বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন গিন্নী এবং ওদেরকে নিয়ে আমরা একসাথে বসে বিশ্বকাপের খেলা দেখতাম। ফুটবল এবং ক্রিকেট-দুটোই। সেই ১৯৯০ সাল থেকে আমাদের একসাথে বসে খেলা দেখার শুরু। বড় ছেলের বয়স তখন আট বছর, মেজো ছেলের ছয়। আমরা তখন থাকতাম ওমান সালতানাতের রাজধানী মাস্কাট শহরে। ফাইনাল খেলার দিন কয়েকটি সমমনা পরিবার একত্রিত হয়ে সপরিবারে খেলা উপভোগ করতাম। তখন থেকেই ওরা দুই ভাইই আর্জেন্টিনা দলের ভক্ত হয়ে উঠলো। ওদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার নাম। ওরা স্বপ্নেও তার খেলা দেখে। ছোটটার (তখন সে ‘ছোট ভাই’ ছিল, পরবর্তীতে মেজো) নামের সাথে ম্যারাডোনার নামের মধ্যাংশের একটু মিল থাকাতে ও এবং ওর মা মনে মনে একটু গর্বও বোধ করতো হয়তো। তারপর, কালের পরিক্রমায় ছেলেরা বড় হতে থাকলো, ওদের যার যার নিজস্ব বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠতে থাকলো, ওরা আমাদের ছেড়ে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুমহলে খেলা দেখা শুরু করলো। আমরা দু’জনে ক্রমশঃ একা হতে থাকলাম, আর সেই সাথে স্তিমিত হতে থাকলো আমাদের মাঝে খেলা দেখার উত্তাপ ও উত্তেজনা।
বহুকাল পর গতকাল আমরা দু’জন ‘Empty Nester’ খালি বাসায় একসাথে বসে “ফিফা বিশ্বকাপ কাতার ২০২২” এর ফাইনাল খেলাটি দেখলাম। খেলা দেখার মাঝেই মনের পর্দায় ছেলেদের মুখগুলো ভেসে উঠছিলো। হায়, ওরা না জানি কে কোথায় বসে খেলাটি দেখছে। ছুটির দিন হওয়াতে বড়ছেলের খেলা দেখতে কোন অসুবিধে হবে না, তা জানি। আর তা ছাড়া সময়টাও ওর জন্য খুবই সুবিধেজনক- সকাল নয়টা। সবচেয়ে অসুবিধেজনক সময় মেজো ছেলের জন্য, রাত দুটো থেকে ভোর পাঁচটা, পরেরদিন সকাল নয়টা থেকে আবার অফিস। ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, সে সময় মত বাসায় আসবে কিনা। সে জানালো, অফিস থেকে ওরা কয়েকজন কলীগ মিলে সরাসরি চলে যাবে একসাথে বসে কোথাও বড় পর্দায় খেলা দেখতে।
ফুটবল পাগল (শুধু ফুটবলই নয়, প্রকৃত অর্থেই সে একজন যথার্থ ক্রীড়ামোদী) আমার এক বাল্যবন্ধু মাত্র দু’দিন আগে কন্যাবিদায় করে ইউনাইটেড হাসপাতালে গতকাল শয্যা নিয়েছে, আজ শল্য চিকিৎসার জন্য তার বুক চিড়ে করোনারি-আর্টারি-বাইপাস-গ্রাফটিং (CABG) হবার কথা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ড্রাইভার গাড়ির চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিল স্থানীয় মাঠে বড় পর্দায় খেলা দেখার উদ্দেশ্যে চেয়ার দখলের জন্য। ও কিছুদূর যেতেই ওকে ফিরালাম। বললাম, আমার এক বন্ধু হাসপাতালে, অপারেশনের আগের রাতে ওকে একটু দেখে আসবো। আমার সেই বন্ধুকে সে ভালভাবেই চিনে। দুদিন আগে তার কন্যার বিয়েতে সে ভুড়িভোজ করে তৃপ্ত হয়েছে, সে কথা সে সেদিনই আমাকে বলেছিল। ও সবচেয়ে খুশি হয়েছিল সব ড্রাইভারকে ওরা ভেতরে ডেকে নিয়ে সহৃদয়তার সাথে আপ্যায়ন করেছিল বলে। আদর আপ্যায়ন কে না বোঝে?
