আজকের তরুণেরাই আগামীদিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে।’
রাজনীতিবিদ,সুশীলসমাজ,বুদ্ধিজীবী মহল,স্কুলের হেডমাস্টার আর কলেজের প্রিন্সিপালদের মুখে মুখে একথা শুনতে শুনতে আমরা অতিষ্ঠ।কি করে ফেলছে এই তরুণ সমাজ আর কিইবা করবে? আমার ইংগিত অন্যদিকে।আমাদের দেশের রাষ্ট্রনীতি থেকে সমাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদেরা।যে তরুনেরা আগামীদিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে,তাদের রাজনৈতিক দর্শন আমাদের জেনে নেয়াটা খুবই জরুরী।আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে যে, শিক্ষার্থীরা বা তরুণেরা আসলে কোন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী? আওয়ামীলীগ,বিএনপি,জামায়াত কিংবা খুব বড় জোর কমিউনিস্ট ভাবছেন তো?
একটু অন্য রকম ভাবুন।সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের অধিকাংশ তরুণদের,শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দর্শন(Political View) যেন I hate politics কিংবা politics sucks! ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক দর্শন এই,সেই দেশের তরুণ সমাজ তথা শিক্ষার্থীরা কিভাবে ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে??
নেতৃত্ব তারাই দেবে যে সব তরুণদের এখন রাজনৈতিক দর্শন আছে।আর মূলত এসব রাজনৈতিক দর্শনওয়ালা শিক্ষার্থীদের কর্মকান্ডের জন্যই সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতি বিমুখ।ছাত্র রাজনীতি এখন সন্ত্রাস-রাহাজানী-নৈরাজ্যের উদাহরণ।কোন যুক্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা-ক্লাসের ফার্স্ট বয়,ফার্স্ট গার্লরা রাজনীতি করতে যাবে?জরিপ করে দেখুন,তারা চায় যেন ছাত্র রাজনীতিটা বন্ধ করে দেয়া হোক।সন্ত্রাস-রাহাজানীর নামে রাজনীতি দিয়ে নিজের ভবিষ্যত কে অনিশ্চিত করতে তারা মোটেই আগ্রহী নয়।যে সমাজের সভ্যদের নিজের জান-প্রাণের কোনো গ্যারান্টি নেই সেই সমাজের সভ্যেরা কোন দুঃখে এই পঁচা গলা রাজনীতির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেম দেখাতে যাবে!
স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট দলকে সমর্থন করা আর ইসলামী ব্যাঙ্ক-রবি’র সৌজন্যে বৃহত্তম জাতীয় পতাকা-লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত এখন তাদের দেশপ্রেম।আমাদের দেশে ডিজুস-এয়ারটেল ভালোবাসার নতুন সংস্করণ বাজারে এনেছে।যা এখন কর্পোরেট ভালোবাসা বা বাণিজ্যিক ভালোবাসা নামে পরিচিত।একই ভাবে দেশপ্রেমটাও এখন কর্পোরেট হাউস আর বিদেশী কোম্পানীর পণ্যে পরিণত হয়েছে।বাংলালিংকের গভীর দেশপ্রেম ভরা বিজ্ঞাপন আমাদের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে।পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় চেতনা,আদর্শ আর মূল্যবোধ সবই আজ পণ্য। তাদের মহিমায় জাতীয় পঁচা গলা রাজনীতি নিয়ে নীরব থাকা বা পক্ষপাতিত্ব না করাটাও এখন এক পর্যায়ের দেশপ্রেম।
কোনো একজন খুব হতাশ হয়ে আমাকে একবার বলেছিলেন,দখলদারেরা যতবার আমাদের দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে,সব সময় সাথে করে একটা জিনিস নিয়ে গেছে।সেটা হচ্ছে মেরুদন্ড।বাঙালীদের সম্ভবত মেরুদন্ড বলে আজ আর কিছু নেই।কুঁজো হয়ে থাকতে থাকতে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজনই অনুভব করিনা।
বায়ান্ন,বাষট্টি,ঊনসত্তর,একাত্তর,নব্বই এমনকি দু’হাজার তেরোর আন্দোলনের পরেও আমি একই কথা বলবো।কারণ সাময়িক সেই মাথা তুলে আমরা আবারো কচ্ছপের মতন খোলসে ঢুকে যেতে দ্বিধা করিনি।
ধরা যাক,এক বড় ভাই যে কিনা হোস্টেলের সিট দখল করে রাখেন,সে বড় ভাই যদি আপনাকে বিশেষ খাতিরে সিটের ব্যবস্থা করে দেয়।আপনি নিশ্চয়ই খুশী হবেন?জেনে রাখুন, সে বড় ভাই যখন আপনাকে সিট দেয়,সেই সাথে আপনার মেরুদন্ড আর বিবেকটাকে তার পকেটে তুলে রেখে দেয়।এক বার সিট পেয়ে গেলে সে ভাইয়ের পক্ষে অন্যায় স্লোগান দিতেও তখন আর বিন্দু মাত্র দ্বিধা থাকে না।আপনি তখন সেই নষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে যান সহজেই যদিও তখনও ফেসবুকে আপনার পলিটিক্যাল ভিউ থাকে I hate politics! ছাত্র রাজনীতির এই নষ্ট সংস্কৃতিকে আমরা এসব সহজেই মেনে নেই।আজকের টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা আগামীদিনে দেশকে নেতৃত্ব দেবে এ সত্যও আমরা সহজেই মেনে নিয়েছি। এমনকি সুশীলসমাজ,বুদ্ধিজীবী মহল,স্কুলের হেডমাস্টার আর কলেজের প্রিন্সিপালরাও মেনে নিয়েছেন।আর সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।কারন আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ও বুদ্ধিজীবীরা নিরপেক্ষ।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক,
আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন এমন সময় দেখলেন একটা শেয়াল মুরগী চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন।আপনি যদি একটা ঢিল ছুঁড়েন তাহলে শেয়ালটা মুরগী ছেড়ে পালায়।কিন্তু আপনি মুরগীর পক্ষও নিলেন না,শেয়ালের পক্ষও নিলেন না।অর্থাৎ,আপনি নিরপেক্ষ।আল্টিমেটলী,আপনি আসলে শেয়ালের পক্ষই অবলম্বণ করলেন।
শিক্ষার্থীরা এখন কোন পক্ষ অবলম্বণ করবে?
