দীর্ঘ ঈদের ছুটি কাটিয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছি। আনন্দের কমতি নেই। সেই যে কবে প্রিয় সকল বন্ধু বান্ধবীদের মায়া ভরা চেহারাটা দেখেছি , এখন সেগুলু ঘোলাটে মনে হয়। ডেইরী গেট, টারজান পয়েন্ট, বটতলা, হাসু ভাইয়ের চায়ের দোকান সব কিছু কেমন যেন হৃদয়টা ধরে টানছে। আমাদের গান, গল্প আর আড্ডা হীনতায় ক্যাম্পাসের সকল যায়গা অভিমানে চেপে আছে। কতদিন পর দেখা হবে। সত্যিই ভাল লাগছে।
বর্ষার আকাশ! একটু বাদে বাদে বৃষ্টি। কোন রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই।আজ সে রকম কিছু নেই।সকাল থেকে ঢাকার শহরটা রোদ ঝলমলে।লোক সরাগমও বেশ। সবাই ঈদের ছুটি কাটিয়ে ব্যাস্ত শহরে ফিরেছে।
আমি মিরপুর থেকে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম সকাল নয়টার দিকে। লোকাল বাস । আস্তে আস্তে চলছে। আমারো তেমন তাড়া নেই। ক্লাস ১১ টায়। তার আগে পৌঁচালেই হয়।
আমাদের বাসটা যখন ট্যাকনিকেল মোড়ে পৌঁচাল, তখন বেশ কিছু সময় সিগনালে আটকে ছিল। স্বাভাবিক সময়ের চেও অনেক বেশি।আমার সমস্যা নেই । আমি চুপ চাপ বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছি। আমার পাশ থেকে কেউ একজন বলছে...ভাই দেখেন, ট্রাফিক হারামজাদারা বাসের সামনে দাড়িয়ে গল্প করছে। তাদের বৌয়ের গল্প। কে কার বৌয়ের সাথে রাতে কি করছে, এইসব। আমাদের কথা তাদের মনেও নেই। আজ অফিসে লেট করে গেলে চাকরি থাকবেনা। যদিও থাকে এক মাসের বেতন কেটে নিবে।অথবা এক ঘন্টা বসের গালাগালি শুনতে হবে। অসহ্যকর যন্ত্রনা। আসলে ওদেরকে কি বলবো? সমস্যাটা হলো আমাদের দেশের।দেশের সরকারের। যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রি জোর গলায় সারাদিন লেকচার মারে। কাজের বেলায় ঠন ঠন।এগুলারে যে কে মন্ত্রি বানয়? এদের দিয়ে উচিৎ জুতা পলিস করানো । তাইলেই ঠিক হবে।
আমি লোকটির কথা শুনে হসছি আর একটু পর পর ঘরির দিকে তাকাচ্ছি।
প্রায় আধা ঘন্টা পর সিগন্যাল চাড়ছে। রাস্তা ফাঁকা । এক টানে চলে এলাম গাবতলিতে। হঠাৎ সামনে দিয়ে দেখি পুলিশের ব্যারিকেট। আচমকে একজন পুলিশ গালি দিয়ে আমাদের ড্রাইবারকে মারতে শুরু করলো। তারা গাড়ি ডুকিয়ে দেয় একটি ছোট গলির ভিতর।
এবার আমি পত্রিকা থেকে চোখ নামালাম। সামনে গিয়ে হেল্পার কে জিঙ্গাস করলাম,..কি হলো?
হেল্পার কাপা কাপা গলায় বললো,,,,প্রধানমন্ত্রি আসবে তাই রাস্তা ক্লিয়ার করছে।
আমি আবার বললাম ,,,,এই জেম চাড়তে কতক্ষন লাগবে?
হেল্পার বললো,,,,যানিনা। তবে মনেহয়, দুই-চার ঘন্টার কম লাগবেনা।
মহূর্তের মধ্যে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আজো বুজি জেমের জন্য ক্লাস করতে পারবোনা?
