ফ্রা ফ্রাং সাম ইয়ত বা মাংকি টেম্পল, লপবুরির ল্যান্ডমার্ক
থাইল্যন্ডের রাজধানী ব্যংকক থেকে ১৩৮ কিমি দূরে একটি প্রদেশ নাম তার লপবুরি প্রাচীন কালের লাভা পুরা যা ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। একসময় ক্যাম্বোডিয়ার বিশাল খেমার সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যাওয়া লপবুরির যতই গৌরবময় ইতিহাস আর ঐতিহ্য থাকুক না কেন সত্যি বলতে কি বর্তমানে পর্যটকদের কাছে এর প্রধান আকর্ষন হলো একটি বাৎসরিক ভোজসভা।
আমন্ত্রন পেলেও আপনি কিন্ত সেই ভোজে অংশ গ্রহন করতে পারবেন না যদি না আপনার একটি লম্বা লেজ থাকে। কারন এ ভোজসভার অতিথিরা হলো খেমার আমলে নির্মিত এক প্রাচীন মন্দির প্রাঙ্গনে বসবাস করা শত শত বানর। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে হাজারো রঙের ফল ফুলের ডালা সাজিয়ে আয়োজিত এই ব্যতিক্রমী বানরের ভোজসভা দেখতে হাজির হয় স্থানীয় জনগন ছাড়াও শত শত পর্যটক।
ফলের সাগরে অতিথি বানর আর দর্শক হলো মানুষ
সাতই অগাষ্ট ২০১৭ সকাল আটটায় এক রাত দুদিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে রওনা দিলাম লপবুরির উদ্দেশ্যে। আমাদের যাত্রা সঙ্গী ছিল ছোট ছোট দুটি মেয়ে আর এক বৃদ্ধ মহিলা সহ এক সিঙ্গাপুরি দম্পতি। জাতীয় মহাসড়ক ৩১৯৬ দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চালক। জানালা দিয়ে দেখছি পথের দুপাশে শহর,নগর, মাঠ ঘাট আর গ্রামীন দৃশ্যপট অত্যন্ত দ্রুততায় সরে সরে যাচ্ছে পেছনে। নির্ধারিত সময় দুই ঘন্টা আট মিনিটের মধ্যেই লপবুরি ইন রিসোর্টে পৌছে গেলাম।
রিসোর্টের দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গীমায় বানরকুলের টেরাকোটা আর্ট
সহ পর্যটকরাও এখানেই উঠলো। শহরের এক প্রান্তে নিরিবিলি ছিমছাম পরিবেশে বানরের মুর্তি ঘেরা সেই রিসোর্ট দেখে বাচ্চাগুলো দারুন উত্তেজিত। আমাদেরও মজাই লাগছিল তা দেখে। দেয়াল ঘেষে সার দেয়া একই ডিজাইনের লাল টালির ছাদের দৃষ্টি-নন্দন পাকা কুটিরের একটি আমাদের জন্য বরাদ্দ হলো। অফ- সিজন থাকায় সকালের নাস্তা সহ ডাবল বেডরুম ভাড়া এক রাতের জন্য ২৮ মার্কিন ডলার।
সারি সারি কুটির আর তার সামনে এমন সব বানরের ভাস্কর্য্য
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে এগারোটার আগেই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্য লপবুরির ল্যান্ডমার্ক মাংকি টেম্পলের উদ্দেশ্যে। আমাদের থাকার জায়গাটি শহরের এক প্রান্তে অবস্থান হওয়ায় যাতায়তের বেশ অসুবিধা দেখতে পেলাম। ব্যংককের মত মিটার ট্যাক্সি বা টুকটুক নেই। গন-পরিবহনের জন্য রয়েছে বাস আর সীমিত সংখ্যক টেম্পু যাকে ওরা বলে সংতোয়ে তাও সেগুলোর চলাচল প্রধান সড়কে। বেশ কিছু পথ হেটে অনেকের সাহায্য নিয়ে অবশেষে বড় রাস্তার পাশে বাস স্ট্যান্ডে হাজির হোলাম। অল্পক্ষনের ভেতরেই লাল রঙের একটি সংতোএ আসলো যা আমাদের গন্তব্যের দিকেই যাবে। ভাড়া নিল মাথা পিছু ছয় বাথ।
পথের ওপাশে দুটো ভেঙ্গে পরা মঠ
শহরের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা চলার পর ড্রাইভার চওড়া একটি রাস্তার পাশে ফুটপাথ ঘেষে গাড়ি থামিয়ে ইশারায় জানালো আমরা গন্তব্যে পৌছে গেছি। যেখানে নামালো তার উল্টোদিকে রাস্তার লাগোয়া সামান্য দুরত্ব বজায় রাখা দুটো প্রাচীন মঠ বা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখা যাচ্ছে। দুর থেকে এক নজর দেখেই বুঝলাম সেখানে দেখার কিছু নেই । অবশেষে হাটতে লাগলাম পেছনে ফেলে আসা এক মন্দিরের উদ্দেশ্যে যা দেখার জন্য আমাদের এখানে আগমন। রাস্তাঘাট বাড়িঘর সহ অন্যান্য চিনহ দেখে বোঝা যায় স্থানটি লপবুরির পুরনো এক ঐতিহাসিক এলাকা।
হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের ভাঙ্গা দেউলের কাঠামো
দু এক কদম এগুতেই নজরে পড়লো হাতের বাঁয়ে ফুটপাথ ঘেষে সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাটির উচু একটি ঢিপি তার উপরে একটি ভাঙ্গা দেয়াল। সামনে ধাতব পাতের ছোট সাইনবোর্ডে ইংরাজী ও থাই ভাষায় লেখা wat indra . অর্থাৎ হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের মন্দির। খেমার সাম্রাজ্যের অধীনে নির্মিত মন্দিরটি লপবুরির দেয়াল ঘেরা নগরীর ভেতরে অবস্থিত। এর নির্মানে খেমার স্থাপত্যের ছাপ ও ধর্মীয় প্রভাব সুস্পস্ট বলে থাই পুরাকীর্তি বিভাগের উদ্ধৃতি রয়েছে সাইনবোর্ডে।
ইন্দ্র মন্দিরের সাইনবোর্ড
একসময় দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার বিশাল অঞ্চল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্বোডিয়ার খেমার সাম্রাজ্যের জনগনসহ রাজন্যবর্গরাও হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পৃথিবীর নতুন বিস্ময় এংকরভাটের নির্মাতা শিবের উপাসক সম্রাট ২য় সুর্যবর্মন পরম বিষ্ণুলোকা। উপাসনা ও তার নিজ সমাধি সৌধ হিসেবেই ভারতীয় এবং খেমার স্থাপত্যের সংমিশ্রনে নির্মান করেছিলেন এংকরভাটকে। পরবর্তীকালে এইসব অঞ্চলে রাজকীয়ভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে পড়ে।
২০১৫ তে দেখা আমার চোখে দেখে আসা এংকরভাট
ওয়াট ইন্দ্রা থেকে ফুটপাথ ধরে কিছুটা সামনে এগুতেই নজরে পড়লো এক চৌরাস্তার মোড় যার মাঝখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা এক সড়কদ্বীপ। আর সেই দ্বীপের মাঝেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লপবুরির বিখ্যাত ফ্রা ফ্রাং সাম ইয়ত (phra prang sam yot) বা মাংকি টেম্পল। ক্যাম্বোডিয়ার সিয়ামরেপের বিভিন্ন মন্দিরের ক্ষুদে সংস্করন এই স্থাপত্যটি ১৩ শতাব্দীর খেমার স্থাপত্য কলার প্রধান নির্মানশৈলী বায়ন রীতিতে তৈরী।
রাস্তা পেরিয়ে কাটাতারে ঘেরা সেই সড়ক দ্বীপের কাছে পৌছে দেখলাম বানর বেষ্টিত মন্দিরে বেশ কিছু শ্বেতাংগ পর্যটক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, তবে স্থানীয় কাউকে দেখলাম না । বানরগুলো কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাদের পর্যবেক্ষন করছে অর্থাৎ এর কাছে কোন খাবার জাতীয় কিছু আছে কি না যা ছিনিয়ে নেয়া যায়। অবশ্য শুধু খাবারই নয় ক্যামেরা, মোবাইল, সানগ্লাসও তাদের হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন।
