২০১১ সালের কথা। আমি তখন অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্র। ভার্সিটির আন্দোলনের কারনে ক্লাশ শুরু হচ্ছে না। এই সমস্যা শুধু আমাদের বিভাগেই ছিল। অন্যান্য বিভাগ ঠিকই ক্লাস-পরিক্ষা নিয়মিত ছিল। ক্লাস না থাকলেও মেসেই থাকি টিউশনি করাতাম বলে। ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে বাড়ি থেকে ফোন আসে, নাদিয়াকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাসার সবাই খুবই চিন্তিত। আমার ফুুপি খুবই কান্নাকাটি করছে।
নাদিয়ার বাবা নাদিয়াকে ছয়মাসের ছোট রেখে যক্ষায় মারা গেছে। ওর একমাত্র ভাইও প্রবাসে। নাদিয়া আমার থেকে ছয় মাসের ছোট। কিন্তু ছাত্রী হিসেবে লাস্ট বেঞ্চার হওয়াতে আমার থেকে তিন বছর পর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ২০১১ সালে ওর তখন এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। থিওরিটিক্যাল পরিক্ষা শেষ কিন্তু প্রাক্টিক্যাল পরিক্ষা তখনো বাকী।
-- পাওয়া যাচ্ছে না! একথা এখন বলতেছ কেন? দিনে বলতে পারলা না?
-- মনে করেছিলাম কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে হয়তো চলে আসবে, তাই আগে জানাই নি। আর তাছাড়া, গ্রামের লোকজন জানাজানি হলেও সমস্যা। নানান কথা আড়িয়ে-বাড়িয়ে বলে বেড়াবে। ওর সব বান্ধবির বাসায় খোঁজ নিয়ে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, তাই তোমাকে ফোন করলাম। (আমার মা উত্তর দিল।)
-- এত রাতে তো আর যাওয়া সম্ভব না, আমি সকালে আসতেছি। চিন্তা করো না। ওর কোন নাম্বার দিতে পারবা?
-- ওর তো কোন মোবাইল নেই। ওর মা'র মোবাইল চালাতো। ওই নাম্বারও বন্ধ!
-- আচ্ছা আমি কাল সকালে আসতেছি দেখি কি করা যায়।
আমার মায়ের সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রেখেই ভাবতেছি, নাদিয়া তো এমন মেয়ে না। যাবে কোথায়? না কি কেও কিডন্যাপ করলো? নানান প্রশ্ন মাথায় আসছে। কোন উত্তর মিলাতে পারছি না।
বিছানায় শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না চিন্তায়! যতটা না নাদিয়ার চিন্তা তার থেকে বেশি টেনশন হচ্ছে ফুপি কে নিয়ে। যদি ভাল-মন্দ কিছু হয় ফুপু তো একদম মরে যাবে। নাদিয়ার বাবা মারা যাবার পর থেকে ফুপু তার ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে আমাদের বাড়ি। তখন নাদিয়ার ভাইয়ের বয়স ১০/১২ বছর আর নাদিয়ার মাত্র ৬ মাস। কত কষ্ট করে ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করছে। যে বয়সে ফুপা মারা যায়, ফুপু চাইলে আরেকটা বিয়ে করতে পারতেন। করেননি শুধু সন্তানদের কথা চিন্তা করে।
ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাড়ি যেতে যেতে সকাল প্রায় ৯ টা বেজে গেছে। বাড়িতে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। কান্নাকাটি করছে সবাই। কিন্তু বাড়ি গিয়ে যে কথা শুনলাম, তাতে করে আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। যে কথা শুনলাম তার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে এ রকম:
নাদিয়া ওর মায়ের ফোন চালাতো। একদিন হঠাৎ রং নাম্বার থেকে ফোন আসে। ও পাশে ছেলে কন্ঠ। এ কথায় সে কথায় ওদের মধ্যে কথিত ভালোবাসার জন্ম নেয়। ছেলে পরিচয় দেয় তার বাড়ি রাজশাহী। সে একটা ব্যবসায়ী। তারা দুই ভাই, বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজছে। তার বড় ভাই বিয়ে করেছে। এখন তার পালা। মা-বাবা নেই। বড় ভাই-ভাবি তাদের অভিবাবক। এসব কথা শুনেও নাদিয়া পটে যায় নি। সে বলেছে, আমার চেহারা কালো, দেখতে আমি সুন্দর না। আমরা গরীব। এক ভাই আছে সিঙ্গাপুরে। ছেলেটি জানায়, আমার সুন্দর চেহারা দরকার নেই, আমার দরকার সুন্দর মন। সুন্দর চেহারা আর ক'দিনই বা থাকে। এই সব কথা বলেও নাদিয়াকে অবশেষে পটাতে ব্যর্থ হয়। ছেলেটি তার ভাবির সাথে নাদিয়াকে কথা বলিয়ে দেয়। নাদিয়া আমার ছোট ফুপুর সাথে কথাটা শেয়ার করে। ছোট ফুপুও একদিন ছেলের সাথে এবং ছেলের ভাবির সাথে কথা বলে। তাদেরকে বলে যে আপনার যদি সত্যিই নাদিয়াকে নিতে চান তাহলে আসেন আমাদের বাড়িতে, আপনাদের অবিভাবক নিয়ে। কথা বলে যা করার সামাজিক ভাবে করেন। ছেলেটি বলে, ঠিক আছে একদিন আসবো।
আমার ছোট ফুপু নাদিয়াকে ছেলের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে। কিন্তু আবার সেই ছেলের সাথে কথা বলে। পা দেয় ছেলেটির ষড়যন্ত্রে। ওর পরামর্শেই নাদিয়া একটা সিম কিনে। সেই নাম্বারেই কথা হয় ওদের। সবাই ধারনা করছে সেই ছেলের সাথেই নাদিয়া চলে গেছে। আমারও তেমনটাই মনে হয়। কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে কিছুই বুঝতে পারছি না।
ফুপু কান্না করছে আর বলছে, খোঁজার দরকার নাই। গেছে গেছেই। আমি মনে করবো আমার কোন মেয়ে নাই।
সেটা না করে কি আর থাকা যায়! আমার বড় কাকাকে পাঠালাম থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে। আর আমি ওর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ নিতে গেলাম। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ওরা কিছুই জানেন না। যাবার দিন ওদের কারো সাথেই কথা হয়নি। সব শেষে একজনের সাথে কথা বলে কিছুটা সন্দেহ হলো। তাকে শক্ত করে ধরলাম। বললাম, তুমি যা জানো বলো। নাদিয়ার কিছু হলে কিন্তু তোমার নামে মামলা হবে। ভয় দেখাতে অবশেষে নাদিয়াকে খোঁজার একটা ক্লু পেলাম। মেয়েটি বললো, "নাদিয়া আজকে যাবে তা জানতাম না আমি। কিন্তু ও বলেছিল একটা সিম কিনে দিতে। তাই আমার মায়ের ভোটার আইডি কার্ড আর ছবি দিয়ে একটা সিম কিনে দেই। কিন্তু নাম্বারটা আমি রাখি নি।" কি বিপদ নাম্বার কই পাই এখন! মেয়েটিকে ওর মায়ের ভোটার আই কার্ড আর ছবি দিতে বললাম। বললাম, চলো আমার সাথে। যে দোকান থেকে সিম কিনেছ দেখিয়ে দিবে। মেয়েটিকে সাথে নিয়ে গেলাম সেই দোকানে, যেখান থেকে সিম কেনা হয়েছিল। অনেকক্ষন খোঁজার পর পেলাম সেই নাম্বার। কিছুটা স্বস্তি পেলাম!
