somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষাহীনতার কারণে অসহায়ত্ব

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দু’সপ্তাহ আমাদের সাথে কাটিয়ে আজ সন্ধ্যায় আমার বড় ছেলে কানাডা ফিরে গেল। ও একাই এসেছিল। আসার দিনে আমি এয়ারপোর্ট থেকে ওকে রিসিভ করে নিয়ে এসেছিলাম। আজও আমিই ওকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসি এবং ইমিগ্রেশন পার হওয়া পর্যন্ত ওর সাথে থাকি। ও যাচ্ছিল এমিরেটস এর ফ্লাইটে, যা দুবাই হয়ে টরন্টো যাবে। ও যখন ইমিগ্রেশন গেইটটা কেবল অতিক্রম করেছে, তখন কর্তব্য পালনরত ইমিগ্রেশন পুলিশের একটু বেখেয়ালের সুযোগ নিয়ে দুবাই প্রবাসী এক মধ্যবয়স্ক বাংলাদেশী নাগরিক গেইটে তার কাগজপত্র না দেখিয়ে ওর পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশ করে ওকে অনুরোধ করলো যেন ও তার এম্বার্কেশন কার্ডটি পূরণ করে দেয়। ও সাধারণতঃ এসব কাজ খুশী মনেই করে দেয়, কিন্তু ও যখন বুঝতে পারলো যে লোকটি এম্বার্কেশন কার্ড না দেখিয়েই গেইট অতিক্রম করেছে, তখন সে যাতে আরো বেশী বিপদে না পড়ে, সেজন্য তাকে গেইটে কর্তব্য পালনরত ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার পরামর্শ দিয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ালো। লোকটি যখন সেই পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলো, পুলিশটি তাকে জিজ্ঞেস করলো, পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস, এম্বার্কেশন কার্ড ইত্যাদি না দেখিয়ে সে কেন গেইটের ভেতরে প্রবেশ করেছে। লোকটি কাচুমাচু করতে থাকায় পুলিশটি ধমক দিয়ে তাকে দূরে সরে যেতে বললো। এদিকে তখন মাগরিবের আযান পড়ছিল। আমার ছেলে গেইট অতিক্রম করার সময় আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি বিমান বন্দরেই মাগরিবের নামায পড়বো, তারপর চলে যাবো। এর মধ্যে তার কোন প্রয়োজন হলে সে যেন আমাকে কল করে, আর বোর্ডিং এর পর আমাকে একটা কল বা এসএমএস দেয়।

পুলিশের ধমক খেয়ে লোকটির চোখেমুখে যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল, তা দেখে আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি প্রথমে লোকটির এম্বার্কেশন কার্ডটি পূরণ করে দিয়ে তারপরে নামায পড়বো। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন অন্তর্যামী, তিনি নিশ্চয়ই আমার মনের খবর রাখেন এবং পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল তিনি নামাযের ব্যাপারে আমার এ গাফিলতিটুকু ক্ষমা করে দিবেন, এ ভরসা আমার আছে। লোকটি যদি এম্বার্কেশন কার্ড পূরণ করতে বেশী দেরী করে ফেলে, তবে তার যাত্রা চরম বিড়ম্বনামূলক এবং কষ্টদায়ক হতে পারে, এমনকি বিফলও হতে পারে। আমি একটু দূর থেকেই লোকটিকে উচ্চঃস্বরে ডাকলাম এবং তাকে বললাম, তার কার্ডটি আমি পূরণ করে দেব। সে খুশী হয়ে কাছে এসে সাথে সাথে তার পাসপোর্টটি আমার সামনে মেলে ধরলো। আমি তার কাছে একটি কলম চাইলাম। সে কাচুমাচু করে তাকাতে থাকলো। নীচুস্বরে বললো, স্যার, লেখাপড়া জানিনা, তাই কলমও রাখিনা। আমি তাকে লেখাপড়া না জানলেও বিদেশ যাত্রার সময় সাথে কিছু কাগজ কলম রাখার পরামর্শ দিলাম।

