পরনে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট (স্কুল ড্রেস) আগে থেকেই পড়া ছিল।সিনিয়র এক ভাই একখানা নকল গোঁফের বন্দোবস্ত আগেই করে রেখেছিলেন।গোঁফটা হাতে নিয়ে জায়গামত লাগালাম।সিনিয়র আপুর ব্যাগে রাখা আয়নাখানা স্বহস্তে বের করে নিজেকে একবার দেখে নিলাম।নাহ...কি যেন বাদ পড়েছে!ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, পন্ডিতমার্কা চশমাটা বাদ পড়েছে।অনেক খুঁজাখুঁজির পর নিজের ব্যাগে চশমাখানা আবিষ্কার করলাম।চশমাখানা ভালোভাবে মুছে পড়ে নিলাম।এখন ঠিক আছে।চুলের সামান্য অংশ ধবল হয়ে আছে।গ্রুপ লিডার অপু ভাই পান খাওয়ার চুল লাগিয়ে দিয়েছেন।
দরজার ফাঁক দিয়ে দর্শকদের সংখ্যা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম।হাজার দুয়েক হবে।স্টেজে অন্য একটা ইভেন্ট চলছে।একটু পরে ঐ স্টেজে পারফর্ম করব।আমাকে দেয়া হয়েছে ‘আদু ভাই’য়ের ক্যারেক্টার।যেটা আমার ক্যারেক্টার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
চরিত্রটা যেরকম আমার চরিত্রের বিরুদ্ধে,তেমনি আমাকে এই অভিনয়ও করানো হচ্ছে আমার মতের বিরুদ্ধে।হাইস্কুল লাইফে একটা ইভেন্টই আমার জন্য বরাদ্দ ছিল।সেটা হল ‘কবিতা আবৃত্তি’।কিন্তু এটাতেও বাধা ছিল।যখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতাম,তখন মনে হত হার্টের মধ্যে কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে।আস্তে আস্তে কবিতা বলা শুরু করতাম।সাথে সাথে পা দু’টোও কাঁপা শুরু করত।আমাদের সিলেটে একটা কথা প্রচলিত আছে যে,ছেলেরা মুরগির পা খেলে না কি অসময়ে পা কাঁপে! অবশ্য, আমি কোনদিন মুরগীর পা খেয়েছি বলে মনে হয় না।
যে ছেলের সামান্য কবিতা আবৃত্তি করার সময় হাত-পা, পিকে মুভির ড্যান্সিং কারের মত কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেয়,সেই ছেলেকে দিয়ে না কি অভিনয় করানো হবে! কাক কি কমলা খেতে জানে!!নিজেকে নিজের কাছেই তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।
গ্রুপ লিডার অপু ভাই এসে আমার গলায় একটা ‘নেমপ্লেট’ লাগিয়ে দিয়ে গেলেন।একটু পর আমাদের ডাক পড়লো।আস্তে আস্তে স্টেজের দিকে এগোতে লাগলাম।মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কে যেন ড্রাম বাজ্জাচ্ছে!পা দুটো সামনের দিকে এগোচ্ছেই না।কোনমতে স্টেজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সবাই আমাদের দিকে (বিশেষ করে আমার দিকে) হা করে তাকিয়ে আছে।কারো দিকে তাকাতে পারছি না। অভ্যন্তরীণ একটা জড়তা আমাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।একে একে সবার অভিনয় করা শেষ।সবশেষে আমার পালা।ভেতরের ড্রাম বাজানোর গতিটা আরো বেড়ে গেল।আস্তে আস্তে স্টেজের দিকে উঠতে লাগলাম।মনে মনে বারংবার আমাদের গ্রুপের হেড টিচারকে গালি দিতে লাগলাম। কোনমতে মাইক্রোফোনটা হাতে নিলাম।মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।ডায়লগগুলো মনেই পড়ছে না। কি বলব কিছুই মনে নেই। চোখ তুলে আমাদের গ্রুপ লিডার অপু ভাইয়ের দিকে তাকালাম।উনি আমাকে ডায়লগ বলার জন্য হাত দিয়ে বার বার ইশারা করছেন।কিন্তু কি বলব সেটাই তো আমার মনে নেই!
কোনমতে দু’লাইন ডায়লগ বললাম।তারপর দিলাম ভৌ দৌড়।এক দৌড়ে কমন রুমে গিয়ে ঢুকলাম।
ঐদিন আমি হেরেছিলাম।আমি যে কাজে দক্ষ নই অর্থাৎ যে কাজটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়,সে কাজটা কেন আমাকে দিয়ে জোর করে করানো হবে?আর জোর করে কাজ করানোর ফলাফল তো সবসময় শূন্যই হয়।
বাস্তবজীবনে কেউই মি.পার্ফেক্ট নন।মি.পার্ফেক্ট হওয়া কেবলমাত্র সিনেমাতেই সাঁজে।
অনেকে এই বিষয় বুঝাতে আমাদের হাতের অসমান পাঁচটা আঙুলকে উদাহরণ হিসেবে নেন।আমিও নিলাম।
নিজের ডান হাতটা একবার মনোযোগ দিয়ে দেখুন।হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান? দেখে মনে হচ্ছে,ক্রিকেট খেলায় যেরকম ব্যাটসম্যানদের সাল অনুযায়ী ব্যাটিং এভারেজ দেখায়,সেরকম একটা চার্টের চিত্র।হাতের মধ্যমা আঙুলটিকে যদি সর্বোচ্চ ধরা হয়। তাহলে ‘আমার পড়ালেখা’কে ধরলাম মধ্যম আঙুল,এর পরেরটাকে ধরলাম ‘কবিতা আবৃত্তি’ এবং সর্বশেষ অর্থাৎ কনিষ্ঠ আঙুলটিকে ধরলাম ‘অভিনয়’ হিসেবে।
অর্থাৎ আমি পড়াশোনা সম্মন্ধে দক্ষ,কবিতা আবৃত্তি সম্মন্ধে সামান্য দক্ষ এবং অভিনেতা হিসেবে অদক্ষ বললেই চলে।সবাইকে সর্ব বিষয়ে দক্ষ হতে হবে।এমন তো কোন কথা নেই.
কোকিল নিজে বাচ্চা পালন করতে পারে না।যার দরুণ কাকের বাসায় ডিম পাড়ে।অর্থাৎ এটা তার দুর্বলতা।পক্ষান্তরে, কোকিল মধুর সুরে গান করতে পারে।অর্থাৎ এ বিষয়ে সে দক্ষ।
আবার কাক কোকিলের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা মনে করে লালন পালন করে।অর্থাৎ সে বাচ্চা পালনে দক্ষ।পক্ষান্তরে, কাক কখনোই কোকিলের মত মধুর সুরে গান করতে পারে না।অর্থাৎ এটা কাকের দুর্বলতা।
কেউ যদি একটা বিষয়ে দক্ষ থাকে, তাহলে অবশ্যই অন্য কোন একটা বিষয়ে তার দুর্বলতা থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
সকল মানুষকে সর্ববিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হবে।এমন কোন কথা নেই।যে যার মত আছে,তাঁকে তার মত থাকতে দাও। নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জনকারীরা, মানুষের মধ্যেই পড়ে।কিন্তু সকল মানুষেরা, ঐ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনকারীদের মধ্যে পড়ে না।
“After all,Don’t judge me. I was born to be awesome, not perfect.” :3