somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফারদীনের জন্য কি আমরা কাঁদব না?

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফারদীন নূর পরশ; ছবি-bdnews24.com

ইদানীং যখন আবরার ফাহাদের কথা ভাবি, তখন মনে হয়, আরে এই ছেলেটাতো ভাগ্যবান। মরার পর অন্তত খুন হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে, খুনীদের সবাইকে না পারা গেলেও অন্তত কয়েকজনকে বিচারের মুখোমুখি করা গেছে। আর ফারদীন নূর পরশকে দেখুন। মরার পরও তাকে "আত্মহত্যা"র অপবাদ নিতে হচ্ছে, তার বাবাকে চিৎকার করে বলতে হচ্ছে, আমার ছেলে একজন যোদ্ধা, সে আত্মহত্যা করতে পারে না।

আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য প্রথমে তাকে একাধিক নারী আসক্ত পুরুষের অপবাদ দেয়া হয়েছে। বলা হল, বুশরা তার গার্লফ্রেন্ড, প্রেম সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জেরে তার মৃত্যু হতে পারে। দেখা গেল, গত দুবছরে বুশরার সাথে তার দেখা হয়েছে মাত্র পাঁঁচবার। ফেসবুকে দুজনের যোগাযোগ চার বছর ধরে, কিন্তু তাদের চ্যাট হিস্ট্রিতে এমন কোন বিষয় নেই, যাতে কোন রোমান্টিক এংগেল প্রতিষ্ঠিত হয়। ফারদীন একজন বিতার্কিক ছিল, বুশরার সাথে যোগাযোগটাও ছিল মূলত বিতর্ককেন্দ্রিক।

সেই অপপ্রচার হালে পানি না পাওয়ায় বলা হল, মূলত সে মাদকাসক্ত, মাদক কেনার জন্য সারারাত ঢাকা শহর চষে বেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চনপাড়ায় রায়হান গ্যাং-এর কাছে গেছে মাদক কিনতে। তখনই দাম নিয়ে বচসার এক পর্যায়ে সে খুন হয়েছে। বন্ধুরা প্রতিবাদ করে বলল, অন্য কোন প্রকার মাদক দূরে থাক, ফারদীন কখনো ধূমপানও করেনি। এমনকি সিগারেটের গন্ধও নাকি সহ্য করতে পারত না।মাদকের বিষয়টি ফারদিনের পরিবারও কোনোভাবে মেলাতে পারছে না। তার মা–বাবা বলছেন, বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থীকে মাদক সংগ্রহ করতে হলে এত দূর যেতে হয়? ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় কোন জিনিস পাওয়া যায় না? তাঁর মা–বাবা বলছেন, তারা ছেলেকে কোনোদিন ধূমপান করতেই দেখেননি। সেই ছেলে পরীক্ষার আগের দিন রাতে মাদক কিনতে চনপাড়া যাবে, সেটা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

এবার শুরু হল নতুন নাটক। ফারদীনকে নাকি পুলিশের সোর্স ভেবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।ডিবি মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার রাজীব আল মাসুদ বললেন, “ফারদিন হত্যার ঘটনায় মাদক সংক্রান্ত কিছু বিষয় পেয়েছি আমরা। আমরা সাসপেক্ট করছি তাকে মাদক ব্যবসায়ীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। সে অনুযায়ী আমাদের টিম কাজ করছে।" এরই মধ্যে হত্যাসহ ২৩ মামলার আসামী সিটি শাহীন নামের একজনকে ক্রসফায়ারেও দেয়া হল, সেদিন রাতে চনপাড়ায় সাদা গাড়ির একটা সিসি ফুটেজও রিলিজ করা হলো। বলা হল, এই গাড়িতে করেই তখন ফারদীনের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডাম্প করার জন্য।Newsbangla24.com এর এ সংক্রান্ত তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্ট দেখে নিতে পারেন এখান থেকে

এতগুলো অপপ্রচারের পর ভেবেছিলাম এবার হয়ত সত্যটা বের হবে। সে আশায় গুড়েবালি। স্পটলাইট থেকে চনপাড়া-রায়হান গ্যাং পুরাই উধাও এবার। বলা হচ্ছে, ফারদীন আত্মহত্যা করেছে। প্রথমে বাবুবাজার ব্রীজে গিয়েছিল ঝাঁপ দিতে। কিন্তু জায়গাটা জনবহুল হওয়ায় সে চলে আসে সুলতানা কামাল ব্রীজে। তাহলে এই চনপাড়া বস্তি নিয়ে এত কথা হলো কেন? সিটি শাহীনকে ক্রস ফায়ারে দেয়া হল কেন? সাদা গাড়ির যে সিসি ফুটেজ রিলিজ করা হল, সেটাতে আসলে কি ছিল? কারা ছিল? কেন ছিল?

হয়ত এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর পাব না। ফিরে আসি ফারদীনের আত্মহত্যার বিষয়ে। ফারদীন সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় যতটুকু আসছে তাতে তাকে বেশ মূল্যবোধসম্পন্ন আর মানসিকভাবে শক্তিশালী বলেই মনে হয়েছে, এরকম চরিত্রের সাথে আত্মহত্যা কোনভাবেই যায় না। অথচ ডিবি যুগ্ম কমিশনার হারুন বলছেন, ফারদীন আত্মহত্যা করেছে তার ফলাফল নিয়ে হতাশা থেকে। কারণ প্রথম সেমিস্টারে ৩.১৫ পাওয়ার পর ২য় সেমিস্টারে সে পেয়েছিল ২.৬৭।হ্যা, ছাত্রজীবনে পরীক্ষার ফলে উত্থান-পতন থাকতেই পারে।লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, ফারদীন থার্ড ইয়ারের ছাত্র। তার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্টের কথা জনসম্মুখে ঘোষণা করলেও হারুন সাহেব তার সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট নিয়ে কোন কথা বলেননি।

এ মূহূর্তে নিজের অন্তত দুজন ব্যাচমেটের কথা আমার মনে আছে, যারা নিজেদের বুয়েট লাইফের শুরুর দিকে অন্তত এক বিষয়ে ফেল করলেও পরের কোন এক সেমিস্টারে একজন পেয়েছিল ৩.৯৭, অন্যজনকে ৪.০০ পেতে দেখেছি। খুঁজলে বুয়েটে প্রতি ব্যাচে, প্রতি ডিপার্টম্যান্টেই এমন ছেলেপেলে পাওয়া যাবে, যারা এক সেমিস্টারে কোন কারণে একটু খারাপ করে ঠিক পরের সেমিস্টারেই কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া ল্যাগ খাওয়া অনেক ছেলেপেলেই (যারা নিজেদের ব্যাচের সাথে পাশ করতে পারেনি, পরবর্তীতে জুনিয়র ব্যাচের সাথে পাশ করেছে) প্রোফেশনাল লাইফে এসে অনেক ভাল করছে। তাই রেজাল্টের এই অজুহাত আমার কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

এবার আসি বিতর্ক আর স্পেন যাওয়া নিয়ে। হারুণ সাহেব বললেন, ফারদীনের স্পেন যাওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল, যার ব্যবস্থা সে করতে পারছিল না। আবার তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ফারদীন চারটা টিউশনি করত। হারুণ সাহেবের কি কোন ধারণা আছে, শুধুমাত্র টিউশনি আর কোচিং-এ বুয়েটিয়ানদের কি পরিমাণ চাহিদা আর এর থেকে তারা কি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে? বহু বুয়েটিয়ান আছে, যারা শুধুমাত্র টিউশনি করেই অনেক প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তারদের বেতনের কাছাকাছি, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের চেয়ে বেশিই উপার্জন করে। বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর বলেছেন, স্পেনগামী দলের প্রতিটি সদস্যকে বুয়েট থেকে ২৫ হাজার টাকা করে স্পন্সর করা হচ্ছিল।এরপরও কি তার স্পেন গমন অনিশ্চিত ছিল?

শেষ কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ফারদীনের পারিবারিক চাপের। সাংবাদিক কাজী নূর উদ্দিনের তিন সন্তানের মধ্যে ফারদীন সবার বড়। পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে নিজের পাশাপাশি ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও ফারদীনকে বহন করতে হচ্ছিল। আগেই বলেছি, ফারদীন চারটা টিউশনি করতে। পাশাপাশি একটা কোচিং-এ সে ক্লাস নিত। বুয়েট লাইফে নিজের দুজন ক্লাসমেটকেই দেখেছি টিউশনি করে নিজে চলার পাশাপাশি গ্রামেও টাকা পাঠাতে। তাই এই কারণটাকেও কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।

আরেকটা হাস্যকর অজুহাত তিনি দেখিয়েছেন। ফারদীনকে তার পরিবার হলে থাকতে দিত না, বাসা থেকে ক্যাম্পাসে তার আপডাউন করতে হত। নিজের বহু ব্যাচমেটকে প্রতিদিনই উত্তরা থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া করতে দেখেছি। তাছাড়া চাকরি জীবনের শুরুতে নিজেও নিয়মিত আজিমপুর থেকে বনানী আসা-যাওয়া করেছি। তাই দূরত্বের অজুহাত এখানে হাস্যকর।

অনেকের কাছে মনে না হলেও আর একটা ব্যাপার আমার কাছে বেশ গুরুতপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ফারদীনের বাবা বলেছেন, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ফারদীন চুল কেটেছিল, শেভ করেছিল। যে মানুষটা আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছে, সে কি চুল কাটা আর শেভ করার মত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে?

ফারদীন হত্যাকান্ডের পর থেকে গত প্রায় দেড় মাস ধরেই এ সংক্রান্ত নিউজগুলো ফলো করার চেষ্টা করেছি। প্রথমদিকে র‍্যাবের তদন্তে কিছুটা আশান্বিত হলেও এখন আর কোন আশা দেখা যাচ্ছে না। হয়ত কোন রাঘব বোয়ালকে বাঁচাতে হবে, তারই জন্য এখন আগের সবকিছুকে অস্বীকার করে সরাসরি আত্মহত্যা নাটক ফাদা হয়েছে। হয়ত সরাসরি জড়িত থাকা বা কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার কারণে সিটি শাহীনকেও ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। রিফাত হত্যার দিকে লক্ষ্য করুন। স্থানীয় সাংসদপুত্রকে বাঁচানোর জন্য নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছিল, মূল পরিকল্পনাকারীর আসলে বসানো হয়েছিল মিন্নিকে। মূল ফোকাসে আনা হয়েছিল রিফা-মিন্নি-নয়ন বন্ডের ত্রিভুজ প্রেম। প্যাটার্ন একই মনে হচ্ছে?

পাশাপাশি যাতে কোন ছাত্র আন্দোলন না হয়, তার জন্য আগে থেকেই গুটিকয়েক বুয়েট ছাত্র-ছাত্রীকে (এরা কি ফারদীনের বন্ধু? ব্যাচমেট? আমি কনফিউজড) দিয়ে বলিয়ে নেয়া হয়েছে, তদন্তে তারা সন্তুষ্ট। (ডিবির ব্রফিং-এ তারা গ্যাপ আছে বললেও এখন সরাসরি "সন্তুষ্ট" শব্দটাই ব্যবহার করছে তারা। র‍্যাব থেকে কোন হুমকি ধামকি দেয়া হয়েছে কিনা- কে জানে)।

পুরো প্লট গুছিয়ে আনা হয়েছে। অপেক্ষার পালা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সাগর-রুনির মত একদিন ফারদীন হত্যাকাণ্ডও ধামাচাপা পড়ে যাবে হয়ত। আমরা বাকিরা নিজেদের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাব। আফসোস শুধু একটাই, মরার পরেও ছেলেটাকে "আত্মহত্যা"র অপবাদ বয়ে বেড়াতে হবে :(


সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৫৩
১৯টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×