আমি গাড়ি থেকে নেমে হাটতে শুরু করলাম।খুঁজতে থাকলাম ভিন্ন কোন রাস্তা।খুঁজতে খুঁজতে মেন রোডে চলে এসেছি।মেন রোডে এসে একজন পুলিশ অফিসারকে জিঙ্গেস করলাম,,,,,,স্যার এখানে কি হবে?
তিনি বললেন,,,,,প্রাইম মিনিষ্টার আসবে।
আমি আবার বললাম,,,,,কখন?
তিনি বললেন,,,,একটু পর।
কন কনে রোদ। রোদের তেজও প্রখর।আমি এই রেদের মাঝে দাড়িয়ে দীর্ঘ১৫ মিনিট খুব ধৈর্য্য সহকারে প্রাইম মিনিষ্টারের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।কিন্তু তা এখনো আসেনি। এর মধ্যে একজন পুলিশ আফিসার বলে দিয়েছে । রাস্তায় লোকজনের হাটাহাটি বন্ধ করে দিন।তাই করা হলো।
পুলিশের তাড়া খেয়ে বাচ্চা মেয়েটির মা রাস্তার ঐ পাড়ে চলে গেল।বাচ্চা মেয়েটি এই পাড়েই থেকে গেল।তার চিৎকার আশে পাশে সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। শুধু পুলিশের হৃদয় স্পর্ষ করতে পারেনি। আসহায় মা, শিশু বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে কান্না চাড়া কিছু করার উপায় ছিল না।
প্রায় ১০ মিনিট ধরে বাচ্চাটি কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজও বেশ লম্বা। লোকজন তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। কিছু পুলিশ তাদের খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছে।তারা মহূর্তের জন্যও বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা পযন্ত দেয়নি।
বাচ্চাটির কাছ থেকে একজন বৃদ্ধা, পুলিশকে লক্ষ করে বললো, প্রধানমন্ত্রি তো এখনো আসেনি। আপনারা বাচ্চাটিকে তার মায়ের কাছে যেতে দিন।
বৃদ্ধার কথা শুনে একজন পুলিশ লাঠি হাতে তার দিকে তেড়ে আসছে আর বলছে ,,,,তুই আমাদের হুকুম দিস? তুই হুকুম দেওয়ার কে??
বৃদ্ধ লোকটি তার জায়গায় অবিচল। সে সেখান থেকেই বলছে,,,প্রধানমন্ত্রিকে ভোট দিয়ে আমরা ক্ষমতায় বসাই।সুতরাং আমাদের কথাই শেষ কথা। সংবিধান রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা আমাদেরকে দিয়েছে।
লোকটির কথা শেষ না হতে অন্য একজন পুলিশ বলে উঠল,,,,এই সরকার আপনাদের ভোটে হয়নি । সরকার নিজেই তার ক্ষমতা বলে আসনে বসেছে। তাই প্রধানমন্ত্রির কথাই শেষ কথা। তিনিই রাষ্ট্র। সংবিধান তার ইচ্ছা মত হবে।
এবার আর আমার চোখের জলকে ধরে রাখতে পারলামনা।সে তার নিজের গতিতে বয়ে চলছে।কয়েক জন পুলিশ কনষ্টেবল লোকটিকে বেদড়ক মেরে টেনে হেচড়ে তাদের ভ্যানে তুলছে।লোকটি "ও বাবা" "ও মা" বলে চিৎকার না দিয়ে বলছে,,,""গনতন্ত্রের জয় হক....স্বৈরাচারী নিপাত যাক""।।
তার উচ্ছ কন্ঠের স্লোগান শুনে বাচ্চা মেয়েটির কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। সে এক ধরনের কৌতহল নিয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে।
আরো প্রায় পাঁচ মিনিট পর প্রধানমন্ত্রির গাড়ি বহর এল। সবাই তার রজকীয় চলে যাওয়া দেখছে।পিচন দিয়ে লোকজন ছুটাছুটি করছে। কে কার আগে যাব ? একরকম হৈ চৈ পড়ে গেল।আমি বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে করে তার মায়ের কাছে দিয়ে এলাম। বাচ্চা মেয়েটি আনন্দে আত্মহারা। সে তার মায়ের গলা জড়িয়ে দু'গালে অবিরাম চুমু খেয়ে যাচ্ছে।
অনেক কষ্টে ঠেলে ঠুলে আমার যায়গা হল একটা বি.আর.টি.সি বাসে।কোন রকম দাড়িয়ে আছি। দুই পাশে দাড়ানো লোকের গরম নিঃশ্বাস আমার গলায় এসে লাগছে। কেউ আবার পা মাড়িয়ে একটু আরামে দাড়াতে চাচ্ছে। শূন্য রাস্তা । আমাদের গাড়ি চলছে বাতাসের বেগে।
গাড়িটা বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ শুনতে পেলাম বিকট চিৎকার। চিৎকারের ধ্বনি এতটাই ভয়ংকর ছিলযে আমার হৃৎপিন্ড পর্যন্ত কেপে উঠেছে।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করি।দেখি লোকটা ঙ্গান হারিয়ে অন্য একজনের কাঁধে শুয়ে আছে।একজন তার মাথায় পানি দিচ্ছে।
আমি কৌতহল বসত পাশের লোকটাকে জিঙ্গেস করি,,,কি হয়েছে ওনার??
লোকটি উত্তর দেয়,,,তার এক মাত্র ছেলে খুব অসুস্থ। গত দুই দিন ধরে হাসপাতালে। আজ দশটায় তার অপারেশন হওয়ার কথা।ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নিয়ে ফিরছিলেন তিনি।কিন্তু এই জেম তাকে নিদৃষ্ট সময়ে হাসপাতালে পৌঁচাতে দেয়নি। তাই হয়ত তার ছেলে..........
আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারছিনা।মনেহয় হেলে পড়ে যাচ্ছি।একদিকে ক্লান্ত অন্যদিকে হতাশা বিদ্ধ মন। আমি ভাবছি এক প্রধানমন্ত্রির সিকোরেটির কথা। যার সিকোরেটির জন্য এক শিশু সন্তান তার মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হল।এক বাবা তার এক মাত্র সন্তানকে হারালো। নেয্য কথা বলার জন্য এক বৃদ্ধা কারাবাসী হল। আমার মত শত শত ছাত্র তাদের গুরুত্বপূর্ন্য ক্লাস মিস করল। যানিনা এর বাহিরে আরো কত কি ঘটে গেল।
এর কি কোথাও শেষ আছে? হয়ত আছে। সেটা আমাদের জানা নেই।
আমরা বাঙ্গালী । ৭১'এর প্রেরনা এখনো আমাদের মন থেকে মুচে যায়নি।আমরা জলে বাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জাতি।তাই এত শত হতাশার মাঝে দেখি প্রত্যাশিত আরেকটি নতুন প্রহর।ঠিক সেই প্রহরটার মত ।
যে প্রহরে দুই জন বাঙ্গালী বৃটেনের একটি লোকাল গাড়িতে করে তাদের নিদৃষ্ট স্থানে যাচ্ছে।হঠাৎ এক বাঙ্গালী তাকিয়ে দেখে তার পাশে ডেবিড ক্যামেরুনের মত একজন মানুষ দাড়িয়ে আছে।তার হাতে অফিসের ব্যাগ। বাঙ্গালী লোকটি তার অপর বাঙ্গালীকে বলছে,,,দেখ ঠিক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রি ডেবিড ক্যামেরুনের মত দেখতে। অপর বাঙ্গালী বললো,, ইনি -এ -ত ডেবিড ক্যামেরুন। এদেশের প্রধানমন্ত্রি ।সেই বাঙ্গালী খুব অবাক হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে অপর বাঙ্গালীকে বলছে,,
দেখিস একদিন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রিও ওনার মত লোকাল বাসে চড়ে অফিসে যাবে। প্রত্যেকটা সাধারন মানুষের সাথে মিশে তিনিও অতি সাধারন হয়ে যাবে। আমাদের দেশটা চির শান্তির দেশে পরিনত হবে। । ।
হেমন্ত ইকবাল ধ্রুব
আইন ও বিচার বিভাগ
৪১ তম আবর্তন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার ,ঢাকা।