somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'মেকা (MECA) পিকনিক-২০২৪' --- সায়াহ্নের মিলনমেলা

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কলেজ বিল্ডিং এর রাতের ছবি (সংগৃহীত, স্বত্বাধিকারীর নাম জানা নেই)

প্রাক-কথনঃ
৭-৭-১৯৬৭-তারিখটি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, পয়মন্তও বটে (তারিখটিতে ৭ সংখ্যাটির আধিক্য লক্ষণীয়)। এই তারিখটিতেই তৎকালীন 'মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ' (পরবর্তীতে 'মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ' নামে পুনঃ নামকরণকৃত) এর সপ্তম শ্রেণীতে যোগদান করেছিলাম। ৫৭ বছর আগের সেই দিনটি আজও স্মৃতিতে ভাস্বর। ৭৩ সালে কলেজ ছেড়ে আসার পর আরও বহুবার বিভিন্ন কারণে, আয়োজনে, ছলে ও উপলক্ষে কলেজে গিয়েছি। যতবারই গিয়েছি, এক অবিশ্বাস্য মায়া, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার গভীর অনুভূতিতে আচ্ছন্ন থেকে কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে নতুন নতুন স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসেছি। আগে যেতাম একা একা কিংবা বন্ধু-সতীর্থদের নিয়ে, তারপর স্ত্রী-সন্তানদেরকে নিয়ে, এখন তাদের সাথে পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিরাও সফরসঙ্গী হয়। সর্বশেষ গেলাম এই গত শুক্রবার ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ তারিখে, 'মেকা পিকনিক-২০২৪' উপলক্ষে।

যাত্রা শুরুঃ
ক্যাডেট নাম্বারের দিক দিয়ে আমাদের ব্যচের শিরোমনি ডাঃ আনিসুর রহমান (১৮০) এর সাথে আগেই ঠিক করা ছিল, যাবার পথে ও আর ওর স্ত্রী এলি আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। কথা অনুযায়ী ওরা ঠিক পৌণে আটটায় এসে যায় এবং আমরা একসাথে রওনা হই আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রার পথ ধরে। দিনটা ছিল বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন, তাই অনেকে অত্যধিক ভিড়ের শঙ্কায় ঐ পথে যাওয়াটা নিরুৎসাহিত করেছিল। কিন্তু আমরা সেটা আমলে না নিয়ে ঐ পথেই রওনা হলাম। আমাদের সিদ্ধান্তটা সঠিক বলে প্রমাণিত হলো, কারণ অকুস্থলে আমরা তেমন একটা ভিড় পাই নি। বেশ কিছুটা পথ গাড়ি খুব ধীর গতিতে চলেছিল বটে, কিন্তু কখনো 'ডেডস্টপ' হয় নি। বয়স্কদের হয়তো মনে আছে, ১৯৭৩-৭৪ সালে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক কর্নেল চিত্তরঞ্জন দত্ত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, "চোরাচালান ডেডস্টপ"! তখন থেকেই 'ডেডস্টপ' কথাটা সাংবাদিক ও সংবাদপত্র পাঠকদের মুখে মুখে বেশ চাউর হয়ে যায়, আমারও মনে গেঁথে যায়।

পৌঁছার পরঃ
আমাদের আরও চারজন বন্ধু ওয়াসিম আদেল এর নেতৃত্বে সাভার হয়ে আমাদের একটু পরে রওনা দেয়। আমরা সকাল সাড়ে নয়টায় কলেজে পৌঁছালাম, ওরা দশটার দিকে। তার একটু পরে আমার বৌমা চার বছরের নাতি আরহাম কে নিয়ে পৌঁছে যায়। ক্যাডেটস ডাইনিং হলে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম, যেখানে বসে ৫৭ বছর আগে ৩০০ জন ক্যাডেট একসাথে খাবার খেতাম। একই প্রক্রিয়া আজও চলমান। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকলো। চেনা মুখগুলোর সাথে ঘুরে ঘুরে স্মৃতিময় আলাপচারিতায় মগ্ন হলাম। বাহিরে কিছু খেলাধুলার প্রস্তুতি চলছিল, শিশুদের জন্য কয়েকটি 'গেম পয়েন্ট' তৈরি করা হয়েছিল, যা ওদেরকে দিনব্যাপী প্রভূত আনন্দ দিয়েছে। আমার হাউজের (ফজলুল হক হাউজ) সামনে নাতি আরহামকে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভেতরে বর্তমান ক্যাডেটরা ছিল, তাই সেখানে প্রবেশ নিষেধ ছিল। একটা বাচ্চাকে দেখলাম তার বাবার সাথে (২৫তম ব্যাচের) ফুটবল খেলছে। যদিও আরহাম বয়সে ওর চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু সে ফুটবল খেলতে দারুণ ভালোবাসে জানি বলে ওকে বাচ্চাটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ও অবিলম্বে ওর সাথে ফুটবলে মেতে উঠলো।

জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ প্রিয়জনদের সাথেঃ
প্রতিবছর (অথবা যে বছরেই যাই) পিকনিকের সময় ভাবি, পুরনো যাদেরকে আমরা কলেজে পেয়েছিলাম, তাদের সাথে গল্প করবো, ছবি তুলবো, স্মৃতিচারণ করবো। কিন্তু দিন শেষে দেখা যায়, পরিচিত ও প্রিয়মুখ অনেকের সাথেই এ কাজটা করতে পারি নি। দূর থেকে দেখেছি, চোখাচোখি হয়েছে, ভেবেছি পরে কাছে গিয়ে কথা বলবো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় নি। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। সময়ের বড়ই অভাব! তবুও এরই মাঝে যে সকল জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সাথে হ্যালো-হাই থেকে আরেকটু বিশদ কথা হয়েছে, তাদের কথা বলছিঃ

কলেজে প্রবেশ করেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্থাপিত রেজিস্ট্রেশন বুথ এ বেশ কয়েকজন প্রাণবন্ত তরুণ এক্স-ক্যাডেট স্বেচ্ছাসেবককে দেখতে পেলাম অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে অতিথিদেরকে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশনে সাহায্য করতে। তাদের সাহায্যে দ্রুতই রেজিস্ট্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফেললাম। সেখানেই দেখা হলো ব্যাচ-২ এর নূরুস সাফা ভাই এর সাথে। তার ব্যাচের অন্যান্য কে কে আসছেন তা জানতে চাইলাম, বিশেষ করে কলেজের প্রথম 'ফুটবল ব্লু' মাহবুব শহীদ ভাই এর কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওনাদের উভয়ের সাথে আমি বেশ কয়েকবার একসাথে শ্রীমঙ্গল, টাঙ্গুয়ার হাওর, বালিয়াটি ইত্যাদি এলাকা সফর করেছি বলেই এতটা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি জানালেন, গাড়িতে উঠে উনি কয়েকজনকে নক দিয়েছিলেন, কিন্তু সাড়া পান নি। পরে অবশ্য ওনার ব্যাচের কানাডা প্রবাসী মানিক (মুজিবুল হক) ভাইকে দেখেছি, বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতাও হয়েছে। অধুনা তার সাথে বিভিন্ন কমন ইন্টারেস্টকে কেন্দ্র করে আমার যোগাযোগটা বেশ নিবিড় বলা চলে। ওনাদের ব্যাচের কলেজ ক্যাপ্টেন শফিক চৌধুরী ভাইও এসেছিলেন বলে জেনেছি, তবে তার সাথে আমার দেখা হয় নি। তৃতীয় ব্যাচের কারও সাথেই দেখা হয় নি। চতুর্থ ব্যাচের ইকবাল ভাই (মেকা প্রেসিডেন্ট) এর সাথে দেখা হয়েছিল, উনি লাঞ্চের পর কলেজ ত্যাগ করেছিলেন। গতবার জাহাঙ্গীর ভাই এর সাথে দেখা হয়েছিল, এবারে বোধকরি তিনি আসেন নাই। এ ছাড়াও ওনাদের ব্যাচের কামাল শাহ ভাই, আহসান কামাল ভাই (প্রাক্তন সিসিসিএল প্রেসিডেন্ট), খন্দকার ভাই, ইফতেখার নাসির টিপলু ভাই এবং উস্কোখুস্কো চুলের ট্রেডমার্ক অধিকারী আতিক-এ-রাব্বানি ভাই এর সাথে দেখা ও কথা হয়েছিল। শেষোক্ত জন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড, সে কারণে আমি তার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক (ইনটেলেকচুয়াল) প্রতিভার সাথে পরিচিত। বিশেষ করে তার দুটো অনন্য স্বাতন্ত্রের জন্য আমি তার ফ্যান হয়ে উঠেছি। তার একটি হচ্ছে নিজে গীটার বাজিয়ে ইউনিক কণ্ঠে বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় মনের আনন্দে গান পরিবেশন, অপরটি হচ্ছে মাথায় একটি 'পাখির বাসা' নিয়ে ঘুরে বেড়ানো! এই 'পাখির বাসা' কথাটি যখন ভাবীর সামনে উল্লেখ করলাম, উনি হেসে দিয়ে বললেন, "আমি তো ওর চুল দেখেই ওকে বিয়ে করেছি"!

মাঠে যখন মহিলাদের 'পিলো পাসিং' খেলা চলছিল, আমি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তখন ষষ্ঠ ব্যাচের ডাঃ নাজমুলকে দেখতে পাই আনমনে হাঁটছে। কাছে ডেকে কুশল বিনিময় করলাম। ও জানালো, পরনের জ্যাকেটটা খুলে ওর ব্যাচমেট শাহনেওয়াজকে ধরতে দিয়ে ও ওয়াশরুমে গিয়েছিল। বের হয়ে সে আর শাহনেওয়াজকে খঁজে পাচ্ছিল না। জ্যাকেটের পকেটে সেলফোনটাও রেখেছিল বলে সে কারও সাথে যোগাযোগও করতে পারছিল না। আমি আমার সেলফোনটা সার্চ করে দেখলাম, ওদের ব্যাচের জহুর (শওকত) এর নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ করা আছে। আমি জহুরকে ফোন করে জানালাম ঘটনাটির কথা। কিছুক্ষণ পর দেখলাম শাহনেওয়াজ আমাদের কাছে এসে নাজমুলকে ওর জ্যাকেটটা দিল। বাংলাদেশ বিমানের জিএম হিসেবে অবসর নেয়া শাহনেওয়াজ এর মুখচ্ছবি আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এভাবে দেখা হয়ে নতুন করে পরিচিত না হলে কোনদিন পাশে দিয়ে হেঁটে গেলেও চিনতে পারতাম না। পরে ওদের ব্যাচের শওকত, আব্দুল্লাহ ফারুক, ডাঃ করিম, খন্দকার মাহবুব হাসান প্রমুখের সাথে দেখা হলো। শওকতের কাছে অকল্যান্ড প্রবাসী ওদের ব্যাচের মাহবুবুল আউয়াল নওরোজ এর কুশল জানতে চাইলাম। ওর সম্প্রতি knee reconstruction surgery হয়েছে বলে জানি। আরও জানলাম, ওর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ওদের ব্যাচের বাশারের সাথে সবসময় এ ধরণের অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কিন্তু এবারে হলো না। জানলাম, শরীররটা ভালো নেই বলে ও এবারে আসতে পারে নি। জুম্মার নামাযের সময় হাতে একটু সময় নিয়েই মাসজিদে গিয়েছিলাম, ফলে একেবারে প্রথম কাতারেই স্থান পেয়েছিলাম। আমার পাশে ছিল আমাদেরই হাউজের দশম ব্যাচের নজরুল ইসলাম। ওর সাথে ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক আলাপচারিতা হয়েছিল। নামায শেষে ডাইনিং হলের পথে ফিরে আসার সময় ১৭তম ব্যাচের ডাঃ জয়নাল আবদিন এর সাথেও কিছু কথা হয়েছিল।

এত বড় পরিসরে তিন বছরের শিশু থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সী আট/নয়শত অতিথির জন্য খাবার দাবারের আয়োজন করাটা মোটেই সহজসাধ্য কাজ ছিল না। সুতরাং ডাইনিং হলের অভ্যন্তরে যা কিছু অব্যাবস্থাপনা ছিল, তা নিয়ে কোন কথা নয়। লাঞ্চের পর দেখা হলো আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নাজমুল আহসান স্যারের সাথে। একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হওয়া ছাড়াও অন্য দুটি কারণে উনি আমার বিশেষ সমীহের পাত্র। প্রথমটা, উনি আমার হাউজ মাস্টারও ছিলেন; দ্বিতীয়তঃ, উনি ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করা ছাড়াও একজন স্বনামধন্য ক্রিকেটার ছিলেন। তিনি ইগলেটস ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে নিয়মিতভাবে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলতেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাশিক্ষা কোরে যোগদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যোগদান করেন নি। কেন, সেটা তার মুখেই সেদিন শুনলাম। ৮১ বছর বয়স্ক আমাদের এই শিক্ষক পিকনিকে আসার সময় তার প্রিয় ছাত্র মানিক ভাইকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সানন্দে ও সাগ্রহে আমাদের সাথে ছবি তুললেন, পুরনো দিনের গল্প করলেন।

প্রতিটি মেকা-পিকনিক, রি-ইউনিয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আমি যে মুখটিকে খুঁজি, এবং যিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবারই আমাকে খুঁজে বের করে আমার সাথে দেখা করেছেন, তিনি আমাদের হাউজের (FH) হাউজ বেয়ারার দেওয়ান আব্দুর রউফ ওরফে 'রউফ ভাই'। এবারে তাকে দেখলাম বেশ বার্ধক্য-জর্জরিত; কানে শোনেন না, একটা চোখে কিছুই দেখেন না, অপর চোখে সামান্য দেখতে পান। এভাবেই তিনি চলাফেরা করেন। কানে শোনেন না বলে তিনি কোন ফোনকল রিসিভ করেন না। ২১তম ব্যাচের প্রতি তিনি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন; ওরা সম্মিলিতভাবে তার বাইপাস সার্জারির ব্যয়ভার বহন করেছিল। এ ছাড়াও তাকে বিভিন্ন সময়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতাভরে কয়েকজন প্রাক্তন ক্যাডেটের নামোল্লেখ করলেন। আমরা যেদিন এমসিসিতে যোগদান করেছিলাম, রউফ ভাই তার মাত্র তিন দিন আগে একজন তরুণ কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এই সমসাময়িকতার কারণে আমাদের ব্যাচটা তার অনেক প্রিয় এবং হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি, এ কথাটা তিনি আমাকে প্রায়ই বলে থাকেন।

