somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তর্ক-বন্ধু আব্বু

১৯ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতকাল বাবা দিবসে সবাই তার নিজ নিজ বাবাকে সুপারহিরো/সুপারম্যান বলছিলো আর ছবি পোস্ট দিচ্ছিলো। নিউজ ফিড স্ক্রল করছিলাম আর ভাবছিলাম, আমার আব্বু কি সুপারহিরো? নাকি সুপারম্যান? নাকি মাথার উপরের বটবৃক্ষ?

নাহ! আমার আব্বু কোনটাই না।

আমার আব্বু একদমই সাধারন একজন মানুষ, যিনি জীবনে প্রচণ্ড বড় বড় ভুল করেছেন, লজ্জিত হয়েছেন আর আমি নিজ চোখে সেসব ভুল দেখেছি, সাক্ষী হয়েছি। অন্যদের আব্বুরা যেমন একদম দোষ-ত্রুটিহীন হন (অন্তত সন্তানের কাছে), আমার আব্বু তেমন নন। এখনো আব্বুর প্রায় ৭০ বছর বয়সে এসেও আমি তার আচরণে হাজারটা অসামঞ্জস্য খুঁজে পাই, মনে হয়, ইশ! শুধরে দেই একটু! তারপরও চুপ করে থাকি, থাক! আমার আব্বু-ই তো!

যারা ভাবছেন, আমার আব্বু প্রচণ্ড খারাপ একজন মানুষ, আগের দিনের মাস্তান টাইপের কেউ ছিলেন! তারা একদমই ভুল ভাবছেন। পেশাগত জীবনে আব্বু একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, পরবর্তীতে স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর কারণে নারীশিক্ষার ব্যাপারে আব্বুর সচেতনতার সিঁড়ি অনেক উঁচুতে। আমি নিজে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে পণ্ডিত হয়েও তার আশেপাশে জ্ঞান রাখি না। তারপরও এই সচেতন আব্বুর সাথেই আমার প্রচণ্ডরকমের দ্বন্দ্ব।

দ্বন্দ্বের শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই। একবার আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। তখন আমরা বেশ ছোট, আব্বুর হাত ধরে তিড়িং বিড়িং করে হেঁটে যাচ্ছিলাম দুজনে, হুট করে খেয়াল করে দেখি আব্বু নেই! কোথায় গেল, কোথায় গেল! অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর উনি মুখ টিপে বের হয়ে এলেন এক বাড়ীর গেট থেকে। সেই ঘটনা নিয়ে আমার যে সে কি রাগ! এখনো রাগ হয়, কেন সেই ছোট্ট আমাদের টেনশনে ফেলে দিয়েছিলেন!

বোধহয় ১৯৯৯/২০০০ সালের কথা। গ্রামের বাড়ীতে আমার ফুফাতো বোনের বিয়ে, সেই উপলক্ষ্যে আব্বু আমাকে প্রথমবারের মত নিজের সাথে মার্কেটে নিয়ে গেলেন। আমার যতই ঝুক্কুর ঝাক্কর জামা পছন্দ হয়, আব্বু আমাকে তা কিনে দেবেনই না! তার কথা এসব জামা দুইদিনও টিকবে না, তুমি সুতি কাপড়ের কোন একটা জামা নাও। বাধ্য হয়ে নীল রঙের একটা ফ্রক নিয়েছিলাম (যদিও ওই ডিজাইনের ফ্রক আমাকে এখন কেউ পড়তে দিলে আমি লাফিয়ে উঠবো!), কিন্তু রেগে গিয়েছিলাম প্রচণ্ড! বিয়ে বাড়ীতে সমবয়সী কাজিনরা সবাই ওই ঝুক্কুর ঝাক্কর জামা গায়ে ছিল, আর আমিই একমাত্র মলিন (আমার মতে) জামা গায়ে ছিলাম। এরপর পড়তে পড়তে জামাটা আমার এতই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল যে মনে আছে, ২০০৩ সালেও সেই জামা আমি পড়ার চেষ্টা করতাম! এবং আব্বুর কথা মতো জামাটা আসলেই নষ্ট হয়নি, একদম শেষ যেদিন একজনকে দিয়ে দিলাম, নতুনের মতই ছিল।

বড় হতে হতে বয়ঃসন্ধিতে এসে আব্বুর সাথে আমার মতামতের বিস্তর ফারাক দেখা দিতে থাকলো। একদিন তো রাগ করে বাসা থেকেই বের হয়ে গিয়ে ফুফুর বাসায় উঠলাম। আব্বু সেদিন পুরো এলাকা খুঁজে এসেছিলেন, পরে ফুফুর বাসায় খুঁজে পেয়ে আমাকে না নিয়েই বাড়ী ফিরে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার সময়ে ভয় ধরে গিয়েছিল আমার, এখন বাড়ী ফিরলে আব্বু মেরেই ফেলবে! সন্ধ্যার পরে বাড়ীর বাইরে থাকার অনুমতি নেই আমাদের কারও। সেদিন বাড়ী ফেরার পর আব্বু কিছুই বলেননি, আমি যে বাসা থেকে পালিয়েছিলাম সেটা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন!

একটা বিষয় খেয়াল করেছি, আব্বু আমাকে তর্ক করার প্রচুর রসদ জুগিয়েছেন। কখনো বলেননি, মেয়ে থেমে যাও। কখনো কখনো আমি তর্কে জিতে গেলে মুচকি হাসতেন, এখনো হাসেন। তখন মনে হয়, বাচ্চা মেয়ের বাচ্চামিতে অনেক মজা পান তিনি। স্কুলে একাই যেতাম, কলেজে যাওয়ার দিনগুলোতে আব্বু সাথে সাথে মেইন রোড পর্যন্ত যেতেন। বেতন জমা দেয়ার জন্য ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানোর কাজটাও যেন তারই ছিল। ফাইনাল পরীক্ষা দিতেও বাড়ীর কাছের কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন প্রত্যেকদিন, ৩ঘণ্টা হলের বাইরেই পায়চারি করতেন। সেই আব্বুই আবার আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলেন ২০১৩তে এসে। ইংলিশ রোডের পপুলার ডায়গনস্টিকে নিয়ে গিয়েছিলাম, মেডিক্যাল টেস্টের জন্য। ওই একদিনই বড়মানুষের মত আব্বুর দেখাশোনা করেছিলাম আমি, আব্বু আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়েছিলেন।

এখনো আব্বুর সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ি। টুকটাক মনোমালিন্য হয়ে যায়। আবার এই আব্বুই সকালে অফিসে যাওয়ার আগে খাবারটা রেডী করে দেন। কনে দেখতে বরপক্ষ আসলে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি আসলেই রেডী তো? বিয়ে করবে তো? আরেকটু ভেবে দেখবে? এই তর্কবন্ধু আব্বুই আবার পেপার খুঁজে বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আসেন, অমুক জায়গায় নিয়োগ হবে, এপ্লাই করবে নাকি? আইইএলটিএস'টা কি এবছরই দিয়ে দিবে? নাকি মাস্টার্সটা শেষ করে দিবে?

আবার দিনশেষে আব্বুই বলবেন, আল্লাহর কাছ থেকে মেয়ে চেয়ে আনসিলাম আমার শেষ বয়সের লাঠি হবে! না, সেই মেয়ে শুধু ঘুমায় আর বাইরে বাইরে ঘোরে। চাকরি করে, তাও রিকশা ভাড়া আমার কাছে থেকে নেয়! আমি রেগে যাই, প্রত্যেকদিন টাকার খোঁটা! কালকে হেঁটেই যাবো। এরপর আবার পরেরদিন সকালে বলি, আব্বু রিকশা ভাড়া! রিকশা ভাড়া! তাড়াতাড়ি! দেরি হয়ে গেল! আব্বু মুচকী হেসে বলেন, যা! ওয়ারড্রোবের দ্বিতীয় ড্রয়ারে আছে, দুইশ' এর বেশি নিবি না কিন্তু! আমি বের হয়ে যেতে যেতে বলি, আব্বু আজকে বিশ টাকা বেশি নিলাম কিন্তু!

নাহ, আমার আব্বু সুপারহিরো নন, সুপারম্যান তো অবশ্যই নন। মাথার উপরের ছায়াও হননি সবসময়। সময় মত হাত ধরেছেন, সময় মত ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন; কিন্তু বাধা তৈরি করেননি কখনো। "না" শব্দটা যাতে আমার শুনতে না হয় তার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অন্য ভাই-বোনদের সাথে আব্বু'র কিছুটা ভয়, কিছুটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকলেও, আমার সাথে সম্পর্কটা সবসময়ই তর্কের আর অভিমানের।

আমার আব্বু শ্রেষ্ঠ বাবা নন, কিন্তু তিনি আমার আব্বু; যিনি "না" বলেননি কখনোই, আবার সহজে হ্যা'ও বলেননি। তবে ওই হ্যা'টা আদায় করে নিতে শিখিয়েছেন। বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, আবার স্বপ্নগুলোকে ধরতেও শিখিয়েছেন। নাটাইয়ের সুতা ছেড়ে উড়তে শিখিয়েছেন, এরপর পাখির মত ডানা দিয়ে দিয়েছেন সুতা কেঁটে।

ভালো থাকুক সকল আব্বু'রা। সন্তানদের উড়তে শেখাক স্বপ্নভোরে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৭ রাত ৩:৪৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×