ক্রিস্টাল মাউন্টেন
ক্রিস্টাল পাহাড় থেকে নেমে পাথরের ওপর বসে আছি, বাকি সবাই তখনো পাহাড়ের উপর। এমন সময় হামাদ এসে তার গজদ্ন্তটি বের করে একটা মিস্টি হাসি দিয়ে জানতে চাইলো আমি ঠিক আছি কিনা?
আজ ১লা অক্টোবর শুক্রবার থেকে পুরো মিশরে ঘড়ির কাটা একঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছে। তাই দুপুর বারোটায় যখন বাহারিয়ায় বাস থামলো তখন আগের টাইম একটা, নামাজের সময়। বাস থেকে নেমেই আমার স্বামী তার অনেকক্ষন ধরে চেপে রাখা নেশা সিগারেটের জন্য অস্থির হয়ে পড়লো।পাশের দোকান থেকে সিগারেট কিনে যখন আসলো তখন তিনটা জীপ বোঝাই হয়ে সবাই হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছে আর আমরা এসে দাড়ালাম সেই প্রচন্ড রোদে পুড়ে যাওয়া বাস কাউন্টারে।
বাহারিয়ার একমাত্র বাস কাউন্টার
সেখানে আমাদের রিসিভ করতে আসা লোক দুজন বলছে অপেক্ষা করো এখনই গাড়ী আসবে তোমাদের জন্য। সে বারবার ফোন করছে কিন্ত গাড়ীর খোঁজ নেই।একটু পরে তারা দুজন একটা প্রাইভেট গাড়ীতে উঠে বল্লো "এখানে দাড়াও আমরা গাড়ী নিয়ে আসছি"।
আমিতো আতংকে কাঠ হয়ে গেলাম। আমরা এসেছি যে বাসটায় সেটাও জানি কোথায় চলে গেছে, আর কোনো গাড়ী ঘোড়া নেই সেই ছোট্ট মরুদ্যান শহরে।
মিশরে দেখলাম ট্যুরিজমটা একটু অন্যরকম। যেমন কায়রো থেকে নিজেরা বাসে বাহারিয়া আসলাম।বাহারিয়া নামলে একজন রিসিভ করে গাড়ীতে উঠিয়ে দিল।হোটেলে নামার পর আরেকজন, সেই মরুভুমিতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আরেক জনার।অন্য একজন শেষে কায়রো যাবার বাসের টিকিট কেটে উঠিয়ে দিল। কোনো লিখিত কাগজপত্রের বালাই নেই শুধু মুখের কথা আর বিশ্বাস। শুধু নির্দিস্ট লোকের কাছে এটুকু বলা যে আমি অমুক ব্যাক্তি।
এরকম নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই সেখানে বেশীরভাগ ট্যুর পারিচালিত হয়ে থাকে। তারা অবশ্য অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই কাজটি করে থাকে ।তবে হাজার হাজার ডলার ইন্টারনেটের মাধ্যমে বুকিং দিয়ে ধনী দেশগুলোর পর্যটকরা কিভাবে ঘুরে বেড়ায় সে সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবোনা। তবে ডেজার্ট সাফারী ট্যুরটা এভাবেই পরিচালিত হয়।
বাহারিয়া মরুদ্যান
যাক আসল কথায় আসি।
আমরা যখন কীংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে আছি রোদের মধ্যে, তখন একটা ছেলে লাল একটা জীপ নিয়ে এসে বল্লো "উঠো'।
উঠো মানে চিনিনা কিছুনা। ছেলেটা বল্লো "ভয় নেই আমারই আসার কথা ছিল, আসো"।
আমিতো উঠবোইনা।আমার স্বামী বল্লো চলো দেখা যাক কি হয়।
আমি কোনোরকমে জীপে উঠে কাঠ হয়ে বসে রইলাম, ছেলেটা আমার নার্ভাস চেহারা দেখে বার বার বলছে "ভয় পেওনা, আমি মুসলমান, তোমাদের কোনো ক্ষতি করবোনা, আমি নামাজে ছিলাম, ফোন বন্ধ ছিল তাই আসতে পারিনি"।
বলতে বলতে হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বল্লো "তোমরা গাড়িতে বসো আমি জুমার নামাজটা শেষ করে আসি"।
চেয়ে দেখলাম একটা মসজিদ।
মসজিদ
৫ মিনিট পর ছেলেটা বের হয়ে এসে মুহুর্তের মধ্যে নিয়ে গেল আহমেদ সাফারী হোটেলে।সেখানে গিয়ে দেখলাম বাকি সঙ্গীরা। জানে পানি আসলো আমার। এই ঘটনার জন্য আমরা কোনো অভিযোগ করিনি কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্ত ম্যানেজার টেলিফোন করে মাফ চাইলো বিস্তর বল্লো টাইম চেন্জের বিড়ম্বনা।
ছেলেটা তার গজদন্ত্ বের করে মুচকী হাসি দিয়ে বল্লো "কি ভয় কেটেছে তোমার"!
