে চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। বোধকরি অত্যধিক স্নায়ু-চাপে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।
এবার এ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে--আমরা ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করেছি। ককপিট থেকে টেম্পারেচার লোকাল টাইম ইত্যাদি জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ট্রাভেল ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি সবার পেছন-পেছন হেঁটে প্লেন থেকে বের হয়ে ইমিগ্রেশন শেষ ক'রে তিন নাম্বার বেল্টের সামনে গিয়ে লাগেজের জন্য দাঁড়ালাম। যেখান থেকে এক নাম্বার টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষমাণ মানুষগুলোকে সহজেই দেখা যায়।
গ্লাসের বাহিরে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম!-- ওখানে মা, বাবা, বোনেরা, ভাগ্নে-ভাগ্নি সবাই দাঁড়িয়ে। আমি সত্যি বুঝতে পারিনি যে, আমার জন্য এত-বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল সেদিন।
একবার ইচ্ছে করছিল লাগেজ-টাগেজ ফেলেই দৌড়ে গিয়ে সবার সাথে আগে দেখা ক'রে আসি। কিন্তু লাগেজ ফেলে কী ক'রে যাই? ওটার ভিতরে যে অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে ফিরেছি সবার জন্য।
দূর থেকে মা-কে দেখছি, ঠিক যেন স্কুলের গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবা-কে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর লম্বা সাদা-দাড়িতে বেশ লাগছে; একেবারে যেন সাক্ষাৎ পীর-আউলিয়ার মতোই দেখাচ্ছে। আচ্ছা, বাবার হাতে লাঠি কেন? কবে নিলেন? বাবা ঠিক আছেন তো!?
একটা কালো চোখের কথা মনে পড়ল। মনের অজান্তেই হয়তো খুঁজে যাচ্ছিলাম। যেমন খুঁজেছি--কখনো চৈত্রের দুপুরে, কখনো শ্রাবণের সন্ধ্যায়, আবার কখনো পৌষের সকালে... যার আজো কোনও অবয়ব মেলেনি।
যাক, লাগেজ হাতে পেলাম। লাগেজ পেয়ে আমি পারলে দৌড়ে বাহিরে চ’লে যাই। কিন্তু আরেকটা কাজ, মানে, কাস্টমসের স্ক্যানিং তো বাকি। আমি স্ক্যানারের দিকে এগিয়ে কাস্টমস অফিসারের কাছাকাছি যেতেই--সে অন্যদিকে চ'লে গেলো। মনে হলো যেন, সে আমাকে দেখলই না। আমিও সুযোগ পেয়ে গ্রীন-চ্যানেল দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলাম।
ভিজিটর রেলিং-এর কাছে দৌড়ে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম আমি; একি! মা ফ্লাইট ইনফরমেশন মনিটরের দিকে তাকিয়ে কেনো? আমি বললাম, ‘আমি তো এসে গেছি মা!’ বাবা, সেও ওইদিকেই তাকিয়ে।
এখানে উপস্থিত সবাই উদ্ভ্রান্ত; পাগলের মতো শুধুই ফ্লাইট ইনফরমেশন মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে, কেউ মোবাইলে কথা বলছে... কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না, আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার ক'রে উঠলাম-- বললাম, ‘কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছ না কেন!? শুনতে পাচ্ছ না কেন!?’
তবুও না, কেউ শুনলো না আমার কথা।
এবার আমিও ফ্লাইট ইনফরমেশন মনিটরের দিকে তাকালাম-- দেখলাম, আমার প্লেনটি আসলে তখনও লেন্ডেড হয়নি।
স্ট্যাটাস: ডিলেড।
.
.
.
