somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরাজিত একজন মানুষ [১৮+]

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

_ এক _
ভীত হরিণীর মত দুটো চোখ ।
ভয়ার্ত ।
বার বার পেছনে ঘুরে তাকাচ্ছে মেয়েটা ।

পোষাক বিন্যাস খুবই ভদ্র এর । হাত আর মুখ থেকে বোঝা যাচ্ছে আকর্ষণীয় গঠন না হয়ে যায় না । তবে যত্নের সাথে সবকিছু ঢেকেই বেড়িয়েছিল সে ।
ভদ্র পোষাকের মেয়েদের এ শহরে আজও ভয় পাওয়ার মত তেমন কিছু ঘটে নি । তবুও এ মেয়ে পেছনে বার বার তাকাচ্ছে ।

মিরপুরের নোংরা এক বস্তিতে একজন বৃদ্ধা থাকতেন । সারাদিন কারও সাথে কথা বলতেন না তেমন ।
তবে আমার সাথে বলতেন । তাঁর নাতনীকে হায়ার ম্যাথ পড়াতাম আমি ।
বয়স্কা ভদ্রমহিলার নামটি ছিল বেশ খান্দানী । সায়েরা খাতুন ।

জাতির আব্বু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
তার আম্মু সায়েরা খাতুন ।

অর্থাৎ অখ্যাত এক বস্তিতে নামগত দিক দিয়ে আমার কথা হত জাতির দাদীর সাথে । সরাসরি ।
জাতির দাদীর মিতা একদিন মাছি তাড়াতে তাড়াতে বলেছিলেন, ‘ঢাকা দিলে খাইদ্যে মাছি বসে না ।’

রাস্তাতে ত্রস্ত পায়ে হাঁটতে থাকা কৈশোর সদ্য পেরুনো এই তরুণী তাঁর কথাকে ভুল প্রমাণ করেছে । ‘খাইদ্য’ ঢাকা আছে । তবুও মাছি উড়ছে ।
তরুণীকে এখন আগের চেয়ে জোরে ছুটতে দেখা যাচ্ছে । মাছির সাথে তরুণীর দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে ।
সবসময় হাত নাড়লে মাছি চলে যায় না, তবুও মেয়েটিকে আমি হাত নাড়াতে দেখলাম । একটা রিকশাকে থামাবার প্রচেষ্টা ।

সাধারণতঃ রিকশাওয়ালারা সুন্দরী মেয়ে পেলে চেইন উল্টে ফেলে ব্রেক কষে । আপনার ত্রিশ টাকার দূরত্বে তারা দাঁড়াবে না । সুন্দরীর তিন মিনিটের হাঁটা গন্তব্যের টানে দাঁড়িয়ে যাবে ।
এই মাত্র যে রিকশাওয়ালাকে ডাকা হল, সে সুন্দরীর দিকে আগ্রহের সাথে তাকায় ঠিকই । কিন্তু দাঁড়ালো না ।

মেয়েটার চোখের হতাশার ভাবটা এতদূর থেকেও বোঝা গেল । ব্যাগ থেকে একটা মোবাইলফোন বের সে করে ফেলেছে এরই মাঝে ।
সায়েরা খাতুন একদিন আমাকে বলছিলেন, ‘বিপদে পড়লে আয়াতুল কুরসি পড়বা বাবা । কামের জিনিস ।’

যুবতী বয়েসে একদিন ভদ্রমহিলার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল । অভিযোগ ছিল, স্বামীপ্রবর ‘মোতি মিয়া’কে খুন করেছেন । পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহুর্তে ফয়সাল ভূঁইয়া স্ত্রীর দিকে একবার ঘুরে তাকিয়েছিলেন । মাথাতে হাত ঠেকিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম ।’

সায়েরা খাতুনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল ।
তিনি জায়নামাজে বসে সারাদিন আয়াতুল কুরসি পড়লেন ।
রাত দুটোতে ফয়সাল ভূঁইয়া বাড়ি ফিরে এলেন ।

রাস্তা ধরে ছুটতে থাকা তরুণী সম্ভবতঃ আয়াতুল কুরসি পারে না । তাকে মোবাইল হাতে বেশ ব্যস্ত হয়ে কাওকে ফোন দিতে দেখা গেল ।
এগারোতম বার যখন তরুণী পেছনের দিকে চোখ ফেরায়, তার দিকে তাকিয়ে আমি মিষ্টি করে হাসলাম ।

মেয়েটা আমার মাত্র পাঁচ ফিট দূরে এখন । রাস্তার পাশের তেতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ।
চোখমুখ থেকে ভয়ের চিহ্ন সরে যাচ্ছে অনেকটাই ।

কাছে গিয়ে খুব স্বাভাবিক গলাতে বললাম, ‘ভেতরে চলুন । এক কাপ চা খাবো ।’
এক মানুষ সমান উঁচু গেট থেকে সমপরিমাণ উঁচু মানুষটা তখনই বের হয়ে এলো । শরীরে দাড়োয়ানের পোশাক ।

মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘ইদ্রিস মামা, এর পাছাতে একটা শক্ত লাথি কষে বিদেয় কর তো ।’

_ দুই _
চায়ের কাপের সামনে ধীরে ধীরে ধোঁয়া পাক খাচ্ছে । সিলিংয়ের দিকে ওরা যাচ্ছে কিনা বোঝার উপায় নেই, চায়ের কাপের ধোঁয়াদের বেশিক্ষণ দেখা যায় না । ছোঁয়াটাও অসম্ভব একটা ব্যাপার ।

সিগারেট আর চায়ের মাঝে পার্থক্যটা এখানে । সিগারেট তার গ্রহীতাকে সুখ দেবে চায়ের চেয়ে বেশি, অথচ চায়ের মায়াময় রূপটা সিগারেটের মাঝে অনুভব কেন যেন করা যায় না ।
সিগারেটের চেয়ে চায়ের অবস্তুগত রূপটা বেশি প্রকট । একে ছোঁয়া যায় না, মায় ধোঁয়া পর্যন্ত ধরার চেষ্টা করা অসম্ভব । এজন্যই কি চায়ের কাপের সাথে মায়াকাড়া একটি অনুভূতি চলে আসেই ?

