somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরোনো গল্পঃ র‍্যাম্বো দ্যা ট্রেকার ১

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“ঐ তুই কই যাস, যা ভাগ” মোটামুটি জোরালো স্বরেই বলল আপেল। র‍্যাম্বো কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সে যাবেই আমাদের সাথে। “দূরে যামু, দূরে”- আপেল র‍্যাম্বোকে বলল। সে যেভাবে র‍্যাম্বোর সাথে কথা বলছে মনে হচ্ছে র‍্যাম্বো তার কথা বুঝতে পারছে। আমাদের ডাকে অবশেষে র‍্যাম্বোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলা শুরু করল আপেল। র‍্যাম্বোও পেছন পেছন হাটা শুরু করল। গন্তব্য স্বপ্নচুড়া “দ্যা মৌদক জায়ান্ট”, দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া সাকা-হাফং। গতকাল কেওক্রাডং পৌছতেই রাত হয়ে যাওয়ায় আর্মিরা আমাদের বাধ্য করে তাদের নিজেদের দ্বারা পরিচালিত গেস্ট হাউজে থাকতে। এখন আমরা বাকলাই এর উদ্দেশ্যে। ঘোর বর্ষায় সাকা-হাফং একটা মোটামুটি ধরনের চ্যালেঞ্জ। আপেল আমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছিল যে এমন পরিস্থিতিতে এর আগে সাকা কেউ সামিট করেনি। টীমের অনেকেই র‍্যাম্বোকে আমাদের টীমমেট হিসেবে ঘোষনা দিয়ে দেয়। র‍্যাম্বো হচ্ছে কেওক্রাডং এর অধিপতি লালা বম এর পোষা এবং অত্যন্ত শক্ত-সামর্থ, যুবক বয়সী লম্বাটে এথলেটিক ফিগারের কুচকুচে কালো একটা কুকুর। দুপুর গড়াতেই পরিস্থিতি পালটে গিয়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। ভিজতে ভিজতে আমরা সাড়ে তিনিটা নাগাদ বাকলাই পাড়ায় পৌছে যাই। এই বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা রেমাক্রি খালের ভয়েই এই ট্রেইলে আসা; এটা ছিল প্ল্যান-বি।

বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাকলাই পাড়ায় আপেলের পরিচিত একটি ঘরে আশ্রয় নেই। জানতাম বাকলাই পাড়ার কাছেই বাকলাই ঝর্নার অবস্থান; যেটা দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্না। ২০১০ এর দিকে ডি-ওয়ে এক্সপেডিটর্সের "প্রোজেক্ট হান্ট ওয়াটারফল" এক্সপেডিশনে বাকলাই এর উচ্চতা মেপে ৩৮০ ফিট পাওয়া গিয়েছিল। এর বেশি কিছুই জানতাম না আসলে বাকলাই সম্পর্কে। আগুন গরম চা এর কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি এত কাছাকাছি এসে ৩৮০ ফিটের একটা জায়ান্ট ওয়াটারফলকে মিস করা ঠিক হবে না। সন্ধ্যা হতে তো এখনো ঘন্টা দুয়েক বাকী। ঝটপট একটা লোকাল গাইড নিয়ে বাকলাই ঝর্নার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আবার বৃষ্টি। টানা বৃষ্টিতে সরু রাস্তার অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। তার ওপর সেটা যদি হয় গয়ালের চলার পথ তাহলে তো কোন কথাই নেই, টাইগার জোঁকের কথা নাই বা বললাম। পরিস্থিতি প্রতিকূলে পুরোপুরি। তবে র‍্যাম্বোর কোন সমস্যা হচ্ছিল না, রাস্তার এ বেহাল দশা দেখে র‍্যাম্বো জঙ্গলকেই তার পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। আমরা ঠিকঠাক আছি কিনা দেখার জন্য নয়তো নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয় র‍্যাম্বো।

