আমার স্কুলটা ছিলো বাসা থেকে অনেক দূরে।পায়ে হেটে এক ঘন্টার পথ।সেজন্যেই বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্যে গাড়িভাড়ার টাকা পেতাম।
তবে গাড়িতে করে স্কুলে যেতাম আমি ৩ দিন।আর বাকি ৩ দিন যেতাম হেটে।এই ৩ দিনের টাকা আর টিফিন খরচ থেকে বাঁচানো টাকা বাঁচিয়ে আমি কিনতাম তিন গোয়েন্দা,কিশোর কন্ঠ,রহস্য পত্রিকা।
প্রতি সপ্তাহেই অন্তত ২টা করে বই কিনতাম আমি এভাবে টাকা জমিয়ে।
যদিও পুরো সপ্তাহের টাকা জমিয়ে কেনা ওই বইগুলো শেষ হয়ে যেতো ২ দিনেই।তারপরেই সিনিয়র ভাই যারা গল্পের বই পড়ে তাদের কাছে ধর্না দিতাম।চলতো এক্সচেঞ্জ অফার।
তারা আমার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তো আর আমি তাদের কাছ থেকে।
অনেক সময় স্কুল থেকে যাওয়ার পথে বইয়ের দোকানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়েই আমি শেষ করে ফেলেছি একটা বই।
এরকমই একদিন পড়তে পড়তে সময় কিভাবে চলে গেলো খেয়াল ছিলোনা।বইয়ের কাহিনীটা অনেক চমকপ্রদ ছিলো আর বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যাও ছিলো বেশী।পড়াই এতো মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে সময়জ্ঞান ছিলোনা আমার।স্কুল থেকে যেতে লেট দেখে আব্বু খোঁজতে বের হলো।আব্বু ধারণা করেছিলো কোথায় গেলে আমাকে পাওয়া যাবে।
মগ্ন হয়ে বই পড়তে পড়তেই ঠাস করে থাপ্পড়টা খেলাম আমি।তাকিয়ে দেখি আব্বু!
আর কি দাড়াই আমি!!
পড়িমড়ি করে দিলাম দৌড় বাসায়।বাসায় এসে দেখি প্রাইভেট টিচার এসে বসে আছে।আব্বুর এতো রাগের কারণটা বুঝতে পারলাম।এরপর বাসায় আমার উপর কি ঝড় গেলো সেটা আর নাই বলি!
ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝতে পারবেন।
রাতের বেলা সাধারণত ১১ টার ভিতরেই ঘুমিয়ে পড়তে হতো আমার।কারণ আমার ক্লাস শুরু হতো সাড়ে ৮টা থেকে!
কিন্তু বইয়ের নেশা কি আর আমাকে ঘুমাতে দেই!!কম্বলের তলাই শুয়ে ছোট পেন্সিল টর্চ জ্বেলেই চলতো আমার বই পড়া।
মায়ের কাছে গোপন থাকেনা কিছুই।একদিন পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে বই পড়তেছি কম্বলের তলাই শুয়ে।কম্বলটা হঠাৎ সরে গেলো মাথার উপর থেকে।তাকিয়ে দেখি আম্মু।
আম্মু হাত দিয়ে কখনোই মারতোনা।উনার অস্ত্র ছিলো নারিকেল পাতার চিকন শলার ঝাড়ু।সেটারই ২-৩ ঘা হজম করলাম সেদিন আমার পিঠের উপর।
তার সাথে আমার যতো সমস্যা হলো সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে গেলো বইয়ের নাম।
মাথা ব্যাথা করতেছে!
- করবেই তো!এতো বই পড়লে কি আর মাথা ঠিক থাকে!
মা,চোখ দিয়ে পানি পড়তেছে!
-আরো বই পড়!আমাকে বলতেছোস কেনো?বই পড়ে পড়েই চোখগুলোর সর্বনাশ করছোস!
অসুস্থ্যবোধ করতেছি।
-বই পড়ে রাত জেগে থাকবি!সারাদিন-রাত চোখগুলো বড়ো বড়ো করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবি!অসুখ তোর হবে না তো কার হবে!
মা,খুব খিদে লাগছে!
-সারাদিন হা করে বই গিলিস!পেট ভরেনি?
এসবই ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা।
বই পড়াটা ছিলো আমার নেশা।
খাওয়ার কথাও ভুলে যেতাম অনেক সময়।
এখন আর সেই দিনগুলো নেই।থাকি প্রবাসে।পেপারব্যাক বই হাতের কাছে খুব কম পাই।ইবুক আর পিডিএফেই ভরসা রাখতে হয়।সারাদিন-রাত বই পড়লেও যে মানুষটি আমার ভালোটা চিন্তা করে বকা দিতো সেই মা আমার এখন আর আমার কাছে নেই।তাই বকা দেওয়ারও কেউ নেই।
তাতেই যেনো অতৃপ্তি ঘিরে থাকে আমার বই পড়ার প্রচন্ড নেশাতেও!