সেদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েই এমন একজনের দেখা পেলাম, যাকে আমি চিনি, কিন্তু যিনি আমাকে চিনেন না। তবে আমি তাকে চিনলেও, তার নামটা ঠিকমত স্মরণ করতে পারছিলাম না। আজকাল এমনটা প্রায়ই হয়; চেনা মানুষের নামটা সময়মত কিছুতেই মনে আসে না, ফলে অনেক সময় বিব্রত বোধ করি।
আমার বাসার কাছাকাছি একই নামে দু’জন ব্যক্তি বাস করেন, তাদের মাঝে অস্বাভাবিক রকমের মিল থাকাতে প্রায়ই এলাকাবাসী, ফেরিওয়ালারা, পত্রিকাওয়ালা, হোম ডেলিভারীর লোকজন ইত্যাদি নানারকমের বিভ্রান্তিতে পড়েন। তাদের দু’জনের মধ্যে মিলগুলো এরকমঃ
*দু’জনের একই নাম।
*দু’জন বাল্যকালে একই স্কুলে পড়াশুনা করেছেন।
*দু’জনেই বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, দু’জনেই একই পদবীতে অবসরে গিয়েছেন।
*দু’জন প্রায় একই উচ্চতার , একজন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের, অপরজনকে নির্দ্বিধায় ফর্সা বলা যায়। প্রথমজনকেও অনেকেই ফর্সার শ্রেণীভুক্ত করতে পারেন।
*দুজনেরই পাকাচুল, তবে একজনের মাথায় কাশফুল, অপরজনের গোলমরিচের গুড়ো আর লবণের মিশ্রণ (salt and pepper)। উভয়ের মাথায় এখনো চুলের পরিমাণ সমান, প্রায় ৮০%।
*দুজনেই ভীষণ হাসিখুশী স্বভাবের, কৌতুকপ্রিয়।
*দু’জন পাশাপাশি বাসায় থাকেন।
*স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা উভয়েই পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন এবং দু’জনেই ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
যাকে নির্দ্বিধায় ফর্সা বলা যায়, তার সাথেই আমার সেদিন দেখা হয়েছিল, এবং তারই মাথায় কাশফুলের মত পক্ক কেশ। নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সাথে একই লয়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্রথম আলাপেই তিনি আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে স্বাগত জানালেন এবং সৌজন্য হিসেবে তার নামটিও বললেন, যা আমার জানা ছিল কিন্তু তখন মনে পড়ছিল না। তিনি আমাকে বিনয়ের সাথে বললেন, প্রথম রাউন্ডে তিনি বেশী জোরে হাঁটতে চান না, তাই তার সাথে হেঁটে হয়তো আমার পোষাবে না। আমি বললাম, আমিও শুরুতে ধীরেই হাঁটি, আর তা ছাড়া কোন তাড়া নেই তো! উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আলাপে আলাপে তার আরো কিছু পরিচয় জানলাম। আমাদের মধ্যে কমন কয়েকজন পরিচিতদের নাম বের হলো এবং তাদের সম্পর্কে কিছুটা আলাপও হলো। অবসর সময়টা তিনি কি নিয়ে কাটাচ্ছেন জিজ্ঞেস করাতে আবার হো হো করে হেসে বললেন, এ্যাকুরিয়ামের মাছ নিয়ে সকালটা কাটে, তারপর এটা ওটা করেই বাকী সময়টাও কেটে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাছকে কি শুধু তিনিই খাওয়ান নাকি ভাবীসহ দু’জনে মিলেই খাওয়ান। তিনি হেসে জানালেন, ভাবী সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে যান, তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষা। ভাবী অফিসে চলে যাবার পর থেকে দুপুর দুইটা আড়াইটা পর্যন্ত তিনিই ঘরদোর সামলে রাখেন। আবার হেসে আরেকটু যোগ করলেন, “এটাই ভাল, কিছুক্ষণ একজন ঘরে থাক, অপরজন বাইরে। চব্বিশ ঘন্টা দুইজনে একসাথে ঘরে থাকাটা শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ! হা হা হা”----
আলাপে আলাপে তিনি জানালেন, তিনি যখন পাকিস্তানে আরো অনেকের সাথে আটক ছিলেন, তখন ভাবী এ দেশে বসবাসরত ছিলেন। তাদের মাঝে আগে থেকেই আলাপ পরিচয় ছিল। আটক থাকা অবস্থায় ভাবীর মা বাবা ভাবীকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবার জন্য অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করেন, কিন্তু ভাবী ছলে বলে কৌশলে সেসব প্রতিহত করতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি দেশে ফেরার পরে ভাবী আর কোন অজুহাত দেখাতে পারছিলেন না, তাই ভাবী এবারে তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য, কেননা সামাজিক চাপে তার পিতামাতা অনেকটা বিব্রত হচ্ছিলেন। আবার সেই হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, দেশে ফিরে আসার চার মাসের মাথায় তিনি প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় ভাবীকে বিয়ে করে বসলেন। পাকিস্তানে বন্দী থাকায় তার হাতে কোন সঞ্চয় ছিল না। দেশে ফেরার পর চার মাসের বেতনে আর কতটুকুই বা জমাতে পেরেছিলেন! আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে তিনি আস্তে করে বললেন, জানেন, আমাদের দেনমোহর কত টাকা ছিল? আমি কৌতুহল প্রকাশ করে বললাম, কত? হো হো করে হাসতে হাসতে তিনি জানালেন, মাত্র দশ হাজার এক টাকা! আর সেই দেন মোহরের টাকা তিনি পরিশোধ করেছেন চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণেরও অনেক পরে, মাত্র কয়েক বছর আগে। আমি আবার কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন পরে সেই দশ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে কত টাকা পরিশোধ করলেন? হা হা হা, হো হো হো করে হাসতে হাসতে তিনি বললেন, আরে ভাই, আপনার ভাবীও তো সেই একই অনুযোগ করে বলেছিল, বিয়ের এত বছর পর তুমি আমার দেন মোহরের টাকা শোধ করছো, সেই দশ হাজার টাকা কি এখনোও দশ হাজার টাকাই আছে? আমি তাকে বলেছি, “যেই আইনের বলে দেন মোহরের টাকা ধার্য করা হয়, সেই আইনে তো সুদ হারাম! তুমি আইনের একাংশ মানবে, আর বাকীটা মানবে না, তা তো হয় না!” এর পরে সে আর বেশী জোরাজুরি করে নাই! অবশ্য জোর করার মানুষ সে নয়, এ টাকাটা তাকে কোনদিন না দিলেও সে কিছু বলতো না, হা হা হা!
বিয়ের সময় তিনি ভাবীকে কোন লাল বেনারসী বা কাতান শাড়ি দেন নাই, দিয়েছিলেন নীল রঙের একটা বিয়ের শাড়ি। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, বিয়ে করেছেন তো ধার দেনা করে, ব্যাঙ্ক থেকে কর্জ করেও কিছুটা। বিয়ের পরে তো এখানে সেখানে পার্টিতে যেতে হবে। বিয়ের লাল শাড়ি পরে তো কোন পার্টিতে যাওয়া যাবেনা, কিন্তু আপাততঃ নীল শাড়ি পরে তো প্রথম প্রথম কয়েকটা জায়গায় যাওয়া যাবে। পরে সময় সুযোগ বুঝে একটা লাল বেনারসী শাড়ি কিনে দেয়া যাবে, কিন্তু পরে আর সে কথাটা তার খেয়ালে আসে নাই! কিন্তু এ অনুযোগটা ভাবীর রয়েই গেছে; সব মেয়েদের বিয়ের লাল শাড়ি থাকে, তার নেই! সংসার জীবনের এসব বিষয়ে হাসতে হাসতে তার নিজস্ব কিছু ব্যর্থতার কথা বলতে বলতেই এক সময় তার খেয়াল হলো যে তার এ্যাকুরিয়ামের মাছের খাবার সময় হয়ে গেছে। হাসিমুখেই আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমার নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী আমার তখনো প্রায় পনের মিনিট হাঁটা বাকী ছিল, কিন্তু উনি চলে যাবার পর আমার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। একজন সুখী লোকের কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরে এলাম। আসার পথে ভাবছিলাম, সামগ্রিকভাবে আমাদের এ জীবনটাতে, এবং আরো প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের দাম্পত্য জীবনটাতে সুখ-শান্তি নির্ভর করে মূলতঃ সমঝোতা, অনুকূল বোঝাপড়া বা ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ (এ শব্দটা আমরা সহজতরভাবে বুঝে থাকি) এর উপর। আমাদের এলাকায় ওনারা এক আদর্শ সুখী দম্পতি হিসেবে সুপরিচিত। অনুমান করতে পারি, অবশ্যই এটা উভয়ের গুণে, ভাবীর হয়তো কিছুটা বেশী!
ঢাকা
০৫ এপ্রিল ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৩১