সত্যিকথা বলতে এখনকার আগ পর্যন্ত আমি র‍্যাম্বোকে আমি টীমমেট হিসেবে মেনে নিতে পারিনি, উপদ্রব মনে করছিলাম। সুমন, নাহিদ ওরা প্রথম থেকেই র‍্যাম্বোকে স্নেহের চোখে দেখছিল। দুপুর দিকে যখন মস্ত একটা গাছের নিচে বসে রিচার্জ হয়ে নিচ্ছিলাম তখন সুমন, নাহিদ, মামুনরা র‍্যাম্বোকে নিয়ে ফটোসেশন শুরু করে দিয়েছিল। সে যাই হোক, এখন আমরা আছি মহা সংকটে। কাদায় ডুবে যেতে যেতে আমরা বাকলাই ঝর্নার দিকে ছুটছি। এমন সময় নাহিদ আর সুমন বলল- “এমনে আর সম্ভব না, আমরা ব্যাক করুম”। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি তখন সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা সবাই ব্যাক করব। এরকম পরিস্থিতিতে অনভিজ্ঞতা আর প্রস্তুতির অভাব যেকোন বিপদ ডেকে আনতে পারে। আপেলকে সিগনাল দেই যে আমরা ফল ব্যাক করব। বেশ কিছুক্ষন রিটার্ন ট্রেইলে হাটার পর বুঝতে পারলাম লোকাল গাইড আর আরিফিন ব্যাক করেনি। ওরা কমান্ড শুনতে পায়নি কারন লোকাল গাইড খুব দ্রুত হাটছিল আর আরিফিন তার সাথেই ছিল। আর সবার আগে যারা, র‍্যাম্বোও তাদের সাথে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বুঝতে পারলাম বেশ বাজে একটা কাজ হয়েছে। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল, বেশ দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছি।

পাড়ায় পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। প্রচন্ড রকম টেনশন মাথায় নিয়ে থম মেরে বসে আছি বাকলাই পাড়ার সেই ঘরে। আপেল আমাকে সান্তনা দিচ্ছে- “কোন সমস্যা নাই গাইড আছে, ঝর্না দেইখা আরিফিন ভাই ফেরত চইলা আসব”। বাইরে তাকিয়ে দেখি পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টি যদি আবার বেড়ে যায়, ওরা যদি ঢলের মুখে পড়ে- এই জংলা ট্রেইলে অন্ধকারে কি করার থাকবে ওদের। মাথা কাজ করছিল না। যদিও আরিফিন অত্যন্ত সাহসী আর শক্ত-সামর্থ্য তারপরেও ভয় লাগছে কারন ও খুব ক্রেজি। অকারনে ঝুকি নেয়। তারপরেও চেষ্টা করছি ওর সামর্থ্যের উপর ভরসা রাখতে। রাত আটটা ছুঁইছুঁই। সুমন বলল- “আমি সামনে আগায় যাই, দেখি অগো দেখা যায় কিনা”। সুমনের প্রস্তুতি সবসময়ই সময়সাপেক্ষ্য এটা সবারই জানা। হঠাৎ দূরে একটা আলোর উৎস দেখা যায়। হ্যা আরিফিন ফিরে এসেছে বীরের বেশে, সাথে লোকাল গাইড আর র‍্যাম্বো। মনে মনে বললাম- “থ্যাঙ্কস গড”।

সবার শারিরীক অবস্থাই ছিল মারাত্নক রকমের বাজে। হঠাৎ ধকল, তাই সামলে ঊঠতে সমস্যা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায়। আটটার দিকে ট্রেক শুরু করি। আমাদের সাথে টেন্ট ছিল না কারন এই ট্রেইলে মোটামুটি সুবিধাজনক দুরত্বেই আদিবাসীদের লোকালয় আছে। শিম্পলম্পি পার হয়ে খাড়া পাহাড়টা থেকে নেমে থান্দুই হয়ে নয়াচরন চলে আসি। সুবিধাজনক একটা ঘর বাছাই করে ঢুকে পড়ি। আজকে সারাদিন মোটামুটি আরামসেই ট্রেক করা গেছে। বৃষ্টি অল্পবিস্তর ভয় দেখালেও খুব একটা প্যাড়া দেয়নি। ব্যাকপ্যাক থেকে বিস্কিট আর খেজুর বের করে সবাই মিলে সাবাড় করছি। আপেল দু-চারটা খেজুর মুখে দিয়ে রান্না চড়ানোর কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমরা যখনই যা খাচ্ছি র‍্যাম্বোকে তার ভাগেরটা বুঝিয়ে দিতে ভুল করছি না। রাতের খাবারও আপেল র‍্যাম্বোর জন্য আলাদা করে রেখে দেয়, এমনকি ওর শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়াটাও আপেলের দায়িত্ব। পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি, একটা পাহাড় টপকে রেমাক্রি খালের দেখা পাই। বর্ষায় মারাত্নক রুপ ধারন করা রেমাক্রি খালটা পার হতে বেশ বেগ পেতে হয়। র‍্যাম্বোর সমস্যা হচ্ছিল দেখে আপেল ওকে কোলে তুলে খালটা পার করে দেয়। এই দৃশ্যটা আমি ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে ভুল করলাম না। তবে এটা জানতাম না যে এই র‍্যাম্বোই পরিশেষে এমন এক রোমাঞ্চের জন্ম দেবে যেটা আমাদের সবাইকে প্রবলভাবে নাড়া দেবে...

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×