somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অকর্মের ঢেঁকী

০৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিকাশের দোকানে ঢুকলাম। এখানে অনেক ভিড়।
আব্বা কালকে পাঁচশ দশ টাকা পাঠিয়েছে। চেয়েছিলাম দুইশো টাকা। কিন্তু তিনি পুরো পাঁচশ দিলেন! তার কাছে টাকা চাইনা। চাইলেও খুব কম। আব্বা বলে
-টাকা লাগলে বলিস।
আমি হেসে বলি
-না আব্বা, দরকার নেই। এমনিতেই চলছে।

ভিড় কমেছে। রাজিব ভাই এর দিকে তাকালাম। রাজিব ভাই আমার পরিচিত। শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে। আমার সাথে ভাল সম্পর্ক।
রাজিব ভাই আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
-ক্যাশ আউট করবে?
-হ্যা।
-কত টাকা?
-একশ।
-আচ্ছা কর।
আমি একটা সুন্দর হাসি দিলাম। এখানে পাঁচশ টাকার নিচে ক্যাশ আউট করেনা। কিন্তু আমার জন্য একশো ক্যাশ আউট করার সুযোগ আছে। পুরোটা একসাথে ক্যাশ আউট করলেও হত। একাউন্ট পুরো ফাকা করলে নিজেকে ফকির ফকির লাগে। শুনেছি অনেক ফকিরের নাকি ব্যাংক একাউন্ট আছে! কিন্তু আমার নেই।
রাজিব ভাই মেসেজ টোন শুনে আমাকে একশো টাকা দিল। দোকান থেকে বের হয়ে এলাম।

রাস্তায় হাটছি। পকেটে একশো টাকা। এই টাকা দিয়ে কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে রাস্তার শেষ মাথায় চলে এলাম। ভ্যানের উপর ছোট্ট হোটেলে ভাত বিক্রি করছে। কালকে দুপুরের পরে ভাত খাওয়া হয়নি। হোটেলের সামনে বেঞ্চিতে বসলাম। দোকানদার আমাকে দেখে বলল
-কি খাইবেন মামা?
-ভাত দেন। সাথে আলুর তরকারি। ঝোল বেশি করে দিবেন।
অনেকে বলে এখানে নাকি বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠানে অবশিষ্ট থাকা বাসি ভাত বিক্রি করে। আমার তেমন মনেহয় না। খেতে বেশ লাগে।

দোকানদার মামা প্লেটভর্তি ভাতের সাথে আলুর তরকারি দিল। ঝোলটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি উনার নিয়মিত কাষ্টমার। তাই ভাত তরকারি একটু বেশি দেন।
বাটি থেকে পুরো তরকারি ভাতের সাথে মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। পুরো ভাত গোগ্রাসে গিলে ফেললাম! পানি খাওয়া দরকার। এখান থেকে পানি খেলে একটাকা গ্লাস। টাকা দিয়ে পানি কিনে খাওয়া বিলাসিতা মনেহয়। হলে গেলেই ফ্রি পানি খেতে পারব।
দোকানদারের প্লেট ধোয়া পানিতে হাত ধুতে ধুতে বললাম
-মামা, কয় টাকা?
-ত্রিশ টাকা দেন।

হলে ফিরে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেলাম। রুমমেট পানি খাওয়া দেখে চোখ বড় বড় করে বলল
-কিরে তাড়া খেয়ে এসেছিস নাকি? এভাবে পানি খাচ্ছিস!
-আরে নাহ। পানি তৃষ্ণা লেগেছিল তো।
-শুভ ভাই তোকে ডেকেছে।
-কেন?
-জানিনা। দেখা করতে বলল।

শুভ ভাই আমাদের হলের বড় ভাই। আমার এক বছরের সিনিয়র। অন্যদের কাছে খারাপ হলেও আমার কাছে খুব ভাল। তার কারনেই হলে জায়গা পেয়েছিলাম। নাহলে এতদিনে এই শহরে থাকা হত না।
সেদিন হলে সিট না পেয়ে ঘুরছিলাম। রাজনৈতিক ক্ষমতা বা কোন ধরনের ক্ষমতা ছিল না। বেডিংপত্র নিয়ে হলের বারান্দায় বসে আছি।
একজন লোক এসে বলল
-হলে সিট লাগবে?
-হ্যা।
-লোক আছে?
-না।
-বাসা কোথায়?
-রংপুর।
-বাবা কি করে?
-কৃষি কাজ করেন। একটা দোকান আছে।
-বাহ। তাহলে মায়ের কাছে ফোন দাও। বল ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতে।
-আব্বা টাকা দিবেনা।
-কেন! মাকে বললে দিবে। বাবা মায়ের কথা শুনে।
-আমার মা নেই। আব্বাকে বললে হয়ত টাকা পাঠাবে। কিন্তু তার জন্য সৎ মা বাড়িতে আশান্তি শুরু করবে।
লোকটা চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-আমার সাথে আয়।
হলে সিট পেয়ে গেলাম। ওই লোকটাই সিট ঠিক করে দিল। লোকটা আমার সাথে রুমে আসল। রুমমেটদের বলল
-শোন, এটা আমার ছোটভাই।
বেডিংপত্র রুমে নিয়ে আসলাম। বিছানা সাজানো গোছানো শেষ। লোকটা যাওয়ার আগে বলল
-আমি শুভ। তোর এক বছর সিনিয়র। কোন সমস্যা হলে বলিস।
-আচ্ছা ভাই।
-তোর নাম জানা হল না!
-আমি রিয়াদ।
শুভ ভাই চলে গেল।

আমার মা বলত, "যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছে।"
মায়ের বলা কথাগুলো এখনো মনের ভেতর গেঁথে আছে। দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেলেও, মা আমার মনে আছে।

সেদিন হঠাৎ করেই খবর পেলাম, মা খুব অসুস্থ। রাতেই রওনা দিতে চাইলাম। কিন্তু বাবা বলল, সকালে যেতে। মেস থেকে বাড়ি যেতে মাত্র দুই ঘন্টা সময় লাগে।
সকালে রওনা দিলাম। মেস থেকে বের হতেই বাবা ফোন দিয়ে বলল
-তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়।
-আমি আসছি। গাড়িতে। মা কেমন আছে?
বাবা কিছু না বলেই ফোন রেখে দিল।
যখন বাড়ি পৌঁছালাম, তখন বাড়িতে মানুষের ভিড়। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলাম না। মা ঘুমাচ্ছে! সাদা কাপড়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে। মা বলত, তার ঘুম আসেনা। চোখে ঘুম নেই। কিন্তু মাকে দেখলাম শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। আশেপাশে এত মানুষের ভিড়েও তার ঘুম ভাঙছেনা। বাড়িতে এলে মা উতলা হয়ে যায়। কি।রেখে কি রান্না করবে। কিন্তু আজ উঠছেনা!

মাকে কবরে রেখে আসলাম। যে মা প্রতিদিন আমার খবর নিত, যে মা আমার কথা না শুনলে চিন্তা করত। সেই মা আর কোনদিন আমাকে ডাকবে না। ঠিকমত খাইনা বলে বকাবকি করবে না!
উঠোনে চুপচাপ বসে আছি। বড় আপু এসে বলল
-তুই এত পাষাণ কেন রে! মা নেই। তবুও একটু চোখের পানি ফেললি না!
কিছু বলতে পারছিনা। বলতে গেলেই চোখের বাধ ভেঙে কান্না বেড়িয়ে আসবে। বাড়ির বাইরে রাস্তায় এসে বসলাম। বাড়িতে সবকিছু অসহ্য লাগছে। মায়ের রান্না করা পুটি মাছের ঝোল খেতে খুব ইচ্ছা করছে।

মায়ের লিভার ক্যানসার হয়েছিল। বাবা জমি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মা রাজি হয়নি। বাবার হাত ধরে বলেছিল
-আমি তো এমনিতেই মারা যাব। শুধু শুধু আমার রিয়াদের জমি কমাবো না। ও জমি আমার রিয়াদের।
কয়েকদিন পরে মেসে চলে এলাম।
তার কিছুদিন পরে আব্বা বিয়ে করল।
রংপুর থাকার সময় মাঝেমাঝে বাড়ি যেতাম। সৎ মায়ের ব্যাবহারের কারনে আস্তে আস্তে যাওয়া কমিয়ে দিলাম।
ঢাকা চলে আসার পরে আর বাড়ি যাইনি।