আর একটা বিষয়,ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করণ।এ ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী মহল আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেশ উদ্বিগ্ন।বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও।সাবেক এক মার্কিন উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নতি না হওয়ার কারণ এদেশের ছাত্র রাজনীতি।’ তার এই উদ্বিগ্নতার কারণটা স্পষ্ট করে দেই।মার্কিন উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানেন যে,বায়ান্নে-বাষট্টিতে-ঊনসত্তরে-একাত্তরে-নব্বইয়ে-দুই হাজার তেরোতে যতো বার এদেশে গণজোয়ারের সৃস্টি হয়েছে তার নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা,তরুণেরা।সুতরাং,যত বেশী করে এদেশের ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে রাজনীতি বিমুখ করে রাখা যাবে,যত বেশী করে নিজের আশ-পাশ সম্পর্কে অসচেতন রাখা যাবে বাংলাদেসকে গ্রাস করতে তাদের ততই সুবিধে হবে।আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে সাম্রাজ্যবাদীদের বুনে রাখা এই জাল ছড়াচ্ছেনা আর আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে সেই জালে আটকে পড়ছি না তা ভাবার সময় এসেছে।
ছাত্র রাজনীতির নামে এখন যা চলছে তা একটা সমস্যা।কিন্তু মূল সমস্যা হলো বর্তমান নষ্ট সমাজ ব্যবস্থা।নষ্ট এই সমাজের গর্ভেই জন্ম বিকৃত রাজনীতির।প্রগতিশীলতা-দেশপ্রেমের অলিতে গলিতে এখন ময়লার স্তুপ জমে গেছে।তারুণ্যের বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাস তাই সহজেই মিলিয়ে যায়।আমাদের চিৎকার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী।আমরা এখন শুধু প্রতিধ্বনীই শুনতে পাই,প্রতিউত্তর নয়।এই ঘরের দেয়াল আমাদের ভাঙতে হবে।
এই পোকা খাওয়া নষ্ট পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে একটি শোষণ মুক্ত,সাম্যবাদী,মানবিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবী। মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলার ভুল নীতি পরিবর্তন করে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে।এই আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদেরকেই রাখতে হবে প্রধান ভূমিকা।ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদের প্রতিভূ সংগঠনগুলোর পরিবর্তে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় বাংলাদেশের সবচাইতে অগ্রসর,আধুনিক,প্রগতিশীল,বিপ্লবী ধারার দেশের একমাত্র স্বাধীন ছাত্র গণ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন ব্যতীত অপরাপর ছাত্র সংগঠন গুলো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠন।অপরাপর সংগঠন গুলো যেখানে নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী আর নেতা নেত্রীর নির্দেশ মানতেই ব্যস্ত সেখানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও শোষণ বঞ্চনাহীন,সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী,মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মহান লড়াই সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রাখছে।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ চেতনা থেকে ঐ বছরের ২৬শে এপ্রিল জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে,সময়ের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জন্ম হয় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের।বিগত ৬ দশকের গৌরবময় ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এখনো প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠন হিসেবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আমার আহ্বান এখানে সুস্পষ্ট।দেশের প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীর এই নষ্ট সমাজ ব্যবস্থার জায়গায় সাম্যবাদী মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবী।
আমরাতো মিলেছি পৃথিবীর লাঞ্চিত সংগ্রামী মানুষের কাফেলায়
যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম সেখানেই আমরাতো মিলি লৌহ দৃঢ়তায়