গতকাল quora.com-এ লগইন করলাম বহুদিন পর।দেখি সজেশানে একটা প্রশ্ন আছে। এক ভদ্রলোক জানতে চেয়েছেন, ব্যবসায় সফল হওয়ার মূলমন্ত্র কি?
যদিও আমি নিজে কোন ব্যবসায়ী নই বা ব্যবসা প্রশাসনের ছাত্র ছিলাম না, তবুও মনে হল উত্তর দেই। বলে রাখা ভাল, উত্তরটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বা কোন থিওরীর ওপর বেসড নয়, পুরোটাই লেখা নিজের কমন সেন্স থেকে। যেহেতু গত একমাসে সামুতেও কোন পোস্ট দেয়া হয়নি, তাই এখানে উত্তরটা পোস্ট করে দিলাম আরেকটু মডিফাই করে।
পাঠক চাইলে এ ব্যাপারে নিজের চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে পারেন। আলোচনার ফ্লোর উন্মুক্ত।
ব্যবসায় উন্নতি করার জন্য আপনার প্রধানত দুটি জিনিস প্রয়োজন।
১.সততা।
২. লেগে থাকার মানসিকতা তথা অধ্যবসায়।
সততাঃ ধরে নেয়া যাক, আপনি এমন কোন পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন যা বাজারে থাকা অন্যকোন সাপ্লায়ার বা ব্যবসায়ীর কাছে নেই অর্থাৎ মনোপলি। এখন ক্রেতা যদি অর্ডার করে আপনার কাছ থেকে সঠিক সময়ে পণ্য না পান বা মানসম্পন্ন পণ্য না পান কিংবা আপনি পেমেন্ট নিয়ে পণ্য সাপ্লাই না করেন, সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মার্কেটে অসৎ ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার বদনাম ছড়িয়ে পড়বে, আপনি ক্রেতা হারাবেন এবং একসময় ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
একই কথা আপনার সাপ্লায়ারের জন্যও প্রযোজ্য। তাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে যদি সঠিক সময়ে বা সঠিক পরিমাণে আপনি পেমেন্ট না করেন-সেক্ষেত্রেও সাপ্লায়াররা আপনার সাথে ভবিষ্যতে আর ব্যবসা করবে না। অর্থাৎ আপনি মার্কেট থেকে আউট হয়ে যাবেন।
উভয়ক্ষেত্রেই দেখবেন মার্কেটে আপনার অবস্থান যত দূর্বল হচ্ছে, মার্কেটে ততই নতুন প্রতিযোগীর উদ্ভব হচ্ছে আর আপনার বায়ার আর সাপ্লায়াররা তার কাছেই যাচ্ছে কেনা-বেচার জন্য।
তাই প্রত্যেক ব্যবসায়ীর উচিত তার ব্যবসার সাপ্লাইচেনের উভয়দিকেই সততা বজায় রাখা।আপনার আশেপাশের মানুষ যখন বুঝবে আপনি সৎ, তখন কাস্টমার এবং সাপ্লায়ার- দুদিক থেকেই আপনি পজিটিভ রেসপন্স পাবেন।
সততার ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আইনের মধ্যে থেকে ব্যবসা করা। ধরা যাক, আপনার সাপ্লাইচেনের উভয়দিকেই আপনি পণ্য সাপ্লাই বা পেমেন্ট সঠিক সময়ে, সঠিক পরিমাণে করছেন, কিন্তু আপনার ব্যবসার মূল পণ্যটাই আইনত দেশে নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারিতে পরলে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি জেল জরিমানারও ভয় আছে।আবার আপনার পণ্যটি হয়ত বৈধ, কিন্তু ভ্যাট-পরিশোধে আপনার গড়িমসি, বিপদ হতে পারে সেক্ষেত্রেও।
এবার আসি অধ্যবসায় তথা পরিশ্রমের এর ব্যাপারে। ধরুন, আপনি সততার সাথেই অনেকদিন ধরে ব্যবসা করছেন, কিন্তু যে সাফল্য আপনি আশা করেছেন, সেটা ধরা দিচ্ছে না।হতাশ হয়ে আপনি ব্যবসা বিক্রি করে দিলেন আরেকজনের কাছে। তিনি হয়ত ব্যবসা শুরুর অল্পদিনের মধ্যেই হু হু করে বিক্রি বেড়ে গেল, ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল।
