
ভাসমান বাজারের ভেসে থাকা নৌকার আদলে তৈরি কাঠের পাত্রে সাজিয়ে রাখা মিষ্টি খাবার
যখন কোন কিছুই পোস্ট দেবার মতো থাকে না, তখন ছবি ব্লগ বা পোস্টই শেষ ভরসা।
প্রিয় ব্লগার সুমন করের এই বক্তব্যে অনুপ্রানিত হয়েই আমারও শেষ ভরসা ছবি ব্লগ । অর্থাৎ কিনা ব্লগে বেঁচে আছি এটা জানান দেয়ার জন্য ।
"নো সি, নো সি ম্যাম, ইতসে লিভাল মার্কেত" গাইডের কথা শুনে ধড়ে যেন পানি আসলো । আমরা যাচ্ছি ব্যংকক থেকে ৮২ কিমি দূরে গালফ অফ থাইল্যন্ড এর কিনারে এক ভাসমান বাজার দেখতে। স্বাভাবিক ভাবেই সে বাজার দরিয়ার বুকে হওয়ারই কথা । আজীবনের পানি ভীতু আমার আতংকিত গলার প্রশ্ন শুনে গাইড এমনি করেই মিষ্টি হেসে আমায় আশ্বস্ত করলো ।

নদীর ধারে অপরুপ কারুকার্য্যময় এক মন্দির চত্বর
থাইল্যন্ডের সব চেয়ে ছোট্ট একটি প্রদেশ (৪১৭ বর্গ কিমি) স্থানীয় ভাষায় তার নাম সামুদ সংখ্রাম , সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ সমুদ্র সংগ্রাম। সমুদ্র পাড়ে বলেই হয়তো এমন নামকরণ। থাই মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ে উৎপন্ন মেক্লং নদী বেশ অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে এখানেই সাগরের বুকে আছড়ে পরেছে তার অসংখ্য শাখা প্রশাখা নিয়ে। সামুদ সংখ্রাম প্রদেশটি আকারে ছোট হলে কি হবে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে তাঁর স্থান বেশ বড়ই বলতে হয়।

বিখ্যাত আমফাওয়া সেতুর নাম ফলক
চক্রী রাজবংশের প্রথম রাজা রামা ১ এর স্ত্রী রানী অমরিন্দ্রা ও দ্বিতীয় রামার জন্মভুমি এই সামুদ সংখ্রামের আমফাওয়া জেলা । উল্লেখ্য পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম রাজ ক্ষমতার অধিকারী থাইল্যন্ডের এক জীবন্ত কিম্বদন্তী ও জাতির কাছে পিতৃতুল্য বর্তমান রাজা ভুমিবল আদুলেয়াদজেও চক্রী বংশের, তাঁর উপাধী নবম রামা ।

থাইল্যন্ডের জীবন্ত কিম্বদন্তী রাজা ভুমিবল
এই আমফাওয়া জেলার বুকে জালের মত বিছিয়ে থাকা মেক্লং নদীর বুকেই গড়ে উঠেছে থাইল্যন্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাসমান বাজার। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে পর্যটকের ভীড়ে জমজমাট এই নদীর দু পাশে বসে তখন নানা রকম খাবার দাবার নিয়ে ভাসমান দোকান । বিক্রীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে হরেক পদের সামুদ্রিক মাছের বার বি কিউ অথবা ফ্রাই। এই ভাসমান বাজারে ভাসমান রেস্তোরাঁর সংখ্যাই ছিল চোখে পড়ার মত।

বিকেল থেকেই ভাসমান রেস্তোরায় পর্যটকদের রসনা বিলাসের আয়োজনে ব্যাস্ত

নারকেল পাতায় মুড়িয়ে রান্না করা খাবার নিয়ে বিক্রীর জন্য নৌকা বেয়ে আসছে
নৌকার উপরেই জলন্ত চুলোয় তেলে ভেজে দিচ্ছে কাকড়া, চিংড়ি, স্কুইড। এসব মাছই পাশে লাল জ্বলন্ত কয়লার উপর বিছিয়ে রেখেছে বার বি কিউর জন্য । পাড়ে সিড়ির উপর টুলে বসেই আপনি খেতে পারবেন গরমা গরম কাকড়া চিংড়ি ভাজা। আর যদি সিড়িতে বসতে না চান তবে ব্রিজ পেড়িয়ে ওপারে চলে যান , প্রচুর রেস্তোরা রয়েছে সেখানে চেয়ার টেবিলে বসে উপভোগ করতে পারবেন মজাদার খাবার দাবার।

এসব রেস্তোরায় চেয়ার টেবিলে বসে খেতে পারেন, তবে দাম কিন্ত অনেক বেশিই পড়বে ।
ব্যংকক থেকে দু ঘন্টায় ভ্যান এ করে চলে আসলাম সামুদ সংখ্রাম। ব্যংকক থেকে আমাদের সাথে আসা গাইডের আমন্ত্রনে তার বাসায় আসলাম । চারিদিকে নীরব নিরিবিলি এক পরিবেশ যে কোন মানুষের মন জুড়িয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট । নীরব সুনসান রাস্তা দু ধারে ঝাউ গাছ, বাশ অথবা নারিকেলের বাগান। এতই শান্ত স্নিগ্ধ চারিদিক যে একটু কান পাতলে সেই নারকেল পাতার শন শন আওয়াজও কানে ভেসে আসবে। সেই অপরূপ সৌন্দর্য্য আর নীরবতায় মুগ্ধ আমার সহ পর্যটক সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার ব্যাপারে গাইডের কাছে খোজ খবর নিতে শুরু করলো ।

গাইডের বাসায় সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পথটি চলে গেছে কোন সুদুরে

সবুজ শ্যমল গাছে আবৃত সেই গাইডের বাসা যা দেখে মুগ্ধ সবাই
তার সাময়িক খালি সেই বাসা থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু দূরে রাস্তার পাশের এক রেস্তোরায় খেতে বসলাম ।

রাস্তার ধারের রেস্তোরায় চিকেন বার বি কিউ তৈরী হচ্ছে

মেলামাইনের থালায় খাবার আর টিনের মগে ঠান্ডা পানীয়। টিনের মগে কবে পানি খেয়েছি মনেও নেই ।

ঝিমুনি কাটাতে ছোট্ট এক কফি শপে এবার কফি খাবার পালা

কফির শপের পাশেই এক গাছে খাচায় বন্দী নাম না জানা পাখী
তারপর শুরু হলো সমুদ্র সংগ্রামে নেমে পড়ার অভিযানে । প্রথমেই গাইড আমাদের গাড়ী করে এই মন্দির দুটি দেখিয়ে নিল । এ মন্দির দুটো আমরা নৌকা থেকে নেমেই দেখতে পারতাম তবে বেশ অনেকখানি পথ হাটতে হতো । আর আমার বাতে ধরা পায়ের জন্যই বোধ হয় এই ব্যবস্থা ।

সামুদ সংখ্রামের নাম করা এই বৌদ্ধ মন্দির ।
সেদিন কিসের যেন বন্ধ ছিল তাই এই মন্দির চত্বরের অস্থায়ী দোকানগুলো ছিল বন্ধ। তারপর ও একলা এক পাপড় বিক্রেতা ঠিকই হাজির ছিল তার পন্য নিয়ে । ভাত দিয়ে তৈরী এমন রংগীন পাপড় আমাদের দেশেও খুবই প্রচলিত।

পাপড় ও বিক্রেতা অলস মধ্য দুপুরে ।
এরপরের গন্তব্য ছিল আয়ুথিয়া আমলে নির্মিত মঠ ওয়াট বাং কুং । এই মন্দিরটি ক্যম্বোডিয়ার সিয়েম রেপের তা প্রহম মন্দিরের মতই গাছের শেকড়ে পুরোপুরি আবৃত । তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যপারটি হলো এর প্রবেশ পথ আর ছটি জানালা কিন্ত সম্পুর্ন শেকড় মুক্ত। আর এটা নাকি কারো হাতের ছোয়ায় নয়, প্রাকৃতিক ভাবেই হয়েছে বলে শুনলাম।

শেকড়ে আচ্ছাদিত ওয়াট বাং কুং

এই মন্দির চত্বরে রয়েছে থাইল্যন্ডের বিখ্যাত কিক বক্সারদের ভাস্কর্য্য ।

আর প্রাচীন শ্যাম রাজ্যত্বকালের সৈনিকদের ভাস্কর্য্য

আর মন্দির প্রাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর মোরগের ভাস্কর্য্য

বিক্রীর জন্য সাজিয়ে রাখা মোরগের সারি।
এখান থেকে যত খুশী লাল ঝুটিওয়ালা মোরগ কিনে আপনি এই মন্দির চত্বরে দান করতে পারেন। কিন্ত এখানে মোরগ দানের গুঢ় মর্মটা কি তা আমাদের সৌখিন গাইড বোঝাতে পারলো না।

আমি অবশ্য দান না করে স্যুভেনীর হিসেবে দুটো মোরগ কিনে এনেছি
এবার আমাদের আসল অভিযান শুরু হলো অর্থাৎ ভাসমান বাজার ভ্রমন । আমফাওয়া ভাসমান বাজারে প্রবেশ মুখে রয়েছে বিশাল এক চত্বর তারপর এক গলি পথে আপনি এগিয়ে চলুন ভাড়ায় নৌ ভ্রমনের জন্য ।

প্রবেশ মুখে বিশাল চত্বর

গলি পথের দু পাশে সারি সারি খাবারের দোকান । রসনা বিলাসী থাইরা সারাদিন ধরে কিছু না কিছু খেয়েই চলে , তবে পরিমানে অল্প।

এখান থেকে ডাব খেয়ে এক প্যকেট মিষ্টি জাম্বুরা কিনে এগিয়ে চলেছি টিকিট ঘরের দিকে।
পুরো নৌকা ভাড়া নিলে কত বাথ মনে নেই তবে বেশ বড় সাইজের সেই ইঞ্জিন নৌকা যাতে ১০/১৫ জন আরাম করে চড়তে পারবে তার ভাড়া জন প্রতি ৫০ বাথ। আমরা অমন একটা নৌকায় বসে পড়লাম।

সেই শান্ত নদী মেক্লং এর দু পাশে নান্দনিক সৌন্দর্য্যের একটি দুটি কাঠের বাড়ী
সিড়ি বেয়ে নেমে আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হোলাম । তবে ওরা নৌকা যাত্রী পুর্নের জন্য অপেক্ষা করে না । যে কারনে ২ ঘন্টার সেই নৌ ভ্রমনে আমরা মাত্র ৫/৬ জনই ছিলাম ।

আমাদের সহযাত্রীরা

নদীর তীরের প্রতিটি বাড়িই এমন ফুলে ফুলে শোভিত, কিছু কিছু ভাড়া হয় দিন কয়েকের জন্য
এখানে একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না তা হলো ব্যংককের জনপ্রিয় ভাসমান বাজার Damnoen Saduak এ আমাদের একটানা ঘুরিয়ে এনেছিল সেই ল্যন্ডিং স্টেশনে যেখান থেকে উঠেছিলাম । কোন নামা নামির সুযোগ ছিল না আর যতদুর মনে হয় নেমে দেখারও কিছু নেই। আর তাজা ফলমূল পকেনাকাটা বিশেষ করে স্যুভেনীরের দোকানগুলো ঐ ঘাটেরই পাড় ঘেসে সারি সারি সাজানো।
কিন্ত আমফাওয়া জেলার মেক্লং নদীর শাখা প্রশাখার উপর ভাসমান বাজার ছাড়াও এর দু পাশে ছড়িয়ে আছে স্থানীয় নকশায় তৈরী প্রচুর বুদ্ধ মন্দির মঠ। এগুলো বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। প্রতিটি স্পটে আমাদের যথেষ্ট সময় দিয়েছে নেমে দেখার জন্য।

প্রথমেই নামার সুযোগ ঘটলো এই মন্দিরে । এর বেশ বড় চত্বরে কিছু পুরনো প্লেন সাজিয়ে রাখা আছে ।
সাথেই লাগোয়া এক মিনি চিড়িয়াখানা আর তাতে রয়েছে নিরীহ কিছু প্রানী যেমনঃ ।

উট

উটের এই আদুরে ভংগীমার ছবিটা না দিয়ে পারলাম না ।

আদর নিতে ব্যাস্ত একাকী হরিন

আমাদের হাতে শাক দেখে বেড়ার গায়ে ভীড় করে এসেছে হরিণগুলো

কলমী শাক খাওয়া ছাগল

ঘোড়া

চিড়িয়াখানার প্রানীদের খাবারের জন্য সাজিয়ে রাখা কলমী শাক, এক আটি ১০ বাথ
এগুলো ছাড়াও কুমির, উট পাখি, ময়ুর আরো অনেক কিছুই ছিল । সবাইকে কয়েক গোছা কলমী শাক খাইয়ে বের হয়ে আসবো দেখি ...

এক নাগলিঙ্গম বুদ্ধের স্বর্নালী মুর্তি জড়িয়ে আছে ।
তারপর আরেক মন্দিরে যাওয়া ।

মন্দির চত্বরে এক নান্দনিক ভাস্কর্য্য
এখানে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে যেখানে স্থানীয় সুর ও বানীর চর্চা হয়ে থাকে । এর পৃষ্ঠপোষক বর্তমান থাই রাজতন্ত্রের অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজকুমারী শ্রীনিধন মহাচক্রী ।

মন্দিরের ছাদের টালি বানিয়ে শুকাতে দিয়েছে চত্বরে ।

নৌকার ছাদের ওপর দিয়ে নদীর ওপারের নয়নাভিরাম দৃশ্য ।

কারুকার্য্য খচিত আরেকটি মন্দিরের প্রবেশ পথ
কতক্ষন আপনি নেমে ঘোরাঘুরি করবেন তার কোন সময় সীমা বেধে দিয়েছিল বলে শুনি নি । যতক্ষন ইচ্ছে থাকো । তার মাঝেও সবাই এক একটি জায়গা দেখে নিয়ম মাফিকই ফিরে এসেছিল ।

তখনও মন্দির সীমানার কংক্রীটের বাধানো রাস্তার ধারের অসাধারন সৌন্দর্য্যমন্ডিত সেই বাতিদানে বাতি জ্বলে নি ।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো নদীর তীর ঘেষে রেলিং বাধানো চত্বরের বেঞ্চে বসে রইলাম । ঠান্ডা শীতল সেই বাতাস ছেড়ে ব্যংককের প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে ফেরার কথা ভাবতেই মনটা বিদ্রোহ করে উঠলো তারপর ও আমাদেরও ফিরে আসতে হয় ।
যতই ভাবি এবার ছবি ব্লগে কোন কথা নয় শুধু ছবির পর ছবি দিয়ে যাবো । কিন্ত কেন যে তা হয়ে উঠে না আমার ।
সমস্ত ছবি আমাদের দুটি ক্যমেরা আর মোবাইলে তোলা ।
গতকাল পোষ্টটি পাবলিশ করার পর নেট স্লো এর কারনে ড্রাফটে নিয়ে যাই । তখন দেখি একটি মন্তব্য । কিন্ত কার মন্তব্য দেখার সুযোগ হয়নি । তার কাছে আমার আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