প্রশ্নটার জবাব খোঁজার কোন মানে দেখলাম না ।
মায়াকাড়া একটা মুখের সামনে মায়াকাড়া চায়ের কাপ যখন অপেক্ষা করে, আর দুটোর কোনটাই যখন নিজের অনুকূলে থাকে না, তখন এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজারও কোন মানে হয় না । ছোট ছোট দুটো ঠোঁট, সুন্দর একটা নাক, আয়ত চোখদুটোর মাঝে জ্বল জ্বলে মণি দুটো অস্পষ্ট – গুচ্ছ গুচ্ছ চুলে ঢেকে গেছে ওরা । মায়াকাড়া ক্যাটাগরিতে ফেলতে হলই ।

অপর্ণাদের দাড়োয়ান আমার পাছাতে শেষ পর্যন্ত লাথিটা মারতে পারে নি । ইদ্রিস মামার মাঝে ইচ্ছেটার কমতি ছিল বলে মনে হয় না । তবে চারটা জাদুর শব্দ উচ্চারণ করতেই থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে বেচারা ।
‘জয়নাল আংকেল আমাকে পাঠিয়েছেন ।’

এই মুহূর্তে আমার দুঃখপ্রকাশ করা উচিত । যুক্তিগত উপসংহার, এই একটা কারণেই আমাকে চা দেওয়া হয় নি ।
রান্নাঘরের জনৈকা রহিমা খালাকে অপর্ণা চেঁচিয়ে বলেছিল এক কাপ চা দিয়ে যেতে ।
বুড়ি এক মহিলা রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে চোখ কপালে তুলে জানতে চেয়েছিল, ‘আফা, আফনে চা খাইতেন না ?’
চা কি করে একজন মানুষ খায় – তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন মেয়েটা আমাকে স্রেফ চমকে দিয়ে রহিমা খালাকে বলেছে, ‘আমি খাব । উনি খাবেন না ।’

আমার মনে হয় বাইরে রীতিমত চরিত্রহীন একটা ছেলের মত অনুসরণ করার একটা প্রতিশোধ নিচ্ছে ও ।
বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার আগেই চট করে প্রশ্নটা করে ফেলে মেয়েটা, ‘জয়নাল সাহেব আপনাকে কেন পাঠিয়েছেন ?’
প্রশ্নের উত্তরটা জেনেও কেউ যদি জানতে চায় তখন তাকে বোঝানো আসলেই সম্ভব নয়, তবুও উত্তর দিলাম, ‘তোমাকে পড়াতে ।’
পাতলা ভ্রু কুঁচকে ও শুধু মন্তব্য করে, ‘রাশেদ ভাইয়ের যে চেহারা মনের মাঝে ছিল, তার সাথে আপনার মিল নেই ।’

এটা কোন প্রশ্ন না । কাজেই জবাব থাকার কথা নয় ।
তাছাড়া অপর্ণা বাইরের পোষাক পাল্টে এসেছে । ফতুয়ার অদ্ভুতুড়ে গঠনের জন্য তার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে । না তাকালেও ওদিকে চোখ চলে যাচ্ছে ।
এ অবস্থাতে চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবকরা সাধারণতঃ জানা প্রশ্নের উত্তর ভুলে যায়, শোনা প্রশ্নটা মনেও করতে পারে না ।

‘বিশ্বাস না হলে তোমার বাবাকে একটা ফোন দিতে পার । বাই দ্য ওয়ে, উনি কখন ফিরবেন ?’, হাতঘড়ি দেখলাম, ‘আমার আরেক জায়গাতে যেতে হত ।’
শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দেয় মেয়েটা, ‘বাবাকে দিয়ে আপনার কি দরকার ?’
‘আপনাকে পড়ানোর ব্যাপারটা তো তাঁরই দেখার কথা ।’
মাথা নাড়ে অপর্ণা, ‘ওটা আমি দেখব । আমার পছন্দ হলে থাকবেন । নাহলে বিদায় ।’
আমি বললাম, ‘ও !’
‘আপনার চেহারা লুচ্চাশ্রেণির ।’
আমি আবারও বললাম, ‘ও !’
‘আপনাকে দেখলে মনে হয় না অটোক্যাড জীবনে খুলে দেখেছেন ।’
আমি কিছু বললাম না ।

দীর্ঘ একটা নীরবতা পার হলে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আসে মেয়েটা । আমি ঢোক-টোক সব বহু কষ্টে গলার ওপরে তুলে রেখে স্বাভাবিক একটা মুখ করে থাকি ।

‘আগে কাওকে পড়িয়েছেন ?’
মাথা দোলালাম, ‘ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের এক ছাত্রী ছিল আমার ।’
‘হুঁ !’, নিচের ঠোঁট মুহূর্তের জন্য কামড়ে ধরে অপর্ণা, ‘কোন কলেজে পড়ত ?’
‘সিদরাতুল মুনতাহা মহিলা কলেজে ।’
‘এটা কই ?’, সুন্দর ভ্রু জোড়াকে আরেকবার পাক খেতে দেখি ।
‘মিরপুরের এক অখ্যাত কলেজ । তোমার জানার কথা না ।’, চোখ ওর মুখের দিকে তুলতে তুলতে বললাম ।

