১৯৯০ সাল। মাস্কাট, ওমান। তখন বেশ রাত। আট বছরের এক বালক টিভি’র সামনে বসে বিশ্বকাপ খেলা দেখছিল তার বাবা খায়রুল আহসান, সা’দ জিয়া আঙ্কেল আর আজমত সা’দ আন্টির সাথে, যারা ঐ সময়ে খেলাধুলার একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন। আরও সেখানে ছিলেন ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আরও অনেক ক্রীড়ামোদী, যারা সবাই তাদের সাথে সিদ্দিক আঙ্কেলের বাসায় সমবেত হয়েছিলেন। ঢুলুঢুলু চোখে সে বালক বিস্ময়াভিভূত হয়ে ফুটবল নামের সেই জাদুর খেলাটি দেখছিল। দল দুটি ছিল আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি। ছিল ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা, বিশ্বের সর্বসেরা খেলোয়াড়। রেফারি আর্জেন্টিনার বিপক্ষে একটি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেয়। জার্মানি গোল করে ম্যাচ জিতে যায়। ম্যারাডোনা কেঁদেছিল, তার সাথে সেই বালকটিও কেঁদেছিল। সেইদিন থেকে একটা আশাহত ফুটবল দলের সাথে সেই বালকটির সম্পর্কের শুরু। যে দলটি ক্রমাগতভাবে (তার সমর্থকদের জন্য) হতাশা আর মর্মপীড়া এনে দিচ্ছিল। ব্রাজিল ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ জিতে নেয় এবং আবারও ২০০২ সালেও। তখন থেকে ব্রাজিল সমর্থকদের কাছ থেকে আসা শুরু হলো ব্যঙ্গাত্মক বিদ্রূপ। ‘আমরা পাঁচবার জিতেছি, তোমরা কয়বার’? বাঁকা হাসি দেয়া, অন্য দিকে তাকানো, সবই করতো। পুনরায় নতুন করে আশার সোপান তৈরি করতো সে বালক, যে আশা মরে যেত, মারতোও।
২০১৪, ঢাকা, বাংলাদেশ। সে বালকটি এখন যুবক পুরুষ। রোযার মাস, গভীর রাত। আরেক ফাইনাল, আবারও আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি। এবারে সে একাই বসে খেলা দেখছে। এবারে আর্জেন্টিনার আরেক সূর্যসন্তান, লিওনেল মেসি। সেই কি সর্বকালের সেরা? লোকে বলে, তা হতে হলে তাকে একটি বিশ্বকাপ জিততে হবে। একটা ভগ্নপ্রায়, অতি সাধারণ মানের দলকে মেসি টেনেটুনে ফাইনাল পর্যন্ত তুললো। চূড়ান্ত এই প্রতিবন্ধকে তার দলের খেলোয়াড়েরা তাকে ছোট করে দিল। অতিরিক্ত সময়ে জার্মানি গোল করে ফেললো। ব্যস, ওটাই চূড়ান্ত ফল নির্ধারক হয়ে গেল! মেসি অসহায়ভাবে ট্রফির দিকে তাকিয়ে থাকলো। এত কাছে এসেও সেটা দূর অধরাই রয়ে গেল! সেই বালকটি (এখন যুবক) তার দলকে চ্যাম্পিয়ন দেখার আশা একেবারে ছেড়ে দিল। এবারে শুরু হলো নব্য জার্মান ভক্তদের পালা। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আবার শুরু হলো। আশার মৃত্যু হলো।
২০২২, রিজাইনা, সাচকাচুয়ান, কানাডা। সেই মানুষটি কিছুদিন আগে চল্লিশ ছুঁয়েছে। আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনাল। এবারে সে বন্ধুদের নিয়ে জাকির মল্লিক ভাইয়ের বাসায় বসে খেলা দেখছে। আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স। এ বারের প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সই সবচেয়ে ভয়াবহ দল। এটাই হবে মেসি’র শেষ ‘সোয়ান-সঙ’ (অন্তিম সঙ্গীত)। সে কি পারবে করণীয়টুকু করতে? এবারে তার সাথে রয়েছে এমন একটি দল, যারা শুধু তার সাথেই খেলে না, তার জন্যেও খেলে। এবারে তাদের রয়েছে একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ কোচ, যিনি একটা সাধারণ মানের দলকে অসাধারণ বানাতে পারঙ্গম। ম্যাকএ্যালিস্টার, মারটিনেজ, জুলিয়ান আলভারেজ, ডি-পল। বিশ্বকাপের আগে এদেরকে খুব কম মানুষই চিনতো। কিন্তু এখন, সবাই তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখছে। ডি-মারিয়া