এই ছেলেটাই হামাদ আমাদের সবচেয়ে বাচ্চা ড্রাইভার, কিন্ত তুখোড় চালক।
কৃস্টাল পাহাড়ের নিচে মার্কিন পর্যটক লিন্ডাকে আহামাদ কি যেন বলছে
এর মধ্যে সবাই ক্রিস্টাল পাহাড় থেকে নেমে জীপে উঠলো, আমরা আবার সেই রানওয়ের মত রাস্তায়। সুর্য হেলে পড়েছে দিগন্তের পানে। আহমেদ কখনো আগে যাচ্ছে, কখনো ওদের আগে যাবার জন্য সুযোগ করে দিচ্ছে। এভাবে কিছুদুর যেতেই রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে মরুভুমির মধ্যে চলা শুরু করলো মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে।
ছোটো ছোটো পাথর দিয়ে পথ নির্দেশ করা, সে নির্দেশ মেনে গাড়ী গিয়ে হাজির হলো ছোট্ট এক মরুদ্যান নাম আইন ই খাদরা।অল্প কিছু খেজুর গাছ আর একটা ছোট্ট কুয়া আছে। সেখানে আর কোনো প্রানী ছিল কিনা জানিনা তবে হামাদ একটা পোকা ধরে দেখালো আমাদের।
আইন ই খাদরা মরুদ্যানে আমরা
সন্ধ্যা হয়ে আসছে আহমাদ গাড়ীতে উঠার জন্য ডাকলো।চারটা জীপ রেডী।আহমাদ প্রথমে তার গাড়ী স্টার্ট দিল সে হচ্ছে দলনেতা। অন্ধকার হয়নি তখনো, আমরা পাহাড় পর্বত উচু নীচু পেরিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ গোধুলীর আলোয় বাইরে তাকিয়ে দেখি অদ্ভুত এক জগতে আমাদের প্রবেশ। মনে হলো অন্য কোথাও চলে এসেছি মহাকাশের অন্য কোনো গ্রহে ।চারিদিকে সাদা পাথরের বিভিন্ন আকৃতির সব অপরূপ মুর্তি যার থেকে নরম সাদা দুধের মতন এক আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারপাশে। বিস্তীর্ন প্রান্তর জুড়ে সেই মুর্তি কোথাও ঘন কোথাও বা ছড়ানো ছিটানো। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখছি প্রকৃতির তৈরী সেই ভয়ংকর সৌন্দর্যের দিকে।আহামাদ জানালো এটাই সেই বিখ্যাত হোয়াইট ডেজার্ট।
বিভিন্ন আকৃতির মুর্তি
এই দৃশ্য দেখে মনে হলোনা পৃথিবীর কোথাও এমনটি আছে, হয়তো বা অন্য কোনো গ্রহে থাকতে পারে। সেই অপুর্ব ভাস্কর্যগুলোকে ডাইনে বায়ে রেখে আমাদের জীপ লাফিয়ে লাফিয়ে আঁকাবাঁকা ভাবে চলছে ।সেই সাদা আলোর বিচ্ছুরন চারিদিকে কি এক মোহোময় পরিবেশের সৃস্টি করে চলেছে তার বর্ননার ভাষা আমি কেন কোনো ভাষাবিদ বা কবির ভান্ডারেও নেই সে ব্যাপারে আমি একশভাগ নিশ্চিত। আর সেখানে আমি সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগও ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা, ছবিতেও তোলা তা সম্ভব নয়।
তুষার মরু
আমাদের গাড়ির হেডলাইট নেভানো। আহমাদ বার বার সেল ফোনটা জালিয়ে বাইরে ধরছে। আর এবড়ো খেবড়ো সাদা তুষারের মত পাথরের চাইয়ের উপর দিয়ে দক্ষতার সাথে জীপটা নিয়ন্ত্রন করছে।
