somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা স্যাটায়ার রিভিউ- "ফুড কনফারেন্স"(১৯৬৯)-আবুল মনসুর আহমদ

১৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্কুলে থাকতে আবুল মন্সুর আহমদের দুইটা গল্প পড়েছিলাম । একটা হল “সবজান্তা শমশের” ও আরেকটি হল আদু ভাইয়ের গল্পটা । দুইটা গল্পই ছিল পাঠ্য । আর ইন্টারে পড়েছিলাম “রিলিফ ওয়ার্ক” । স্যাটায়ার আমার ভালো লাগা শুরু হয়েছিল আবুল মনসুর আহমদের লেখা পড়ার সময় থেকেই । বাংলা বই থেকে জানতে পেরেছিলাম লেখকের অন্যান্য লেখার নাম । “ফুড কনফারেন্স”, “আসমানী পর্দা” ইত্যাদি বইগুলো পড়ার ইচ্ছা তখন থেকেই হয়েছিল ।

একদিন বইয়ের দোকানে গিয়ে থরে থরে সাজানো বইয়ের বামদিকে খেয়াল করি বেশ কিছু পুরোন আর কম চোখে পড়ে এমন কিছু বই সাজানো আছে । “ফুড কনফারেন্স” বইটাও চোখে পড়ল । কি টাইপের বই সেটা নিয়ে ক্ষনিক ধোঁয়াশায় থাকলেও বইটা কিনে ফেলেছিলাম । বাসায় এসে পড়তে আরম্ভ করলাম । মোট নয়টি গল্প আছে এই বইটিতে । গল্পগুলোর নাম যথাক্রমে- ফুড কনফারেন্স, সায়েন্টিফিক বিজিনেস, এ আই সি সি, লঙ্গরখানা, রিলিফ ওয়ার্ক, গ্রো মোর ফুড, মিছিল। জমিদারী উচ্ছেদ, জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি । কিছুক্ষণ পরেই হাসি থামানো কঠিন হয়ে পড়ল ।

প্রতিটা গল্পেই ব্যাংগ, রঙ্গ , হিউমার এর সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলার জাতীয় জীবনে নৈতিক অধঃপতনের বয়ান দিয়েছেন লেখক । আবুল কালাম শামসুদ্দিনের মতে, লেখক এই গ্রন্থে বাঙ্গালি হিন্দু-মুসলমানের সাধারণ চরিত্রের দিক তুলে ধরেছেন । কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, সবকালেই ছিল । তাদের কথাও আবুল মনসুর বাদ দেননি । “রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদ তেমনই একটি চরিত্র ।

“ফুড কনফারেন্স” গল্পে দুর্ভিক্ষ সামলাতে ব্যর্থ নেতাদের শেরে বাংলা, মহিষে-বাংলা, কুত্তায়ে বাংলা, বিল্লিয়ে বাংলা, চুঁহায়ে বাংলা, বেজিয়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা থেকে শুরু করে পোকায়ে, মাকড়ে, চিঁউটিয়ে বাংলা ইত্যদি নানা নাম দিয়ে ইজ্জতের লটারী করে ছেড়েছেন । চরিত্রগুলোর মুখে নানা সংলাপের মাধ্যমে তিনি ব্যাঙ্গের তুফান ছুটিয়ে দিয়েছিলেন । খাদ্য সংকট কেন দেখা দিল সে নিয়ে পাঁচটি সূত্র দিয়ে সব দোষ চাষীদের উপর চাপিয়ে দেন নেতারা । আর যুক্তিগুলোর কথা নাইবা বললাম! “ফুড কনফারেন্স” এর শেষে সব “জানোয়ারে-বাংলা” রাই বেঁচে থাকে, “মানুষে বাংলা”রা সব মরে যায় ।

“সায়েন্টিফিক বিজিনেস” নামক গল্পে চাপরাশীগিরি আর কেরানীগিরি করে অভ্যস্ত বাঙ্গালি জাতিকে ব্যবসা, তেজারতি ইত্যাদি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । আবুল মনসুর আহমদের কল্পনায় বাঙ্গালিতা তেজারতি শিখলে কি পরিমাণ অনর্থ করতে পারে তার বিস্তারিত বয়ান দিয়েছিলেন । বাঙ্গালি সবকিছুতেই তেজারতি করতে থাকায় রোগে ভুগে দুনিয়া থেকে সাফ হয়ে পরকালেও তেজারতি করে দুই নাম্বারি আরম্ভ করে । এই গল্পের শেষ হয় এভাবে-“……বাঙ্গালি জাত যেখানে যেখানে বাস করেছে, সেখানে হাইজিনিক মেযার হিসেবে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দাও ।” মোটকথায় বাঙ্গালির ইজ্জতের লটারী এই গল্পে ভালোভাবেই করা হয়েছে ।