নাম্বারটা নিয়ে ফোন দিলাম নাদিয়াকে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরলো ফোনটা। কাপা কাপা গলায় "হ্যঁলো কে" বললো নাদিয়া। আমি পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই ফোনটা কেটে দিল। আবার ফোন দিলাম। ধরলো কয়েকবার বাজার পর। ধমক দিলাম এবার বেশ জোরে। ফোনটা তখন সেই ছেলের হাতে দিল। ছেলেটি আমার সাথে কথা বললো। বললাম, আপনারা কোথায় আছেন। আর এভাবে সবাইকে টেনশনে কেন রাখছেন! আপোসেও তো আপনি বিয়ে করতে চাইলে না করতাম না। ছেলেটি বেশি কথা বললো না। কেটে দিল লাইন। সবাই নিশ্চিত হলাম নাদিয়া কার সাথে আছে।
বিকাল প্রায় সাড়ে চারটা বাজে। একটু পরে দেখি নাদিয়ায় কল দিয়েছে আমার নাম্বারে। কল দিয়ে যা বলছে তাতে আরো আশ্চর্য হলাম। মাটি যেন পায়ের নিচ থেকে সরে গেল। ওকে নন্দন পার্কে বসিয়ে রেখে ছেলেটি কোথায় যেন চলে গেছে। ওর সাথে থাকা গহনা আর টাকা মিলে প্রায় ২ লক্ষ টাকার জিনিস নিয়ে গেছে। সাথে একটি টাকাও নেই। বাসায় আসার সাহসে কুলাচ্ছে না ওর। বলছে, আমি যদি বাসায় যায় তাহলে আশে-পাশের মানুষের কথা শুনে শুনে তিলে তিলে মরতে হবে। তার থেকে ভাল হবে গাড়ির নিচে পরে এখানেই মরে যাই। অন্তত মানুষের কথা আর মায়ের চোখের জল দেখতে হবে না। আমি বললাম, একদম চুপ থাক কোন কথা বলবি না।
ফোনটা রেখে দিলাম। নাদিয়া যে নন্দন পার্কে বসে আছে সেই কথাটি বললাম বাড়িতে। ফুপুর কান্নার আওয়াজ ততক্ষণে আর শুনা যাচ্ছে না। দিনরাত কান্না করতে করতে স্বর বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে। শুধু বলছে, আমি এই মেয়েকে ঘরে তুলবো না। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসার কোন দরকার নাই। চাচাদেরকেও জানালাম নাদিয়া নন্দন পার্কে আছে সে কথা। ওনাদেরও সেই একই কথা, এই মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসার কোন দরকার নেই। আমি সবাইকে বুঝালাম, আপনারা যে সমাজের মানুষের কথার ভয় পাচ্ছেন ওকে নিয়ে না আসলে যদি এর থেকে বড় কিছু হয়, যদি এক্সিডেন্ট করে বসে। তাহলে আপনাদেরই আবার থানা পুলিশ করতে হবে। সবাইকে বুঝিয়ে ওকে নিয়ে আসতে গেলাম। বাড়িতে আনার সাহস করলাম না তবুও। বাড়িতে নিয়ে আসলে এ সময়ে সবাই ওকে ঘিরে ধরবে। শহরে আমার এক চাচার বাসায় নিয়ে রাখলাম শেষ পর্যন্ত।
তার মাত্র দু'দিন পর নাদিয়ার প্রাক্টিক্যাল পরিক্ষা ছিল। ওকে সাথে করে পরিক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে দেখাশুনার অনেকটা দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়েছে। আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, তোর সাথে কোন খারাপ আচরন করছে কিনা! তোর সাথে কিছু করে থাকলে ডাক্তার দেখাতে হবে। নইলে পরে সমস্যা হবে। ও নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, কোন কিছুই হইনি ওর সাথে। এ কয়দিনে নাদিয়ার দিকে তাকানো যায় না। না খেয়ে খেয়ে হাড্ডিসার অবস্থা। মেন্টালি সাপোর্ট দিয়ে দিয়ে কিছুটা সুস্থ করার চেষ্টা করলাম।
এই ঘটনার প্রায় দুইমাস পর ওকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারছিলাম। পরিস্থিতি তার পরেও স্বাভাবিক করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। নাদিয়ার কাছ থেকে পরে জানতে পেরেছিলাম, সেই ছেলেটি যাকে ওর ভাবি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে আসলে ওর নিজেরই বউ ছিল। ওদের পেশাই হচ্ছে এভাবে মেয়েদেরকে প্রেমের জালে ফাসিয়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়া। একবার চেয়েছিলাম, ছেলের চৌদ্দগোষ্টি দেখে দেই। কিন্তু সবাই মানা করাতে অবশেষে আর কোন আইনি পদক্ষেপ নেই নি। যাই হোক, মেয়েটি বেঁচে গিয়েছিল সেই লম্পটের হাত থেকে। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশির হাত থেকে রেহাই পেতে পারেনি অনেকদিন। যতবারই কোন বিয়ের প্রস্তাব আসতো ততবারই নাদিয়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার কথা বলে প্রতিবেশি নামধারী কিছু লোক বিয়ে ভেঙে দিত।
অবশেষে কিছুদিন আগে বিয়ে হলো ওর। দোয়া করি সুখী হোক। কিন্তু আমার আরেক বোন, ঢাবির ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হলো! বড় কথা হচ্ছে, তনুর মত জীবনটা কেড়ে নেইনি ওরা। এখন আমার ভয় হচ্ছে, বেঁচে যাওয়া ঢাবির ছাত্রীকে আমরা কি কথা আর বাঁকা চোখের তীরে মেরে ফেলবো দৈনিক?
দ্রষ্টব্য: পোস্টে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:০১