somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্ববিরোধী ধর্মের কিচ্ছা!

২৭ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার অফিসের কলিগের সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। তার সাথে এই আলোচনার সূত্রপাতটি হলো অনেকটা এরকম, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এরকম বিগ্রায় গেলেন কেন?

আমি প্রথমে প্রসঙ্গটা বুঝি নাই। আমি বিগ্রায় গেলাম কেমন করে? আমি তো খেটে খাওয়া আর দশটা ছেলের মত চালিয়ে নিচ্ছি। তিনি বললেন, না মানে এই যে আপনি লিবারেল চিন্তা করেন, নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেন, ধর্মের গোড়ামীর বিরুদ্ধে বিনা-বাক্য ব্যায়ে দাঁড়িয়ে যান, এসব কেন হলো?

প্রশ্নটা আমাকে শৈশবের অনেক দূরের কোন দিনে নিয়ে গেল। আমি জন্মেছিলাম লিবিয়ার এক সমুদ্র সৈকতের পাড়ের গ্রামে। আরবীদের মধ্যে আমার জন্ম ছিল। তবু আমি কখনই তাদের সাথে সেই অর্থে মিশি নাই। আমার মেশার মানুষ ছিল লিবিয়ার বাঙ্গালিরা আর আমার আপণ পরিবার।

সে সময়টাতে বাঙ্গালিদের মধ্যে সবথেকে বেশি কথা হতো বাংলাদেশকে নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে। আমি দেখতাম লিবিয়ানরা ভারতীয়, বাঙালি আর পাকিস্তানিদের নির্বিশেষে "পাকিস্তানি" বলে সম্বোধন করত। আর বাঙ্গালিকে যদি পাকিস্তানি বলা হত তাহলে বাঙ্গালিরা গোয়ারতুমি শুরু করত। তারা পুলিশের মুখের উপর বলত, "আই এম বাংলাদেশি, নট এ পাকিস্তানি"।

তো এক লিবিয়ান পুলিশকে বাস্টার্ড গালি দিয়ে এক বাঙালি তো জেলে ছিল সারা রাত। পুলিশের অপরাধ ছিল সে তাকে পাকিস্তানি বলেছে, আর বাঙালি সেই সম্বোধন সহ্য করতে না পেরে তাকে বেজন্মা গালি দিয়েছে।

লিবিয়ার কথা আরেকদিন লেখা যাবে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসলাম। আর যাবো না লিবিয়ায়। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তখন লিবিয়ার মানুষ ফুসছিল। একথা বাঙ্গালিরা বিশ্বাস করে না।

যাহোক, বাংলাদেশে এসে তো আমার চোখ চড়ক গাছ। এই দেশের মানুষই কিনা পাকিস্তানের জন্য জান দিয়ে দিতে চায়। আরবী শিক্ষা করার জন্য আমার বাসায় এক হুজুর রাখা হলো। ভারত পাকিস্তান নিয়ে কথা উঠছিল, খেলা প্রসঙ্গে। আমার হুজুর পাকিস্তানের জানি সাপোর্টার। তিনি বললেন, জান দিয়ে হলেও মুসলমানকে সাপোর্ট করতে হবে।

আমি তখন ছোট। শুধু এইটুকু বুঝি পাকিস্তান আমাদেরকে অমানুষের মত হত্যা করেছে ১৯৭১ সালে। তাহলে এই দাড়িওয়ালা নেক বান্দা কেন এই বিভতস্য দেশটাকে সাপোর্ট করে? কোন অর্থে সাপোর্ট করে?

আমিও হুজুরকে জবাবে বলেছিলাম, আমি মরে গেলেও পাকিস্তানের পক্ষে যাবো না। বিষয়টাতে হুজুর যেন আকাশ থেকে পড়লেন। আমার বাবাকে বললেন, আমাকে নিয়ে মসজিদে যাবেন। সেখানে আমার আরবী শিক্ষা হবে, আর নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া হবে। আমার বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ছেলেকি বেশি ত্যাদড় নাকি, ত্যাদড়ামি বেশি করলে পিটান।

হুজুর বলেছিল, ছেলে অতিশয় ভদ্র কিন্তু পাকিস্তানকে সে সাপোর্ট করে না। সুতরাং তার হেদায়তের দরকার আছে। আমার বাবা তখন হুজুরের উপর চটেছিলেন। বললেন, আপনার কাজ ওরে আরবী শিক্ষা করানো, ও ইন্ডিয়া না পাকিস্তান সাপোর্ট করবে সেটা ঠি করার আপনি কে? ডু ইউর জব, আমার ছেলেকে এই চৌকাঠের বাইরে নেওয়ার চেষ্টাও করবেন না।

হুজুর তখন মাসে ৫০০ টাকা করে পায় আমাদের বাসা থেকে। আর শুক্রবারে পায় এক প্লেট পোলাও, তাই তিনি আমাকে আরবী শিক্ষা করানো বন্ধ করেন না। আমার সাথে আমার বোনও তখন আরবী শিক্ষা করত। হুজুর আমাকে আরেকটি (অ)শিক্ষাও দিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েদের ঋতুস্রাব হয়। তখন আমার বয়স ৮ কি ৯ বছর! কেন তিনি আমাকে এ কথা শিখিয়েছিলেন আজও বুঝতে পারি না।

সেই থেকেই নানা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। প্রথম প্রশ্নই হলো কেন? কেন একটা লোক হলোকাস্টকে সাপোর্ট করে?

তখন আসলো সেই বিখ্যাত থিওরি। "খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না"। তখন প্রশ্ন জাগলো, তাহলে ফুটবল খেলায় কেন মানুষ আমেরিকাকে সাপোর্ট করে না? নানা ভাবেই তো আমরা আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। আবার ভিসার ডাক দিলে আমরা ছুটে যাই কাশিমপুরের কুঠিতে, আমারও ভিসা চাই।

আরেকটু বড় হলে ঘটে আরেকটি ঘটনা। যেটা আমাকে সম্পূর্ণ ধর্ম বিমুখ করে তোলে। আমি একটি ক্রিষ্টান মিশনারী স্কুলে পড়তাম। সে স্কুলের প্রতি ক্লাসে খ্রীষ্টান, হিন্দু আর মুসলমান ছিল। মুসলমানরাই সংখ্যাতে বেশি ছিল। যখন আমাদের ধর্ম ক্লাস হতো, তখন খ্রীষ্টানরা বেড়িয়ে যেত তাদের ধর্ম ক্লাস করতে, আর হিন্দুরা বেড়িয়ে যেত তাদের ধর্ম ক্লাস করতে। আর আমরা মুসলমানরা বসে থাকতাম আমাদের ধর্ম ক্লাস করতে।

তো একদিন কি হেতু জানি অন্যান্য ধর্মাবল্বিরাও আমাদের ক্লাসে থেকে গেল। পুরো ৩৫টি মিনিট তারা ইসলাম ধর্ম ক্লাসই করল। যিনি আমাদের হুজুর ছিলেন তিনি হিন্দু খ্রীষ্টানদের ভর্তসনা করে কথা ছেড়ে গেলেন। হিন্দুরা মূর্তি পূজারি তাই তারা খারাপ, খ্রীষ্টানরা শুয়োরের মাংসখেকো তাই তারাও খারাপ। ক্লাসের তাবৎ হিন্দু খ্রীষ্টানরা পুরো ক্লাস মাথা নিচু করে সহ্য করে গেল।

আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল রিকি এন্থোনী নামের এক ছেলে। সে খ্রীষ্টান, আরবী স্যার ক্লাস থেকে চলে গেলেও আমরা বন্ধু ছিলাম। সে শুকুরের মাংস খায় বলে তাকে আমি ঘৃণা করব এমনটা আমার মনে সৃষ্টি হয়নি।

সেদিন ক্লাসে অন্যান্য ধর্মাবল্বিদের এই অপমান আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম যদি আমার ধর্ম নিয়ে কেউ এভাবে আমার সামনে বলত? কোন অধিকারে একজন শিক্ষক এমনভাবে ক্লাসে কথা বলবেন? কেন বলবেন?

