বয়সটা খুব বেশি না।
নয় কি দশ বছর হবে। অথচ শরীরের গঠনে মনে হবে ষোল পেরিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর মতো অবস্থায় পড়েছিলেন হয়তো। মক্তবে আমপাড়ার পাঠ শেষ করার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল মাকে। পায়ে আলতা আর হাতে মেহেদী মানে যে বিয়ে তা বুঝে উঠার আগেই হলুদ শাড়ি গায়ে জড়াতে হয়েছিল। যে বয়সে ছোট ছোট হাড়িপাতিল নিয়ে খেলা করবার কথা সে বয়সে হাতে হাড়ি পাতিল উঠেছিল ঠিকই কিন্তু সেগুলোর ভার বইবার মতো শক্তি তখনো যে নরম শরীরটাতে হয়ে উঠেনি।
আমার মা-বাবা সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন।
চাচাতো ভাই-বোন হলেও একবাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব মাইল দশেক তো হবেই। বিয়ের পর প্রথম প্রথম শ্বশুড় বাড়িতে থাকতে চাইতো না আমার মা। না থাকতে চাওয়ার বড় কারন হলো শ্বশুড় বাড়িতে তিন বেলা ঠিক মতো খেতে পারতো না। আমার বাবা-চাচারা মিলে মোটামুটি একটা ফুটবল টিম গঠন করার মতো সক্ষমতা রাখতো। দাদার একার আয়ে সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খেত দাদী। সকালে গমের আটার জাই, আর রাতে এক মুঠো করে ভাত। দুপুরটা পানি খেয়ে কোন মতে পার করতে হতো।
একদিনের ঘটনা।
সকাল বেলা পান্তা ভাত কাচা-মরিচ পেয়াজের নাস্তা ছিল সেদিন। রাগ করে মা ভাত খান নি। রেখে দিয়েছেন মনের দু:খে। এদিকে বেলা বেড়ে যাবার সাথে সাথে ক্ষিদেটাও তরতরিয়ে বাড়ছে। সেদিন আবার আমার ছোট মামা আসছে আমাদের বাড়িতে। ঘরে এমন কিছু নেই যা দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়। মা আর উপায় না দেখে সকালের পান্তা ভাত খেতে দিলেন মামাকে। মামা খেয়ে দেয়ে বিকেল বেলা চলে গেলেন। মায়ের পেটে সেদিন আর কিছু পড়লো না। জলের উপর ভরসা করে দিন পার করতে হলো। এরকম উপোস থাকার দিন গেছে যে কত তার হিসেব নেই। সেসময়টাতে আমাদের ঘরে নিত্যদিনই রোজার মতো পার হতো!
আমার জন্মের পর অবশ্য অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
মায়ের বিয়ের ৮ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কোন সন্তানের দেখা নেই। পরিবারের সবাই চিন্তিত! তবে কি আর সন্তান হবে না! অনেক কবিরাজি চিকিৎসা করার পর নাকি আমি হয়েছি। আমার যখন জন্ম হয় তখন মায়ের বয়স ১৯ এর কাছাকাছি। বিধাতাও হয়তো চাননি এর আগে আমি দুনিয়ায় আসি। তখনকার লোকেরা সন্তানের জন্য কত কি যে মানত করতো তার হিসেব নেই।
আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হয় আমি হবার ৬ বছর পর।
আমার ছোট ভাইয়ের নাম রাখা হয় হাসান। হাসানের বয়স যখন ৩ বছর তখন ওর খুব পাতলা পায়খানা হয়। সে সময় ২ টাকা দামের ছোট ডিটারজেন্টের প্যাকেট পাওয়া যেত। আমার মা হাসানকে ঐ ডিটারজেন্টের প্যাকেটকে স্যালাইন মনে করে খাওয়াচ্ছিলেন। দু এক চামচ মুখে দেওয়ার পর যখন খেতে চাচ্ছে না, তখন মা মুখে দিয়ে দেখে এ তো গুড়া সাবানের প্যাকেট!! আসলে আমার মা বাংলা পড়া কিছুই পড়তে পারেন না। তার যে স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি। স্কুলের বয়সটায় সময় কেটেছে শ্বশুড়বাড়িতে।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছি আমরা এইতো ক'বছর হলো।
আগেকার দিনে তো মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোকে বেকার খরচ ভাবা হতো। মায়েরা এককেকটা ভ্রাম্যমান স্কুল। মায়ের শিক্ষা সন্তানের জন্য জীবন গড়ার প্রথম ফাউন্ডেশন। ভিত মজবুত না হলে স্থাপনার স্থায়িত্ব যে খুব বেশি হয় না। বেগম রোকেয়া হয়তো পেরেছিলেন কিছুটা। কিন্তু আমাদের ঘর পর্যন্ত অবরোধবাসিনীর আওয়াজ পৌঁছতে অনেক দেরী।
ছবি: আরিশের আব্বু
বুননে: আরিশের আম্মু
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২১ দুপুর ২:১৮