জানার আর আগ্রহ দেখালোও না অবশ্য মেয়েটা ।
‘বেতন কত পান তাকে পড়িয়ে ?’
হুট করে প্রশ্ন করে ফেলল । অথচ আমি এর বয়স জানতে চেলে ইদ্রিস মামাকে আবার ডাক দিবে সন্দেহ নেই ।
তবে প্রশ্নটার পেছনে আমার কুকুরের চামড়ার মত দেখতে জ্যাকেটটা দায়ী থাকতে পারে । ছয় শীত আগের জিনিস ! আমি অবশ্য কিছু বলি না, ছেলেদের মাঝে মাঝে মান সম্মান থাকতে নেই । আরেকজনের বাসাতে চাকরির আশাতে আসলে সেরকম একটা সময় পার করতে হয় ।

‘কিছু পেতাম না । বিনা টাকাতেই পড়াতাম ।’, জানিয়ে দিলাম তার চোখে চোখ রেখে ।
মেয়েটা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, ‘থাকত কোথায় আপনার এই ছাত্রী ?’
কাঁধ ঝাঁকালাম, ‘তুরাগ সিটির কাছে এক বস্তিতে ।’
ভ্রুজোড়া তৃতীয়বারের মত পাকিয়ে যায়, ‘বস্তিতে কলেজ লেভেলের মেয়েও থাকে নাকি ? বিয়ে দিয়ে দেয় নি ?’
মাথা নাড়লাম, ‘পরিবারটি বস্তিতে আজীবন ছিল না । তাই মনে হয় আলাদা রকম সম্মান পেত । মেয়েটা নিরাপদেই ছিল ।’
‘পাস্ট টেন্সে বলছেন কেন সব ? মেয়েটাকে পড়ান না আর এখন ?’

দুইপাশে আলতো করে মাথা দুলিয়ে তার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিলাম ।

‘কেন ?’, আঁতকে ওঠে অপর্ণা । যেন একটা মেয়েকে না পড়ানোর মত আশ্চর্যের আর কিছু নেই ।
‘এক ছেলের সাথে ভেগে গেছে পুতুল ।’
হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা, তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘মিথ্যে বলছেন কেন ?’
‘মিথ্যে ?’
‘মেয়েটা কোন ছেলের সাথে পালায়নি । কি করেছেন তাকে আপনি ?’

পুতুল নামে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া বস্তির একটা মেয়ে কোন ছেলের সাথে পালায়নি এব্যাপারে অপর্ণার কণ্ঠের দৃঢ়তা আমাকে স্পর্শ করে । আমার নীরবতা তাকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না । ভ্রু নাচালো ও ।

‘কি করেছেন তাকে নিয়ে ? রেপ ?’
বিস্ময়ে আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়, ‘কি আশ্চর্য ! আমি ওকে রেপ করতে যাব কেন ?’
‘সেক্সুয়াল নীড শেষ হতে খুন করে একপাশে ফেলে দিয়েছেন তো ? এরকম বহু দেখা আছে । বিনা টাকাতে পড়িয়ে বাহাদুরী করার কিছু নেই ।’, আমাকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে বলে চলেছে অপর্ণা, ‘একজন শিকার শেষ হতে আরেকজন ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ? আমাকে পড়াতে চাইছেন সেজন্য ।’

আমার মুখ মাছের মত হা হয়ে যায় । রহিমা খালাকে তার মাঝেই রান্নাঘর থেকে একটা ট্রে নিয়ে বের হয়ে আসতে দেখলাম ।

‘ডেট-রেপ ফেসটা আয়নাতে একবার দেখেছেন ?’, এখনও বলে চলেছে ও, ‘পুরোটা সময় আমার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । ভেবেছেন জামাটা বেখেয়ালে পরে এসেছি ? বলিনি, আমি চাইলে আপনি থাকবেন । না চাইলে থাকবেন না ?’

নিজের সম্পর্কে অপর্ণা খুবই অদ্ভুত কথা বলছে । তবুও রহিমা খালার মুখে কোনরকম পরিবর্তন দেখলাম না । শান্তভাবে আমার সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে চলে গেলেন আবার রান্নাঘরের দিকে ।

অপর্ণা উঠে দাঁড়ায়, ‘আপনার মত লুচ্চা লোকজনের কাছে অটোক্যাড শেখার কোন ইচ্ছা নাই । চা খেয়ে চলে যান । এ বাড়ির ত্রিসীমানাতে আর আসবেন না ।’

_ তিন _

ঘটনাটার ঠিক তিন দিন পর আমার নম্বরে গ্রামীণফোনের একটি নম্বর থেকে ফোন আসল । অচেনা নাম্বার দেখে আমার ফোনটা ধরার কথা না । কিন্তু ধরে ফেললাম ।
কেন ধরলাম, তার ব্যাখ্যা দিতে হলে আমাকে চার ঘণ্টা পিছিয়ে যেতে হবে ।

তিয়ানা নামে আমার এক বান্ধবী আছে । রীতিমত ডেঞ্জারাস মেয়ে, বৃষ্টি নামে আরেক মেয়ের সাথে প্রেম করছে এখন চুটিয়ে । সাত বছরের রিলেশন । আমার মনে হয়, তিয়ানা-বৃষ্টির প্রেম একেবারেই অমর ।
লেসবিয়ান প্রেম সাত বছর কিভাবে টিকল তা ভেবে যখন আমাদের সবাই মাথা কুটে মরছি, তখনই তিয়ানা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ।

আর তিন বছর পর ওরা বিয়ে করবে । তারপর, তারও দু’ বছর গেলে বাচ্চা নেবে । ইন্ডিয়ার এক স্পার্ম ব্যাংকের সাথে কথা বলা হয়ে গেছে । বাচ্চাটা নেবে বৃষ্টি ।
পরিকল্পনা শুনে আমার চোখ ট্যারা হয়ে গেছিল কিছুক্ষণের জন্য । তারপর যে হাসিটা দিয়েছিলাম – তাকে বলে দাঁত কেলানো হাসি ।

