কে আপন কে পর, চিনতে চিনতেই একটা জীবন গেল। কাকে বলি আপন? কাকে বলি পর? প্রশ্ন করা সহজ, জবাব পাওয়া মুশকিল। আপন-পরের একটা বর্ণনা_ সাধু আর ঠগ। প্রবাদে পাই, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। তার মানে সবাই ঠগ। গ্রামটাই খালাশ! সাধু নেই একজনও। তারপরও আমরা দমি না। আপনা মান আপনি রাখো, কাটা কান চুল দিয়ে ঢাকো! বন্ধু হারালে তো নিজেরই মান যায়। মানুষ হিসেবে মানুষেরই মান যায়। তাই আমরা তারপরও সাধুর সন্ধান করি। আপন খুঁজি। বন্ধু খুঁজি। বন্ধুত্ব করি।
সেই বন্ধুত্বেরও এক খবর আছে। এ খবর নতুন নয়। এ খবর আমরা হাজার হাজার বছর আগেই পেয়ে গেছি ঈশপের কাছে। ঈশপই যে এ খবর প্রথম দিলেন তা নয়, তার বহু আগেকার মানুষের বহু তেতো কিন্তু সত্য অভিজ্ঞতাকেই তিনি রূপকের আকারে গল্পে জানিয়ে গেছেন। ঈশপের গল্পে পাই_ দুই বন্ধু হাঁটছিল বনের মধ্যে, এমন সময় এলো ভালুক। একজন চট করে গাছে উঠে গেল আরেকজনকে ফেলে। দিশে না পেয়ে আরেকজন যে শুয়ে পড়েছিল মাটিতে, মরার ভান করে পড়ে ছিল, ভালুক তার কানে কানে কী বলে গিয়েছিল? বিপদেই বন্ধুর পরিচয়! চাচা আপন প্রাণ বাঁচা যার নীতি, সে আর যাই হোক আপনজন নয়।
বাস্তবে দেখি বন্ধুরাই এখন ভালুক। ঈশপের সেই উপদেশক ভালুক নয়, হন্তারক হয়েই সে আমাদের চলার পথে এখন অনবরত দেখা দেয়। তবুও বন্ধুর আশা কে ছাড়ে? বন্ধু যে চাই-ই চাই। বাকস্বার্থে বন্ধু এর যুক্ত হয়ে বন্ধুর_ যেমন বন্ধুর কাছে যাচ্ছি। একটু আড় করে যদি দেখি, বন্ধুর কেবল বাকস্বার্থেই নয়, নিজেই সে একটা শব্দ, যার অর্থ অসমতল, বিষম, উদ্ঘাতী। বন্ধুর পথ। কিন্তু ওই খটমটে শব্দটা কী? উদ্ঘাতী_ ওর মানেটা কী? মানে, যা ঠোকর দেয়, যাতে হোঁচট খেতে হয়। পথই কেবল এখন বন্ধুর নয়, বন্ধুরাও বন্ধুর। এই বন্ধুর শব্দটি যে এসেছে বন্ধুর মতোই বন্ধু সূত্রে, এ মোটেই আকস্মিক নয়। শব্দের শেকড়ে থাকে মানুষের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই আমাদের উপাদান জোগান দেয় শব্দ তৈরির কাজে। এর নগদ প্রমাণ দেখি এখানেই_ বন্ধু আর বন্ধুর শব্দ দুটির গর্ভ অভিন্নতা।
বন্ধুহীন মানুষ বড় অসহায়। বন্ধুহীন মানুষ মরা মানুষই বটে। মরা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমরা বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কিছু আকাঙ্ক্ষা নেই জীবিতের। মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। ভুবন অসুন্দর হলেও কে মরতে চায়? আত্মহত্যা তাই মহাপাপ_ সর্বকালে সর্বজাতিতে সর্বধর্মে।
এই যে আপন-পর, এই যে বন্ধু আর অবন্ধু, এসেছে মূলের শব্দ বন্ধ থেকে। উচ্চারণে এটি বন্ধো নয়, বন্ধ্_ পশ্চিমবঙ্গে হরতাল বোঝাতে যে শব্দটি, এর উচ্চারণ ঠিক তারই মতো। এই বন্ধ্ খোলাসা হচ্ছে বিশেষ্য পদে এসে_ বন্ধুন, আরও সরল করে বাঁধন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাই :
শাখাবন্ধে ফল যথা, সেই মত করি,
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি?
পদটার ভেতরে আমরা কি হাহাকার শুনতে পাচ্ছি? বন্ধু হারিয়ে ফেলবার হাহাকার? বহু বছর যে ছিল বন্ধু হয়ে সে এখন আর বন্ধু নয়। বৃক্ষের শাখা থেকে ফল খসে পড়বার শোকতুল্য এই বন্ধু হারানো। রবীন্দ্রনাথ শোক করে উঠেছেন কবিতায়, আর আমরা রক্তাক্ত হচ্ছি প্রতিদিন এর বাস্তবতায়। এ বাস্তবের সঙ্গে এখন আমাদের নিত্য বসবাস। বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা দেখে এখনও আমরা বন্ধু শব্দটা অভিধান থেকে মুছে ফেলিনি।
অভিধানে বন্ধু শব্দটা বেশ গৌরবের জায়গা নিয়েই আছে। কত ভাব-অভিভাব নিয়েই না আছে। সগোত্র, জ্ঞাতি, স্বজন_ রক্তের সম্পর্কে এরা তো আছেই, আরও আছে এক আশ্চর্য অভিধা এই শব্দটির_ অভিধানকর্তা জানাচ্ছেন, অ-ত্যাগসহন জন যিনি তিনিই বন্ধু। যার ত্যাগ যার বিচ্ছেদ সহ্য করা যায় না, সেই বন্ধু। ওদিকে, আকাশের দূর রোহিণী নক্ষত্রেরও এক নাম বন্ধু। একালে বন্ধু এখন আকাশের তারার মতোই দূরলক্ষ্য দূরস্থাপিত, ধরা যায় না, ধরার আশাও করা যায় না। থাকলেও আজকাল দেখা যায় না। মেঘেই ঢাকা পড়ে আছে। এই মেঘ স্বার্থের, ঈর্ষার, আত্মপরতার। তবু আমরা উৎসুক তাকিয়ে থাকি_ যদি দেখা যায়! তবু আমরা হাত বাড়াই_ যদি পাওয়া যায়! তবু আমরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেয়ে উঠি_ বন্ধু, রহো রহো সাথে। গেয়ে উঠি_ কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে।
কথা কী বলে? হাতে কি রাখে হাত? ছোটবেলাতেই পাঠ পেয়ে পাই যাই বিদ্যাপাঠের পদ্যাংশে : দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার কে তোমার বলে জীব করো না ক্রন্দন। আরও উপদেশ পাই, সংসার সমরাঙ্গনে যুদ্ধ করো দৃঢ়পণে, ভয়ে ভীত হয়ো না মানব। ভীত না হয়ে উপায় আছে?
মানুষের জন্য সবচেয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি, আমি তো এই দেখি, আপন-পর চিনতে না পারা, শত্রুমিত্র শনাক্ত করতে না পারা। সেই কবে প্রণম্য রামমোহন রায় ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতে বসেও এই চিনতে না পারার শোক ভুলতে পারেননি, গানেও তিনি গেয়ে উঠেছেন :তুমি কার, কে তোমার, কারে বল রে আপন! রামমোহনের মাথায় কি কেবল এই চিন্তাটাই কাজ করেছিল যে_ মানুষ নয়, ঈশ্বরই আসলে মানুষের আপন? মনে হয় না। আপনজনের কাছ থেকে আঘাত তিনিও তো কম পাননি। ধর্মবিশ্বাস, রাজনীতি, সামাজিক প্রথা কত কিছুই না নিয়ে তিনি মানবিকতা ও মূল্যবোধের পক্ষে সমেরুদণ্ড উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সেই তারই পিঠের পরে পড়েছে কত না লাঠি। ব্রহ্মসঙ্গীতের ওই পদ রচনা করতে গিয়ে সেই ইতিহাস কি তাকে তুলে রেখে দিয়েছিলেন রামমোহন? নিশ্চয়ই নয়। বাংলাদেশে একটা কথা এখন প্রায়ই শোনা যায় রাজনীতির আলোচনায়_ যখন সেই পুরনো পাকিস্তান ছিল, ছিলাম আমরা পাকিস্তানের মধ্যে, তখন শত্রুমিত্র চেনা যেত সহজেই; আর এখন বাংলাদেশ হয়ে শত্রুমিত্র মিশে গেছে, শনাক্ত করা শক্ত। মিশে গেছে মানে, এখন আমরা সবাই এই মাটিরই তো, তাই সবার চেহারা এক, বুলিও এক_ মিত্রর তো বটেই, শত্রুদেরও। এ এক চমৎকার ছদ্মবেশই বটে।
সাহিত্যের মাঠেও বাংলাদেশে এ ছদ্মবেশ আছে। সাহিত্য মানুষের সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্র। আর, সৃষ্টিশীলতা মানেই তো মানবের অনুকূল একটি কাজ। কাজটি যারা করেন তাদের কাছে মানবিকতা আর মূল্যবোধ আশা করাটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাও এখন বিপন্ন, নষ্ট, ধ্বস্ত। শ্রদ্ধা এখন অন্তর্হিত আমাদের সাহিত্যিক সমাজে। রচনার চেয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠা দেবেন না? ঘাড়ে ধরে আদায় করে নেবো। আপনি বড়? আপনার জায়গায় উঠতে না পারি, আপনাকে টেনে নিচে নামাতে পারি তো! কাজে না পারি, চরিত্রহনন করে খুবই পারি। পেরে সেটা দেখাচ্ছিও আমরা।
রাজনীতি আর সাহিত্য থাক, সমাজেও এখন এই হাল। বাঙালির এখন একটা চরিত্র লক্ষণই হয়ে দাঁড়িয়েছে_ কে কাকে টেনে নামাতে পারি। বাঙালি এখন উঠতে ভুলে গেছে। ওঠাতেও ভুলে গেছে। নামানোতেই তার উল্লাস। এ উল্লাসে যোগ দিতে আমরা সবাই উৎসাহী। বাঙালি এখন কারো বিষয়ে ভালো কথা শুনলে হাঁ হুঁ করে উদাসী ধ্বনি করে, সত্যমিথ্যা যাই হোক কারও বিষয়ে মন্দ কথার আভাস পাওয়া মাত্র কান ঘন করে আনি_ বলুন, বলুন, আরও বলুন তো!
হাটেবাজারে শোনা যায়, মানুষ চেনা দায়, মানুষ চেনা মুশকিল। অথচ কী মুশকিলে কথা, মানুষ থাকে চোখের সামনেই। এত দেখেও ঠাহর হয় না, কে আপন কে পর। আপন বলি কাকে? আপন তো নিজ, নিজেই। আপন এসেছে আত্মীয় থেকে। আত্মীয় প্রাকৃতে এসে হয়েছে অপ্পণ, সেই থেকে বাংলায় ওটি আপন। তবে আত্মীয়েরই খোঁজ নেওয়া যাক আগে। এ আত্মীয় পারিবারিক অর্থে ব্যবহার আমরা করলেও এর ভেতরের কথাটা হচ্ছে_ আত্ম শব্দটার সূত্রে_ আমরা, আমারই, নিজের, নিজেরই। আর কোথাও না হলেও আত্মহত্যা আর আত্মসাৎ ক্ষেত্রে আত্ম-টা আমরা অনায়াসে লাগাই, বলি, বলে আসছি। কিন্তু ভুলে গেছি এই আত্ম শব্দের রঞ্জন ও ব্যঞ্জনা সর্বাংশেই।
আত্ম যে নিজ, আত্মীয় যে নিজেরই, আত্মীয় থেকে গড়ে ওঠা সেই আপন শব্দটা যে ব্যক্তিরই নিজ প্রকাশক একটি শব্দ কেবল তা নয়_ সম্প্রসারণে সে আরও গভীর কিছু বলে, আমারে মনুষ্যত্বের কথা বলে, মূল্যবোধের কথা বলে, মানবসংঘের কথা বলে, সভ্যতা সংস্কৃতি যে এই আপন এই আত্মীয় এই আপনতা এই আত্মীয়তা-র বাহনেই চড়ে এসেছে_ আজ কে মনে রাখে এ সকল?