আমার কথা শুনে আমার তরুণ ড্রাইভারের মুখটা যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেল! আমি ওর মুখে আমার ছেলেদের মুখগুলো দেখতে পেলাম। আজ এ মুহূর্তে যদি ওদের বস খেলা দেখার পরিকল্পনা পণ্ড করে কোন কাজ দিত, ওদের কেমন লাগতো? আমার ছেলেদের মতই সেও তো আর্জেন্টিনা দলের এক মহা সমর্থক। সকাল থেকেই তো সে আর্জেন্টিনা দলের জার্সি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি সেটা বুঝে ওকে আদরের সাথে বুঝিয়ে বললাম, আমি নয়টার আগেই ফিরে আসবো। এতে তোমার হয়তো চেয়ারে বসে খেলা দেখা সম্ভব নাও হতে পারে, তবে আরও অনেক মানুষের মত তুমি নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে পারবে। এর বিনিময়ে আমি একজন অসুস্থ বন্ধুকে দেখে আসার সুযোগ পাবো। ও প্রথমে ভেবেছিল, আজ তার খেলা দেখা পণ্ড হয়ে গেল! আমি নয়টার আগেই ফিরে আসবো বলায় সে আশ্বস্ত হলো, খুশিতে ফিক করে হেসে বললো, “কোন সমস্যা নাই স্যার”।
বন্ধুর সাথে দেখা করে আমি রাত আটটা চল্লিশে বাসায় ফিরে এসে ওকে মুক্ত করে দিলাম। ও লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এক দৌড় দিল। ঘরে বসে আমরা খেলার প্রথমার্ধটুকু বেশ স্বস্তি নিয়েই দেখলাম। সময়মত ঔষধ খেতে হবে বলে গিন্নী আগেই ডিনার সেরে নিয়েছিল। আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এশার নামায পড়ে নিয়ে খেলা দেখতে বসলাম, ফলে প্রথম পাঁচ মিনিট মিস করে বসলাম। হাফ টাইমের সময় নাকে মুখে খেয়ে নিয়ে আবার এসে বসলাম খেলা দেখতে। কিন্তু এ পর্বে খেলা দেখার সময় উত্তেজনায় আমরা দুজনেই কাঁপছিলাম। মাত্র সাতানব্বই সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’ দু’টো গোল করে ফ্রান্স যখন বীর বিক্রমে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনলো, তখন আমাদের চোখে মুখে আশঙ্কার ছায়া! ফেসবুকে আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধুরা থেকে থেকে আগাম বিজয়োল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। আমি সেসব দেখে ছোট একটা স্ট্যাটাস দিলামঃ “Do not count the chickens before the eggs are hatched!” এটা তাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে যতটা নয়, নিজেকে প্রবোধ দিতে তার চেয়ে বেশি। পেনাল্টি শুটআউটের সময় তো সোফায় বসে থাকতে পারছিলাম না, টিভি’র আশে পাশে পায়চারি শুরু করলাম। হাসপাতালে শয্যাশায়ী সেই ক্রীড়ামোদী বন্ধুর কথা মনে পড়লো। মনে মনে দোয়া আওড়ালাম, হে আল্লাহ, ও যেন আজ রাতের এই বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দেখার জিদ না ধরে বসে!
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমার বড় ছেলে গতকালের খেলা দেখে ফেসবুকে সুন্দর একটা পোস্ট লিখেছে। সেখানে সে ১৯৯০ সালের সেই বিশ্বকাপের খেলার কথা লিখেছে, যা আমরা কয়েকজন বন্ধু পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে একসাথে বসে দেখেছিলাম। সে আমার কথা লিখেছে, তখন তার বয়স আট বছর ছিল। আমি তাদেরকে নিয়ে সেই বাসায় একত্রিত হয়েছিলাম। সে রাতে আর্জেন্টিনা জার্মানি’র কাছে পরাজয় বরণ করাতে সে আর তার ভাই কেঁদেছিল। জীবন বৃত্তের পরিক্রমায় গতরাতে সেও তার মেয়েকে নিয়ে বন্ধু পরিবার পরিবৃত হয়ে বিশ্বকাপ ২০২২ এর ফাইনাল খেলা দেখেছে। কাকতালীয় হলেও, তার মেয়ের বয়সও এখন আট বছর। শুধু পার্থক্য এই, সে রাতে তার প্রিয় দল পরাজয় বরণ করাতে সে কেঁদেছিল, গতরাতে তাদের প্রিয় দল ভালো খেলে জয়লাভ করাতে সে এবং তার মেয়ে দু’জনেই হেসেছে, ওরা দু’জনেই খুব খুশি। আমরাও, অনেকটা তাদের আনন্দের কারণেই!
ঢাকা
১৯ ডিসেম্বর ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৮২১
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ৮:০৭