আরও প্রশ্ন বাড়তে লাগল, উত্তর মিলে না। স্কুল কলেজের গন্ডি পার হয়ে পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে। ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ত ভালো কিছু মুক্তমনা পাবো। কিসের কি, কেউই মুক্তমনা নয়। উলটা। আমার এক বান্ধবী আমাকে বলল, হিন্দুদের সাথে এত মিশিশ কেন? ওরা কি খায় না খায়, নাপাক থাকে সারাক্ষণ!

এসবই আকাশ থেকে পড়া কথাবার্তা। কারণ ছোটবেলা থেকে মানুষে মানুষে ধর্মের ভেদাভেদ করতে চাইতাম না। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সকলেই মানুষ সেই শিক্ষার কোন প্রতিফলনই পড়তে দেখলাম না ভার্সিটিতে পড়ুয়া আমার বন্ধুদের গায়ে। তারা সকলেই হয় মেয়ে মানুষ নয় হিন্দু খ্রীষ্টানদের জাত ধৌত কাজে ব্যস্ত থাকত।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষভাগে হলো রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে আক্রমণ। কেউই কোন কথা বলল না। ভাবটা এমন যে বৌদ্ধরা তো কুকুর বিড়াল, ওরা মরলে আমাদের মাথা ঘামাতে হবে কেন?

তখন আমি এক সূত্র ধরে আগালাম। ভাবলাম ধর্ম তো মানুষ ইনহেরিট করে। কাউকে জন্মের সময় অপসন দেওয়া হয় না তুমি কোন ঘরে যাবা, হিন্দুর ঘরে নাকি মুসলিমের ঘরে। তাহলে কেন ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে এত বিভেদ ছড়ানো হয়।

তা যাহোক, এখন দেখছি মুসলিমদের সেই দ্বৈত চেহারা দিনকে দিন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আইসিস যখন নবী ইউনূস (আঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ উড়ায় দেয় তখন তারা নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু হিন্দুরা যদি বাবড়ি মসজিদের কথা শুধু মুখে বলে, তাহলে এই দেশে সব হিন্দু কতল করতে বের হয়ে যায়!

বর্তমানে ইসরায়েল গাজায় যে মানুষ হত্যা করছে, এটা মুসলমানরাও চায়। কেননা এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনেক অনেক জঙ্গি বানানো যাবে, আর বিধর্মীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার কাজেও একে ব্যবহার করা যাবে। মসজিদে মসজিদে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইসরাইল আর গাজার নামে, মনে হয় একেকটা মুসল্লি একটি মানব বোমায় পরিণত হচ্ছে। এরা যেকোন সময় ফেটে পড়বে।

ক্রমেই বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলমান দেশগুলোকেও দেখা যাচ্ছে একই রাস্তায় হাটতে। তারা ইসলামি জঙ্গিদের টেরোরিজমকে চোখে দেখাও দেখে না, কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় কত মানুষ মরল তা মুখস্থ করে রেখেছে।

আরও অনেক অবাক করা বিষয়ই লক্ষ্য করছি। ১৯৭১ সালে আমাদের সাহাযার্থে কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। কারণ মুসলমানরা যখন মুসলমানদের হত্যা করে, সে কি শিশু মারছে নাকি নারী মারছে তা অন্য মুসলমানদের কাছে জায়েজ। ১৯৭১ সালে যেহেতু পাকিস্তান আমাদেরকে হত্যা করেছে, তাতে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যাথা ছিল না। মাথা ব্যাথা ছিল ভারতের আর রাশিয়ার! কি অদ্ভূত!

আর এখন যখন ঐ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কথা বলা হয়, তখন সবার আগে মুসলিম দেশগুলাই এর বিরোধিতা করতে শুরু করে!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৫৪
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড্রাকুলা

লিখেছেন সুদীপ কুমার, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১২

কোন একদিন তাদের মুখোশ খুলে যায়
বেরিয়ে আসে দানবীয় কপোট মুখায়ব।

অতীতে তারা ছিল আমাদের স্বপ্ন পুরুষ
তাদের দেশ ছিল স্বপ্নের দেশ।
তাদেরকে দেখলেই আমরা ভক্তিতে নুয়ে পড়তাম
ঠিক যেন তাদের চাকর,
অবশ্য আমাদের মেরুদন্ড তখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×