ফেসবুকের একটি গ্রুপ "শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)"-য় একজন প্রশ্ন করেছেন জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার একটি লাইনের মর্মার্থ জানতে চেয়ে। আমি সেই প্রশ্ন আর আমার দেয়া উত্তরটি এখানে তুলে দিচ্ছি।
প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশের লেখা পঙক্তি "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।" এই পঙক্তিটির ভাবার্থ কারো জানা থাকলে একটু বুঝিয়ে বলুন,ধন্যবাদ
আমার দেয়া উত্তরঃ
বনলতা সেন কবিতার এই লাইনে "বিদিশার নিশা"-এর সাথে কবি বনলতার নিকষ ঘনকালো চুলের তুলনা করেছেন। বিদিশা হল প্রাচীন শহর। সেই শহরের অন্ধকার রাতের মতই নায়িকার কেশ কালো।
তবে এখানে আরো কথা আছে। কবি কী করে জানলেন বিদিশা শহরের রাত অত কালো? কেন কবি অন্য কোন শহরের রাতের সাথে বনলতার চুলের তুলনা করেননি, যেমন, হরপ্পা, ইলোরা, অজন্তা ইত্যাদি? জীবনানন্দ দাশ এই শহরের নামটি মূলত পেয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষায় লেখা কালিদাসের "মেঘদূত" কাব্যগ্রন্থ থেকে যেখানে বিদিশার নিশার কথা বিস্তারিত উল্লেখ আছে। কবির অনুজ অশোকানন্দ দাশের লেখা থেকে জানা যায় কবি স্কুলে থাকতেই সংস্কৃত ভাষায় এই কাব্যগ্রন্থটি পড়েছেন।
এই কাব্যগ্রন্থের একটি লাইন হল, "সকল উপাচারে কামুকবৃত্তির পূর্ণফল" (বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)। বিদিশা মূলত দশার্ণদেশের রাজধানী ছিল। সেকালে এই নগর ছিল পাপাচারের কেন্দ্র। পেশাদার গণিকাবৃত্তিতে এই শহর নাম করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত্রি হলেই নগর চঞ্চল হয়ে উঠত, বারবনিতাদের নিয়ে পুরুষরা লাগামহীন কমোন্মাদনায় মেতে উঠত। বিদিশার নিশায় সেই বেশ্যাদের দেহ হতে ভেসে আসতো পরিমলের গন্ধ। পরিমল বলতে পেষণ-মর্দনজনিত গন্ধ। বনলতাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। অর্থ্যাৎ, বিদিশা নগরের নিশিকালে বেশ্যাদের দেহ হতে যে গন্ধ ভেসে আসতো, তেমনি গন্ধ বনলতার চুলে। মানে দাঁড়ায়, পাপাচারে লিপ্ত নগরীর সাথে তুলনা করতেই শুধুমাত্র কালো চুলের কথা বলা হয়নি, বেশ্যাবৃত্তির সাথে এর বেশ যোগসাজশ রয়েছে। অনেক গবেষকের দ্বিমত সত্ত্বেও, এর থেকে বহু গবেষক অনুমান করেন, বনলতা সেন কবির দুর-সম্পর্কের বোন ছিলেন না, ছিলেন মূলত গণিকা যার কাছে গিয়ে কবি "দুদণ্ড শান্তি" পেয়েছেন বলে কবিতায় উল্লেখ করেছেন।
এই তথ্যগুলো আমি পেয়েছিলাম ডঃ আকবর আলি খানের "চাবিকাঠির খোঁজে- নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন" বই থেকে।
স্বভাবতই আমার উত্তর অনেকের পছন্দ হয়নি। অনেকেই আবার পছন্দ করেছে। যারা করেনি তাঁদের বেদনা হয়ত অন্যখানে। এতকাল প্রেমিকাকে মুগ্ধ করেছেন এই কবিতা দিয়ে। বনলতার ভিন্ন পরিচয়ে নিশ্চয়ই তাঁরা আর স্বস্তিতে নেই। প্রায় নব্বই বছর পর কবিতার বিশ্লেষণ ইতিহাস চর্চার মতই। কালে কালে অনেক গবেষক আসবেন এক এক প্রকার তত্ত্ব আর তথ্য নিয়ে। সুতরাং হতাশ হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করি।
২৬ জানুয়ারি
জাহিদ কবীর হিমন, বার্লিন থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:৩২