প্যালেস্টাইনের গাজা ও পশ্চিমতীরে আক্রমনের জন্য সামান্য অজুহাতের তোয়াক্কা করে না ইসরায়েল। হামাস বা ফাতাহ্কে বশে রাখতে ইসরায়েলী সেনারা এমন করে হামলা চালায় যেনো অবরোধ ভেঙ্গে স্বাধীনতাকামী গেরিলারা দেশকে স্বনির্ভর করে ফেলেছে। ইসরায়েল জানে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মতো নেতা এ মূহুর্তে প্যালেস্টাইনীদের নেই। তাই ওদের জোর করে দমিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে ভাল কাজ বলে ইসরায়েল মনে করে। ইসরায়েলের আক্রমন বিষয়ে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় বইছে কিন্তু আমেরিকা, বৃটেন সহ ইইউ জোটের তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। গাজার ইসরায়েলি বোমা হামলার বিরুদ্ধে লন্ডন, ইস্তাম্বুল এবং বার্লিন সহ বিশ্বের প্রায়-সব ক'টি শহরে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করে ইসরায়েলি সামরিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবী জানায়। ইস্তাম্বুলে ইসরায়েলি দূতাবাস লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীরা। আঙ্কারায় রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে প্রতিবাদ স্বরূপ পতাকা ওড়ানো হয়। এতকিছুর পরও ইসরায়েল এতটুকু অনুতপ্ত না হয়ে বরং জমি অধিগ্রহণের মিথ্যাকে ঢাকা দেয়ার প্রচেষ্টায় রত থেকেছে।
এদিকে যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মিশরের মধ্যস্থতায় হামাস যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব বিবেচনায় আনে। যুদ্ধ বিরতির জন্য কিছু শর্ত জুড়ে দেয় ইসরাইলের সামনে। শর্তগুলোর মধ্যে পশ্চিমতীরে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর নির্মাণসহ সাত বছরের জন্য অবরোধ তুলে নেয়া অন্যতম। মিশরের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যকার পরোক্ষ আলোচনা কোনো সফলতা ছাড়াই শেষ হয়। ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বাড়াতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু হামাসের দেয়া শর্তে যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হওয়ায় বাহাত্তর ঘন্টা বিরতির পর আবার শুরু হয় হামলা, পাল্টা হামলা।
ইসরাইলের অবস্থানে আপাতত মনে হচ্ছে তারা আন্তরিকভাবে যুদ্ধ বিরতি চেয়েছে, কিন্তু আসল ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হামাস যুদ্ধ বিরতির জন্য তিনটি প্রধান শর্ত দিয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে - গাজার ওপর থেকে সাত বছরের অবরোধ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে, ইসরাইলের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে হবে এবং গাজার ওপর আগামী ১০ বছর কোনো হামলা করা যাবে না। এর সঙ্গে হামাসের দাবি ছিল গাজার বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর চালু করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এর একটি দাবিও মানেনি ইসরাইল। সে কারণে হামাসের পক্ষে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতিতে যাওয়া সম্ভব হয় নি। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আবার রকেট হামলা শুরু করে হামাস। পাল্টা জবাবে ইসরাইলও বিমান ও ট্যাংক হামলা শুরু করে।
হামাসের দাবি ছিল যৌক্তিক। কারণ এখনই যদি ইসরাইল গাজার ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার না করে তাহলে ভবিষ্যতেও করবে না। আর অবরোধ প্রত্যাহার না হলে গাজার জনজীবনকে স্বাভাবিক করা অসম্ভব। সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরও চালু করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, সমুদ্রে তেল-গ্যাস ও মৎস্য সম্পদ আহরণের মতো কার্যক্রমও চালানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে হামাসের সামনে তাদের দাবি মানার কোনো বিকল্প নেই। অবরোধ তুলে নেয়ার বিষয়ে হামাসের দাবিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সমর্থন দিলেও, অস্ত্র ও মদদ জুগিয়ে চলেছে ইসরায়েলকে। অন্যদিকে, ইসরাইল জাতিসংঘ ও মধ্যস্থতাকারী মিসরকে অযৌক্তিক শর্ত দিয়েছে যে, হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি কতটা যৌক্তিক? মূলত হামাসের যৌক্তিক দাবি না মানা এবং ইসরাইলের অযৌক্তিক দাবি আদায়ে অনড় অবস্থান গ্রহণের কারণেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেছে। নতুন করে গাজার ওপর বিমান হামলার মাধ্যমে তাদের সফলতার দাবিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তারপরও জাতিসংঘের প্রচেষ্টা বিফলে গেলেও হিউম্যনরাইটস ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নীরব থেকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে ইসরায়েলকে। এতে করে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনীদের কুটনৈতিক দৈন্যতা ও নেতৃত্ব সংকটের চিত্র।
এবার একটু পিছনে ফিরে দেখলেই পরিস্কার হবে ইসরাইলিদের উৎসাহিত কারা করছে! ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় ফিলিস্তিনিদের ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস। হামাসের বহুমুখী সামরিক হামলায় বিপর্যস্ত ইসরাইল কিছুটা কাবু হয়। এছাড়াও ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে আল-আকসা মার্টিয়াস ব্রিগেডসহ একাধিক মিলিশিয়া বাহিনী। নিজেদের মধ্যে দ্বনদ্ধ থাকায় প্যালেস্টাইন একমত হতে পারেনি স্বায়ত্ব শাসনের রূপরেখা সম্বন্ধে। তারপরও প্যলেস্টাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত বিবাদমান গ্রুপগুলোর সাথে একাট্টা করতে মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। তার অসুস্থতার সময়ও ইসরাইলি সেনাদের হাতে অবরুদ্ধ ছিলেন। জাতীয় প্রশ্নে পশ্চিমতীর ও গাজায় সক্রিয় গেরিলারা তাকে সহায়তা দেয়নি বরং তাকে ব্যস্ত রেখেছে বিবাদ মেটানোর কাজে। আরাফাতের কাছে অন্য গ্রুপগুলোর আস্থা ও সহযোগিতা পেলে আজ ফিলিস্তনের চেহারা অন্য রকম হতো। ইসরাইলের আগ্রাসন এ মাত্রা পেতো না। খোদ ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেয শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-র সাবেক প্রধান ইয়াসির আরাফাত হত্যায় তাদের হাত ছিল। ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের সাবেক প্রধান ইয়াসির আরাফাত হত্যাকাণ্ডে হাত থাকার কথা এই প্রথমবারের মতো স্বীকার করে শিমন পেরেয বলেন, ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করা ঠিক হয় নি, কারণ তার সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ ছিল। কিন্তু ইয়াসির আরাফাতের অবর্তমানে পরিস্থিতি আরো খারাপ এবং জটিল দিকে মোড় নিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
৬৪'র পর ফিলিস্তিন প্রশ্নে নতুন মাত্রা যোগ করেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতা ইয়াসির আরাফাত। ১৯৮৮ সালে তিনি আলজিয়ার্সে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। শুরু হয় নতুন পথ চলা। ১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলন এবং পরে ১৯৯৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের মধ্যস্থতায় অসলো চুক্তির ফলে ইসরাইল সীমিতভাবে ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়। স্বায়ত্ব শাসন পাওয়ার পর দেশ শাসনের প্রশ্ন উঠে। এ নিয়ে প্রায় দু'বছর আলাপ আলোচনায় সবগুলো গেরিলা সংগঠন একমত হয় সাধারণ নির্বাচন প্রশ্নে। এ সময় অসলো চুক্তির জন্য ইয়াসির আরাফাত, আইৎজাক রাবিন ও শিমন পেরেজ যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনের সাধারণ নির্বাচনে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রতিপক্ষরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে। আবার শুরু হয় ত্রিমুখি সংঘর্ষ আর অন্তর্কলহ। ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে সংঘাত অবসানের প্রয়াস নেন। চুক্তি করার পরও নতুন করে সংগঠিত হতে থাকে বিদ্রোহীরা। এরই সুযোগ নিয়ে ইসরাইলি বাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতকে ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সালের শেষ ভাগ পর্যন্ত রামাল্লায় তার অফিস কম্পাউন্ডে অবরুদ্ধ করে রাখে। ২০০৪ অক্টোবরে নিজ অফিসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্যারিসের পার্সি সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। এখানেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১১ নভেম্বর মারা যান। তার মৃত্যু স্বাভাবিক নয় মনে করে রাশিয়া ফরেনসিক পরীক্ষা করে প্রকাশ করে, বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরে তা স্বীকারও করেন শিমন পেরেজ, পশ্চিম তীরে তাকে সমাহিত করা হয়।
স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো স্বীকৃতি ও সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। জাতিসংঘের পাশাপাশি আরব লীগ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থাসহ (ওআইসি) আন্তর্জাতিক প্রায় সব সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করে ফিলিস্তিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ইয়াসির আরাফাতকে বাংলাদেশের জনগণ মহান বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাকে সম্ভাষণ জানান। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আরাফাতকে পরম বন্ধুর মর্যাদায় অভিষিক্ত করে ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়ান। মুসলিম ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। সাম্প্রতিক ইসরাইলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু নিজ-দেশের মানুষের জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে আসা আরাফাতকে চেনেনি ফিলিস্তিনী গেরিলারা, সমর্থন দেয়নি শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে। ফলে বিশ্ব হারিয়েছে এক শান্তিকামী নেতাকে আর ফিলিস্তিন হারিয়েছে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে। এ শূন্যতায় কোনঠাসা হয়ে হারিয়েছে কুটনৈতিক অগ্রগতি, বাড়ছে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা।