তাকিয়া [ধর্মীয় কারণে মিথ্যাচার]তে অভ্যস্ত শিয়ারা যেমন মুসলিমদের সামনে এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে, তেমনি কিছু সরলপ্রাণ মুসলিম ভাই মনে করেন -- "শিয়াদের যতই ভিন্ন মত থাকুক, ওরাও তো আমাদের মত একই কুরআনে বিশ্বাস করে!"
কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কি শিয়ারা দ্বীন ইসলামের কিতাব আল কুরআনে পূর্ণরূপে বিশ্বাস করে?
শিয়াদের ধর্মীয় বিধি-বিধানের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে - মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনীর ‘আল কাফী’ (الكافي)। এটি তাদের নিকট সব থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য "হাদিস" গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ৩টি খণ্ডের ১ম অংশ উসুলুল কাফী (أصول الكافي) তে শিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস সন্নিবেশিত আছে। তাদের আকিদার রেফারেন্স দিতে হলে এই কিতাব থেকেই দিতে হবে। এই আকিদা না মানলে সে মূলধারার শিয়াই না। এই গ্রন্থে باب أنه لم يجمع القرآن كله إلا الأئمة و أنهم يعلمون علمه كله অধ্যায় [ইমামগণই আল-কুরআনকে পরিপূর্ণ সংকলন করেন এবং তারাই তার পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে] শিরোনামের অধীনে বর্ণনা করা হয়েছে:
“জাবের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ জাফর(আ) [জাফর সাদিক]-কে বলতে শুনেছি, মানুষের মধ্যে মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউ দাবি করতে পারে না যে, আল্লাহ যেভাবে কুরআন নাযিল করেছেন, সে তা পরিপূর্ণভাবে সেভাবে সংকলন করেছে; বরং আলী ইবন আবি তালিব ও তার পরবর্তী ইমামগণই আল্লাহ যেভাবে তা নাযিল করেছেন, ঠিক সেভাবে সংকলন ও সংরক্ষণ করেছেন।”
কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের ৬৭ পৃষ্ঠায় (ভারতীয় ছাপা) আরও বর্ণনা করেন:
.
“আবূ আবদিল্লাহ[জাফর সাদিক] বললেন: “… যতক্ষণ না কায়েম বা মাহদীর উত্থান ঘটবে, যখন সে কায়েম বা মাহদীর উত্থান হবে, তখন আল্লাহর কিতাবকে তার সীমারেখায় রেখে পাঠ করা হবে; আর তিনি কুরআনের ঐ কপিটি বের করবেন, যা আলী(আ) লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
তিনি আরও বললেন, আলী(আ) যখন তা লিপিবদ্ধ করে অবসর হলেন, তখন তিনি জনগণের নিকট তা বর্ণনা করলেন এবং তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন: এটা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব, যেমনিভাবে তা মুহাম্মাদ(ﷺ)এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন; আমি দু’টি ফলক থেকে তা সংকলন করেছি।
তখন লোকেরা বলল: আমাদের নিকটে তো কুরআন সংকলিত রয়েছে; এর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। অতঃপর আলী বললেন: জেনে রাখ! আল্লাহর শপথ, আজকের এই দিনের পরে তোমরা তা আর কখনও দেখতে পাবে না; কারণ, যখন আমি তা সংকলন করি, তখন আমার উপর দায়িত্ব ছিল যে, আমি তা তোমাদেরকে জানাব, যাতে তা তোমরা পাঠ করতে পার।”
.
নাউযুবিল্লাহ, কুরআন বিকৃতির তত্ত্ব কেউ বিশ্বাস করলে তার ঈমান থাকার কথা নয়; আর তারা সেই কুফরী বিশ্বাসটিকে মহান সাহাবী আলী(রা) এর দিকেই সম্পর্কযুক্ত করল। -_-
.
শিয়ারা তাদের ‘কুরআনের’(!) তাফসিরগুলোতে মুসলিম উম্মাহর আল কুরআন নিয়ে কী মন্তব্য করে? চলুন দেখি।
.