ইন্দোনেশিয়ার মুনা দ্বীপের একজন দ্বীপবাসীনি--তখন সাগর পাড়ে বিচ্ছিন্ন একটি বড় পাথরের উপর একটা ডাইরি হাতে নিঃসঙ্গ ব'সে আছে। ডাইরির পাতাগুলো একবার সে প্রথম থেকে শেষ, আবার শেষ থেকে প্রথম এমন করেই উল্টিয়ে যাচ্ছে। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে আবার বন্ধ ক'রে দিচ্ছে। তার চেহারা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, সে ভিতরের লেখাগুলো কিছুই বুঝতে পারছে না।
আমি মেয়েটির পাশেই ব’সে আছি। কিন্তু এখন আমি জানি, সেও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি তাকে চিনি না। তবে তার কালো-গভীর চোখ দেখে আমার সেই খুঁজতে থাকা চোখটির কথাই মনে পড়ল। আমি হাসলাম। নিজেকে বললাম, আমি কি তবে শেষমেশ অবয়ব খুঁজে পেলাম!?
--গল্পটির প্রথম অংশের সাথে শেষাংশের কোন সংযোগ খুঁজে পেলাম না।
২. সোনালী বালির প্রাচীর- আখেনাটেন
"কলার খোসাটা এভাবে রাস্তার উপর ফেললেন কেন?’’ লোকটা উঁচু স্বরে কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল। সাথে সাথে আমার মেজাজ গেল হট হয়ে। কাছে গিয়ে ঠাস করে দেড় টনি চড় হাঁকালাম। ঘটনার আকস্মিকতায় লোকটা মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছে। আমি কুৎসিত কিছু গালি দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। এই সাধু বাবাদের জন্য সমাজে যে নিজের খুশি-রুচিতে চলব সেটাও হওয়ার জো নেই। এই ভদ্রলোকদের পাছার কাপড় খুলে প্যাঁদানো দরকার। এত ভদ্রগিরি কোথা থেকে আসে এদের!..........."
"শিলার ছোটভাই মবিন দেখি হাসপাতালের গেটেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদাকাটি শুরু করে দিল। আমার চোখও দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বুকটা খালি খালি লাগছে। ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে আমি শিলাকে বিয়ে না করলেই হয়ত ওর এরকম অবস্থা হত না!
মবিনকে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে এটা ঘটল? মবিন বেশ রাগত স্বরে চিৎকার করে বলল, ‘শিলাপা, শফিক সাহেবের ফার্মেসিতে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য নেমেছিল আপনার ছোটবোনের সাথে। কোন শুয়োরে নাকি আপনাদের গলির মুখে রাস্তার উপর কলার খোসা ফেলে রেখেছিল। ওটার উপর পা পিছলেই শিলা আপা পাশের…’’
মবিন আর সব কি যেন বলছিল! আর আমার কানের কাছে কথাগুলো গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের মতো এসে বিঁধছে। এভাবেও প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পারে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। খালি মবিনকে একটি কথা আস্তে করে বলতে পারলাম, ‘‘শুয়োরটা তার নিজের বাচ্চাকেই খেয়ে ফেলেছে রে মবিন। বাচ্চার মাকেও...’’। ...এরপরই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশে...।"
--একটা কলার খোসা থেকে কত বড় ঘটনার জন্ম! হাস্যরসাত্মক গল্পের ইতি এভাবে হবে ভাবতেই পারিনি। এক কথায় চমৎকার সমাজ সচেতনতা মূলক গল্প। ভালো লেগেছে খুব।
৩. ডিল্যুশন-(গেম চেঞ্জার)
"শোন, দেশপ্রেম হলো একটা ভ্রান্তি! মানুষ ঠকানোর ছল। যদি দেশপ্রেম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতো, তাইলে ঐ যে মুনিম খান, উপজেলা চেয়ারম্যান সে সেইটা বেশি চর্চা করতো, ঐ যে এহসান শহিদ, এমপি। সে সেইটা বেশি জানতো! তোগোর হেডমাস্টারে করে দেখাইতো! তোরা দেইখ্যা দেইখ্যা শিখতি।
ঐ বালের এম-পি নিজেই বর্ডার থাইক্কা টনের পর টন বিদেশি মদ-হেরোইনের ব্যবসা করে কোটিপতি হইতেছে থানা পুলিশরে ক্ষেমতা দিয়া আটকাইয়া। ঐ ওসি কি করে জানিস? ঘুষ খাইয়া গরিব মাইনশের মামলা না নিয়া জুলুমগারগো পক্ষে কলম লিখে। ঐ শালারপুত সাংবাদিক সেইটারে সাপোর্ট কইরা পত্রিকা ভইরা দেয়। এইসব দেইক্ষা তোগোর বড় ভাইরা বিদেশে গিয়া পরিবার লইয়া আরামে আছে। তারা ঐসব দেশের আইন মানে। সেইসব দেশের উন্নত থাইক্কা আরো উন্নত করতে কাম কাজ করে। আর আমরা এইখানে ভেজাল খাইয়া, ক্যান্সার লইয়া, অসুখ লইয়া এইখানে পইচ্চা আছি।
ক্যান পইচ্চা আছি জানিস?.........."
এক্কেবারে বাস্তব ধর্মী একটা গল্প। আমরা ছোটবেলায় কেউ যখন প্রশ্ন করে "বড় হয়ে কি হতে চাও?" আমরা এর উত্তর দেই মুখস্থ। আসলে আমরা অনেকেই মন থেকে কথাগুলো বলিনা। ডাক্তার হয়ে গরীবের সেবা করবো কিংবা পুলিশ হয়ে দেশের সেবা করবো বলি ঠিকি তা আমাদের মনের কথা নয়। গল্পে গল্পে এমন বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে।
৪. জুঁই-সামিয়া ইতি:
অনলাইনে বিভিন্ন রোবটিক চ্যাট অ্যাপস পাওয়া যায়। অনেকেই এই রোবটকে বাস্তব মানুষ মনে করে চ্যাট করতে থাকে। এক পর্যায়ে রোবটের প্রেমে পড়ে যায় কেউ কেউ। শেষমেশ দেখা করতে বললে রোবটিক অ্যাপস আর চ্যাট করে না। এমনই গল্পের প্রেক্ষাপট। জুঁই একটি চ্যাটবুট সফটওয়ারের নাম। গল্পের নায়ক সত্যি ভেবে তার সাথেই প্রেম করতে থাকে।
শেষটা জানতে হলে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে। সবটা বলে দিলে তো মজাই শেষ..........
৫. এক ডলার ছাপ্পান্ন সেন্ট-সোহানী।
তথাকথিত আধুনিক পরিবারের একজন স্বাধীন অবিবাহিত মায়ের সন্তান লিসা। তার মায়ের একাধিক বয়ফ্রেন্ড। লিসা জানেনা তার বাবা কে। লিসা বড় হতে থাকে পিতৃস্নেহ ছাড়াই। এক পর্যায়ে লিসার মাও লিসার সাথে থাকে না। লিসার দিন চলতে থাকে খুব কষ্টে। লিসা সিদ্ধান্ত নেয় বিবাহের আগে কোন ভাবেই সন্তান নিবে না......... এমনই ঘটনার প্রবাহ ধরে এগিয়ে গেছে গল্প। চমৎকার লেখনির বহিপ্রকাশ গল্পটি। একদম যুগোপযোগী। নারী স্বাধীনতার ভয়াবহ রূপ দেখানো হয়েছে গল্পে........
৬. ভালোবাসার জাল বুনেছি- শিখা রহমান
""বাইরের দরজা বন্ধ করে বহ্নি শোবার ঘরের বিছানায় এসে বসলো। ও ঠোঁট চেপে কান্নার দমক সামলাচ্ছে; আবীর জানে না কিন্তু ও আসলেই একটা বিষাক্ত মাকড়শা, Black Widow। একবছর আগে ঠিক আজকের দিনটাতে রণো ঠিক ওর ঠোঁটের মতো বেগুনী হয়ে গিয়েছিলো। এতো অভিমানী হয় মানুষ? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে বহ্নির মানুষটা চুপচাপ ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে যাবে? একবারো বললো না যে “বিয়ে করো না”; শুধু কষ্টে বেগুনী হতে হতে চিরকুট লিখে গেলো “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ না শুধু একটা রানী মাকড়শা দায়ী।“
বহ্নি দেয়াল বেয়ে ওঠা মাকড়শাটার দিকে তাকিয়ে বললো “রণো...মিছেমিছি তুমি জাল বুনে যাচ্ছ। রানী মাকড়শাটা সেই কবেই তোমার ভালোবাসার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে। আমার বোকা মাকড়শা...ভালোবাসার জাল বুঝি কেউ ছাড়াতে পারে? কিন্তু আমার জাল তুমি কাটলে কেন বলতো? খুব অভিমানী ছিলে যে...বেশী বেশী ভালোবাসা পেতেই বুঝি ভালোবাসার জাল ছিড়েছো? তুমি ফেরারী আর আর আমি? সেই কবে থেকে বাঁধা পড়ে আছি.....আর কতোদিন তোমাকে একা একা ভালোবাসবো বলতো? আমি যে এখনো অপেক্ষা করে আছি...এখনো...” """ দারুণ লেখনীর অসাধারণ গল্প। এ ছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
=== অনুগল্প===
১. সীমাবদ্ধতা-সুমন কর
গল্প পড়ে বুঝলাম নায়ক নায়িকার ধর্ম আলাদা বলে সমাজ তাদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছে না। নায়িকা পালিয়ে যেতে বলছে কিন্তু নায়ক তাতে রাজি নয়।
২. কৃষ্ণজল- মনিরা সুলতানা
গল্পটি সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করবো না। মনিরা আপু কাজটা ঠিক করেন নি। একটি ছোট গল্প লিখতে পারতেন।
=== কবিতা===
১. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর- রাবেয়া রাহীম
" মায়ের অপেক্ষায় যে পথ শেষ হয় সে পথে চেয়ে থাকি
পশ্চিম আকাশে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে
প্রার্থনার জন্য শেষ্ঠ সময়; কাঁদবারও!"
দারুণ কবিতা। চোখ ছলছল করার মতো। ভালো লাগবেই আপনার।
২. মিথোজীবিতা--জাহিদ অনিক
"তর্জনী উঁচিয়ে মুখের যেখানটা'য় ঠেসে ধরলে চুপ হয়ে যাওয়া বোঝায়-
ঠিক সেখানটায়; উপরের ওষ্ঠে তোমার প্রথম খাঁজ।
কিছুটা বাঁকা- কিছুটা রুক্ষ;
শীতে ফেটে যাওয়া ক্ষত যেন উপশম নেই - যত্ন আত্তি নেই অনেকদিন।
নিজ ওষ্ঠাধর কখনো ছুঁয়ে দিয়েছ আঙ্গুলের ডগায়?
ওটা যেন বর্ষার জল গড়িয়ে চলার অগভীর স্রোতস্বিনী।"
--জাহিদ অনিকের কবিতার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন তার কবিতার ভাষা তেমনই গভীর ভাব।
৩. আমি তোমার জলকাব্য হবো-কাজী ফাতেমা ছবি
"তুমি মাঝি হও ছোট ডিঙার! কি হবে? চলো ডিঙা ভাসাই অথৈ জলে
আমি তোমার জলকাব্য হবো! কি লিখবে ছন্দ আমায় নিয়ে-মন নেবো আজ ছলে
ভেবেছিলে চুপটি বসে থাকবে একাকি! একটু চোখ ফিরাও মন রাজ্যের সুলতান
তুমি হবে আমার গোধূলিয়ার রঙ বাহারী কুহু সুরের মুলতান?
ফিরে তাকাও না-গভীর ভাবনার বেড়াজালে তুমি বন্দি
নাকি আমাকে পরাজিত করবে বলে-মনে আঁটছো কোনো ফন্দি?"
-- কি দারুণ কবিতার ভাষা, কি তার ছন্দ। ভাবের গভীরতারও কমতি নেই। কবিতাটি পড়ে মনে হতে পারে বই কেনাটাই স্বার্থক!