আব্বা প্রায়ই বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু পড়ালেখার ছুতোই যাইনা। তিনি জানেন সবকিছু। তাই বাড়ি যাওয়ার জন্য জোর করেনা। তিনি নিরুপায়। ঘরের বউ এর ব্যাপারটাও তাকে দেখতে হবে। তবে তিনি আমায় অনেক ভালবাসেন। সৎ মাকে লুকিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রাখেন। মাঝেমাঝে টাকা চাইলেও দিয়ে দেন।

শুভ ভাইয়ের! রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজায় টোকা দিয়ে বলল
-ভাই আসব?
শুভ ভাই সিগারেট খাচ্ছিল। জলন্ত সিগারেট এস্ট্রের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল
-আয় ভেতরে আয়।
ভেতরে ঢুকে শুভ ভাইয়ের সামনের বেডে বসলাম। মাথা নিচু করে বললাম
-আমাকে ডেকেছেন?
-তোকে না বলেছি আমাকে তুই করে বলবি। আপন ভাইকে কেউ আপনি বলে!
আমি মুচকি হাসলাম। চাইলেও উনাকে তুই করে বলতে পারিনা। এক বছরের সিনিয়র তো।
শুভ ভাই বলল
-কালকে তোর কাজ আছে?
-না ভাই। কেন?
-এক জায়গায় যেতে হবে। একটা দাওয়াত আছে।
-কখন যেতে হবে?
-দুপুরের দিকে গেলেই চলবে।
-আচ্ছা ঠিকাছে।
-এখন যা।

নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘড়িতে তিনটা বাজে। চারটায় একটা টিউশানি আছে। এই টিউশানির প্রতি আমার অনেক মায়া। স্টুডেন্ট ক্লাস সেভেনে পড়ে। বেশ ভাল ছাত্র। পড়ালেখার প্রতি তেমন মনোযোগী না হলেও কিভাবে যেন ভাল রেজাল্ট করে ফেলে!
ঢাকায় এসে অনেকগুলো টিউশানি পেয়েছি। এই একটা বাদে অন্যগুলো টিকেনি। কোন স্টুডেন্ট আমাকে পছন্দ করেনি। কখনো স্টুডেন্ট এর বাবা মা আমাকে পছন্দ করেনি।
এই টিউশানিটা কিভাবে টিকে আছে জানিনা! মনেহয় কোন স্যার খুঁজে পায় না!

টিউশানি শেষ করে হলে ফিরলাম। বিকেলবেলা রুমমেটরা বাইরে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছে। কিন্তু আমার খাওয়া হয়নি। আমি খেলতে পারি না। ব্যাপারটা হাসির হলেও সত্য, আমি কোন খেলায় পারদর্শী না।
খেলার চেয়ে বরং ঘুমালেই ভাল হবে। জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম।

ঘুম ভাঙল ফোনের কর্কষ শব্দে। ফোনটা ঠিক করিয়েছি। তারপরেও কেমন বেসুরোভাবে বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম অবনীর ফোন!
এই সময় অবনী ফোন দিল কেন! এক সপ্তাহ হল তার কোন খোঁজ নেই। আমি নিজে থেকেও তাকে ফোন দেইনি। ফোন দিলেই সে সুন্দর সুন্দর জ্ঞান দিতে থাকে। যেটা আমার একদম অসহ্য।

ফোন ধরে বললাম
-বল।
-কেমন আছিস? কোথায় আছিস?
-ভাল আছি। হলে আছি। তুই কেমন আছিস?
-ভাল। এতদিন ফোন দেইনি কেন জিজ্ঞেস করবিনা?
-হ্যা বল।
-বলব না। সারপ্রাইজ।
-সারপ্রাইজ!
-হ্যা। কালকে দেখা করবি। সব বলব তোকে।
-কখন দেখা করব?
-ফোন দিয়ে জানাব।
-আচ্ছা।

অবনী ফোন কেটে দিল। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার আজ সে আমাকে কোন জ্ঞান দেয়নি। তাই আমিও বেশ খুশি।
অবনী আমার সবচেয়ে ভাল ফ্রেন্ড। আর আমি তার গবেট মার্কা ফ্রেন্ড। তার মতে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে গর্ধভ মার্কা ছেলেটা আমি। ওর সাথে পরিচয় ওভাবেই।

ক্লাস শেষ করে বসেছিলাম। নতুন নতুন এই শহরে এসে মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি সবার চেয়ে আলাদা। ক্লাসের অনেকেই আমাকে নিয়ে হাসা-হাসি করে। ব্যাপারটা আমলে নেইনা। কেউ আমাকে দেখে খুশি থাকলে ক্ষতি কি!

-ওই তুই এইরকম গর্ধভ কেন!
হঠাৎ একটা মেয়ের এমন কথা শুনে অবাক হলাম। মেয়েটাকে আমি চিনিনা। তবে এটুকু জানি, সে আমাদের সাথেই পড়ে। ক্লাসে কয়েকবার দেখেছি তাকে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-আমি অবনী।
-আমি...
-তোর নাম জানি। আমি তোর ক্লাসমেট।
-জানি।
-তাহলে এমন করে আছিস কেন!
-এমনিই।
-আচ্ছা তুই ভার্সিটিতে চান্স পেলি কিভাবে! তোর মত ছাত্র এখানে চান্স পায়!
আমিও মাঝে মাঝে ভাবি। কিভাবে চান্স পেলাম! ছাত্র হিসেবে আমি তেমন ভাল না। কিভাবে কিভাবে যেন চান্স পেয়ে গিয়েছি! মায়ের দোয়া কাজে লেগেছে!

-তুই এমন হয়ে থাকিস কেন! নিজেকে চেঞ্জ করতে পারিস না!
অবনীর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। একদিনেই এত কথা! মেয়েটা যথেষ্ট চঞ্চল প্রকৃতির।
পায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
-চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারছি না।
-তোর দ্বারা কিছুই হবে না। তুই একটা অকর্মের ঢেঁকি।
আসলেই আমি অকর্মের ঢেঁকি!
ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র অথবা সবচেয়ে শয়তান ছাত্রটি সবার নজরে থাকে। কিন্তু আমি সেসব কিছুই না। একা একা থাকি নিজের মত।

সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেল। হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে বসলাম। নাস্তা করা দরকার। কিন্তু নাস্তা করব না। দুপুরে দাওয়াত আছে। দাওয়াত থাকলে সেদিন সকালবেলা খাই না। খেলে বেশি খাওয়া যায় না। শুধু শুধু টাকা দিয়ে পেট ভরাবো কেন!

শার্ট প্যান্ট পরে রেডি হচ্ছি। দুপুর হয়ে গিয়েছে। শুভ ভাই রেডি হতে বলল। অবনী ফোন দিয়েছে! এখন আবার কি হল তার!
ফোন রিসিভ করে বললাম
-কিরে!
-তুই ক্যাম্পাসে আয়।
-কেন!
-দেখা করবি এখন।
-আমি আসতে পারব না। দাওয়াত আছে।
-দাওয়াত ক্যান্সেল। তুই আসবি এখনই।

অবনী ফোন কেটে দিল। শুভ ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম। শুভ ভাই আমাকে দেখে বলল
-চল।
-আমি যাব না।
-কেন!
-অবনী ফোন দিয়েছিল। ওর সাথে দেখা করতে বলল। আর্জেন্ট।
-আচ্ছা যা।
-ভাই রাগ করবেন না।
শুভ ভাই হেসে বলল
-যা।

হল থেকে বেড়িয়ে ক্যাম্পাসে এলাম। এই শহরে অবনী আর শুভ ভাই সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাদের কারো কথাই ফেলতে পারিনা।
ওই তো অবনী দাঁড়িয়ে আছে! অবনীর পাশে গোতে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে বলল
-যাক আসলি তাহলে! চল হাটতে হাটতে কথা বলি।
অবনীর সাথে হাটছি। সে রাজ্যেত যত কথা আছে সব বলে যাচ্ছে। আমি শুধু হু হা বলে যাচ্ছি। ক্ষুধায় পেট জলে যাচ্ছে। তার জন্য দাওয়াত ক্যান্সেল করলাম! এখন দুপুরে না খেয়ে তার সাথে হাটব! বিরক্তিকর একটা কাজ।

-কিরে তোর মুখ শুকনা কেন!
শুকনা হবেনা! ক্ষুধা পেটে এমন হাটলে কি।মুখ রসে ভর্তি থাকে! হাসার চেষ্টা করে বললাম
-এমনিই।
-সকালে খেয়েছিস?
-না।
-আমার সাথে চল।
হাটতে হাটতে দুজন ক্যাম্পাস থেকে বাইরে চলে এলাম। অবনী আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকল। সচরাচর রেস্টুরেন্ট এ আসি না। মাঝেমাঝে অবনী খাওয়ালে সেদিন আসি।
চেয়ার টেনে দুজন সামনাসামনি বসলাম। অবনী দুইটা গ্রিল চিকেন আর নান রুটির অর্ডার দিল।
আমি খাবারের আশায় বসে আছি।

খাবার চলে এসেছে। অবনী এবারে মুখ খুলল। খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল
-সারপ্রাইজ কি শুনবি না?
-বল।
-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
-হু।
খাওয়ায় মন দিলাম। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে দিলাম। অবনী বিরক্ত হয়ে বলল
-আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
-ভাল তো। ছেলে কি করে?
-ডাক্তার।
-বাহ। ভালই তো। ফ্রি ফ্রি চিকিৎসা নিতে পারবি।
-আর কিছু বলবি না?
অবনীর কথার উত্তর না দিয়ে খেয়ে যাচ্ছি। খাওয়ার সময় বেশি কথা বলা উচিত না। আমার খাওয়া দেখে অবনী রেগে যাচ্ছে। আমি হাত দিয়ে যেভাবে ছিঁড়ে খাচ্ছি, এখানে এভাবে খাওয়া ঠিক না। তবুও আমি নিজের মত খেয়ে চলেছি।

আমার খাওয়া শেষ। আর কিছু না পারলেও খাওয়াটা খুব দ্রুত সাড়তে পারি। অবনীর প্লেটের চিকেন ওভাবেই রেখে দিয়েছে। সে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। তার রাগ ভাঙানোর জন্য হেসে বললাম
-খুব ক্ষুধা লেগেছিল। তাই।
-তোর খাওয়া নিয়ে কিছু বলেছি! আমি আরো কিছু বলেছি সেটা নিয়ে কিছু বল।
-কিছু বলবি না?
-কি বলব! ছেলে তো ভাল। ডাক্তার ছেলে খারাপ না। তবে তারা নিজের বউ এর চেয়ে রোগীর সেবা বেশি করে।
-নে খা।
অবনী তার চিকেনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি এটাও গিলতে থাকলাম।

খাওয়া শেষ। আহ কি শান্তি! পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। অবনী চুপ করে বসে আছে। তার বিয়ের জন্য মন খারাপ! এমন তো হবার কথা না। ওর আগেও অনেকবার এমন বলেছে। পরে বুঝেছি সে মজা করেছে। এবারেও মজা করছে বোধহয়!
অবনী রেস্টুরেন্ট এর বিল মিটালো। দুজন বের হলাম। অবনী রিক্সা ডাকল। আবার কোথাও যেতে হবে! পেট শান্ত আছে। এখন যেখানেই যেতে বলুক কোন সমস্যা নাই। সে এখনো রেগে আছে।

অবনী রিক্সায় চড়ল। আমিও রিক্সায় চড়লাম। আমাকে রিক্সায় চড়তে দেখে অবনী আরো রেগে গেল। কাধের উপর কিল দিয়ে বলল
-নাম।
-কেন!
-আমি বাসায় যাব।
রিক্সা থেকে নেমে গেলাম। অবনী আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই দেখ রিং। সত্যি এবার আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
-অনুষ্ঠান কবে?
-পরশু।
-পরশু! শোন বিয়েতে ভাল করে গরুর গোশত রান্না করতে বলবি। ঝাল কম দেয় যেন। বেশি ঝাল খেলে আমার পেট ব্যাথা করে।
-আমায় ভালবাসিস?
চুপ হয়ে গেলাম। এই কথার উত্তর আমি জানিনা। জানলেও বলতে পারব না। তবুও সাহস সঞ্চয় করে বললাম
-না।
অবনী চোখ মুছতে মুছতে রিক্সাওয়ালাকে বলল
-মামা, যাও।
অবনী চলে গেল। তার উত্তরটা হ্যা দিলেও হত। কিন্তু না বললাম! ইচ্ছা করে বললাম নাকি বাধ্য হলাম! কি জানি!
আমি হলের দিকে হাটা দিলাম।

আজ অবনীর বিয়ে। সকাল থেকেই মনটা শরীর খারাপ। জ্বর জ্বর লাগছে। ভাবছি অবনীর বিয়েতে যাব না। কিন্তু না গেলেও হয় না। শরীরে জ্বর নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম। গোসল করে প্যান্ট পরে একটা টি-শার্ট গায়ে দিলাম। এটা অবনীর কিনে দেওয়া টি-শার্ট।
হল থেকে বেড়িয়ে রাজিব ভাইয়ের দোকানে ঢুকলাম। আজ দোকানে তেমন ভিড় নেই। চারশো টাকা ক্যাশ আউট করলাম। রাজিব ভাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। আজ প্রথম এত টাকা ক্যাশ আউট করলাম!

রাজিব ভাইয়ের দোকান থেকে বেড়িয়ে হাটা শুরু করলাম। পনের মিনিট হাটলেই অবনীর বাসা।
হাটতে হাটতে অবনীর বাসার সামনে এলাম। সুন্দর করে পুরো বিল্ডিং সাজানো হয়েছে। সাজাবে না কেন! বড় মেয়ের বিয়ে। একটু ধুমধাম না করলে চলে!
অবনীদের বাসার সামনে থেকে পুরো চারশ টাকার আইসক্রিম কিনলাম। অবনী খুব আইসক্রিম খেতে পছন্দ করে। প্রায়ই আমাকে বলে
-আইসক্রিম খাওয়াবি?
পকেটে টাকা না থাকায় বলি
-ধুর আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লাগবে।
অবনী আর কিছু বলে না।

অবনীদের বাসার ভেতরে ঢুকলাম। হাতে আইসক্রিম এর প্যাকেট।
এর আগে একদিন এই বাসায় এসেছিলাম। সেদিন অবনী ওর বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। উস্কোখুস্কো চুল, মুখে দাড়ি দেখে তার বাবা বলেছিল
-এমন ছাগল মার্কা ছেলে তোর ফ্রেন্ড!
আমি মাথা নিচু করে মুচকি হেসেছিলাম।

অবনী স্টেজে বসে আছে। ওর চারপাশে কয়েকটা মেয়ে বসে আছে। কড়া মেকাপে তাকে একদম সুন্দর লাগছে না। বরং ভুত ভুত লাগছে। মানুষ ভাবে মেকাপ নিলেই বুঝি সুন্দর লাগে! কিন্তু তারা জানেনা বেশি মেকাপ নিলে সুন্দরের বদলে ভুত ভুত লাগে।
স্টেজের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। তাই একা একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।
অবনী আমাকে দেখেছে! আমার দিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম অন্য কাউকে ডাকছে। পরে বুঝলাম আমাকেই ডাকছে।

আমি স্টেজে উঠতে উঠতে স্টেজ খালি হয়ে গেল। অবনীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার হাতে প্যাকেট দেখে বলল
-এটা কি?
-আইসক্রিম।
-আইসক্রিম! কার জন্য!
-তোর জন্য। অনেকবার চেয়েছিস। কিন্তু দিতে পারিনি।
অবনী চুপ করে থাকল। আমিও চুপ। কি বলব খুঁজে পাচ্ছি না। অবনী বলল
-রিয়াদ।
-হু।
-আমাকে নিয়ে পালাবি?
অবনীর দিকে তাকালাম। সে মজা করছে আমার।সাথে! না মজা করছে না। তার কঠিন আবদার। যেন বলছে তার আবদার পূরন করতেই হবে।
আমি বললাম
-কিরে খাওয়ানো শুরু হয়েছে? খুব ক্ষুধা লেগেছে।
অবনী মাথা নিচু করে আছে। আইসক্রিমের প্যাকেটটা ওর হাতে দিলাম। স্টেজ থেকে নামলাম। একবার পিছন ফিরে ওর দিকে তাকালাম। আইসক্রিমের মত ওর চোখ থেকে পানি গলে পরছে।
আমার চোখ থেকে পানি ঝরছে না। কারন আমার কাঁদার অধিকার নেই। আমি অক্ষম। যে ছেলে ভালবাসার মানুষকে মনের কথা বলতে পারেনা, পালিয়ে যাওয়ার কথা অফার পেয়েও কিছু বলে না। তার কাঁদার অধিকার নেই।
অবনী ঠিকই বলে। আমি আসলেই একটা অকর্মের ঢেঁকি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৪৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×