
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের পাহাড়-নদী এলাকায় পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবিতে একটি যুক্তি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে—"প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে!" এই দাবির পক্ষে আবেগঘন ছবি ও সৌন্দর্যের মোহ ব্যবহার করে জনমত গঠনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু সৌন্দর্য দেখেই কি একটি অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ত্যাগ করা উচিত? নাকি সৌন্দর্য ও উন্নয়নের ভারসাম্য রেখে সমাধান খুঁজতে হবে?
১. অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: স্থানীয় সম্পদ বনাম আমদানিনির্ভরতা
বাংলাদেশ ২০২৩ সালে শুধু ভারত থেকে ৮০০ কোটি টাকার ক্রাশড পাথর ও ২০০ কোটি টাকার চুনাপাথর আমদানি করেছে (শুল্ক বিভাগ)। অথচ সিলেট, ভোলাগঞ্জ, জাফলং ও কোম্পানিগঞ্জে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত পাথর দিয়ে এই চাহিদার বড় অংশ মেটানো সম্ভব (বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর)। পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখায়:
বেকারত্ব: লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ হারিয়েছে (বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন)।
আমদানি ব্যয়: বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বাড়ছে।
নির্মাণ খাত: স্থানীয় পাথর ব্যবহার করলে রাস্তা, সেতুর খরচ ও সময় কমত (RHD এর মতে, সিলেটের পাথর উচ্চমানের)।

২. পরিবেশগত সংকট: পাথর জমে বন্যার ঝুঁকি
পাথর উত্তোলন বন্ধের ফলে সিলেটের নদীগুলোতে বিপরীত প্রভাব পড়েছে:
নাব্যতা হ্রাস: পিয়াইন নদীর উৎসমুখে পাথর জমে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা ২০২২-২০২৪ সালের বন্যার অন্যতম কারণ (স্থানীয় প্রশাসন)।
ভরাট নদী: প্রতিবছর পাহাড় থেকে প্রাকৃতিকভাবে নেমে আসা পাথর অপসারণ না করায় নদী তলদেশ উঁচু হয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়ছে।
পরিবেশের ভারসাম্য: জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে।
বিশেষ উদাহরণ: জাফলং জিরো পয়েন্টে পাথরের স্তূপ নদীর গভীরতা ৩০-৪০ ফুট কমিয়ে দিয়েছে, যা বন্যা ও ভাঙন বাড়াচ্ছে (মানবজমিন, ২০২৪)

৩. সমাধানের পথ: নিয়ন্ত্রিত উত্তোলন ও আধুনিক প্রযুক্তি
পরিবেশবান্ধব খনন: ভারত ও ভুটানের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন ও নদী ব্যবস্থাপনা সম্ভব।
স্থানীয় অর্থনীতি: খনিজ শিল্প চালু রাখলে স্থানীয় বাজার, পরিবহন ও রাজস্ব আয় বাড়বে।
সিন্ডিকেট বন্ধ: অবৈধ খনন রোধ করে সরকারি তত্ত্বাবধানে উত্তোলন জরুরি।
৪. সৌন্দর্য বনাম টেকসই উন্নয়ন
প্রকৃতির সৌন্দর্য সংরক্ষণ জরুরি, কিন্তু তা কখনোই স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও জাতীয় অর্থনীতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতির মাধ্যমে:

পুনর্বনায়ন: উত্তোলন শেষে গাছ লাগানো।
পরিচ্ছন্ন খনন: যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নদীর পাথর সরিয়ে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।
"সৌন্দর্য" এর নামে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ও বন্যার মতো দুর্যোগকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের সমন্বয়ে আধুনিক প্রযুক্তি, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হলো টেকসই সমাধান।

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