৪. এক থালা ভাত- অক্ষর অনিক
"ভাতাররে ভাষায় খাইলো, পোলা দুইডারে স্বাধীনতায় খাইলো
বাজানডারে রাজাকারে খাইলো
হামারে কেউ খায় না!
হামি কি বেশি কিছু চাইছিলাম!
হামারে একথালা ভাত দে,
হামি পোলা দিমু, ভাতার দিমু, বাজান দিমু
আর তুই আমারে এক থালা ভাত দে!"
-- এ যেন কবিতা নয় এক মহাকাব্য। '৫২ থেকে '৭১-এর অপূর্ব সংযোগ ঘটেছে কবিতায়।
=== ছড়া===
১. বীরপুরুষ- কি করি আজ ভেবে না পাই!
"যে হারায়, সে-ই বুঝে
মায়ের কি মমতা;
অপূর্ব নেয়ামত
কি অসীম ক্ষমতা!"
-- একটি ছোট্ট খোকার বেড়ে উঠা এবং মা হারানোর গল্প। চোখ ছলছল করে উঠলেও অবাক হবো না। সত্যিই অসাধারণ লেখনি।
-- দু'টি বানান ভুল ছিলো: দুখ (দু:খ ) মধূর (মধুর)
২. মা- আলভী গাংনি
"মাকে ভালোবাসি
মাগো তোমায় ভালোবাসি
আজকে শুধু নয়
তোমায় আমি বাসবো ভালো
সারা জীবনময়!"
-- মাকে নিয়ে লেখা ছড়াটিও অসাধারণ হয়েছে।
৩. সেকালের শ্বশুর বাড়ি- শহিদুল ইসলাম প্রামাণিক
" এখন বুঝি শ্বশুরগুলো
আগের মত নাই
নতুন নতুন বিয়ে করেও
শান্তি পাই না তাই।"
-- একখান মজার ছড়া। পড়বেন আর হাসবেন। বেশি আনন্দে মিষ্টি বানান মিস্টি করে ফেলছেন প্রামানিক দা!
===রম্য===
১. নিজে বাঁচলে দিগম্বর মামার নাম- গিয়াস উদ্দিন লিটন
-- প্রতিটি লাইনে লাইনে রম্য। পড়বেন আর হাসবেন।
সতর্কতা: গল্পটি পড়ার সময় কোন ভাবেই লুঙ্গি পড়া যাবে না। কারন হাসতে হাসতে লুঙ্গি খুলে গেলে গল্পকার দায়ী নন!
===প্রচ্ছদ সমাচার এবং সম্পাদকীয়===
১. প্রচ্ছদের উপরে লেখা সম্পাদনা- শায়মা, গিয়াস উদ্দিন লিটন। আসল নাম তো শায়মা হক!
২. প্রচ্ছদের ভিতরে কিছু কথা লেখা আছে, যেখানে ব্লগের নাম লেখা আছে "সামহ্যোয়ার ইন ব্লগ!" বানানটি আসলে "সামহোয়্যার ইন...ব্লগ"
৩. দেড় পৃষ্ঠার সম্পাদকীয়তে ৯টি বানান ভুল! যা কোন ভাবেই মেনে নেয়ার মতো না। বইয়ের নাম যতবার উল্লেখ করা হয়েছে ততবার ভুল করা হয়েছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে "লেখাজোখা সংকলন!" আসল বানান হলো "লেখাজোকা সংকলন।"
সহজ স্বীকারোক্তি: ব্লগটি প্রায় অর্ধেক লেখার পর হঠাৎ করে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়। ফলাফল সব নতুন করে লিখতে হলো। অনেকগুলো লেখায় আলোচনায় আনতে পারিনি। সময় করে আপডেট করে দেব। ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়।
সবশেষে চমৎকার একটি সংকলনের জন্য লেখাজোকা টিমকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। লেখাজোকা দীর্ঘজীবী হোক। ভালো থাকুক এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:১০