সবুজ সড়ক দ্বীপের মাঝখানে বানর মন্দির
কোথায় জানি পড়লাম এক পর্যটকের স্ত্রীর মাথার ক্লিপগুলোও তারা দক্ষ হাতে খুব ধীরে ধীরে খুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছিল। কখনো কখনো তারা কামড়ে দেয় আর যার জন্য আপনাকে দ্রুত ক্লিনিকে গিয়ে র্যাবিস ইঞ্জেকশনও নিতে হবে গোটা চার। এসব শুনে আমার স্বামীতো ঢুকলোই না। আমি ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এর মাঝে গোটা দুই বানর আচমকা আমাকে ঘিরে গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল আমি ভয়ে হিম হয়ে যাচ্ছিলাম। তা দেখে এক পর্যটক তার হাতের লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতেই তারা আমাকে ছেড়ে পালালো।
গেটের প্রবেশ পথে জটলা
এখানে প্রবেশ ফি মাথা পিছু পঞ্চাশ বাথ। তবে ঘটনা হলো আমি সেই ফি দেয়ার কথা জানতামই না এবং দেইওনি । যখন বিষয়টি জানলাম আমি তখন সেখান থেকে অনেক দূরে। আসলে আমি যখন সিড়ি বেয়ে উঠে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিলাম তখন সেখানে হাটতে অক্ষম এক লম্বা চওড়া শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে আসা পরিজনরা হুইল চেয়ারে বসানোর কসরত করছিলো। সেই ভজঘটের মধ্যে আমি ডান দিক দিয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি।সেখানে বাঁদিকে যে ছোট ঘরটিতে নিরাপত্তা রক্ষীরা বসেছিল আর তারা যে টিকিটও নিচ্ছিল তা আমি বুঝতেই পারি নি।
ভালোই হয়েছে নৈলে এংকরভাট, তা-প্রহম আর প্রাসাত বায়ন দেখা আমার কাছে ফ্রা ফ্রাং সাম ইয়ত এর আকার-আকৃতি ও রক্ষনাবেক্ষনের হালে হতাশ আমার কাছে সামান্য ঐ পঞ্চাশ বাথই বিশাল হয়ে উঠতো ।
অপরিচ্ছিন্ন মন্দির প্রাঙ্গন
বানরের জন্যই কিনা জানি না থাইল্যান্ডের অন্যন্য দর্শনীয় স্থানগুলোর চেয়ে এই পুরো মন্দির ও তার লাগোয়া চত্বরটি বেশ অপরিচ্ছন্ন মনে হলো আমার কাছে। খেমার মন্দিরগুলির ক্ষুদ্রতম রেপ্লিকা তিন চুড়া বিশিষ্ট এই মন্দিরটি শুধু বাইরেই নয়, ভেতরেও যে সামান্য নিদর্শন রয়েছে যেমন খিলান, গম্বুজ, কারুকার্য্য করা স্তম্ভ ও একাধিক ভগ্নমুর্তি, শিবের পুজার জন্য নির্মিত পাথরের পবিত্র স্থান সব কিছুতেই খেমার নকশার প্রতিফলন লক্ষ্যনীয়, তবে নির্মান কাজ সিয়ামরেপের মন্দিরগুলোর মত তত সুক্ষ নয়। এখানকার প্রচুর নিদর্শন থাইল্যান্ডের জাতীয় যাদুঘরের আলাদা গ্যালারীতে সংরক্ষিত রয়েছে। সরু করিডোর দিয়ে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত মন্দির তিনটি দেখতে যথেষ্ট কসরত করতে হচ্ছিল সবাইকে।
একেই জালে ঘেরা নীচু জানালা তাতে সারাদিন বাদরের ঝুলাঝুলি । আলো প্রবেশের উপায় নেই
বানরের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে জাল বেষ্টিত নীচু জানালা দিয়ে আসা সামান্য আলোয় ভেতরের অপরিসর মেঝেতে স্থাপিত বেশ বড়সর আকারের মাথাবিহীন মুর্তি ও পুজার স্থানগুলোতে কোন রকমে হোচট খেতে খেতে দেখে নিলাম এংকরভাটের বাচ্চাকে। অন্য একটি দল নিয়ে আসা গাইডকে মস্তকবিহীন একটি মুর্তি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কার মুর্তি ?
