সেদিন সকালে (০৫ মে ২০১৯) সবাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে ব্যাগ গুছিয়ে রেখে নাস্তা খেতে বসলাম। দেখলাম, ফররোখ আগের রাতে দেয়া আমাদের যার যার মেনু বেশ মনযোগের সাথেই পরিবেশন করেছে। রাতে কম্বল গায়ে দেয়ার পরেও বেশ শীত শীত করছিল। সকালে দেখি ঠান্ডার কারণে গলাটা খুসখুস করছে। ফররোখের বানানো চমংকার চা খাওয়ার পর মনে হলো গলার অবস্থার খানিকটা উন্নতি হলো। নাস্তার পর ওদের ভিজিটরস’ বুক এ স্বাক্ষর করলাম। শাফি শাহ তখনো গাড়ী নিয়ে আসেনি। আমি এই ফাঁকে বোট হাউসের সামনের বারান্দায় বসে রোদ পোহাতে পোহাতে ছেলের কাছ থেকে Steven Gerrard এর “My Story” বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম এবং কয়েক পাতা পড়ার পর, ঠিক সময়মত শাফির ফোন পেলাম। সে জানালো, সে অদূরের একটি পার্কিং এলাকায় গাড়ী নিয়ে প্রস্তুত আছে। আমরা তৈরী হয়ে থাকলে যেন নৌকো নিয়ে লাগেজ সহ লেইকের অপর প্রান্তে রাস্তায় এসে তাকে ফোন দেই।
আমরা তাই করলাম। মাত্র একটি রাতের জন্য ছিলাম, কিন্তু তাও লেইকের উপরে ভাসমান সেই বোট হাউসটার উপর মায়া ধরে গিয়েছিল। বোটের মালিক মাজিদ বাই (Majeed Bai) স্বভাবে অত্যন্ত মিতবাক হলেও সৌজন্য প্রকাশে মোটেও কার্পণ্য করেননি। বিদায়ের সময় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোই কুছ তাকলিফ হুয়া তো মেহেরবাণী কারকে মুঝে মা’ফ কার দেঙ্গে”। আমি অবাক হ’লাম তার এই বিনয় দেখে। মাঝি তাড়াতাড়ি করে আমাদের তিনটে ব্যাগ নৌকোয় তুলে নিল। আমরা ফররোখ এবং মাজিদ বাই এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকোয় উঠে বসলাম। ফররোখ বললো, আমাদেরকে বিদায় দিয়েই সেও তার নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে গুলমার্গ রওনা হবে। আমরা ওঠার পর নৌকো সড়ক সংলগ্ন ৭ নং ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকো আগের দিনের সেই একই ঘাটে ভিড়লো। আমি মাঝিকে বললাম শাফিকে কল করতে, কেননা আমাদের ফোন দিয়ে ওকে ডাকা যাচ্ছিল না। নিমেষেই করিৎকর্মা শাফি পার্কিং থেকে গাড়ী নিয়ে হাজির হলো। শুরু হলো প্যাহেলগামের উদ্দেশ্যে আমাদের সেদিনের সে যাত্রা!
‘ডাল লেইক’ এর ৭ নং ঘাট থেকে গাড়ীতে উঠে শ্রীনগর ছেড়ে আসতে মায়া হচ্ছিল। পরেরদিন (০৬ মে ২০১৯) প্যাহেলগাম থেকে শ্রীনগর শহর এড়িয়ে সরাসরি বিমান বন্দরে চলে যাবার কথা। তাই গাড়ীতে বসে মুগ্ধ দু’চোখ ভরে শেষবারের মত দেখে নিচ্ছিলাম এ কয়দিনে পরিচিত হওয়া ব্যস্ত শ্রীনগর শহরের রাজপথ, রাজপথের সাইনবোর্ডগুলো, ‘ডাল লেইক’ এর শান্ত জলরাশি আর জলের উপর ভাসমান তরীসমূহের উপর নির্ভরশীল গরীব জনগণকে। এক সময় শহর ছেড়ে বের হয়ে এলাম, রাস্তার দু’পাশে গ্রামীণ দৃশ্য দেখতে দেখতে। অন্য ক’দিনের মত এ রাস্তাটা বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়-উপত্যকার পাশ দিয়ে নয়, বরং শ্যামল শ্যামলিমায় ঢাকা সমতলভূমির মধ্য দিয়ে চলছিল। রাস্তার দু’পাশে ছিল সবুজের সমারোহ। রাস্তার আইল্যান্ডের উপর কিছু শ্রমিক কে দেখলাম, ওরা কি সব ছোট ছোট কিছু গাছ গাছড়ার পরিচর্যা করছে। শাফিকে জিজ্ঞেস করায় সে জানালো, ওরা আইল্যান্ডে কেসর লাগাচ্ছে। কেসর বা জাফরান ঐ এলাকার অর্থকরি ফসল। রাস্তার দু’পাশেও দেখলাম, বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে একই গাছ লাগানো। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল!
একসময় শাফি রাস্তার একপাশে গাড়ী থামিয়ে একটা দোকান দেখিয়ে বললো, এটা তার এক দোস্তের দোকান। ওখানে বসে আমরা যেন একটু কেসর এবং নানাবিধ বাদামের সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত ‘কাহওয়া’ (এক ধরণের চা) পান করে যাই। তার দোস্তও আমাদেরকে কাহওয়া বানানোর সাথে সাথে অনেক আগ্রহভরে নানাবিধ বাদাম (নাটস) দেখিয়ে সেগুলোর গুণাবলী বর্ণনা করতে লাগলো। অন্যান্য এলাকায় যেসব নাটস পাওয়া যায়, তার থেকে ঐ এলাকার নাটসের পার্থক্য বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ‘কাহওয়া’ পান করে আমি সত্যিই তৃপ্ত হ’লাম, তবে আমার স্ত্রী ততটা নয়। আমরা সে দোকানটি থেকে কিছু নাটস কিনে নিয়ে আবার রওনা হ’লাম, কিন্তু কিছুদুর এগোতে না এগোতেই এক নতুন উপদ্রবের সম্মুখীন হতে থাকলাম।
দিল্লীর আদেশে শ্রীনগর সরকার সপ্তাহে দুই দিন “হাইওয়ে ব্যান” আরোপ করে রাখে। কোন দুই দিন সে ব্যান আরোপিত হবে তা আগে থেকে জানানো হয় না, আরোপের আগের দিন রাতে ঘোষণা করা হয়। শাফি আমাকে মুখ ভার করে জানালো, ‘স্যার লাগতা হ্যায়, আজ কুছ মুশকিল হোগা’। কিসের মুশকিল তা জানতে চাইলে সে জানালো, সেদিন “হাইওয়ে ব্যান” আরোপিত হয়েছে। সে বলতে থাকলো কাশ্মীরবাসীর দুঃখের কথা। কারণে অকারণে এভাবে “হাইওয়ে ব্যান” আরোপিত হওয়াতে সাধারণ জনগণ যে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়, তার কথা। এভাবে আকস্মিক ব্যানের কারণে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা লাভের উদ্দেশ্যে রাজধানী শ্রীনগরের হাসপাতালে যাওয়া আসা করার উপায় থাকে না, ব্যবসায়ীদের জরুরী প্রয়োজনে তাদের পণ্য পরিবহণের উপায় থাকে না, পরিবহণ মালিক আর শ্রমিকদের হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। শুধুমাত্র পর্যটকদের গাড়ীগুলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চলাচলের জন্য ছাড় দেয়া হয়, কারণ পর্যটকরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। সাধারণ জনগণের “জরুরী প্রয়োজন” নিরূপনের জন্য অবশ্য হাইওয়েতে ম্যাজিস্ট্রেটরাও থাকেন, তবে তাদের বিবেচনায় সাধারণতঃ সাধারণ জনগণের কোন প্রয়োজনই “জরুরী” বিবেচিত হয়না, কারণ সারাদিনে আমি এম্বুল্যান্সসহ একটি “সাধারণ” গাড়ীকেও ব্যানের বৈতরণী পার হতে দেখিনি; সবগুলোকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সেদিন দেখলাম, ব্যান দিবসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মহাযজ্ঞ। হরেক কিসিমের বাহিনীর সমাবেশ থাকে রাস্তায় রাস্তায়, কয়েক শ’ গজ পর পর। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এত ফৌজ ওরা পায় কোথা থেকে! প্রাদেশিক পুলিশ ছাড়াও সেনাবাহিনী, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ, বিএসএফ এবং আরও অন্যান্য কিছু নাম না জানা বাহিনীকে সেদিন রাস্তায় দেখেছিলাম। তার মধ্যে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী শিষ্টাচার ও মার্জিত আচরণ লক্ষ্য করেছি। অন্যান্যগুলোর চোখেমুখে এবং ভাষায় ঔদ্ধত্যের প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলাম। জায়গায় জায়গায় চেকিং এর সময় ওরা ড্রাইভার ছাড়াও আমার সাথেও কথা বলে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করেছে, আমার পাসপোর্ট পরীক্ষা করে দেখেছে। অনেক বাধা পার হয়ে শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় এসে আমরাও বাধাপ্রাপ্ত হ’লাম, আমাদের গাড়ীটাকেও এক বাহিনীর সদস্যেরা ঘুরিয়ে দিল। ড্রাইভার অনেক অনুনয় বিনয় করলো, কিন্তু কাজ হলোনা। শেষ পর্যন্ত আমি অনুরোধ করাতে একজন দেখিয়ে দিল অদূ্রে পার্ক করে রাখা একটা জীপের দিকে, সেখানে বসে থাকা একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে যেতে। আমি হাতে পাসপোর্ট টা নিয়ে গেলাম ওনার কাছে। উনি আমাকে আমার এবং আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। তার পর মূল আইডি কার্ড দেখতে চাইলেন। সাধারণতঃ আমি বিদেশ ভ্রমণের সময় পাসপোর্ট আর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে যাই। কি ভেবে যেন এবারে মূল পরিচয় পত্রটাই সাথে নিয়েছিলাম। ঝটপট করে সেটা বের করে দেখালাম। উনি বেশ কিছুক্ষণ সেটা নেড়ে চেড়ে দেখে একটা সনদপত্র লিখে দিলেন “যাহার জন্য প্রযোজ্য” শিরোনামে। সেখানে তিনি লিখলেন, আমি একজন ট্যুরিস্ট, প্রয়োজনে পরীক্ষা করে যেন আমার চলাচলে আমাকে সহায়তা করা হয়। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!!
চলবে....
ঢাকা
২৯ মে/০৮ জুন ২০১৯ ঢাকা
শ্রীনগরের 'ডাল লেইক' এর এই সেই সাত নং ঘাট, যেখানে নেমে আমরা আমাদের বোটহাউসে গিয়েছিলাম এবং পরের দিন এখান থেকেই গাড়ীতে উঠে প্যাহেলগামের উদ্দেশ্যে শ্রীনগর ত্যাগ করেছিলাম।
এটাই শাফি'র দোস্তের দোকান।
কেসর এবং নানাবিধ বাদামের সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত ‘কাহওয়া’ (এক ধরণের চা)
"অন্য ক’দিনের মত এ রাস্তাটা বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়-উপত্যকার পাশ দিয়ে নয়, বরং শ্যামল শ্যামলিমায় ঢাকা সমতলভূমির মধ্য দিয়ে চলছিল।"
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৯ সকাল ১১:৪৬