আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কখনও কিছু লেখার সাহস করিনি। সত্য মেনে নিতে দোষ নেই। আমাদের নীতিনির্ধারকবৃন্দ এ খাতটিকে কি লেভেলের প্রায়োরিটি দেন এবং কি চিন্তা করে বারবার এই পলিসি সেই পলিসিতে পরিবর্তন আনেন তা আমার মাথার ঠিক তিন হাত উপর দিয়ে যায়। আর আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের এদেশের শিক্ষা পলিসি নিয়ে থিসিস শুরু করে দেয়াটা রীতিমত আমাদের জন্য কাইন্ড অফ বিলাসিতা তথা সময় নষ্ট করা যেখানে বড় বড় শিক্ষাবিদরাই ঝিম ধরে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না।
ওই প্রসঙ্গে আর না গেলাম। আজকে হঠাত করে রাত সাড়ে তিনটা বাজে এই শিক্ষা খাত নিয়ে কিছু লেখার সাহস করে ফেলার যথেষ্ট কারণ অবশ্য বিদ্যমান। আস্তে আস্তে আসছি। প্রথমত বলে নেই আমার মত এভারেজ ক্যাটাগরির স্টুডেন্টের নিজের অযোগ্যতা বলেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয় নাই। তার পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে যেই আভাসটি দিলাম সেদিকে আজ আর না যাই। হুট করেই দুঃখবোধটা না বাড়াই। তবে প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার ছিল না এটা বলে দিচ্ছি কারণ আজকাল সকল ব্যর্থতার পিছনেই সবাই কেন যেন এই নারীঘটিত ব্যাপারগুলোই খুঁজে বেড়ায়!
যাই হোক, ২০১২ সালের শুরুতেই এডমিশন নিলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অবশ্যই প্রথম সারির একটি বলা যায়। আব্বা আম্মাকে অনেক রিকুয়েস্ট করেছিলাম যে আরেকটাবার ট্রাই করি। সেকেন্ড চান্সে যদি হয়ে যায়! নাহ বাবা মাকে মানানো গেল না। আমার এক বছর লস হয়ে যাবে সেটা তারা কোনভাবেই মানতে রাজি না। সব থেকে বড় কথা বাসায় বসে বসে আত্মীয়স্বজনের তিরস্কার সইতে হবে এটা আমার আম্মা হতে দিতে চাননি। সেবার তাদের ইচ্ছাতেই কেবল ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর জাহাঙ্গীরনগরের বাইরে কোথাও দেয়া হল না। একমাত্র ছেলে হওয়ার যে কেমন জ্বালা সেটা সেদিনই বুঝেছিলাম। চোখের সামনে বাবা মায়ের কষ্টগুলোকে মেনে নিতে হয়। আমার জন্য তাদের বুক ফাটে আর তাদের জন্য আমার বুক ফাটে এই হচ্ছে যখন অবস্থা তখন আর তাদেরকে কনভিন্স করা যায়নি। এন্ড অফ দ্যা ডে, আই হ্যাভ নো রিগ্রেটস। ব্র্যাকের কোয়ালিটি, স্ট্যান্ডার্ড কোন অংশেই খারাপ না। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব বেশ ভালই চলছিল ইভেন এখনও চলছে। তবে সত্যি কথা কি প্রাইভেটে এডমিশন নেয়ার ঠিক পর পরই একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে আমি ইতোমধ্যেই সমাজের একটা গ্রুপের তাচ্ছিল্যের পাত্র বনে গেছি। মাঝে মাঝেই কানে আসে ছেলে প্রাইভেটে পড়ে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনছে। খুব ক্লোজ একজন বলে তোমাদের আবার কিসের পড়াশোনা! পরীক্ষার আগের দিনই তো প্রশ্ন দিয়ে দেয়!! এসব টাইপের কথাবার্তা। কিছু বলি না বাট মনে মনে প্রচুর ঘৃণার জন্ম নিতে থাকে। আশ্চর্য হই এদের চিন্তাভাবনার লেভেল দেখে। ভেবে পাই না এরা এখনও কোন যুগে বাস করছে!! নাইনটিজ এর প্রাইভেট ভার্সিটি আর ২০১৫ এর প্রাইভেট ভার্সিটি মাঝখানের ফারাকটা যে কতটা এটা তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে না। সব প্রাইভেট ভার্সিটি যে অতিশ দীপঙ্কর আর দারুল ইহসান না এটা উনারা জানেন না। আর কখনও জানার চেষ্টাও করেন না।
কষ্টটা সেখানেও না। ধরেই নিলাম এরা আগের জেনারেশানের মানুষ এখনও পুরনো চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নাই। কষ্টটা হয় তখনই যখন দেখি আমাদের শিক্ষিত প্রজন্ম পাবলিক প্রাইভেট ডিভাইডেশানে জড়ায়! যখন ফেসবুকে গিয়ে দেখি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের ভাইয়া আপুরা আমাদের নানা বিশেষণ জুড়ে দেন। গাজা খাই, বাবা খাই, মাইয়া খাই, টাকার গরম দেখাই এসব কথাবার্তা! আরে ভাই আপনারা প্রাইভেটের কয়টা ছেলেমেয়েকে চিনেন? আমি যদি বলি আমি আজ পর্যন্ত একটা সিগারেট কি জিনিস মুখে দেই নাই আপ্নারা বিশ্বাস করবেন? না করলেও কিছু যায় আসেনা। কথা হচ্ছে কেন এই ডিভাইডেশান?? সব ভার্সিটিতে সব টাইপের ছেলে মেয়েই থাকে। সো কিছু মানুষকে দেখে পুরা সিস্টেমটাকে সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলে আসা সবাইকে জেনারালাইজ করে ফেলাটা একদম ঠিক না। সত্যিকার শিক্ষা মানুষের মনকে বিকশিত করে কলুষিত নয়। আরেকটা কথা প্রাইভেটে এত টাকা খরচ লাগে জেনেও সবাই ভাই মনের সুখে বা ভাব নিতে পড়তে আসে না। কিছু কিছু এরকম থাকতেই পারে বাট এক্সেপশান ক্যান নট বি এক্সাম্পুল। প্রতি বছর যে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এইচএসসি পাশ করে বের হচ্ছে তাদের অর্ধেকের সিটও তো পাবলিকে নাই ভাই। তাহলে কি এই বিশাল একটা গ্রুপ উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে? সেদিন দেখলাম একজন ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন তাহলে ন্যাশনালে পড়তে পারে না! ন্যাশনাল খারাপ না। নো অফেন্স উইথ দ্যাট। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভাই সবারই জানা। সরকারের এত নেগলিজেন্স আর অথুরিটির অনিয়মের কারণে ন্যাশনাল আজ ধুকে ধুকে মরছে। চার বছরের গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করতে লাগে ছয় বছর সাত বছর! এগুলো আপনারা জানেন না? তাহলে এরকম কেন বলেন? আমরা আপনাদের ভাই না? তাহলে সঠিক সাজেশানটা দিতে দোষ কিসে? মধ্যবিত্ত যারা কোনমতে খেয়ে না খেয়ে এফরড করে ফেলতে পারবে তাদের উচিত না মোটামটি ভাল একটা প্রাইভেটে এডমিশন নিয়ে চার বছরে গ্র্যাজুয়েশানটা কমপ্লিট করে তাড়াতাড়ি সংসারটার হাল ধরা? এর মধ্যে ভাল রেজাল্ট করতে পারলে তো টিউশন ওয়েভার আছেই তাই না! বুঝাতে পারছি আমি? বিশ্বাস করেন আর না করেন এসব প্রাইভেটের আজ ৭০% এর বেশি স্টুডেন্ট হচ্ছে মধ্যবিত্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা। আমি নিজে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।
এবার আসি ৭.৫% ভ্যাট প্রসঙ্গে। সরকারের এই সিদ্ধান্তটা কতটুকু যৌক্তিক এখন আশা করছি সবাই কিছুটা হলেও জাজ করতে পারছেন। ৭০% ছেলেমেয়ে যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সো তাদের জন্য এক্সট্রা ৪/৫ হাজার টাকা মানে অনেক কিছু ভাই। যেখানে ৭ হাজার টাকা হলে পুরো মাস চলে যায়!! কিন্তু এই কথাটাই সরকার এমনকি আমাদের অনেকই বুঝতে চাচ্ছে না। আচ্ছা শিক্ষাটা কি পণ্য? তাহলে কেন মরার উপর এই খাড়ার ঘা চাপানো!! কোন যুক্তিতে?? মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাহেব হিসেব দেখিয়েছেন প্রাইভেটের প্রত্যেক্টি ছেলেমেয়ের দৈনিক খরচ নাকি ১০০০ টাকা! কথাটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য তা বুঝার অবকাশ থাকে না। হুম এরকম হয়ত আছে বাট তাদের পরিমানটা খুবই হাতেগোনা। বেশিরভাগই কিন্তু হচ্ছি আমরা যারা বাবার গায়ের রক্ত পানি করা আর জায়গা জমি বিক্রি করা টাকায় পড়াশোনা করছি। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এরকম মজা করার কোন রাইটস সরকারের নাই। একদিকে দেশের সব নিত্যপন্যের দাম আকাশচুম্বী। অন্যদিকে বেড়েছে সব ইউটিলিটি বিল, বেড়েছে ট্রান্সপোরটেশান কস্ট। তার উপর তারা ৭.৫% ভ্যাট টা দাবি করে বসেন কিভাবে?? উনারা সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন ১০০% বৃদ্ধি করেছেন কিন্তু আমাদের বাবাদের বেতন তো এক টাকাও বৃদ্ধি পায় নাই! এটাও তো তাদের বুঝা উচিত। অর্থমন্ত্রী এক একবার এক একরকম মন্তব্য করেই যাচ্ছেন। এনবিআরের ব্রিফিং এ বলা হল ভ্যাট নাকি ভার্সিটি অথুরিটি দিবে! এটা কি আদো সম্ভব? ভ্যাট টা কারা দেয়? যারা এন্ড ইউজার তারাই তো নাকি? এখানে আমরাই তো এন্ড ইউজার। তাহলে কেন এই টোপ গেলানো? ভার্সিটির অথুরিটি এখন হয়ত সরকারের চাপে পরে বলছে এই বছর আমাদের ভ্যাট দিতে হবে না বাট পরের বছর তো তারা ঠিকই আদায় করবে! হয়ত সরাসরি ভ্যাটই ধরবে না হয় আমাদের আদার খরচগুলো (স্টুডেন্ট এক্টিভিটি ফি, লাইব্রেরী ফি, ল্যাব ফি) এগুলো বাড়িয়ে দিবে। তখন সরকারের তো কিছুই করার থাকবে না তাই না!
এখন আপনারাই বলেন এই অযৌক্তিক ভ্যাট আরোপের কোন মানে হয়? আমাদের আন্দোলনে নামাটাই কি স্বাভাবিক নয়? শিক্ষাকে পণ্য বানানোর এই পায়তারা রুখে দেয়া কি আমাদের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে পরে না? এখানে পাবলিক প্রাইভেট বিতর্কটাই বা আসবে কেন!! তবে আশার কথা হচ্ছে আস্তে আস্তে পাবলিক ভার্সিটিগুলোও আমাদের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা শুরু করেছে। দ্যাট ইজ দ্যা পজিটিভ সাইট। দেশটা তো আমাদেরই তাই না? কর্মক্ষেত্রে কি আমরা পাবলিক প্রাইভেট খুঁজি? সবাই কাঁধে কাধ মিলিয়ে যেভাবে দেশের সেবা করে যাই ঠিক সেভাবেই কি আমরা সবাই মিলে পারি না জাতি গড়ার মেরুদন্ড শিক্ষাখাতকে এই অন্যায় ভ্যাট আরোপের মত নেক্কারজনক পদক্ষেপ নেয়া থেকে সেইভ করতে? আমাদের প্রজন্ম তাকিয়ে আছে... আমাদেরকে যে পারতেই হবে! চলুন সবাই কন্ঠে আওয়াজ তুলি-
#শিক্ষা কোন পণ্য নয়
#নো ভ্যাট অন ইডুকেশান
No VAT on Education- A Request to Honorable Prime Minister Sheikh Hasina
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৩৮