মন্দির অভ্যন্তরে মস্তক বিহীন মুর্তি ও পুজার উপাচার ।
প্রশ্ন শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিল আমি তার দলের সদস্য নই, অর্থাৎ বিনে পয়সায় তথ্য জানতে চাচ্ছি। তারপর অত্যন্ত বিরক্তির সাথে জানালো এটা বুদ্ধের মুর্তি। কিন্ত এংকরভাটে শুনেছিলাম রাজকীয় ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু কিছু হিন্দু দেবতার মুর্তির মাথা ভেঙ্গে বুদ্ধের মাথা বসানো হয়েছিল, সে ইতিহাস থাক। বাইরে একটা প্রমান সাইজের বসে থাকা কালো পাথরের বৌদ্ধ মুর্তির গা বেয়েও চলছে বানরের অবিরাম ওঠানামা। যাই হোক ভয়ে ভয়ে ঘুরে ফিরে দেখে বেরিয়ে আসলাম।
বুদ্ধমুর্তি বেয়ে চলছে বাঁদরের বাঁদরামী
এবার যাবো লপবুরির বিখ্যাত নারাই মিউজিয়ামটি দেখতে যা এখন থেকে একশ গজ দুরত্বে। হাটতে হাটতে অবশেষে হাজির হোলাম দেয়াল ঘেরা মিউজিয়ামের প্রধান প্রবেশ গেটের কাছে। বাইরে দেয়ালে বড় করে লেখা মিউজিয়ামের নাম।
মিউজিয়াম গেটের বাঁ পাশে লেখা রাজা নারাই মিউজিয়াম
থাইল্যান্ড তথা প্রাচীন শিয়ামের এক মহান রাজা ছিলেন নারাই যা হচ্ছে ভারতীয় দেবতা নারায়ন নামের অপভ্রংশ (১৬৫৬ –১৬৮৮ )। তাঁর রাজধানী আয়ুথিয়াতে হলেও চীনের ক্রমাগত আগ্রাসনের মুখে নিরাপত্তার জন্য ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ লপবুরিতে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তোলেন। আর এখান থেকেই তিনি বছরের আটমাস শাসন কাজ পরিচালনা করতেন। দেয়াল ঘেরা তাঁর রাজকীয় প্রাসাদ ও অন্যান্য স্থাপনা মিলিয়েই পরবর্তীকালে গঠিত হয়েছে মিউজিয়াম।
দ্বিতীয় রাজধানী লপবুরিতে ইউরোপিয় নকশাঁয় নির্মিত রাজা নারাই এর রাজপ্রাসাদ যা বর্তমানে যাদুঘর
রাজা নারাই ছিলেন এক দুরদর্শী রাজনিতীবিদ এবং অসাধারন কুটনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী। ব্যংককের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ছাওফ্রায়া নদীর তীরে গোলা আর কামান নিয়ে আক্রমনের জন্য উদ্যত ডাচ বনিকদের বানিজ্যিক সুবিধা দিয়ে নিজ দেশকে পরাধীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। এ ঘটনাটি তৎকালীন বিশ্বের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একটি বিস্ময়কর ঘটনাই বলতে হবে। আবার ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন ফ্রান্স, ইংল্যন্ড ছাড়াও এশিয়ার পারস্যের সাথে ঘনিষ্ঠ কুটনৈতিক আর বানিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে রাজা নারাই ক্ষমতার ভারসাম্যও রক্ষা করেছিলেন।
ব্যংককের জাতীয় মিউজিয়াম প্রাঙ্গনে মহান রাজা নারাই দাঁড়িয়ে থাকা মুর্তি
থাইবাসীদের গর্ব যে সে সময় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইউরোপের ক্ষমতাবান দেশগুলোর উপনিবেশে পরিনত হলেও তাদের প্রিয় মাতৃভুমি আজ পর্যন্ত কখনোই কারো অধীন বা উপনিবেশে পরিনত হয়নি। আর এ কারনেই থাইবাসীরা রাজা নারাইকে একজন মহান রাজা বলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে যখন যাদুঘরের প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করি তখনই দ্বাররক্ষী দ্রুত এগিয়ে এসে জানালো যাদুঘর বন্ধ কারন সোমবার ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি। আর সেদিনটি ছিল সোমবার। এতদুর থেকে এত টাকা খরচ করে এসে মন্দির দেখে হতাশ আমি ভেবেছিলাম যাদুঘর দেখে পুষিয়ে নেবো। দ্বাররক্ষীর কথায় হতাশা আমাদের চোখে মুখে ফুটে উঠলেও কিছু করার ছিল না। তাই ইশারায় বোঝালো দু ভাগে বিভক্ত মিউজিয়ামটির অন্দরমহল বন্ধ থাকালেও বাহির মহলটি যেন আমরা অবশ্যই ঘুরে দেখি।
বিদেশী অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য হল ঘর
কি আর করা অবশেষে বিশাল বিশাল কড়ই গাছের হাল্কা ছায়া ছায়া মায়াময় এক পরিবেশে আমরা দুজন সবুজ ঘাসের চত্বরে ভাঙ্গা ইটের দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। লপবুরি আসার আগে ইতিহাস থেকে জেনেছি রাজা নারাইয়ের শাসন ব্যাবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বিদেশীর প্রবল প্রভাব ছিল। গ্রীক অভিযাত্রী সেই বিদেশীর নাম ছিল Constantine Phaulkon । ফরাসীরা যাকে সম্বোধন করতো মশিয়ে কনস্টান্স বলে। তিনি এতটা ক্ষমতাশালী ছিল যে আজকের প্রেক্ষাপটে তাকে একজন প্রধানমন্ত্রীর সমকক্ষ হিসেবে তুলনা করা যেতে পারে। তারই প্রভাবে লপবুরির রাজকীয় নিবাসের বেশিরভাগ স্থাপনাগুলোই ইউরোপীয় নঁকশার ছাপ সুস্পষ্ট। এর মাঝে আমাদের না দেখা রাজপ্রাসাদটি যা বর্তমানে যাদুঘরটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লপবুরি দ্বিতীয় রাজধানীতে মশিয়ে কনস্টান্স এর মহল
বিশাল চত্বর জুড়ে তৈরী বাইরের মহলে মশিয়ে কন্সটান্সের বাসভবন ছাড়াও বিদেশী কুটনীতিক ও অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য হলঘর, রাজকীয় জিনিসপত্র রাখার কিছু গুদাম ঘর এবং আরো কিছু স্থাপনা রয়েছে যার সবই ভগ্নদশা হলেও খুবই সযত্নে সংরক্ষিত। আর রয়েছে অন্দরমহলে প্রবেশের তালাবদ্ধ এক বিশাল সাদা রঙের তোরন। উকি মারার জন্য কোন সামান্য ছিদ্রও খুজে পেলাম না, ফলে অটুট নিশ্ছিদ্র সেই গেটের ওপারে কি আছে তার কিছুই নজরে এলো না।
দুপাশে লাল ইটের রাজকীয় বস্তুর সংরক্ষনাগার আর তার মাঝ বরাবর দুরেই দেখা যাচ্ছে অন্দরমহলে প্রবেশের বন্ধ শ্বেত তোরন
ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে ব্যর্থ মনোরথে বাইরে এসে ঘড়ি দেখলাম প্রায় পাঁচটা বাজে। স্থানীয়রা কেউ ইংরেজী বোঝে না ফলে ফিরতি যানবাহন খুজে বের করতে খুবই সমস্যা হলো । এই রাস্তা সেই রাস্তা করে যখন পা ভেঙ্গে আসছিল, তখন খুজে পেলাম আমাদের রিসোর্টের দিকে যাবার একটি সং-তোয়ে । রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানার আশ্রয়ে। রুমে খাবার অর্ডার দিয়ে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত আমরা আটটার মধ্যেই মনে হয় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
খাটের মাথাতেও নকশা করা বানর বাবাজী
গতরাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় আজ খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। দুপুর দুটোর সময় ব্যংকক রওনা দেবো তাই তার আগের সময়টিকে কি কাজে লাগানো যায় ভেবে সহ পর্যটককে বললাম ‘গতকাল যাতায়তে খুব কষ্ট হয়েছে আজ আমাদের ভ্যানের ড্রাইভারকে ডাকো’। যার সৌজন্যে এই ভ্রমনে এসেছি সেই আমাদের ম্যানেজার সাহেবকে ফোন করা হলো। উনি জানালেন ঠিক নটায় রিসোর্টের রিসেপশনে ভ্যান নিয়ে আমাদের ভ্যান চালক আসবে। তার আগেই আমরা নাস্তা খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রিসোর্টের বাইরে ডানদিকে যে দুরের উচু সবুজ পাহাড়গুলো দেখা যায় সেদিকে কিছুদুর হেটে আসলাম ।
ডানদিকের রাস্তা ধরে ভোর ভোর সকালে বেশ খানিকটা ঘুরে আসলাম, তবে পাহাড়টি অনেক দূর
নেট থেকে তথ্য নিয়ে জেনেছি একটি মন্দির ও কুমিরের খামার ছাড়া লপবুরিতে আমাদের আর দেখার তেমন কিছুই নেই । বিভিন্ন দেশে বিদেশে প্রচুর মন্দির আর কুমিরের খামার দেখায় সেগুলো দেখতে আর আগ্রহ বোধ করলাম না।
লপবুরির প্রধান দ্রস্টব্যগুলো রেলস্টেশনের পাশে হওয়ায় বেশিরভাগ পর্যটকই ব্যংককের পুরানো এয়ারপোর্ট ডন মুয়াং রেল স্টেশন থেকে ১১৫ কিমি দুরত্বের লপবুরিতে লোকাল ট্রেন রাপিড ১১১ তে করে চলে আসে। ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই যা দেখার দেখে আরেক ট্রেনে চেপে ব্যংকক ফিরে যায়। তাই সত্যিকারের পর্যটক বান্ধব শহর এটি নয় বলতে গেলে।
সেই নির্জন পাহাড়ী পথের এক গাড়িতে বসে আছে কুকুর ছানা
নটায় ড্রাইভার আসলে তাকে জানালাম আমরা চিড়িয়াখানায় যাবো। কেন জানি আমার সব সময়ের পছন্দের একটি জায়গা হলো চিড়িয়াখানা আর এর অবস্থানও আমাদের রিসোর্ট থেকে সামান্য দুরে। কিন্ত লপবুরির চিড়িয়াখানাটির যে এই হাল তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। হাটা সহ দশ মিনিট সেই অধিকাংশই প্রানীশুন্য খালি খাঁচাগুলো দেখে বিফল মনোরথে যখন ফিরে আসছি তখন খেয়াল করলাম গেটের ভেতরের বিশাল প্রাঙ্গন জুড়ে বিভিন্ন নার্সারি হরেক রকম গাছের চারা সহ ফলমুল নিয়ে এক মেলা বসিয়েছে। সেখান থেকে আমি দুটো এয়ার প্ল্যন্ট কিনলাম আর এক প্যাকেট দেশী বড়ই সাথে লবন মরিচ আর আমার স্বামী কি সব ফল কিনে গাড়িতে এসে বসলাম।
একমাত্র এটাকেই দেখলাম নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে
চিড়িয়াখানার ভেতরে খুড়ে পাওয়া গেছে রাজা নারাই এর আমলে নির্মিত পানি সরবরাহের মাটির পাইপ
রিসোর্টে ফেরার সময় গতকালের দেখা সড়ক দ্বীপের মাঝে গোলাপী রঙের অর্ধচন্দ্রাকৃতির দেয়াল আর বাধানো চত্বরের উপর সেই কালো ব্রোঞ্জের দন্ডায়মান মুর্তিটি আবার চোখে পড়লো। ড্রাইভার জানালো সেটা তাদের বিখ্যাত রাজা নারাই এর মুর্তি ।
বাঁ পা সামান্য এগিয়ে রাখা প্রাসাত তং রাজবংশের শেষ বিখ্যাত রাজা নারাই
সেখানে কিছু সময়ের জন্য গাড়ি থামানোর অনুরোধ করলাম। স্থানীয় জনগনের উদ্দোগে ১৯৬৬ খৃষ্টাব্দে প্রাদেশিক বিচারালয়ের সামনে চৌরাস্তার পাথর বাধানো সড়ক দ্বীপে এই ব্রোঞ্জ মুর্তিটি স্থাপন করা হয়। উচু বেদীর উপর দন্ডায়মান, মুখটি পুর্বদিকে সামান্য ঘোরানো, ডান হাতে তলোয়ার আর বাঁ পা সামান্য এগিয়ে রেখেছেন প্রাসাত তং রাজবংশের শেষ বিখ্যাত রাজা নারাই। সেই কড়া রোদে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না তার পরো পুরো চত্বরটি ঘুরে ফিরে দেখে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
ফিরে দেখা গোলাকার গোলাপী রঙের বেদী
গাড়ী থেকে নামার পর ড্রাইভার মহোদয় হেসে জানালো এই এক ঘন্টা ভ্রমনের জন্য তারা সবার কাছ থেকে ৫০০ বাথ নিয়ে থাকে,তবে আমাদের জন্য এটাও ছিল ম্যনেজার সাহেব তথা ট্যুর অপারেটরের পক্ষ থেকে সৌজন্য সফর। তার প্রতি আমরা অশেষ কৃতজ্ঞ ।
খাওয়া দাওয়া শেষে দুপুর দুটোর দিকে লপবুরি ছেড়ে রওনা হোলাম সেই সাথে শেষ হলো আরেকটি ভ্রমণ। চারটার সময় পৌছে গেলাম গন্তব্যে ।
গন্তব্যের পথে।
রাজা নারাই এর রাজপ্রাসাদ তথা বর্তমান মিউজিয়াম ও বানর ভোজের ছবিটি বাদে সমস্ত ছবি আমাদের মোবাইলে তোলা।
আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্লগার ডঃ এম আলী বানর ভোজ নিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও মনোগ্রাহী পোষ্ট দিয়েছেন যার লিংক দিলাম ।
বায়ো-মেডিকেল পরীক্ষা বনাম পর্যটন শিল্প বিকাশে বানরের অবদান সম্ভাবনায় থাইল্যান্ডের বানর ভোজ উৎসবের উদাহরণ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:১১