মেসি’র দীর্ঘদিনের গোলসঙ্গী। অনেকে বলতে পারেন যে ২০১৪ সালে তিনি ফিট থাকলে আর্জেন্টিনা সেবারে বিশ্বকাপ জিতে নিত। কিন্তু ফুটবল ‘কী হতে পারতো’ তা নিয়ে থোরাই কেয়ার করে; ‘এখন কী’ সেটাই ফুটবলের বিবেচ্য বিষয়। আর্জেন্টিনা বিস্ময়কর ফুটবল খেলে প্রথমার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে রইলো। ফ্রান্স দ্বিতীয়ার্ধে (৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে) পর পর দু’টি গোল করে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনলো। তাদেরকে একটি ‘ভয়াবহ দল’ তো শুধু শুধুই বলা হয় না! রাজীব জামান ভাইকে লেবুর শরবত পান করতে হলো। শ্বাসরুদ্ধকর ‘অতিরিক্ত সময়’ শুরু হলো। উভয় দলই একটি করে গোল করলো। মেসি একটি পেনাল্টিসহ মোট দুটি গোল করলো। কিন্তু ফ্রান্সের তো রয়েছে এমবাপ্পা, সে সমুচিতভাবেই হ্যাটট্রিক করলো। এটাই কি বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা ফাইনাল? পেনাল্টি শুট আউট শুরু হলো। একমাত্র তানভীর চৌধুরী ভাই জয়ের বিশ্বাসে অবিচলভাবে স্থির হয়ে আছেন। সাঈদুর রহমান ঘোষণা দিয়ে বসলো সে পেনাল্টি শুট আউট দেখবে না। সুজন নূরে আলম ভাই, গোলাম সারোয়ার সবুজ, জামিল লিমন- এদের প্রত্যেকের হৎপিণ্ড যেন কণ্ঠে এসে ঠেকেছে। ব্রাজিল সমর্থক ফাহাদ আক্তার ভাই চাচ্ছেন আর্জেন্টিনা জিতুক, কেননা তারা ভালো খেলেছে। এ মুহুর্ত থেকে আজকের খেলায় কেবলমাত্র একজনই হিরো হয়ে থাকবে, সেটা হচ্ছে যে কোন একটি দলের গোলরক্ষক। এমি মার্টিনেজ নিরাশ করলো না। মুহূর্তের মধ্যে সে-ই হয়ে উঠলো আর্জেন্টিনা! বিশ্ব গোলার্ধ জুড়ে সে-ই পরিণত হয়ে গেল আর্জেন্টিনীয় সমর্থকদের প্রতীকে। (তার জন্যই) আর্জেন্টিনা জিতে গেল, বিশ্ব ফেটে পড়লো।
ছত্রিশ বছরের ভগ্ন হৃদয়ের ব্যথা, বেদনা, হতাশা, নিরাশা, নিমেষে সবকিছুর অবসান হয়ে গেল। জোবায়ের আলমের সাথে গত বিশ বছর ধরে ফুটবল নিয়ে আলাপচারিতা, সকলের নিরঙ্কুশ ও অটল সমর্থন, সবকিছুই প্রতিপাদিত হলো এ জয়ের মাধ্যমে। সকল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, ঠাট্টা-উপহাসের জবাব দেয়ার সময় বুঝি এলো, কিন্তু আমার অনুভূতি কেবলই আবেগের পরিতৃপ্তির, কেবলই নিবৃত্তি ও স্বস্তির, সীমাহীন আনন্দের। লিওনেল মেসি, তোমাকে ধন্যবাদ, আমার জন্য এ আনন্দধারা বয়ে আনার জন্য। ধন্যবাদ, বত্রিশ বছরের এই পথ পরিক্রমণকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য। আমি ভিন্ন ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের নিয়ে তুলনা করার পক্ষে নই, তবে আমি এটুকু বলতে পারি যে ২০০৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তোমার খেলা দেখাটা আমার জন্য ছিল এক অবিমিশ্র আনন্দানুভূতি। তোমার আগমনের আগেও আমি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছি, তোমার পরেও দিতে থাকবো, কিন্তু (অনুভূতিটা) একই রকম থাকবে না। সেই শৈশব থেকে আজকের এই পরিণত বয়স পর্যন্ত একজন ফুটবল অনুরাগী হিসেবে আমার বত্রিশ বছরের পথ পরিক্রমা যেন আজ পূর্ণতা পেল, হতাশা থেকে সিদ্ধিতে পরিণত হলো। এর অতিরিক্ত সব কিছুই হবে বোনাস। এটাই হবে বিশ্বকাপ নিয়ে আমার লেখা একমাত্র পোস্ট।
লিওনেল মেসি, বয়, ইউ আর স্পেশাল!
মূলঃ আদনান আহসান খন্দকার
রিজাইনা, সাচকাচুয়ান, কানাডা
১৮ ডিসেম্বর ২০২২
ভাষান্তরঃ খায়রুল আহসান
ঢাকা, বাংলাদেশ
২০ ডিসেম্বর ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৩৫