সেই তিয়ানা যখন রাতটা বাসাতে কেউ থাকবে না বলে আমাকে আর বৃষ্টিকে ডাক দেয়, তখন সেটা অগ্রাহ্য করা যায় না ।
এখানে আমার ভূমিকা নগণ্য । সারা রাত জুড়ে প্রেম করবে ওরা দুইজনই । বাসাতে লোকজন ভর্তি থাকলেও করে । মেয়ের ঘরে বান্ধবী থাকবে রাতে – এতে কোন বাবা-মার আপত্তি হওয়ার কথা না । তিয়ানার বাবা-মাও করেন নি । সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ধামাকা প্রেম করছে ওরা গত কয়েক বছর ধরেই ।

তবে বাসা সম্পূর্ণ খালি না থাকলে এইটীন মাইনাস প্রেম ছাড়া আর কিছু করার থাকে না । আজকে ওরা করবে এইটিন প্লাস প্রেম । আমার সেখানে কোন ভূমিকা নেই । আমার ভূমিকা আলাদা জায়গাতে ।
অনেকদিন ধরে তিয়ানাকে গাঁজার জন্য জ্বালাচ্ছিলাম । আজকে বৃষ্টি ভালো সাপ্লাই এনেছে । তিনজনে বসে বসে ওটাই চুষছিলাম ।

দুটো স্টিক ফেঁড়ে ফেলে এখন সব কিছু দুটো দেখছি । আমার মনে হয় সামনে দুটো তিয়ানা আর দুটো বৃষ্টি বসে আছে । ওরা কি আজ রাতটা নিজেদের জন্য পাবে ? মনে হয় না ।
হ্যাংওভার কাটিয়ে কাল উঠতে উঠতে একটা-দুটো বাজবেই ।

ফোনটা তখনই এলো ।
বাম হাতে ফোন তুলে নিয়ে রিসিভ করলাম ডানহাতে। এখন আড়াইটা তিয়ানা । আড়াইটা তিয়ানার সাথে দেড়টা বৃষ্টি ।

‘রাশেদ বলছ ? আমি শরাফত হায়দার বলছিলাম।’, ওপাশ থেকে কণ্ঠটা বলে ।
আমি গ্যাঁ গ্যাঁ করে উঠলাম, ‘চিনলাম না তো । রাখি ?’
হাহাকার করে ওঠেন শরাফত সাহেব, ‘থামো থামো ! আমি অপর্ণার বাবা ! এবার চিনেছ তো ?’

আমার নেশা টুটে গেল এবার, ‘জ্বি ?’
‘তোমার সাথে তো ফাইন্যান্সিয়াল দিকটা নিয়ে কথাই হল না । তোমার এক্সপেক্টেশনটা আমাকে বল ।’

দুখন্ড পাছা নিয়ে পালাতে পেরেছি, এরপর আরও এক্সপেক্টেশনের কথা জানতে চাইছেন অপর্ণার বাবা ?

‘না -’, বুঝতে পারলাম না আমার কি বলা উচিত ।
‘আরে বলে ফেল তো !’, তাগাদা দেন শরাফত সাহেব ।
‘সাড়ে আট হাজার, স্যার, মানে মোনার্ক !’, তালে বেতালে চেয়ে ফেললাম ।
‘চমৎকার । তা তোমার যখন সুবিধে হয় এসো ।’, ভুল শুনেছেন ভেবে ঠিকটা ভেবে নেন শরাফত সাহেব ।
‘জ্বি ইয়াক ক ...’
‘আর একদিন তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে থাকল, ইয়ং ম্যান । অপর্ণা কিন্তু বেশ পছন্দ করেছে তোমাকে । মেয়ে যা খুঁতখুঁতে - বাড়িতে একটা টিউটর টেকে না মেয়ের জন্য । তুমি টিকে গেলে স্বস্তি পাই ।’

মিনিট তিনেক পর যখন ফোন রেখে দিচ্ছি, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে । অপর্ণা বলেছিল উল্টো কথা ।
মানসিক সমস্যা কতটা গভীর এই মেয়ের ?

তিয়ানার বুকে আছড়ে পড়ার আগে ওটাই ছিল আমার শেষ ভাবনা ।

_ চার _
ষষ্ঠদিনে হতাশ হয়ে গেলাম ।
এই মেয়েকে অটোক্যাড শেখানো আমার কাজ না । তার বডিগার্ড হওয়াটা এর চেয়ে সহজ হবে বলে মনে হল । সারদিন ননস্টপ বকবক করতে পারে মেয়েটা । কিন্তু কাজের বেলাতে নেই । ল্যাপটপের চার্জ শেষ হয়ে চার্জারের জীবনকালও শেষ হওয়ার পথে । তবুও তাকে ট্রিম করানোটাই শেখানো গেল না ।

রহিমা খালা আরও অদ্ভুত একজন মানুষ । এই হাসি আর এই গাম্ভীর্যতা তার মাঝে ।
সেদিনও আমাদের সামনে ল্যাপটপ খোলা । যথারীতি অপর্ণার কথার ট্রেনের থামাথামি নেই । তাকে তাল দিতে ইচ্ছে না থাকলেও দিতে হচ্ছে ।
একজন মানুষের খুচরো কথা বন্ধ করা চলে, কিন্তু প্রতিটি লাইনের পর যে ট্যাগ কোয়েশ্চেন লাগায় – তাকে বন্ধ করাটা কঠিন ।

‘জিলং চেং নামে নতুন একটা চাইনীজ তো খুলেছে । গেছেন সেখানে ?’, একটা কলম মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে অপর্ণা ।
‘টাকা কামড়ায় না আমার ।’, শুরুতেই পানি ঢেলে দিতে চাইলাম মেয়েটার আড্ডার বাক্সে ।
‘আমার সাথে একদিন যাবেন ? টাকা নিয়ে ভাববেন না ।’, একটুও দমানো গেল না তাকে ।
‘ডেড-রেপ ফেসের একজনের সাথে চাইনীজে যেতে চাইছো কেন ?’, অবাক হওয়ার ভান করতে করতে বললাম ।
‘আমাকে আপনি রেপ করবেন না ।’, এক হাত চেয়ারের হেলান দেওয়ার অংশে তুলে দেয় অপর্ণা, ‘আমি জানি ।’
ল্যাপটপটা তার দিকে ঘুরিয়ে দেই, ‘গত চারদিন ধরে ট্রিম করা শেখাচ্ছি, করে দেখাও আমাকে ।’