আমরা মুগ্ধের মত চেয়ে দেখছি প্রকৃতির সেই রূপ।মনে হচ্ছে দুধের মত সাদা কিন্ত হালকা এক আলোর আভরন আমাদের চারিদিকে জোৎস্নার অমল ধবল পালের মত জড়িয়ে নিচ্ছে তার আঁচলে। দম বন্ধ করা সেই সৌন্দর্যে আমাদের নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।
সাদা মরুভুমি
সেই ভয়ংকর সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, চুপচাপ।ব্যাটারীর চার্জ কমে যাওয়ায় ফ্লাশ জ্বালিয়ে ছবি তোলার সাহস পাচ্ছিনা কারন আহমাদ বলছে ছবি তোলার আরো জায়গা আছে। ওমার তুলছে অনবরত তার শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে। যতই শক্তিশালী ক্যামেরা হোক আমরা কেউই সেই সৌন্দর্যের কনা মাত্রও তুলতে পারিনি ।
ওদিকে বাকি তিনটা গাড়িও দেখা যাচ্ছেনা। ড্রাইভার বার বার জীপটা স্লো করে পেছনে তাকাচ্ছে। আমার কেমন ভয় করতে লাগলো,পথ হারিয়ে ফেলেনিতো মরুভুমির মাঝখানে !
আমি দুবার সোজা ইংরাজীতে জানতে চাইলাম "আহামাদ হ্যোয়ার ইজ দ্য রোড? সে বল্লো "দিস ইজ দ্য রোড"।
আমার বিশ্বাস হলোনা এটা কোনো রাস্তা। হঠাৎ পেছনে অনে--ক দুরে পাহাড়ের আড়ালে দুটো হেড লাইট জ্বলেই নিভে গেল।আটকে রাখা দমটা আস্তে করে বের হয় আসলো আমার।
সেই সাদা ধবধবে চুনা পাথরের বিভিন্ন মুর্তির মধ্যে দিয়ে আমাদের জীপটা চলতে শুরু করলো আবার ঝাকুনি খেতে খেতে। একটু পরেই ওরা আমাদের ধরে ফেল্লো।চারটে গাড়ী একসাথে চলছে।
চুনাপাথরের বেড়ালের সামনে আমার স্বামী
অন্ধকার হয়েছে অনেক আগেই চারিদিকে কেমন জংগলের মত লাগছে ভাবলাম কোনো মরুদ্যান। হঠাৎ খোলা একটা জায়গায় গাড়ী থামিয়ে আহমাদ বল্লো "এখানেই আজ রাতে ক্যাম্প করবো"।
জীপ থেকে নেমে দেখলাম মরুদ্যান নয় সেটা ঐ সাদা দুগ্ধ ধবল মরুভুমিই আর তার চারিদিকে সেই আলোর বিচ্ছুরন বের হওয়া বিশাল বিশাল সব চুনা পাথরের টুকরা দাড়িয়ে আছে কোনো মহান শিল্পীর হাতে বিভিন্ন রুপ লাভ করে।
ক্লান্ত আমি
গাড়ী থেকে নেমেই ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পরা শরীর এলিয়ে দিল কয়েকজন সরাসরি বালির মধ্যে। দু:সহ গরমটা কমে আসছে। চারিদিকে চেয়ে মনে হচ্ছে অন্য একটি গ্রহ। অনেক দুরে মিটমিট করে ২/১ টা বাতি জ্বলছে। আহামাদ জানালো তারাও আমাদের মত ডেজার্ট সাফারীতে এসেছে। হামাদরা জীপের ছাদ থেকে জিনিস পত্র নামাচ্ছে ক্যাম্প তৈরীর জন্য।ওদের নামানো একটা ফোম এনে বসে রইলাম তার উপর। চাঁদ উঠছে যদিও পুর্নিমা নয় তবুও স্নিগ্ধ এক আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।শুনশান নীরবতা মনে হচ্ছে ভিন গ্রহে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে আছি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আমরা কয়েকজন।
রাতের ক্যাম্প
চলবে...
Click This Link
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪০