somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফাইনাল কাউন্ট ডাউন

১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জন্ম'র সময় আর দশটা দেবশিশুর মত সেও চিৎকার করে উঠেছিল। মেনপোজ শুরুর আগে জন্ম নেয়া একমাত্র নবজাতিকার চিৎকার বাবা-মার বুকে ছন্দ'র মত বাজে। হয়তো সেই ছন্দ'র তালে মেয়েটার নাম রাখা হয়ে ছিল রিদমা। রিদমিক থেকে রিদমা। আমার চোখেও সে একটা ছন্দ'র নাম। মালকোশ, ভৈরবী বা তিন তালের ছন্দ নয়; পাগল-পারা বৃষ্টি'র মত ছন্দ। রিদমা'র ছোট ছোট সুখ, হাসি, বেদনা আর আবদার গুলো আমার কাছে মুষলধারা বৃষ্টির ছন্দ'র মত ঠেকে। এমনকি অন্যায় আবদার গুলাও। আজ দিন সাতেক হল আমাদের কথা বন্ধ। ভালোবাসা'র মানুষের সাথে কথা বন্ধ হলেও বার্তা বন্ধ হয় না। আমাদেরও বার্তা বন্ধ হয় না। আজ অবশ্য পরিস্থিতি গুরুতর। কথা-বার্তা সবই বন্ধ।

আজানের সুর ভেসে আসছে আজাদ মসজিদের মাস্তুল থেকে। আস সালাতু খায়রুম মিনান নাম়্… অথচ রিদমার চোখে ঘুম নেই। ঘুম অপেক্ষা নামাজ উত্তম শোনার পর শুরু হয় তার ঘুমের প্রস্তুতি। বিছানা কম্বল ঝেড়ে, হাত-মুখ ধুয়েমুছে ঘুমের প্রস্তুতি নিলেও ফাঁকে নাস্তা-টা খেয়ে নিত। সকাল ৭ টা বেজে গেলে নাশতা সেরে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ রিদমা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।

আজ অবশ্য ভোরবেলা-টা যথারীতি অন্যদিনের মত নয়। আমার ঘুম ভাঙল রিদমার গুঙানির শব্দে। কোন রকম হাতরে চশমা পেয়ে গেলাম। চোখে লাগিয়ে রিদমারে ডাকতে শুরু করলাম। না অন্যদিনের মত আজও সে আমার পাশে নেই। লিভিং রুমে ঢুকতেই দেখি ডিভানে শুয়ে কুকরে যাচ্ছে সে। হাত-পা শরীর ধনুকের মত কিছুটা বেঁকে আসছে। খিচিয়ে থাকা মানুষের মত চোখ মুখ। শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে গুঙরানির মত শব্দ। যেন জমদূতের সাথে টানানাটি।

আমি গিয়ে ধাক্কা দিলাম ওরে। কি হয়েছে তোমার? ততক্ষণে দু'হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করেছে। হাতের যে অংশ ঠোঁট বরাবর গিয়েছে সেখানে সজোরে কাম়্ড়ে ধরছে আর ছাড়ছে। আমি আস্ত একটা পুরুষ ওর দুহাত চেপে ধরার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিদমার দু'হাতের কব্জি মুষ্টিবদ্ধ করলাম দু'হাতে। কিন্তু তার ধাক্কা আঁটকে দেবার মত শক্তি হল না। ছিটকে গেলাম আমি। ওর হাতে মুঠো ভরা লম্বা চুল উঠে আসছে, কুনুয়ের ওপরে দাঁতাল কামুড়ে ক্ষত। দাঁত যেন চামড়া ভেদ করে মাংসপেশী স্পর্শ করেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। উঠে গিয়ে আবার চেপে ধরলাম। আবারও ব্যর্থ আমি। যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে শরীরে।

ইতিমধ্যে রহিমা খালা হাজির। রহিমা খালা আমাদের বহুদিনের হেল্পিং হ্যান্ড। রিদমার মা'র যখন নতুন সংসার তখন থেকেই আছে পিচ্চি রহিমা খালা। সময় পরিক্রমায় আমাদের বাসাতেও তার সারে তিন বছর পার হয়ে গিয়েছে। রিদমাকে আতুর ঘর থেকেই খালা পেলে-পুষে বড় করেছে। হাও-মাও করে কাঁদতে কাঁদতে খালা এসে আমার সাথে রিদমারে চেপে ধরেছে। যেন তারে নিবৃত করা যায়। দুজনের সম্মিলিত শক্তিও পরাজিত হল তারে থামাতে। মিনিট দুয়েক ধস্তাধস্তির পর একেবারে এলিয়ে গেলাম আমরা। তারে ধরে রাখতে যে শক্তি দরকার তার সিকিভাগও নেই আমার। দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরি। অজান্তে আমার হাত চলে গেল মাথায়…

রহিমা খালা বলল বাসাত লাগছে ভায়ে। খারাপ বাসাত..

তখনি ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মত শব্দ করে চুপ়্সে যেতে শুরু করল সে। ধনুকের মত বেঁকে যাওয়া হাত-পা স্বাভাবিক হতে লাগলো। দাঁতের কামুড়ে রক্তাক্ত হাতে ব্যথার অনুভূতি ফিরে আসতে শুরু হল। গিঁট বেধে যাওয়া থোকা থোকা চুল আর কামুড়ের ক্ষত দেখে যেন বিষ্ময়ের সীমা রইল না তার। অঝোর কাঁন্নায় পরিবেশ গুমোট হয়ে গেলো।

এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত রাখতে চাইলাম। দুহাতে টেনে নিয়ে আমারে বুকের আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলল সাথে সাথে। আমারও দু'চোখ আদ্র হয়ে উঠল। কি যেন এক সুখ সুখ যন্ত্রণার শিস বিঁধতে শুরু হল মগজে। শিসের সুরটা খুব চেনাচেনা। অবশ্য কিছুতেই মনে পরছে না ঠিক কোথায় যেন শুনেছি...

ভাগ্য একদিকে সুপ্রসন্ন বলতে হয়। সম্পূর্ণ ঘটনা তিন চার মিনিটের বেশি স্থায়ী হল না।

রহিমা খালা এক-গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসেছে। তার মুখে পান। পানের রস ঠোঁট বেয়ে চুয়ে চুয়ে পরছে। খালা বলল বুজচ্ছ নি ভায়ে, ছুড়ুক বেলাত একবার পরীতে নিছিল আমাগের রিদু আফারে। আমাগের একটা কাশা'র কলস ছিল, সেই কলসের পানিতে বদ হাওয়া...

খালার কথা শেষ হবার আগেই আরো একবার গুঙরে উঠল রিদমা। আমি ছুটে গেলাম। এবার অবশ্য নিজেই নিজে-রে সামলে নিল সে...

ভেতরে ভেতরে খুব ঘাবড়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম রিদমা-রে হাসপাতালে এডমিট করিয়ে তারপর অফিস যাবো। কানাডা থেকে সিয়ার্স এসেছে। ওদের সাথে সময় দিতে না পারলে বিপদ। মার্চেন্ডাইজিং বাদ দিয়ে বউ নিয়ে হাসপাতালে থাকলে চাকরি থাকবে না। চাকরি না থাকলে চিকিৎসা হবে-না। মধ্যবিত্ত'র শনির দশা আর কি!

ঢাকা শহরের সব বড় হাসপাতালে নক দিলাম। চেনাজানা ডাক্তারদের ফোন দিলাম। সিম্পটম শুনে সবাই বলে আমরা পাগলের চিকিৎসা করি না। রুগী-রে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যান, ওখানে মানসিক চিকিৎসার ইউনিট আছে। আমার বউ পাগল আমি মানতে পারছি না। যা ঘটার তা মাত্র তিন চার মিনিটের ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাকি সময় সে স্বাভাবিক। একেবারেই স্বাভাবিক। শুধু ঐ সময় টুকুর রেশে ক্লান্ত বিধ্বস্ত।

ইতিমধ্যেই আশেপাশের ফ্লাটের ভাবী-আন্টিরা চলে এসেছে৷ তারা সবাই খুব উত্তেজিত। বাড়িতে একজন পাগল পাওয়া গিয়েছে। যে পাগল এক রাত্রি আগেও তাদের সাথে স্বাভাবিক-ভাবে কথা বলেছে। সেই পাগল সরাসরি লাইভে দেখার সুযোগ কেউ ছাড়তে চাইছে না। আগামী অন্তত এক বছর ভাবী-আন্টিদের গল্প আড্ডা আর গিবতের জন্য মুখড়চক ইস্যু পাওয়া গিয়েছে। এমন ইস্যু হাতছাড়া করা আলবত উচিৎ হবে না..

ফোন শেষ হতেই রহিমা খালা আবার হাজির। এতক্ষণ সম্ভবত আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিল। খালা আবার বলল বুজচ্ছ ভায়ে ছুড়ুক বেলাত একবার পরীতে নিছিল আমাগের রিদু আফারে। আমাগের একটা কাশা'র কলস ছিল, সেই কলসের পানিতে বদ হাওয়া…

খালার কথা শেষ হবার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ। চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে। ইয়া লম্বা চওড়া এক হুজুর এসে হাজির। কোন এক ফাঁকে খালাই তারে সংবাদ দিয়েছে আসার জন্য। হুজুর আমাকে মোটেও পাত্তা দিল না। দেয়ালে টাঙানো নারী পোর্টেট দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। দোয়া-দরুদ পরে ছবিতে ফু দিয়ে দিলেন। ফু দিয়েই ঘোষণা দিল বাড়িতে সমস্যা আছে। সমস্যাটা মূলতঃ বাড়ির দক্ষিণ দিকে। ছবিটাও দক্ষিণমুখী দেওয়ালে আছে। পোর্ট্রেট নামিয়ে ফেলার হুকুম দিলেন হুজুর। বললেন বাড়ির মেয়েছেলের ছবি রঙ করে টাঙিয়ে রাখা বেদাত। এ কারণেই বদ জিনের নজর পরেছে। জুব্বার পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে পোর্টেট আরেকটু ভালো মত পরখ করে নিলেন তিনি। তারপর আমার দিকে স্মিত মুখে তাকালেন। বললেন বড্ড খতরনাক জিন। তবে আপনার স্ত্রী-কে জিন মুক্ত করে ফেলব ইনশাআল্লাহ। আমি বললাম হুজুর ইনি আমার স্ত্রী না। ইনি লিও দ্যার গার্লফ্রেন্ড নাম মোনা। আমার কথায় হুজুরের সুরমা মাখা চোখ মোটামুটি কপালে উঠে গেলো। কিছুটা বিব্রত হয়েই বোধহয় বলল ছি ছি ছি শিগ়্গির বিবাহ করুন, গার্ল্ফ্রেন্ড নিয়ে থাকেন কেন? বেগানা মহিলা জানলে তো আমি আসতাম-ই না। আচ্ছা এসেই যখন পরেছি নিশ্চয় ওপর ওয়ালার ইশারায় এসেছি। আপনি খেদমতের ব্যবস্থা করুন। আমার সাথে বুজরুক জিন আছে। জিনদের খান-ই-খানান।

রহিমা খালা ইতিমধ্যে সাজিতে পান নিয়ে হুজুরের সামনে হাজির। মাথার ঘোমটা আধা হাত টেনে মুখ ঢাকলো খালা। বুজচ্ছন নি মাওলানা সাপ ছুড়ুক বেলাত একবার পরীতে নিছিল আমাগের রিদু আফারে। আমাগের একটা কাশা'র কলস ছিল, সেই কলসের পানিতে বদ হাওয়া…

হুজুর বলল খামোশ! আমার মারিফতে সব সংবাদ আছে।

ফ্লাটের ক'জন মহিলা রান্নাঘরে ঢুকলো। কি কি সব জোগান-যন্ত করে রিদমা'র ঘরে চলে গেলো। আমিও পিছু নিলাম। রিদমা বেঘোরে ঘুমচ্ছে। আমার নিষেধাজ্ঞা পরোয়া করা হল না। মুরুব্বী খালাম্মারা আমারে মোটামুটি ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিল। ভেতর থেকে এখন লক। কিছুক্ষনের ভেতর রুমের ভেতর থেকে ভারিক্কি ফাটা গলার স্বর আসতে শুরু হল। দড়জার নিচের ফাকা দিয়ে ঝাঁঝালো গন্ধ। ভেতরে কেউ কেউ কাশছে। শুকনা মরিচ পুড়ার গন্ধে আমিও কাশতে শুরু করলাম। হুজুরের হাঁক ডাক পাওয়া যাচ্ছে, যা ভাগ ভাগ, এক্ষুণি যা, যা যা, খা খা খা পক্ষিলারে খা.. আরো অজিব শব্দমালা। হুজুরের সাথে সাথে রিদমার আওয়াজও আসছে। তবে হুজুরের ধমকের কাছে তা নিতান্তই ছেলেমানুষী।

