-“স্যার,একজন বৃদ্ধলোক আপনার সাথে দেখা করতে চান।আমি উনাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলেছি।”
-“ওহ উনাকে ভিতরে আসতে বলুন।”
কথা বলছিলো ফাহাদ এবং তাঁর অফিসের পিয়ন রহমতের সাথে।ফাহাদ ৪ বছর হল বিয়ে করেছে।একটা ৩বছরের সন্তানও আছে।
একটু পর একজন অতি বৃদ্ধ লোককে নিয়ে আসলো রহমত।হাতে একটা লাঠি।বয়সের ভারে বেচারা নুইয়ে পড়েছে।মুখে সাদা সাদা দাঁড়ি,পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া,চোখে চশমা। চশমার ফাঁক দিয়েও দেখা যায় ঐ ব্যক্তির চোখের নিচে কালি পড়েছে।লোকটা ধীরে ধীরে ফাহাদের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো।
ভদ্র মহাশয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলো ফাহাদ।লোকটি বলল,“আমার নাম আবুল কাশেম।”
নামটা শুনতেই চমকে উঠলো ফাহাদ।লোকটিকে ভালো করে দেখলো ফাহাদ।আরে এ যে ফাহাদের কাশেম স্যার!!আজ উনার জন্যই তো ফাহাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
১০বছর আগের কথা।ফাহাদের বাবা তাকে রেখে মারা গিয়েছিলেন।তাঁর পরিবার বলতে শুধু ছিলেন তাঁর মা।বাবার সঞ্চয় বলতে কিছুই ছিলো না।কারণ উনি ছিলেন দিনমজুর।এমনিতেই দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটতে কষ্ট হত।তার উপর বাবা মারা গেলেন।সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়লো তাঁর মায়ের উপর।
বাবার ছিলো না কোন পৈতৃক সম্পদ।তাই বাধ্য হয়ে তাঁর মাকে বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে হত।ফাহাদ তখন ক্লাস সিক্সে পড়তো।ফাহাদ খুব ভালো ছাত্র ছিল।এমনকি সে ৮ম শ্রেণীতে বিশেষ বৃত্তিও পেয়েছিল। আস্তে আস্তে ফাহাদ দশম শ্রেণীতে উঠে।
অনেক কষ্ট করে মা তাকে পড়াশুনা করাতেন।কিন্তু আস্তে আস্তে মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে।একসময় ফাহাদের জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নেয় ‘মা’ নামক অমূল্য সম্পদটি।অভাগার কপালে হয়ত অজস্র দুঃখ লিখে দিয়েছিলেন বিধাতা।
ফাহাদের পড়ালেখা থমকে দাঁড়ায়।কিছুদিন সে স্কুলে যেত।কিন্তু ক্রমেই সে পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যায়।এস.এস.সি পরীক্ষার সময় এসে যায়।কিন্তু এখন ফাহাদের রেজিস্ট্রেশন করা হয় নি।আর রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে ছিলেন এই কাশেম স্যার।কাশেম স্যার ফাহাদকে খুব আদর করতেন।এমনকি ফাহাদ ছিল উনার খুব প্রিয় একজন ছাত্র।কিন্তু প্রিয় ছাত্রের এরকম পড়া ছেড়ে দেয়া তাঁর মনকে বিষণ্ণ করে তুলে।
ফাহাদ একটা রেস্টুরেন্টের মেসিয়ার হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছিলো।কারণ ও মনে করেছিলো বিধাতা হয়ত তাঁর কপালে সুখ লিখে দেন নি।
পরেরদিন কাশেম স্যার ফাহাদ যেখানে কাজ করত সেখানে আসেন।
-“কি, পরীক্ষা দিবি না কেন?”
-(মাথা নিচু করে) “টাকা নেই,স্যার।”
স্যার ফাহাদের কান ধরে টেনে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।বলেছিলেন,
“গাধা,তর কাছে যে টাকা নেই সে কথা আমায় বলিস নি কেন?”
স্যারের একটা বাইসাইকেল ছিলো।এটা চড়ে তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসতেন।স্যারের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না।৮ সদস্যের একটা সংসার চালাতেন একাই।একই তো মাসের শেষ ছিলো।তাই হাতে কোন টাকা পয়সা ছিলো না।বাধ্য হয়ে নিজের প্রিয় সাইকেলটা বিক্রি করে ফাহাদের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলেন।
ফাহাদের পড়াশুনা আবার চলতে লাগলো।স্যার এক সময় এসে ফাহাদকে পড়াতেন।এস.এস.সি পরীক্ষা দেয় সে।
ফাহাদ জিপিএ ৫ পায়।স্যারকে বলার জন্য সমস্ত স্কুল তন্ন তন্ন করে খুজে।কিন্তু পায় নি।পরে শুনতে পায় স্যার তাঁর পরিবারসহ একটা কাজের জন্য ঢাকায় গেছেন।আসতে মাসখানেক লাগবে।
ফাহাদ নিরাশ হয়ে মাসখানেক অপেক্ষা করে।এরই মধ্যে ফাহাদ একটা গ্যারেজেও ঢুকে গেছে।কলেজে ভর্তির টাকাটাও গ্যারেজের ম্যানেজারের কাছ থেকে ধার নিয়েছে।দিনবেলার কলেজ শেষে কাজ করতো।আর রাতে পড়াশুনা করত।
২ বছর পার হয়ে গেলো।কিন্তু এখনো স্যারের দেখা মেলেনি।এইচ.এস.সি পাশ করে।পরে BBA ও MBAকরে।আর এখন একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে।
স্যারের কথা ফাহাদ ভূলেই বসেছিলো।কিন্তু স্যারের এই হঠাৎ আগমন ফাহাদকে সেই ১০বছরের ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।আর এই স্মৃতিগুলো ২ ফোঁটা চোখের জল হয়ে দু'চোখের কোণে জমা হয়।
স্যার এসেছেন তাঁর কাছ থেকে সাহায্য নিতে।কিন্তু স্যার জানেন না যে আজকের এই প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিটি সে-ই ফাহাদ।
ফাহাদ আর পারলনা নিজেকে সামলাতে।চেয়ার থেকে উঠে সরাসরি স্যারের পায়ে ধরে অঝরে চোখের অশ্রু ফেলতে থাকে।
-“এ কি করছেন? আমার পায়ে ধরে কাঁদছেন কেন?”(স্যার)
-“স্যার,আমায় আপনি ক্ষমা করে দিন স্যার।আমি আপনার খোজ খবর নেই নি।“
-“আপনি কি সব উল্টা-পাল্টা বকছেন?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
-“স্যার,আমি ফাহাদ।”
-“কোন ফাহাদ?”
-“রেশমপুরের সেই ফাহাদ।যার রেজিস্ট্রেশনের জন্য আপনি নিজের সাইকেল বিক্রি করেছিলেন।”
এতক্ষণ কাশেম স্যার ফাহাদকে চিনতে পারলেন।উনার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।তারপর ফাহাদকে দুই হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করলেন।ফাহাদ নিজেই দাঁড়িয়ে গেল।আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন কাশেম স্যার।তারপর ফাহাদকে বললেন, “ছেলেরা বড় হলে পায়ে থাকে না।ওদের জায়গা হয় এখানে (নিজের বুককে নির্দেশ করে)”
সেদিন স্যারের আদর্শে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ফাহাদ।আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্যারের বুকে ঠাই পেয়ে পরম শান্তি অনুভব করল।
যিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ফাহাদকে মানুষের মতো মানুষ করেছিলেন।আজ তাঁর এমন অবস্থা কেন?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কাশেম স্যারের ললাট সামান্য কুঞ্চিত হয়।তারপর অশ্রুভরা চোখ নিয়ে উত্তর দিলেন,
“সবই আমার ভাগ্য।একজন আদর্শবান শিক্ষক হয়েও নিজের সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করতে পারলাম না।রেশমপুর নামক গ্রাম ছেড়ে গিয়েছিলাম প্রধান শিক্ষকের মিথ্যা অপবাদের কারণে।তারপর ঢাকায় গিয়ে একটা স্কুলে চাকুরী পাই।নিজের সন্তানদের আমার আদর্শে চলার কথা বলি।কিন্তু একটা সময় আসে,আমার সন্তানরা আমার কথার গুরুত্ব দিত না।তাঁরা তাদের মতো করে চলতো।ছেলেরা অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরত।আর মেয়েটা ওর মতো করে চলতো।মেয়ের বিয়ে দিলাম।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!দুর্ঘটনায় মুনাসহ (‘মুনা’ স্যারের মেয়ের নাম) ওদের পরিবারের সবাই মারা যায়।আমি তো পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।মুনার মাও স্ট্রোক করে আমায় একা রেখে চলে গেল। ছেলেরা একে একে সবাই বিয়ে করল।সবাই আলাদা হয়ে গেল।কিন্তু আফসোস এই যে,একজনও আমায় তাদের সংসারে রাখতে চাইলো না।আমি ওদের কাছে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ালাম।
কোন এক ভোরে একটা লাঠি আর একখানা পুরনো চাদর সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে।এখানে এসে জানলাম ফাহাদ নামের কে একজন মানুষকে সাহায্য করে।তাই চলে এলাম সাহায্য নিতে।আর তখন তো জানতাম না যে,তুই আমার সে-ই ফাহাদ।তুই কি আমায় সাহায্য করবি,বাবা?”
ফাহাদ এতক্ষণ নিরবে সব কথা শুনছিলো।স্যারের দিকে তাকালো।ওর (ফাহাদের) চোখ দু’টি লাল বর্ণ ধারণ করলো।আর কিছু বলল না।সরাসরি স্যারের হাত ধরে ওর বাসায় নিয়ে গেল।
কলিংবেল টিপতেই এক সুন্দরী রমনী দরজা খুলে দিলেন।ফাহাদের সাথে এমন উদ্ভট টাইপের একটা লোক দেখে তাঁর মুখটা কালো হয়ে গেল।
-"রিয়া,এই আমার কাশেম স্যার।যার কথা আমি তোমায় বলেছিলাম।"(ফাহাদ)
-"স্লামুলাইকুম।"(গম্ভীর সুরে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল রিয়া)
-"ওয়ালাইকুমাস সালাম।কেমন আছো,মা?"
-"জ্বি,ভালো।"
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাহাদ বলে উঠলো, “চলুন,স্যার,ফ্রেশ হয়ে,খেয়ে-দেয়ে তারপর কথা হবে।”ফাহাদ স্যারকে ধরে গেস্ট রুমে নিয়ে গেল।
রাতের খাবার শেষে কাশেম স্যার গেস্ট রুমে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন।হঠাৎ ফাহাদের ঘর থেকে কার গলার আওয়াজ শুনা গেল।
-“আমি পারবো না।আমার ঘরটাকে কি আশ্রম পেয়েছ না কি?কালকের মধ্যে যদি ঐ গাইয়্যা লোকটা না যায়, তাহলে আমি আর রিফান(ফাহাদের ছেলে) চলে যাবো।”
-“এসব তুমি কি বলছ?আমি স্যারের জন্য এতো বড় হয়েছি।আমি ছাড়া এখন উনার আর কেউ নেই।এখন আমি উনাকে কি করে চলে যেতে বলি?আমি কখনোই পারবো না।তোমার ইচ্ছে হয় তুমি চলে যাও।”
-( চোখভরা অশ্রু নিয়ে) “এটাইতো তোমার বলা বাকি ছিলো।আমি কালই রিফানকে নিয়ে ওর নানু বাড়ি চলে যাব।”
এই বলে রিয়া শুয়ে পড়লো।ফাহাদ চোখ দু’টো লাল করে বসে রইলো।
ও ঘর থেকে স্যার সবকিছু শুনতে পেলেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।হয়ত এই দীর্ঘশ্বাসের মানে,“যার তারুণ্য নেই,তার কেউ নেই।”
সকালে স্যার ফাহাদকে ডাকলেন।স্যারের ডাকে ফাহাদ রুমে গেল।ফাহাদ দেখলো স্যার নিজের পুরনো চাদরটা নিজের কাঁধে নিয়েছেন।
-এখানে বস।
ফাহাদ বাধ্য ছেলের মতো বসল।
-মন খারাপ কেন?কি হইছে তোর?
-কই?কিছু না।
-মিথ্যে বলছিস কেন?আমি সব শুনেছি।
-(ফাহাদ বিস্মিত হয়ে স্যারের দিকে তাকালো)
-দেখ,এরকম আলিশান বাড়িতে থাকাটা হয়ত বিধাতা আমার কপালে লিখে দেন নি।সেজন্যই তো নিজের সন্তানের বাসায়ই থাকতে পারলাম না।আর তুই তো আমার সেই কবে কার ছাত্র।তোর একটা ভবিষ্যৎ আছে।আমি না হয় বুড়ো মানুষ ক’দিন পর এ জগত ছেড়ে চলে যাবো।কিন্তু তকে তো সংসার নিয়ে থাকতে হবে।আমি চাই না আমার জন্য তর সংসার ভেঙ্গে যাক।আমি এখনি চলে যাবো।
-(ফাহাদ হঠাৎ জোরে জোরে কেঁদে উঠলো) না স্যার।আমি আপনাকে যেতে দেবো না।আমার সংসারের দরকার নেই।
-ধুর পাগল,কি বলে?সংসারের দরকার নেই কেন?তরও তো একটা সন্তান আছে না কি?আমার কথা শুন।
ফাহাদ নাছোড়বান্দা।স্যারের পায়ে ধরে বসে আছে।কিন্তু স্যার ওকে তুলে ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন,“আর হ্যাঁ,একটা কথা।নিজের সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবি।আমার দোয়া সবসময়ই তোর সঙ্গেই আছে।”
এই বলে স্যার চলে যেতে উদ্যত হলেন।কিন্তু ফাহাদ ছেলেমানুষের মতো স্যারের হাত ধরে বসে থাকলো।স্যার বললেন, “চল,আমায় গেট পর্যন্ত ছেড়ে দিবি,আয়।”
ফাহাদ না বোধক মাথা নাড়লো।স্যার একরকম জোর করে ওকে গেটের কাছে নিয়ে গেলেন।
তারপর বললেন,“চলি রে,নিজের খেয়াল রাখিস।”
ফাহাদের চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে স্যারকে দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, “আমায় ক্ষমা করবেন,স্যার।আমি এত বড় একজন হতভাগা যে নিজের প্রাণপ্রিয় স্যারকে বিপদের সময় সাহায্য করতে পারলাম না।”
স্যার বললেন,“যাহ,তোর অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
স্যার আর কিছু বললেন না।হাতের লাঠিটা দিয়ে মাঠিতে ভর দিয়ে চলতে লাগলেন।ফাহাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কত বয়স হবে স্যারের?স্যার কি ঠিকমতো কোথাও থাকতে পারবেন?না কি রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকবেন?স্যার কি কিছু খেতে পারবেন? না কি,ক্ষুধার যন্ত্রণায় ধুকে ধুকে পরপারে পাড়ি জমাবেন?
হায়রে দুনিয়া,শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর হয়েও মনুষ্য সমাজে ঠিকমত বেঁচে থাকতে পারবেন না।এ কেমন নিয়ম?এ কেমন ভাগ্য?যিনি শত শত অমানুষকে মানুষ বানিয়েছেন।তিনিই কি না নিজের সন্তানদের মানুষ করতে পারলেন না?
দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল ফাহাদের ঐ রক্তিম চোখ থেকে।
;_________'সমাপ্ত'__________
[উৎসর্গঃআমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক আবুল কাশেম স্যার]
গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় এখানে