আপন-এর বিপরীতে পর শব্দটাতে দোষ দেখেছি শতেক? খোঁজ নিলে অবাক মানতে হবে, অভিধানে কিন্তু পর শব্দটা খারাপের ব্যঞ্জনে আদৌ আসেনি। পরদিন, পরবর্তী, পরকাল কি খারাপ ব্যঞ্জনার শব্দ? বরং পর-এর অর্থ ভালোর মধ্যে এতটাই ভালো যে প্রকৃষ্ট, শ্রেষ্ঠ, উত্তম, পরম, নিরন্তর, মোক্ষও বোঝায়। এর কোনোটাই কি দোষের? কিন্তু ভাষায় হয় এই_ শব্দ বদলায় না, শব্দের রঞ্জন ও ব্যঞ্জন বদলায়, বদলায় সে মানুষেরই হাতে।
অভিজ্ঞতা প্রকাশের চাপে মানুষ পুরনো শব্দকে পুরনো চেহারাতেই নতুন করে তোলে অর্থে। এই রকম বহু শব্দের মধ্যে একটি এই পর শব্দটা। পরচর্চা চেনা লাগছে? আড্ডাবাজ বাঙালি হিসেবে তো আমাদের চেনবারই কথা। চর্চা-র সঙ্গে জুড়ে সে নিন্দনীয় হয়ে উঠেছে। পরকীয়-র স্ত্রীলিঙ্গরূপ ধরে পরকীয়া হয়ে উঠেছে। ছিঃ। আর বেশি কিছু বলতে হয় না, ওই এক শব্দেই খেউড়ের চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এরই পাশে পরোপকার আজও শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে পুণ্যের পোশাকে। পরকে উপকার। অন্যের উপকার সাধন। পর এখন বাংলা ভাষায় বোধহয় ওই একটি জায়গাতেই_ পরোপকার-এ তার আদি রঞ্জন ও ব্যঞ্জনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর কোথাও নয়। বাস্তবক্ষেত্রে সে পরোপকারও এখন পরিহাস্য হয়ে পড়েছে বটে।
বিপরীতে আপন সংকীর্ণ হতে হতে আমাদেরই স্বার্থের ভেতরে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। আর এ স্বার্থ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থই। ক্ষুদ্রই কেবল নয়, সভ্যতা, সংস্কৃতি মানবিকতাবিরোধী। মায়ার খেলা গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :
আপন মন নিয়ে কাঁদিয়ে মরি
পরের মন নিয়ে কী হবে?
কথাটা এখন তার নাট্যের অভিপ্রায় ছেড়ে আমাদেরই কুবাস্তবে আমাদের বেলায় খুবই খাটানো যায়। আপনব্যস্ত আত্মব্যস্ত আমরা এখন পরের কথা ভাবিই না। কবি চণ্ডীদাসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হয় : আপন শির হাম আপন হাতে কাটিনু। আমরা আপন-কে সংকীর্ণ করতে করতে আমাদের মানুষ-মাথাটিকেই কেটে বসে আছি। তবে, ঈশপের সেই ভালুকের মনে যে কথাটা ছিল, তারই প্রকাশ বুঝি রবীন্দ্রনাথের ওই গীতিনাট্যেই পাই, ওই পদেরই পরে পরে :
আপন মন যদি বুঝিতে পারি
পরের মন বুঝে কে কবে?
আপনাকে_ নিজেকে_ চেনাটাই কাজ। নিজেকে চেনা গেলেই পরকে চেনা যাবে। নিজের জন্য কাঁদতে পারলে তবে অশ্রু ঝরবে পরের জন্য। তখন আমরা আমাদেরই ক্লিষ্ট স্বার্থতা সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। তখন পর হবে আপন, আপন হবে না পর।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:১৭