ঢাকায় একটি ছোট বাচ্চা মেয়ের যোগসাজশে তার বাবা মা দুইজন নৃশংস ভাবে খুন হয়েছে। এইটাই খবর এখন। টক অফ দ্যা টাউন। আমাদের দেশে কি এমনটা হওয়ার কথা ছিল?
মনে করিয়ে দেই, "ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ"?
নাহ! এত স্নেহে আসলেই ভাটা পড়েছে এবার। মারামারি, কাটাকাটি নয়। সোজা খুন! কি বীভৎস!
আসুন এবার একটু গভীরে যাই। একটু ভাবি। তাহলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবো (হয়তো!)।
আমেরিকায়, কানাডা, ম্যাক্সিকো আর ইউরোপে এধরণের খুন হয়। বাবা মাকে হত্যা করে স্কুল বয়সী শিশুরা। শুধু তো বাবা মাকেই হত্যা করে তা নয়। এর সাথে যুক্ত হয় উন্মত্ততা। স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকে গুলি করে ৬-৭ জন শেষ হয়ে গেল।
আমাদের বাবা মারা কখনই সন্তানদের দূরে সরিয়ে রাখেন না। ইউরোপ, আমেরিকায় যেটা করা হয়। এক বছরের বাচ্চাকে আলাদা ঘরে শুতে দেওয়া হয়। ছোট বেলা থেকেই একটা দাগ টেনে দেওয়া। এই দাগ কিন্তু একাকীত্বের দাগ নয়, এটা হলো স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেওয়া।
এই ধারণার একটা ভয়ংকর দিক আছে। বাবা মার সাথে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সন্তান স্বাধীন তো হয় ঠিকই, কিন্তু এই স্বাধীনতাই তার কাল হতে পারে। আমেরিকায় "সিরিয়াল কিলার" আর "সাইকো" দুইটা জিনিস খুবই প্রচলিত নয় কি?
আমাদের দেশে মা বাবা এরকম করে সন্তানদের দূরে ঠেলে দেন না। তবে তারা একটা কাজ করেন যা আরও মারাত্মকভাবে ছেলে মেয়ে থেকে বাবা-মায়ের দূরত্ব সৃষ্টি করে। বিত্তশালী মায়েদের প্রায়শই দেখা যায় কাজের মেয়ের হাতে বাচ্চা তুলে দিচ্ছেন। হয়ত তিনি হাউজ ওয়াইফ, কোন কাজ নাই সারাদিন, তবুও কাজের মেয়ে একটা ক্ষেত্রবিশেষে তিন-চারটা।
ছেলে-মেয়ে রাতের বেলা শুধু বাবা-মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছে। বাকিটা সময়? সেই কাজের মানুষের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। শেষে ছোট অবস্থাতেই বাচ্চার এমন হয় যে সে বাবা-মার একটা ধমক শুনতে পারে না, অথচ কাজের মেয়ে বা ছেলের কথায় সব করে। কার্টুন দেখে, সিনেমা দেখে, দেখা যায় তাদের সাথে কাজের লোক।
মা-বাবা সাময়িক ভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেন। ছেলে মেয়ের দুই একটা বেয়াদবি চর থাপ্পড় দিয়ে সামলে নেন। অথচ, তাঁরা এই সত্যটা বুঝতেই পারেন না যে সন্তানের থেকে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।
আমার শৈশবে আমার মা এই কাজটি করতেন না। যদিও দুইজনই চাকরিজীবী ছিলেন। আমার ও আমার বোনকে তাঁরা নিজেদের হাতেই গড়েছেন। তাই তাদের সাথে শত জায়গায় আমার দ্বিমত হলেও নৈকট্য-টাই কিন্তু উপলব্ধি করি। আর তাই অনেক সময় নিজের অনেক ইচ্ছাই বিসর্জন দিতে শিখেছি হাসিমুখে।
পেশাজীবী বাবা-মা হয়েও দুইজনই বাচ্চা নিজের মত লালন করতে পারেন। এমনটা করতে অনেক কষ্ট হয়। তবে এইটাই নিয়ম। বাচ্চাকে দূরে ঠেলে দেওয়া খুবই ভয়ংকর।
ঐশি (টক অফ দ্যা টাউন) এর ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
এখানে আরেকটি জিনিস লক্ষ্যণীয়। তার আগে অবশ্য আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা জরুরী। ১৯৯৭ সালে আমার বাবা-হঠাতই আমাকে ইংলিশ মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়ামে ট্রান্সফার করে দিলেন। আমি খুবই মর্মাহত হলাম। কেন করলেন সেটা জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা অত ধনী নই।
ধনী হয়ত আমরা ছিলাম না। তবে আমি জানতাম বাবা ঠিকই স্কুলের খরচটা দিতে পারত। কিন্তু বাবা সেটা করেননি। এখন বুঝি কেন। ইংলিশ মিডিয়ামে বড়-লোকের বড় পোলা অনেক বেশি। এদের সাথে মিশলে আমিও সেরকম বড় পোলা হয়ে যেতে পারতাম। আরে "বাংলা" হইলো তোর ক্ষেতের ভাষা, ক্ষেতের সাহিত্য (এই কথাটা সত্যই আমার এক ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া বন্ধুর মন্তব্য)।
আরেকটা উদাহরণ এরকম। আমরা ছিলাম চরম মধ্যবিত্ত। বাবা ভাবলেন বাংলা মিডিয়ামে দিলে অনেক মধ্যবিত্তের মধ্যেই আমি বড় হবো।
সত্যি তাই হলো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা বড় আজব। কোনদিন দশটাকার বেশি টিফিনে খরচ হলে সবাই আফসোস করতাম! আর সেই থেকেই তো আমাদের বুঝতে শেখা।
সুতরাং পারিপার্শ্বিকতাটা নির্ধারণ করাটাও বাবা-মার একটা মুন্সীয়ানা হওয়া উচিৎ। অক্সফোর্ডের মত স্কুলে একটা ছাপোষা পুলিশ অফিসারের মেয়ে কি মানায়? বড়লোকের ছেলে-মেয়েরা বড় হয় টাকার বান্ডিল দেখে। ওদের কাছে খুন, চুরি ড্রাগ হলো কুলনেস। আমাদের কাছে হাস্যকর।
সুতরাং মনে রাখবেন। এই দুইটা জিনিসের ব্যাপারে সতর্ক হোন। তাহলেই বাচ্চা লাইনে থাকবে। আর না হলে, গন কেস!