শিয়া মুফাসসির মোল্লা হাসান তার তাফসিরের শুরুর অংশে উল্লেখ করেন:
“আবূ জাফর(আ) [জাফির সাদিক] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যদি আল্লাহর কিতাবের মধ্যে কম-বেশি করা না হত, তবে কোন বিবেকবানের কাছেই আমাদের হক (অধিকার) গোপন থাকত না।”
[মোল্লা হাসান, তাফসীরুস সাফী (تفسير الصافي), পৃ. ১১]
শিয়া আলেম নুরী আত-তাবারসী ‘ফসলুল খিতাব’ (فصل الخطاب)-এর মধ্যে বলেন:
“আমীরুল মুমিনীনের [অর্থাৎ আলী(রা)] একটি বিশেষ কুরআন ছিল, যা তিনি রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ইন্তিকালের পর নিজেই সংকলন করেন এবং তা জনসমক্ষে পেশ করেন; কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে। অতঃপর তিনি তা তাদের দৃষ্টি থেকে গোপন করে রাখেন; আর তা ছিল তার সন্তান তথা বংশধরের নিকট সংরক্ষিত, ইমামত তথা নেতৃত্বের সকল বৈশিষ্ট্য ও নবুয়তের ভাণ্ডারের মত যার উত্তরাধিকারী হয় এক ইমাম থেকে অপর ইমাম। আর তা প্রমাণ (মাহদী) এর নিকট সংরক্ষিত রয়েছে। -আল্লাহ আল্লাহ দ্রুত তাকে মুক্ত করে দিন- ; তিনি তখন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন এবং তাদেরকে তা পাঠ করার নির্দেশ দিবেন; আর তা সংকলন, সূরা ও আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতার দিক থেকে বিদ্যমান এই কুরআনের বিপরীত; এমনকি শব্দসমূহও কম-বেশি করার দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিপরীত। আর যেখানে সত্য আলী’র সাথে; আর আলী সত্যের সাথে, সেখানে বিদ্যমান কুরআনের মধ্যে উভয়দিক থেকেই পরিবর্তন রয়েছে; আর এটাই উদ্দেশ্য।”
[ফসলুল খিতাব (فصل الخطاب), পৃ. ৯৭]
.
হ্যাঁ, সে (নূরী তাবরসী) এ রকম ভাষ্য ও শব্দে এ জঘন্য কথাটি বলেছে, নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ এদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন।
হোসাইন আন-নুরী আত-তাবারসী ‘ফসলুল খিতাব’ (فصل الخطاب) নামক গ্রন্থের মধ্যে আরো বলেন:
“অনেক প্রবীণ রাফেযীর নিকট থেকে বর্ণিত আছে যে, আমাদের নিকট যে কুরআন বিদ্যমান আছে, তা ঐ কুরআন নয়, যা আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ(ﷺ) এর উপর নাযিল করেছেন; বরং তা রদবদল করা হয়েছে এবং করা হয়েছে তাতে কম-বেশি।”
[ফসলুল খিতাব (فصل الخطاب), (ইরানি সংস্করণ) পৃ. ৩২]
শিয়া মুফাসসির মোল্লা হাসান বর্ণনা করেন:
“আবূ জাফর থেকে বর্ণিত, আল-কুরআন থেকে অনেক আয়াত বাদ দেয়া হয়েছে; আর কতগুলো শব্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
[মোল্লা হাসান, তাফসীরুস সাফী (تفسير الصافي), পৃ. ১১]
মোল্লা হাসান আরও বলেন:
“আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের সুত্রে বর্ণিত এসব কাহিনী ও অন্যান্য বর্ণনাসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আমাদের মধ্যে প্রচলিত কুরআন [[ অর্থাৎ যেই কুরআন মুসলিম উম্মাহ পাঠ করে ]] মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর অবতীর্ণ কুরআনের মত পরিপূর্ণ নয়; বরং তার মাঝে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার পরিপন্থী আয়াত যেমন রয়েছে; আবার তেমনি পরিবর্তিত ও বিকৃত আয়াতও রয়েছে। আর তার থেকে অনেক কিছু বিলুপ্ত করা হয়েছে; তন্মধ্যে অনেক জায়গায় আলী’র নাম বিলুপ্ত করা হয়েছে; আবার একাধিক বার "آل محمد" (মুহাম্মদের বংশধর) শব্দটি বিলুপ্ত করা হয়েছে; আরও বিলুপ্ত করা হয়েছে মুনাফিকদের নামসমূহ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এটা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পছন্দসই ক্রমধারা অনুযায়ী সাজানোও নয়।”
[মোল্লা হাসান, তাফসীরুস সাফী (تفسير الصافي), পৃ. ১৩]
আর কুলাইনী বর্ণনা করেন:
“আবূ আবদিল্লাহ(আ) {জাফর সাদিক} থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নিশ্চয় জিবরাঈল আ. যে কুরআন মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট নিয়ে এসেছে, তাতে আয়াত সংখ্যা সতের হাজার।”
[উসুলুল কাফী (أصول الكافي), (ভারতীয় সংস্করণ) পৃ. ৬৭১]
শিয়াদের কাল্পনিক “কুরআনে”(??!!) আয়াত ১৭,০০০; অথচ আল্লাহ তা’আলা যেই কুরআন নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর নাজিল করেছেন, তার আয়াতসংখ্যা ৬২৩৬।
এরপরেও কেউ কিভাবে দাবি করতে পারে যে শিয়া ধর্মের লোকেরা মুসলিমদের আল কুরআনে বিশ্বাস করে? যারা আল কুরআনেই ঠিকমত বিশ্বাস স্থাপন করে না তারা আবার কেমন মুসলিম?
সম্মানিত কিতাব আল কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেন:
“আলিফ-লাম-মীম, এটা সেই কিতাব; এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তকীদের জন্য তা পথ প্রদর্শক”
(সূরা আল-বাকারাহ: ১-২)
তিনি আরও বলেন:
“আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক”।
(সূরা আল-হিজর: ৯)
তিনি আরও বলেন:
“তাড়াতাড়ি ওহী আয়ত্ব করার জন্য তুমি তোমার জিহ্বা তার সাথে সঞ্চালন করো না। এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর; অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই।”
(সূরা আল-কিয়ামাহ: ১৬-১৯)
তিনি আরও বলেন:
“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা নিয়ে আস।”
(সূরা আল-বাকারাহ: ২৩)
আমরা দেখলাম যে শিয়ারা আলী(রা) এর নামে কিছু মিথ্যা ঘটনা তৈরি করেছে এবং আলী(রা) এর বংশধরদের অর্থাৎ তাদের ইমামদের উপর এক “কাল্পনিক কুরআন” এর মতবাদ সৃষ্টি করে তাতে বিশ্বাস করেছে। মুসলিম উম্মাহ যে কুরআন পড়ে, তাকে তারা বিকৃত মনে করে। তাদের নিজ গ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্টভাবে এসব জিনিস লেখা আছে। অথচ আল্লাহ তা’আলা নিজেই আল কুরআনে এর সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন। মুসলিম আলেমগণ যুগে যুগে এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে গিয়েছেন। যেখানে কুরআনের একটি আয়াত অবিশ্বাস করা কারো ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট সেখানে পুরো আল কুরআনকে বিকৃত বলে বিশ্বাস করে যারা, তারা কিভাবে মুসলিম বলে গণ্য হতে পারে? আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকলেই বিশ্বাস করেন যে, ‘আল-কুরআন বিকৃত’-এই কথায় বিশ্বাসীরা কাফির, মুসলিম মিল্লাত (জাতি) থেকে বহিষ্কৃত। শিয়া আলেমদের এই বানোয়াট অভিযোগুলো লুফে নিয়ে আজ খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা আল কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপপ্রচার চালাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:২৮