বৃথাই মাউসটা হাতে নেয় অপর্ণা । তারপর কিছুক্ষণ অযথা ক্লিক করে ।
কাজটা করতে না পারায় অসহায় একটা ভাব তার মুখে ফুটে উঠতে চলেছে – তার মাঝেই প্রশ্নটা করে ফেলে, ‘পুতুলকে রেপ কেন করলেন ?’
অন্যদিনের মত আজ এড়িয়ে গেলাম না বিষয়টাকে, ‘পুতুলকে রেপ করেছি কেন মনে হল তোমার ?’
‘আপনার চেহারাতে লেখা আছে সেটা ।’, বিড়বিড় করতে করতে ল্যাপটপের ওপর আরেকবার ঝুঁকে পড়ে মেয়েটা । আরও একবার কষ্ট করে চোখ সরাতে হয় আমাকেও ।

রহিমা খালাকে দরজার কাছে কিছুক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, এবার তাঁর দিকে প্রশ্নবোধক একটা দৃষ্টি মেলে দেই ।
‘বড় সাহেব আপনার সাথে কথা বলতে চাইতেছিলেন । আপনার কি সময় হবে ?’

শরাফত সাহেবের শিষ্টতাবোধ আমার ভালো লাগে । শুনেছি বড়লোক বাবাদের হুটহাট মেয়েদের ঘরে ঢুকে যাওয়ার অভ্যাস আছে ।

খালার দিকে তাকালাম, ‘আমার সময় হবে । চলেন ।’

*
শরাফত সাহেব আরামকেদারাতে হেলান দিয়ে চুরুট ফুঁকছিলেন । জানালার দিকে চোখ, সেদিকে তাকাতে আমার চোখে পড়ে একটা কাঁঠাল গাছ । জানালার সাথে একটা চড়ুইয়ের বাসা । এতদিনে তারা পালিয়ে যায়নি কেন আমি জানি না । শহরের বুকে বসেও বাড়িটার এখানে দাঁড়িয়ে কি এক গ্রামীণ নিবিড়তার ছোঁয়া !
আমাকে দেখে শসব্যস্ত হয়ে উঠে বসতে গেলেন অপর্ণার বাবা ।

‘রহিমা নিশ্চয় ঠিকমত বলতে পারে নি ? আমি তো তোমাকে সময় বুঝে দেখা করতে বলেছিলাম । সাথে সাথে উঠে না এলেও হত ।’
মুচকি হাসলাম আমি, ‘ও কিছু না । আপনি বসুন ।’
শরাফত সাহেব আবারও বসে পড়লেন, চুরুটটা থেকে টেনে নিলেন একবুক ধোঁয়া । আমার মনে হল ভদ্রলোক কোথাও হারিয়ে গেছেন । জগতটা আজকের দিনের ঢাকার নয় ।

‘আমি একটা সিগারেট ধরাচ্ছি ।’, শক্ত কণ্ঠে জানালাম তাঁকে ।
‘ধরাও, কোন সমস্যা নেই ।’, বলতে গিয়ে শরাফত সাহেব খেয়াল করলেন, তাঁর কাছে অনুমতি চাই নি আমি ।
পকেট থেকে সস্তা গোল্ডলীফ বের করে হুস করে ধরিয়ে ফেললাম । এখানে আসার আগে তিয়ানার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি ।

‘আপনার মেয়ের কাছে কোন টিউটর টেকে না । সেটার জন্য মেয়ের খুঁতখুঁতানি স্বভাব দায়ী নয় । তাই না ?’, চট করে বলে ফেললাম ।
কাঁধ ঝাঁকালেন এবার শরাফত সাহেব, ‘বুঝলাম না ।’
‘আপনার মেয়ের ভিন্নরকম সমস্যা আছে । ক্যাটাগরি অনুযায়ী তাকে আমি ছেলেখেকোতে ফেলব ।’, চোখের পাতা না কাঁপিয়ে বাবাটিকে বলে দেই, ‘সেটা আপনি ভালো করে জানতেন ।’
গল গল করে ধোঁয়া ছাড়লেন তিনি সিলিংয়ের দিকে, ‘ঠিক ওরকম না ব্যাপারটা । আসলে ও বড় ছেলে মানুষ ।’
‘নিশ্চয় ।’, মাথা দোলালাম, ‘ষোল বছর বয়েসে আর কে প্রেগন্যান্ট হতে পারে ?’

জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন শরাফত সাহেব ।

‘বাদ দিন । আমাকে ডেকেছিলেন কেন ?’, সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি ।
‘অপর্ণার ঘটনাটা কিভাবে জানলে ? ও বলেছে তোমাকে ?’, পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি ।
‘না তো । আপনাদের পরিবারটিকে আমি বেশ কয়েকবছর ধরেই চিনি ।’, মিষ্টি করে হাসলাম ।

মেঘ জমে গেছে শরাফত সাহেবের মুখে ।

‘আমি এখানে মেয়েটার দোষ দেখি না । মা নেই ওর । গাইড দেওয়ার মত কেউ ছিল না নিশ্চয় ? উচ্ছন্নে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না ।’

শরাফত সাহেব এবারও কিছু বললেন না ।

‘অপর্ণাকে কি বলেছেন ওর মা রেপড হওয়ার পর খুন হয়েছিলেন ?’, বিচ্ছিরি একটা হাসি মুখে তুলে জানতে চাই আমি ।