তার পাসপোর্টটি পরীক্ষা করে দেখলাম, সেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটো আকামাহ (ভিসা) লাগানো আছে। অর্থাৎ সে প্রায় চার বছর ধরে সেখানে কর্মরত। পেশা হিসেবে দেখলাম লেখা আছে “ফিটার”। বুঝলাম, জীবনে সে কলম ধরার সুযোগ না পেলেও যন্ত্র ধরেছে এবং করায়ত্ব করেছে, আর যন্ত্রও তাকে ধরেছে। কলমের পরিবর্তে যন্ত্র এবং দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে সে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। একসময়ে কার্ডের একটি ঘর পূরনের জন্য আমি তার মোবাইল ফোন নম্বরটি চাইলাম। সে বলতে পারলো না, তবে পকেট থেকে বহু পুরনো আমলের একটা ছোট্ট সেলফোন সেট বের করে দিয়ে বললো, শেষ দুটো সংখ্যে ৮২, বাকী গুলো আমি যেন খুঁজে নেই। আমি ভাবলাম, তার সেই ফোনসেট থেকে তার নিজের নম্বরটি খুঁজে বের করতে আমার যে সময় লাগবে, তার চেয়ে বরং আমিই তার হয়ে অন্য কারো সাহায্য নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার মত আরেকজন প্রবাসীকে আমি অনুরোধ করাতে সে ঝটপট নম্বরটা বের করে দিল। দেখলাম, শেষ দুটো সংখ্যা ঠিকই ৮২। আমি নিশ্চিত হয়ে সংখ্যাটি কার্ডে পূরণ করে দিয়ে তাকে জায়গামত স্বাক্ষর করতে বললাম। সে বহু সময় ধরে তিন অক্ষরের একটি নাম স্বাক্ষর করলো- “শহিদ”। জাস্ট কোনমতে সে তিনটে অক্ষর বসানো শিখেছে, আর কোন অক্ষরের আগে হ্রস্ব ‘ই’ কারটা বসাতে হবে তা মনে রেখেছে। পাসপোর্টের সাথে মিলিয়ে দেখলাম, স্বাক্ষর ঠিক আছে। তাকে বললাম, এবারে তাড়াতাড়ি করে গেইট অতিক্রম করতে। সে কিছুটা ইতস্ততঃ করতে করতে চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পকেট থেকে একটি পাঁচশত টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিতে চাইলো। আমি শুধু একটু হেসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দেখে কি তার মনে হয়েছে যে আমি টাকার বিনিময়ে তার এ কাজটুকু করে দিতে চেয়েছি? সে লজ্জা পেয়ে দ্রুত প্রস্থান করলো। সে ইমিগ্রেশন গেইট পার না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকিয়ে থাকলাম। সে ভেতরে চলে যাবার পর আমি একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে মাগরিবের নামায পড়ে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করলাম।

সামান্য একটু লেখাপড়া না শেখার কারণে এভাবেই এদের পকেট থেকে ঘাটে ঘাটে না জানি কত পাঁচশত টাকার নোট বের হয়ে যায়! আর সবখানে অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনার সম্ভাবনা তো থাকেই। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে Bureau of Manpower Employment & Training (BMET) নামে একটি সরকারী দপ্তর অয়েছে, যারা বিদেশে জনশক্তি রপ্তানীর ব্যাপারগুলো দেখে থাকে এবং এ বাবদ প্রতিটি ব্যক্তির কাছ থেকে বেশ উচ্চহারেই ফী নিয়ে থাকে। তাদের উচিত, কর্মোপলক্ষে বিদেশ গমনেচ্ছু প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে নেহায়েৎ জরুরী কাজগুলো শেখানো, যেমনঃ চেক-ইন, ইমিগ্রেশন নিজে নিজে কিভাবে করতে হয়, এম্বারকেশন কার্ড কিভাবে পূরণ করতে হয়, লাগেজ হারিয়ে গেলে কী করতে হয়, কেবিনের অভ্যন্তরীণ শিষ্টাচার ইত্যাদি।

ঢাকা
০৪ অক্টোবর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১২:২৩
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×