এজন্যই হতাশ হয়ে মাঝপথে ব্যবসা ছেড়ে না দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা উচিত। চেষ্টা করা উচিত সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে আজ হোক, কাল হোক, সাফল্য আসবেই, ইন শা আল্লাহ। নিজে সমস্যা খুঁজে না পেলে এক্সপার্ট তথা প্রফেশনাল কনসালট্যান্ট এর সাহায্যও নেয়ার সুযোগ আছে।
অধ্যবসায়েরই একটা অংশ ডেডিকেশন। ব্যবসা যে পর্যায়েই থাকুক না কেন লেগে থাকতে হবে।অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী একসময় কর্মচারীদের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দেন বলে শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ঘটে।ডেডিকেশনের অভাবেই মূলত এক প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা পরেএ প্রজন্মে গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে। এই ব্যাপারটার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ মনে হয় অনিল আম্বানি। বাবা ধীরুভাই আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপের বিশাল সাম্রাজ্য ভাগ হয়েছিল দুইভাই মুকেশ আর অনিলের মধ্যে। মুকেশ আম্বানি তার পরিশ্রম দিয়ে ভারতের তথা এশিয়ার শীর্ষ ধনী (বর্তমানে দ্বিতীয়) হতে পারলেও অনিল হয়েছেন দেউলিয়া। বিরাট আকারের লোন নিয়ে ডুবিয়েছেন ইয়েস ব্যাংক। অনেকে অবশ্য এর মধ্যে মানি লন্ডারিং এর কথা বলেন, তবে সেটা ভিন্ন আলোচনা।
সবার শেষে দরকার উদ্ভাবন এবং নতুন কিছুকে স্বাগত জানানোর মানসিকতা, সময়ের প্রয়োজনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা। ২০০৭ সালে এপল যখন টাচস্ক্রীন আইফোন নিয়ে আসে, নকিয়া তখনও তাদের সিম্বিয়ান বাটন ফোনগুলো নিয়েই বাজার মাত করবে বলে বিশ্বাস করত।এমনকি এপলের কাছে আমেরিকার মার্কেট হারানোর পরও আমেরিকার মার্কেট পুনরুদ্ধার না করে নোকিয়া তার ইউরোপ-এশিয়ার মার্কেট শেয়ার নিয়েই খুশি ছিল।শেষ পর্যন্ত নোকিয়া তার অতিআত্মবিশ্বাসের চড়ামূল্য দিয়েছে নিজেদের ফোন ডিভিশন মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি করে।
ব্যবসায় সফল হওয়ার ক্ষেত্রে আরও অনেককিছুই প্রয়োজন। যেমনঃ এফিশিয়েন্ট প্রোডাকশন প্রসেস ও সাপ্লাই চেইন, সফল মার্কেটিং ইত্যাদি। তবে সততা আর অধ্যবসায় থাকলে বাকিগুলো অর্জন করতে আর সমস্যা হয় না।
সবার শেষে একটা কুইজ।এখানে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও শেয়ার করি। এক সিনিয়র কলিগ একবার গল্পচ্ছলে জানতে চাইলেন, ধরে নিন, আপনি একটা কোম্পানির বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ক্রমাগত লসের মুখে আপনারা কোম্পানির সিইও-কে ইতিমধ্যেই বরখাস্ত করেছেন।
আজ চলছে সিইও ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ। মোট দুজন ক্যান্ডিডেট। ধরা যাক, একাডেমিক ও প্রোফেশনাল কোয়ালিফিকেশন এবং অভিজ্ঞতা দুজনেরই সমান কিংবা কাছাকাছি। তাই নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোটাই ডিপেন্ড করছে আজকের ইন্টারভিউর ওপর।
দুজন ক্যান্ডিডেটের কাছেই আপনি একই প্রশ্ন করলেন। এই ডুবতে থাকা কোম্পানিকে বাঁচানোর জন্য তার পরিকল্পনা কি?
প্রথমজন জবাব দিলেন, তিনি প্রথমেই ব্যয় সংকোচন নীতিতে যাবেন। প্রয়োজনে অফিসের কর্মবল কমিয়ে ফেলবেন।
দ্বিতীয়জন জবাব দিলেন, তিনি প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশনের দিকে হাঁটবেন।
প্রিয় পাঠক, আপনি কাকে সিলেক্ট করবেন? কেন?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৫