“এ আই সি সি” এর পূর্ণরূপ “অল ইন্ডিয়া কন্ডোলেন্স কমিটি” । এই লেখাটি যেই সময়ে লিখেছিলেন আবুর মনসুর আহমদ, সেই সময়ে সম্ভবত ভারতবর্ষে বিভিন্ন “শোক প্রকাশ সমিতি” গঠনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল । তাই নিয়ে ব্যাংগ করেই হয়ত এই লেখাটি লেখা হয়েছিল । যথারীতি হাস্যরসে পরিপূর্ণ একটি লেখা ।

“লঙ্গরখানা” গল্পটি আমার মতে বাংলা স্যাটায়ার হিসেবে ক্লাসিকের পর্যায়ে পড়ে । দুই বন্ধু আকবর ও শমশের কিভাবে অধ্যাপনা ও উকিলগিরি ছেড়ে ধান্ধাবাজী করতে করতে নেতার পারমিশন বাগিয়ে লঙ্গরখানার কারবার খুলে বসে তাই নিয়ে এই স্যাটায়ার । এই লঙ্গরখানা ভুখা-নাঙ্গাদের খাওয়ানোর চেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে চাল-ডাল পাচারের কাজেই বেশি ব্যবহার হতে লাগল । কাজেই দিনে দিনে বাড়ে লঙ্গিরখানার সংখ্যা, দিনে দিনে বাড়ে অভুক্তের পরিমাণ । মৃত মানুষের, মজুদদারদের, সেবক(!)দের পরিমাণ বাড়তেই থাকে । এভাবেই কাহিনী পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ।

“রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদের কথা আগেই বলেছি । বিপন্ন মানুষের সেবা করার জন্য ত্রাণ কর্যের দলে যোগদান করে । কিন্তু সেখানে গিয়ে হামিদ দেখতে পায় দুর্বল ভুখা-নাঙ্গারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে, আর মাত্রাতিরিক্ত খাতির আর ত্রাণ পাচ্ছে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা । হামিদের চোখে এই অনাচার বর্ণনা করেছেন লেখক ।

“গ্রো মোর ফুড” তখনকার কৃষিব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাকে ইঙ্গিত করে আর “মিছিল” সাম্প্রতিক রাজনীতির পটপরিবর্তন নিয়ে লিখেছিলেন লেখক । এধরণের লেখা লিখতে হিম্মতের দরকার আছে । একেবারে হুল বিঁধানো মার্কা লেখা ।

“জমিদারি উচ্ছেদ” এই বইয়ের আমার অন্যতম পছন্দের একটা গল্প । এই গল্পে সাধারণ একজন ব্যক্তি(মুনশীজি) জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করে নির্বাচন করেন । লোকজন রেডিমেড খানবাহাদুরকে ভোট না দিয়ে মুনশীজিকে জেতাবার পর তার ভোল পালটে যায় । তিনি নিজেই নতুন জমিদার সেজে বসেন । আর নানা কুযুক্তি দিয়ে বোকা বানাতে থাকেন গ্রামের সরল সাধারণ মানুষদের ।
“জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি” গল্পটাও ভাল । একজন শিক্ষিত যুবক নানা-ছলাকলা করে জনসেবা করার কথা বলে লাটসায়েব হয়ে শেষ পর্যন্ত জনসেবা করতে সমর্থ হল তার একটি ব্যাঙ্গাত্নক কাহিনী ।

সব মিলিয়ে বইটা একেবারে মাস্ট রিড । না পড়া থাকলে এখনই পড়ে নিন । সংগ্রহে রাখার মত বই ।

আগের রিভিউঃ মাসুদ রানা থ্রিলার রিভিউ- 'ব্ল্যাক স্পাইডার'(১৯৭৪)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৪৫
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×