শাসকচক্র সুবিচারের সামান্যতম মুখোশটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে:
বিবাদী পক্ষে কৌশলী রাখা আর প্রয়োজনীয় নয়:
সাক্ষ্য গ্রহণ বা বাতিলের ক্ষমতা জল্লাদের হাতে ন্যাস্ত
তবে কি ওরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসী দেবেই
[রাজনৈতিক ভাষ্যকার]
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিচারের প্রচলিত বিধানের সামান্যতম মুখোস টুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখানে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গিয়েছে যে, ৮৮ নং সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী এই বিচার প্রহসনের সংশোধিত পদ্ধতি অনুযায়ী আদালতে বিবাদী পক্ষের উকিলের উপস্থিতির কোন প্রয়োজন হবে না। এই সংশোধনী বলে সাক্ষ্য প্রমাণ সংক্রান্ত বিধিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এতে প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথভাবে নথীভুক্ত না করে, শুধু প্রদত্ত সাক্ষ্যের স্মারকলিপি বা সংক্ষিপ্তসার (মেমোরাণ্ডাম) নথীভুক্ত করা হবে। তাছাড়া কোন সাক্ষ্যকে তাদের অভিমত অনুযায়ী বিরক্তিকর, কিম্বা বিচারে বিলম্ব ঘটতে পারে অথবা “বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে” বলে মনে হলে সামরিক আদালত তা বাতিল করতে পারবে।
এই সংশোধনী থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে অপরাধী বলে ঘোষণা করে তাকে প্রাণদণ্ডদানের পথে সামান্যতম অন্তরায় রাখতে চায়না। ইতিমধ্যেই গোপনে সামরিক আদালতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় নেতার বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশন-বৈধতার প্রশ্ন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সামরিক জান্তা তাতে কর্ণপাত না করে এক তরফা ভাবে দণ্ডদানের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে বপরিকর।
সামরিক আইনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপনে বিচারের ব্যবস্থা করার পরও আদালতে বিবাদী পক্ষের কৌশুলীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা রহিত করার কয়েকটি অর্থ হতে পারে। সামরিক জান্তা কর্ত্তৃক সামরিক আদালতে তাঁর বিচারের এখতিয়ারই বঙ্গবন্ধু অস্বীকার করেছেন এবং সেই জন্যে তিনি আÍপক্ষ সমর্থন করতে রাজী হন নি। তা সত্বেও বিচারের মুখোসটা বজায় রাখার জন্যে তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশিষ্ট আইনজীবী এ, কে, ব্রোহীকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনের জন্যে নিযুক্ত করেছিল। তারপর অকস্মাৎ সেই মুখোস ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিচার পদ্ধতির সংশোধন করার প্রয়োজন হলো কেন? হয় সামরিক জান্তার বিচার প্রহসন এতই হাস্যকর যে, যে কোন আইনজীবীর কাছেই তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ঠেকতে বাধ্য, কাজেই ব্রোহীর মত আইনজীবীর পক্ষে এই বিচারের সঙ্গে যুক্ত থাকা হয়তো অসুবিধাজনক মনে হচ্ছে। অথবা নিজেদের সুবিধা ও ইচ্ছা অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রমাণ ও নথীপত্র জাল করা সত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বিবাদী পক্ষের কৌঁশুলীর উপস্থিতির ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ না করে সাক্ষ্যে কি বলতে চাওয়া হয়েছে (যা অবশ্যই সামরিক আদালতের বিবেচনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে) সে সোরাম্ভাসে শুধু সেটুকু লিপিবদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে প্রদত্ত সাক্ষ্যকে তারা নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। যে সাক্ষ্য সেদিক থেকেও সামরিক কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তাদের মামলার অনুকূল বলে মনে হবে না, তাকে ‘বিরক্তিকর,’ ‘বিচার দীর্ঘায়িত করবে’ কিম্বা ‘বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে’ বলে সেই সাক্ষ্য বাতিল করার ব্যবস্থা করায় বিচার পদ্ধতিটিকে একটি পূর্ব নির্দিষ্ট রায়ের অনুকারী করা হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত পক্ষে পূর্বাহ্নেই বিচারের রায় দিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়, কারণ এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী নিজেই বিচারক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশ্ব জনমতের প্রতি এই সংশোধনী একটা চ্যালেঞ্জ। তারা সকল চক্ষু-লজ্জার বালাই বিসর্জন দিয়েই খোলাখুলি রায় ঘোষণা করে জানিয়ে দিতে চায় যে, তারা বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা করে না। বঙ্গবন্ধুকে তারা দণ্ডদান করবেই,বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের খোলাখুলি ভাবে একথা জানিয়ে দিয়ে তাদের ওপর একটা চাপ সৃষ্টির অভিপ্রায়ও সামরিক জান্তার থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অধিকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা, ত্রাস ও নির্যাতনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেও তারা মুক্তি সংগ্রামীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর বে আইনী বিচার প্রহসন ও প্রাণনাশের হুমকীও মুক্তিকামী বাঙালীদের নিবৃত্ত করতে পারবে না। কারণ বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার নির্দেশ ও নির্ধারিত পথই অনুরণ করে চলেছে। কোন সময় নির্দেশ দেবার জন্যে তিনি না থাকলেও তার আরদ্ধ কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ওপর ন্যস্ত করে গেছেন। দেশের মানুষ সেই পথ থেকে কোন ক্রমেই বিচ্যুত হবে না। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও তার ঘাতক-বিচারকদেরকেই এদেশের মানুষ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করবে।
মুজিবের বিচার প্রহসন পাকিস্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হবে
সাবেক বৃটিশ পার্লামেণ্টে শ্রমিক দলীয় সদস্য এবং উইলসন সরকারের কেবিনেট মন্ত্রী মিঃ পিটার শোর গত ২৮শে আগষ্ট কলকাতায় বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসন পাকিস্তানের জন্য একটা অমর্যাদাকর ব্যাপার এবং তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অসামান্য ক্ষতির কারণ হবে।
তিনি বলেন, ‘অনুরূপ একটা বিচার গোপনে অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করাও লজ্জাজনক।’
মিঃ শোর সরেজমিনে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের জন্য ঐ দিনই নয়া দিল্লী থেকে কলকাতা আসেন। বিমান বন্দরে তিনি সংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার যে কোন সমাধান তথাকার জনগণের অনুমোদন লাভে করতে হবে।
তিনি বলেন, জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরূপনের সর্বোত্তম পন্থা হল গণভোট। তবে গত নির্বাচনে শেখ মুজিবের দলের বিপুল বিজয়ের পর সেখানকার জনগণ কি চায় সে সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
জয় বাংলা (১) ১: ১৭ ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:৩৬