এর ভেতরেই মনে হল আমার নাম ধরে কাঁদছে রিদমা। নিজেরে সংবরণ করতে চেষ্টা করেও পারলাম না। তুমি ডাকছ আমি নিরুত্তর থাকি কিভাবে! দরজা ধাক্কা দিই কিন্তু কেউ খুলে দিচ্ছে না। সে যেন আমার আক্ষেপ বুঝতে পারল। দরজায় দু'হাত রেখে আমিও তার ডাকের উত্তর করছি। লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে চাইছি সেগুন কাঠের দরজা। আমি বড্ড অসহায়! দরজা ভেঙে ফেলার শক্তি চেয়ে খোদার কাছে আমার চিৎকার খোদার আরশে পৌঁছুচ্ছে না…

যখন দরজা খুলা হল রিদমা বিধ্বস্ত ভাঙাচুরা এক মানুষ। এই মাত্র কিছুক্ষণ সময়ে যেন তার বয়স এক নক্ষত্র বছর বেড়ে গিয়েছে। সরু চোখে তাকাতে চেষ্টা করছে। আফসোস চোখ খুলে রাখার শক্তি নেই তার।

রহিমা খালা আর মুরুব্বিরা জানাল জিন স্যান্ডেল মুখে নিয়ে পালিয়েছে। প্রমাণ হিসাবে একপার্ট স্যান্ডেল দেখিয়ে বললো অন্য পার্ট জিনেই নিয়ে বারান্দা দিয়ে ভেগেছে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলাম সানসেটে আঁটকে আছে ডান পা'র স্যান্ডেল। সম্ভবত পালানোর সময় সানসেটের বুগি ট্রাপে আটকা পরেছিল জিন।

দুপুরবেলা জেগে উঠলো রিদমা। স্যালাইন দেয়া হয়েছে। মাথার ওপর ষ্টান্ড। চারিদিকে হাসপাতাল টাইপ ফিনাইলের গন্ধ। ফিনাইলের গন্ধে মাদকতা আছে কিনা পরীক্ষা করে জানা দরকার। দুজন সিষ্টার এসেছে শিফট ডিউটি করবে। সিষ্টার পাঠিয়েছে কোম্পানি। তাদের কথা হল বউকে ডাক্তার সিষ্টারের হাতে ছেড়ে দাও, আর নিজেরে ছেড়ে দাও কোম্পানির জন্য। ফ্যামিলির যাবতীয় দায় কোম্পানি নিলে তুমি কেন একশ ভাগ কোম্পানি-কে দিবা না! কে তাদের বুঝাবে আমি কর্পোরেটের রোবট মার্চেন্ট নই। আমি রক্ত মাংস'র এক মানুষ! রিদমাকে টাইগার শ্রিম্পের সুপ দেয়া হয়েছে। সে অতি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ওর তৃপ্তি দেখতে ভালই লাগছে।

অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ কষ্টিং প্রাইসিং এ মন দিলাম। কিছু আইডেন্টিটিকাল সুতাটুতা লাগবে। সেগুলোর সোর্সিং না করে উপায় নেই। এ সপ্তাহে এগুলো শেষ করে ফেললে কদিনের জন্য ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাব। রিদমারে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসা যাবে তখন।

দ্বিতীয় দিন কাটল ঝামেলা ছাড়া। আমিও আশ্বস্ত হলাম। তৃতীয় দিন রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ঝামেলা শুরু হল সেদিন। ২/১ বার নয়, ২৪ ঘণ্টায় কমসে কম সাত আটবার খিচ খেল। এবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া যুক্ত হয়েছে। আগে নিজে শুধু নিজেরে আঘাত করত, এখন সামনে যারা থাকছে তাদেরকেও আঘাত করছে। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙাচুড়াও হচ্ছে। তবে ইন্টারেষ্টিং যেটা দেখলাম আমি বাসায় উপস্থিত থাকলেই শুধু ঘটণা ঘটছে। আমি ছাড়া অন্য কাউরে আঘাত করেনি।

স্বাভাবিক ভাবেই নিজেরে দোষী মনে হল। সেই আঁটকে যাওয়া শিস-টা মাথার ভেতর ফিরে এলো। অফিস শেষে বাড়ি ফিরতে ভয় ভয় হয়। আমি না থাকলে যেহেতু সমস্যা হয় না তাই বাড়ি ফেরার সময় পিছিয়ে দিলাম। ফলে কাগজে কলমে উন্নতির দেখা পেয়ে নার্স তুলে নিল কোম্পানি। এভাবে বাড়ি না ফিরে বেঁচে থাকা যায় তবে মানুষ থাকা যায় না। আমারও তাই হল। ক্লাবে, পাবে, বিলিয়ার্ডে কাটতে থাকল আমার মধ্যরাতের সময়। যত কম সময় বাড়ি থাকি তত বেশী সময় ভালো থাকে রিদমা।

সিদ্ধান্ত নিলাম ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাব তারে৷ সেখানে পরীক্ষা নিরিক্ষার সুযোগ বেশি। রিদমা'র কাছে চেম্বারের কথা পারতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। উত্তেজিত হতে হতে আবারও ধনুকের মত বেঁকে যেতে থাকল। সারাদিন কাজ করে, বাড়ি ফিরেই ক্লান্ত দেহ বিছানায় ছেড়ে এলিয়ে যেতে ইচ্ছা হয়। এসব অশান্তি অসহ্য লাগে। আমি প্রার্থনা করলাম খোদা এরচে বরং আমারে শারীরিক অসুখ দিয়ে শায়েস্তা কর, তবুও তারে উন্মাদনা থেকে মুক্ত করে দাও…

এরমাঝে একদিন বিছানার তোষকে ম্যাচ ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দিল সে। আমি আগুন টের পেলাম যখন তীব্র ধোঁয়া খাবার টেবিল অবধি চলে এলো। সে আগুন জ্বালিয়ে শান্ত বালিকার মত আমার কাছে এসে বসেছে। তার দু'চোখ তখন শান্ত, স্বচ্ছ মুখে পরিতৃপ্ত হাসি।

এরপর আর অপেক্ষা করা যাই না। এম্বুলেন্স ডেকে জোর-জবস্তি করে নিয়ে গেলাম বান্ধবীর হাসপাতালে। সমস্যা খুলে বললাম। সে অভয় দিল। না জানিয়েই ডেকে পাঠালো রিদমার বাবা-কাকাদের। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম বটে। আমার পছন্দ না দুজনের সমস্যা অন্য কেউ জানুক। তার বাবা-মা আসার আগেই আমারে ডেকে পাঠালো ডাক্তার। বলল, চল সামনের কফি শপে বসি। আমিও মাথার ভেতর আঁটকে থাকা সেই শিস নিয়ে গেলাম তার সাথে সাথে। আর হুম ইতিমধ্যেই কোম্পানি থেকে দু মাসের অগ্রিম বেতন চলে এসেছে একাউন্টে। সাথে ডিসচার্জ লেটার-ও।

বলল শুনো আমি যা বলি সব মন দিয়ে। প্রশ্ন করবে না কোন, বাড়তি কিছু জানতেও চাইবে না। রিদমা-রে যেভাবে ইঞ্জেকশন পুশ করা হচ্ছে তা দেখে আমার বেশী কষ্ট হচ্ছে কি না জানতে চাইলো। একটা মানুষ-রে ইঞ্জেকশন পুস করতে দুই তিনজন মিলে হাত-পা চেপেও যখন ধরে রাখা যায় না- তখন ভালো লাগবে কিভাবে? - পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম আমি।

ডাক্তার বলল শুনো আজ তোমার পেসেন্ট সুস্থ হয়ে যাবে। বাবা-মামারা মানে তোমার শশুরবাড়ির লোকেরা চাইবে আজই রিলিজ নিতে। তুমিও হয়তো রিলিজ-ই চাইবে। তবে আজ মোটেও রিলিজ নেবে না। অন্তত আজ রাতে তো নয়-ই।

আমি ভ্রুকুঞ্চন করে জিজ্ঞেস করলাম ভেঙে বল। আমি বুঝতে পারছি না।

আমি আগেই বলেছি বাড়তি কিছু জানতে চাইবে না। সে উত্তর দিল।

শুনো রিদমা'র যে অসুখ এর কোন চিকিৎসা আসলে নেই। আবার এই অসুখের অনেক চিকিৎসাই প্রচলিত আছে। সেসব ট্রিটমেন্টে কাজ হয় না, তা কিন্তু না। হুম ট্রিটমেন্ট কাজ হয় কিন্তু অসুখ ভালো হয় না। বাড়িতে হুজুর এনে যে মরিচ-পুড়া চিকিৎসা দিয়েছিলে সেটাও কিন্তু কার্যকর ছিল। আবার আমার এখানে যে চিকিৎসা হচ্ছে সেটাও কার্যকর।

আমি বললাম তুমি কি বলছ নিজেই কি তার মাথামুণ্ড কিছু বুঝছ?

এবার বিদ্রূপাত্মক একটা বাঁকা হাসি সে দিল আমাকে। বলল আমি যা বলছি তা কোন ডাক্তার ইথিকালি পেসেন্ট পার্টি-কে বলে না, বলবেও না। আমি বলছি কারণ আমি আগে বন্ধু তারপর ডাক্তার৷

শুনো হুজুরের মরিচ-পুড়া ট্রিটমেন্ট আরো দু-একদিন চললে হয়তো হাসপাতালে আসতে হত না তোমাদের। আমি শুধু শুকনা মরিচের বিপরীতে মাসলে ডিষ্টিল ওয়াটার পুশ করেছি। ইচ্ছা করেই বেশী বেশী ব্যথা দিতে বলে দিয়েছি ডিউটি ডাক্তারকে৷ খেয়াল করেছ নিশ্চয় কোন সিষ্টার ইঞ্জেক্ট করেনি রিদমারে।

এই রোগ ভালো করতে রোগীর চেয়ে একটু বেশী চতুর হতে হয়, একটু বেশী ধৈর্য ধরতে হয় আর শক্ত হতে হয়৷

বললাম; কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। লেডি ডাক্তার বলল, ৩৫০০০ টাকা বিল হবে কাল পর্যন্ত। ডিস্কাউন্ট করার কথা বলে দিয়েছি। থার্টি পার্সেন্ট ডিস্কাউন্ট ইজ ফেরার এনাফ আই থিংক।

তোমার আরেকটা কাজ বাকি থাকছে। রিদমারে কাল বাসায় নিয়ে যাবার আগে তুমি আজই বাসাতে যাবা। গিয়েই উইথ ব্যাগ এন্ড ব্যগেজেস রহিমা আপারে বিদায় করবে। ইনক্লুডিং দ্যা সো কলড কাজিন। আই মিন রহিমা খালার ছেলে। তাদের ব্যবহার করা যাবতীয় যা আছে সব ধুয়েমুছে দিবা। যেন রহিমারা কেউ কোন দিন ছিলই না কোথাও।

যা বুঝার বুঝে ফেলেছি আমি। সকাল বেলা বিল পে করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। আমি ড্রাইভ করছি পাশে বসেছে রিদমা। তারে আজ অপ্সরাদের মত লাগছে। তবে রহিমা খালা আর তার ছেলেকে অবশ্য বিদায় দিলাম না। কিছুই বলব না মনস্থ করলাম।

ওরে রুমে শুইয়ে দিয়ে একটা চুমু দিলাম ঠোঁটে। তার চোখের জল গড়িয়ে পরছে। আমার হাত-টা ছুঁয়ে বলল I'm sorry..

রুম থেকে বেড়িয়ে খালারে বললাম এক-জগ ঠাণ্ডা পানি দেন আপনার আপারে। তার সাথে কথাবার্তা বলেন, সময় দেন। খালা আর তার ১৮ বছরের ছেলে দু'জন মিলে রুমে ঢুকে গেলো। আমি পকেট থেকে গুনে গুনে পাঁচটা লাইটার বের করলাম। মোনালিসা পোর্ট্রেটের নিচে রাখা ওভেনের ভেতর গ্যাস লাইটগুলো রেখে টাইট করে ঢেকে দিলাম। ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড গুলো যতটা সম্ভব ন্যকেড করে দিলাম। কেটে দিলাম গ্যাসের পাইপ। হায়েষ্ট টেম্পারেচার সিলেক্ট করে টাইমার সেট করলাম ওভেনে। ওভেন গরম হতে শুরু করেছে।

আমার গাড়ি ষ্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। Dohs পেরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে উঠে এসেছি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো আমার উল্টো পাশ দিয়ে ছুটে চলছে। ওদের গন্তব্য আমার জানা...

ওভার ড্রাইভ এক্টিভ করে মিউজিক সিষ্টেম প্লে করে দিলাম ..

Walking Down d Street, Distant Memories R Buried In d Past Forever I Follow D Moskva Down 2 Gorky Park Listen 2 d Wind Of Change Take Me 2 d Magic Of d Moment On a Glory Night Where D Children Of Tomorrow share Their Dreams With U n Me.. The Future's In d Air I Can Feel it Every Where Blowing In D Wind of Change

মাথার ভেতর আঁটকে যাওয়া সেই হুইসেলের সুর খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে।।

#বনল
সাঁঝবাতি
১৩ই অক্টোবর

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:০৫
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×