প্রচণ্ড ক্রোধে শরাফত সাহেবের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে । ধীরে ধীরে ওই মুখে জমে ওঠে জীঘাংসা । পরমুহূর্তেই আমার দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়লেন, ‘গেট আউট ! এখনই বের হয়ে যাও আমার বাসা থেকে ! এখন-’

পেছনে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলছিলেন তিনি, কান না দিয়ে বিদায় নিলাম বাড়িটা থেকে ।

_ পাঁচ _
‘তারপর ? ফ্যামিলির ব্যাপারে কিছু বলেন না তো আমাকে !’, অভিমানী কণ্ঠে বলে অপর্ণা ।

মুচকি হাসি আমি ।
জিলং চেং নামক নতুন চাইনীজ রেস্টুরেন্টেই বসে আছি । ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার করে রাখে ওরা সব সময় । পর্দা দিয়ে ঘিরেও রাখে কেবিনগুলোকে ।
সম্ভবতঃ প্রেমিক-প্রেমিকাদের গুরুত্ব দিয়ে বানানো এটা ।

আমাকে হাসতে দেখে হেসে ফেলে অপর্ণা । ওর থুতনি ধরে সামান্য নেড়ে দিতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার । মেয়েটা অন্যরকম একটা মায়া নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে । নিখুঁত দেহকাঠামোর সাথে মায়ার কোথায় জানি একটা বিয়োগসূত্র আছে ।
অপর্ণার বেলাতে তা হয় নি । ও পেয়েছে দুটোই ।

আমার চোখে ইদানিং ওর তাকিয়ে থাকার পরিমাণ আশংকাজনক হারে বেড়েছে । এই মুহূর্তেও কাজটা করছে সে ।
টেবিলের ওপর দিয়ে আমার হাতে হাতও রাখে । মেয়েটার আগের ‘সুনাম’ সম্পর্কে আমি অবগত । তবুও হাত সরিয়ে নিলাম না । বরং মৃদু চাপ দিলাম ওতে ।

‘কয় মাস ধরে পড়াচ্ছেন ? মনে করতে পারবেন ?’, পাল্টা চাপ দেয় ও ।
‘ছয় মাস তিন সপ্তাহ ।’, উত্তরটা দেই ।
‘আমার বাসাতে এর আগে মাসখানেকের বেশি কোন টিউটর টেকে নি ।’
আজকে প্রশ্নটা করি আমি, ‘চলে যেত ? নাকি তোমার হাত ছিল ওদের সরাতে ?’
মুখ বাঁকায় অপর্ণা, ‘বাদ দেন তো । চলেন অর্ডার দেই ।’
হাসলাম না আমি, ‘অর্ডার দিয়েছি একবার । ভুলে গেলে ? বলতে ইচ্ছে না হলে বলার তো দরকার নেই ।’
মাথা দুইপাশে নাড়ে ও, ‘আমার এক ছেলেকে বেশিদিন ভালো লাগে না ।’
ওর হাতের বাঁধন ছাড়লাম না, আরেকটু চেপে ধরি, ‘চিরকাল এরকম ছিলে না তুমি । কাজেই এ নিয়ে নিজেকে ছোট ভাবার কারণ নেই ।’

অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় মেয়েটা । ওর অতীত জানার পর কেউ কোনদিন সম্মানিত কোন জায়গা তাকে দিতে চেয়েছে বলে মনে হয় না । এবারই মনে হয় প্রথম শুনল এরকম কিছু ।
আশ্বাসের হাসি দেই আমি ওকে, ‘একটা কথা মনে রাখবে, ভুল পথ থেকে ফিরে আসার সময় কোনদিনও শেষ হয়ে যায় না ।’

অপর্ণার চোখের কোণে একফোঁটা পানি দেখলাম বলে মনে হল । রেস্টুরেন্টের অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই নিশ্চিতভাবে ।
এরকম মারদাঙ্গা একটা মেয়ের চোখে পানি জমে থাকাটা প্রকৃতির অবিচার ছাড়া আর কিছু না । আমি দ্রুত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলি ।

‘আমার মা বাবার ব্যাপারে আজ তোমাকে বলতে পারি । তবে কথা দিতে হবে, ভবিষ্যতে কোনদিন এ নিয়ে আমার সাথে কোন কথা বলতে পারবে না।’, সরাসরি ওর দিকে তাকাই না আর ।
‘তোমার কষ্ট হলে থাকুক ।’, ফিস ফিস করে বলে মেয়েটা ।
‘তোমার শোনার অধিকার আছে, অপর্ণা ।’, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের করে দেই আমি, ‘তোমার শোনার অধিকার আছে ।’
অবাক একটা দৃষ্টি ফুটে উঠেছে ওর মুখে, ‘আমার শোনার অধিকার কিভাবে ?’

কিছু বললাম না । মোমবাতি জ্বলছে টেবিলের মাঝে ।
তিনটা ।
আমার মনে হয় প্রতি চোখে একটা করে মোমবাতি ঢুকে গেছে আমার । কি অসহ্য যন্ত্রণা ! চোখের ভেতর থেকে আগুনটা মাথার ভেতরে ঢুকে যায় । ক্রোধ !
অসহ্য ক্রোধে সবকিছু ছিঁড়ে যেতে থাকে যেন চারপাশে ।

শক্ত করে কেউ আমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছে, টের পেলাম । চোখ মেলি ধীরে ধীরে, গালের কাছটাতে ভিজে আছে আমার । বাম পাশে সারা শরীর দিকে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে অপর্ণা । কাঁপছে একটু একটু ।

‘শান্ত হও, রাশেদ । প্লিজ, শান্ত হও !’
মাথা নাড়ি আমি, ‘আমার আব্বু নেই । আব্বুকে খুন করে আব্বুরই বন্ধুরা ।’
আমার চুল খামচে ধরে মেয়েটা, ‘কিচ্ছু মনে করতে হবে না তোমাকে । প্লিজ, শান্ত হও ?’
হাল্কা কাঁপছি আমিও, ‘দরজার পাশে লুকিয়ে থাকতাম আমি ছোটতে । কেউ দরজার কাছে আসলে লাফিয়ে বের হয়ে ভয় দেখাতাম । সেদিনও দরজার পাশে লুকিয়ে ছিলাম ।’
টের পেলাম অপর্ণার কাঁপুনী থেমে গেছে অনেকটা ।

‘আম্মু পাশের ঘরে কাজ করছিল আর গুন গুন করে গান করছিল । আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রামে । আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন আম্মু আসবে এদিকে । আর আমি ভয় দেখাবো । আম্মু অনেক সুন্দর ছিল জানো ? বাংলাদেশী ফেস কাটিং আম্মুর ছিল না । আমার আম্মু ছিল অনেকটা ইংরেজ চোয়াল আর অস্ট্রেলিয়ান নাকের একটা মেয়ে । গ্রামের প্রত্যেকে অবাক হয়েছিল আব্বু যখন আম্মুকে বিয়ে করে ...’
‘বলার দরকার নেই। রাশেদ -’, আমার মাথা ওর বুকে জড়িয়ে রাখে শুধু ।
বলেই চলি আমি, এখন থামলে আরও বেশি কষ্ট হবে আমার, ‘তখনই ওদের গলা শুনলাম । আব্বুর দুই বন্ধু । আমাদের গ্রামেরই ছেলে । শহরে বড় ব্যবসা করছে তাদের একজন । বন্ধে আসলে আব্বুর সাথে দেখা করবেনই চাচা । অন্যজন এই গ্রামেরই । গ্রামের বন্ধুটা আম্মুর সাথে টুক টাক কথা বলতে থাকে । ভুঁইয়া নামে ডাকত ওকে সবাই । সমবয়েসী বউ বিয়ে করাতে গ্রামে তখন এই ভুঁইয়া চাচা সমালোচিত । আমি অবশ্য বুঝি নি সমবয়েসী বিয়ে করলে কি হয় ।’

অর্পণা আমাকে সাবধানে ছেড়ে দেয় । মনোযোগ দিয়ে শুনছে ।

‘ভুঁইয়া চাচার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন সেদিনের এক মাস আগে । জাহিদ ভাইয়া আমার চেয়ে কত বড় ! অথচ আব্বু আর ভুঁইয়া চাচা একই সমান । সমবয়েসী বিয়ের মর্ম ততদিনে কিছুটা বুঝেছি আমি । আব্বুর শহুরে বন্ধু অবশ্য আম্মুর সাথে গল্প করে না ।’, হঠাৎ করে ভুঁইয়ার ব্যাপারে কথা বলা থামাই আমি, ‘লোকটা সারা বাসা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে আর কেউ আছে কি না ।’
‘সেদিন দুপুরেই এর সাথে আমার দেখা হয়েছে । আব্বুর সাথে যাচ্ছিলাম ফুপুর বাসাতে । কথাটা আব্বু অবশ্য চাচাকে বলেছেও । কাজেই তাঁর খোঁজের অর্থ বুঝলাম না । অবশ্য পরে আমাদের যাওয়া ক্যানসেল হয়ে যায় । আব্বু মত পাল্টে ঠিক করেন শহরে যাবেন । স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আব্বু । হেডস্যার আচমকাই দায়িত্ব গছিয়ে দিল । আমিও বাড়ি ফিরে এসেছিলাম ।’

অপর্ণার দিকে তাকালাম, দু’চোখে রাজ্যের উৎকণ্ঠা ওর ।

‘আম্মুর জ্বর ছিল হাল্কা । ফুপুর বাসাও দূরে না । তাই আব্বু আমাকে নিয়ে গেছিল বিকেলের মাঝে ফিরবে বলে । গ্রামের সবাই পরিচিত, তাই আম্মু একা থাকলেও আব্বুর চিন্তা করার কারণ ছিল না তখন । আমি দরজার আড়ালে । কাজেই আব্বুর শহুরে বন্ধু আমাকে দেখতে পেলেন না ।’

অপর্ণার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে । পাত্তা না দিয়ে বলে চললাম ।

‘আব্বুর দুই বন্ধু আম্মুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । শহুরে বন্ধুটি আব্বুর বিয়ের দিন থেকেই এই ইচ্ছে মনের মধ্যে নিয়ে ঘুরছে । ওরা শব্দ করে আম্মুর একটা একটা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে । আমি পাশের ঘরে থেকে সব শুনতে পাই স্পষ্ট । হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছিল আমার – একটা শব্দ করতে পারছিলাম না প্রচন্ড ভয়ে – দুই চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছিল আমার শুধু ...’
শক্ত করে আমাকে চেপে ধরে অপর্ণা আবারও, ‘বলতে হবে না, রাশেদ -’
‘আম্মুর চিৎকার থেমে গেল শুরুতেই । মুখে বালিশ ধরেছিল ওরা । পাশের ঘরে থেকে আমি শুধু গোঙানি শুনতে পাচ্ছিলাম । ওরা দুইজনই পালা ক্রমে রেপ করে আম্মুকে সেদিন । আর আমি শুধু থর থর করে কাঁপছিলাম পাশের ঘরে । ঠিক তখনই আব্বু আসল বাসাতে । পরে শুনেছিলাম শহরের ফাইলটা আরেকজনের হাতে পাঠিয়ে দিয়ে আগে ভাগে চলে এসেছিল সেদিন আব্বু ।’

অপর্ণার চোখে এখন শুধু ভয়ের ছোঁয়া – সেই সাথে মিশে আছে অসীম বেদনার ছাপ ।

‘হাকডাক করার আগেই ভুঁইয়া চাচা জবাই করে ফেলল আমার আব্বুকে । আমি ঘর ঘরে শব্দটাও পরিষ্কার শুনলাম ওঘর থেকে । নিজেদের অপরাধ লুকোতে এ ছাড়া তাদের আর কোন পথ খোলা ছিল না ।’, একটু বিরতি দেই আমি, ‘আমার বাবাকে উঠোনে জবাই করে রেখেই আবার আম্মুর কাছে ফিরে আসে ওরা । দুপুর তিনটার দিকে গ্রামের মানুষ অন্যের বাড়ি বেড়ায় কম আমাদের ওখানে । কাজেই ওদের মনে ভয় ছিল না ।’

অপর্ণার দুইচোখে বাঁধ নেমেছে । কি আশ্চর্য !
মেয়েটা কাঁদছে !
ডুকরে ডুকরে কাঁদছে ! দেখে মনে হচ্ছে ওর ছোট্ট বুকটাতে অনেক দুঃখ জমে আছে ।
অনেক !

পর্দা সামান্য সরিয়ে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে খাবার রাখে ওয়েটার । পরিস্থিতি অনুমান করেই বোধহয় টু শব্দটা না করে বেরিয়ে যায় আবার ।

চুপচাপ আমি অপর্ণার চোখের পানিতে ভেজা গালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো একটা একটা করে সরিয়ে দিতে থাকি ।
মায়াবতী মেয়েটা কিভাবে এক্সেপশনাল একটা কেস হয়ে গেল ?

_ ছয় _

একবছর পর আমার আর অপর্ণার বাসরটা করলাম তিয়ানার বাসাতে ।
তিয়ানা বৃষ্টির সাথে টর্নেডো বইয়ে দিল বাসাতে । আমি আর অপর্ণাই চুপচাপ শুয়ে ছিলাম একে অন্যকে ধরে ।
মেয়ে দুটো এতদিনেও ছেলেমানুষই থেকে গেল !

অপর্ণার সাথে আমার শর্ত ছিল, আম্মু বা আব্বু নিয়ে কোন কথা বলবে না আমার সামনে । আমাদের শরীরদুটো ঠাণ্ডা হতে হতে ফুরফুরে একটা দুঃখের অনুভূতি চেপে ধরে কেন জানি । কি নাম দেব এই অদ্ভুত অনুভূতির ? আমার জানা নেই ।

আমার বুকের সাথে মিশে থেকে অপর্ণা জানতে চেয়েছিল, ‘পুতুল মেয়েটা কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায় নি । তাই না ?’
সেদিন কেন জানি মিথ্যে বলতে পারি নি ওকে আমি, বললাম, ‘না । মেয়েটাকে রেপ করে মেরে ফেলেছিলাম আমি । ভুঁইয়া চাচার নাতনী হত সে । জাহিদ ভাই কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল । সাথে ছিল ভুঁইয়া চাচা । প্রতিশোধের জন্য আর কেউ ছিল না বাকি ।’
আমার বুকে আলতো করে চুমো খায় অপর্ণা, ‘কিচ্ছু হবে না । আমি বুঝি তোমাকে । তাছাড়া, আমার অতীত তো আরও বাজে । জানোই তুমি । এখন থেকে তো আর একে অন্যের বিশ্বাস ভাঙছি না আমরা । তাই না ?’
ওর খোলা পিঠে হাত বুলাই আমি, ‘তাই হ্যাঁ ।’

একে অন্যের প্রতি আমরা আজ থেকে বিশ্বাস রাখা শুরু করিনি । এক বছর হয়ে গেল, একে অন্যের প্রেমে আসলেই হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা । আমার মত একটা ছেলেকে কি মায়া দিয়ে যে বেঁধে নিয়েছে এই মেয়ে – আমি আজও বুঝলাম না ।

আমার দিকে চকচকে চোখদুটো তোলে অপর্ণা, ‘আর দ্বিতীয় শত্র ? তোমার বাবার শহুরে বন্ধুকে খোঁজ নি ?’
ওর ঠোঁট ভিজিয়ে দিলাম শান্তভাবে, ‘না । খুঁজে পাই নি আর তাকে পরে ।’

এই শেষ ! আর কোন মিথ্যে বলব না তোমাকে আমি, অপর্ণা !
উচ্চারণ করি মনে মনে ।

দ্বিতীয় শত্রু বলে অপর্ণা যাকে বুঝিয়েছে, সে ছিল আমার টার্গেট লিস্টের প্রথমে ।

*
শরাফত সাহেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুইজন ।
বাবা বিয়েটা মানবেন না – তাই আমাদের কাজীর কাছে যেতেই হয়েছিল । তিয়ানা-বৃষ্টি প্রচণ্ড সাহায্য করেছে আমাদেরকে । ওদের ঋণ শোধ করা যাবে না ।

শরাফত সাহেবের চোখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা নেই অপর্ণার । সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে । মোজাইকের ডিজাইন দেখছে মনে হচ্ছে নয়নজুড়ে । বাবার ধমকে শরীর সিঁটিয়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত একেবারে ।

আমি ওর মত গুটিসুটি মেরে নেই । সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি শরাফত সাহেবের চোখের দিকে ।
শরাফত সাহেব আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নেই । বরং একবার আমার, আর একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন তিনি ।

আমি জানি, তাঁর প্রতিটা কোষ চেঁচিয়ে বলতে চাইছে, ‘এ কাকে বিয়ে করেছিস তুই, অপর্ণা ? এই ছেলেটা তোর মাকে রেপ করেছে । তারপর খুন ! এ তুই কি করেছিস ??’

কিন্তু, সময়ের পাক ঘুরে গেছে । আমি জানি, আজ এই ঘৃণিত মানুষটা কিছুই বলতে পারবে না । কিচ্ছু না ।
বাড়িটিতে পা রেখেছিলাম মানুষটাকে খুন করার জন্য ।

আজ অপর্ণার হাত ধরে ওর রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই বুঝে গেলাম, পেছনে পড়ে আছে একজন মানুষ ।

পরাজিত একজন মানুষ ।

--- ০ ---
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×