অষ্টম ব্যাচের কলেজ ক্যাপ্টেন শাব্বিরকে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা সেরে নিলাম। বছর কয়েক আগেও আরেকবার এরকমেরই একটা অনুষ্ঠানে (পিকনিক কিংবা রি-ইউনিয়ন) একই মাঠের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলেছিলাম। ওর আন্তরিকতায় দু'বারই মুগ্ধ হয়েছি। অষ্টম ব্যাচের ৪/৫ জন একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এদের মধ্যে সাজেদ খান ও মুনীরের সাথে আমার প্রায় প্রতিবারেই দেখা হয় এবং ওরা এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করে। শাব্বির, মঈন (নবম ব্যাচ) এবং স্বয়ং আমার ব্যাচমেট ড. নজরুল ইসলাম- এই তিন প্রাক্তন কলেজ ক্যাপ্টেন এর সাথে কথা বললেই আমি 'যে যত বেশি বিদ্বান, সে তত বেশি বিনয়ী' - এই প্রবাদটির সত্যতা খুঁজে পাই। ওরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষা এবং পেশায় সাফল্যের শীর্ষ সোপানে আরোহণ করেছে; কিন্তু সেই সাথে ওরা অত্যন্ত বিনয়ী ও অমায়িকও বটে। ওদের নেতৃত্বের গুণাবলী কলেজে থাকতেই সঠিকভাবে শনাক্ত হয়েছিল।

আমার প্রথম ব্যাংকঃ
কলেজ ত্যাগের পর এমসিসিতে বহুবার যাওয়া আসা করেছি; স্মৃ্তিময় প্রতিটি জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে অতীত জীবনে ফিরে গিয়েছি, মনে মনে স্মৃ্তিচারণ করেছি। কিন্তু এক কোণায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্থাপনা এ যাবত প্রতিবারেই আমার নজর না এড়ালেও মনযোগের বাইরে থেকে গেছে। সেটি হচ্ছে আজকের 'অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ শাখা', যেটা ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ সালে 'হাবিব ব্যাংক লিমিটেড' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সদ্য উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করা একজন সুদর্শন যুবক এটির প্রথম ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার নামটা আজ মনে নেই, কিন্তু সদালাপী এই ব্যবস্থাপক বৃহত্তর বরিশাল এলাকার লোক ছিলেন, তা মনে আছে। তিনি অত্যন্ত অমায়িক একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে আমাকে ব্যাংকের চেকলিপি এবং ডেপোজিট স্লিপ পূরণ করা শিখিয়েছিলেন। সে শিক্ষাটা আমার আজীবন কাজে লেগেছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আমার ঋণের কথা স্মরণ করে এর সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলে রাখলাম। সেখানে কলেজের একজন সিকিউরিটি গার্ডের সাথে আলাপ হলো, নাম নজরুল ইসলাম। সে জানালো যে সে আমাদের সময়ের নজরুল হাউজের হাউজ বেয়ারার 'রহমান ভাই' এর ছেলে। হাসিখুশি, ভদ্র আচরণের এই ছেলেটিকে দেখে ভালো লাগলো। পিতার সদাচারণ তার আচরণেও মূর্ত।

তাজুদ্দিনের বাসায়ঃ

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনেক ক্যাডেট দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তারা অনেকেই আর ফিরে আসে নাই। ফলে ক্লাসের অনেক আসন খালি হয়ে যায়। সেই শুন্যতা পূরণের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর আমরা যখন একাদশ শ্রেণিতে উঠলাম, তখন ১৫/১৬জন নতুন ক্যাডেটকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে দুইজন ছিল স্থানীয়, কলেজ এলাকার আশেপাশেই ওদের বাড়ি ছিল। তাদের একজন ছিল আবু সাঈদ, সে কলেজ ত্যাগের পর বিএ পাশ করে কলেজ সংলগ্ন রাজাবাজার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। বছর দুয়েক আগে সে ইন্তেকাল করেছে। মৃত্যুর আগে সে সেই স্কুলটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছিল। অপরজন হচ্ছে তাজুদ্দিন আহমেদ। সে দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় চাকুরি বাকুরি ব্যবসা ইত্যাদি করে বেশ বিষয় সম্পত্তি করেছে। ঢাকা শহর ও আশেপাশে তার ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও সে কলেজ সংলগ্ন এলাকাতেই একটি সুন্দর দোতলা বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে সস্ত্রীক বসবাস করে। তার ছেলেমেয়েরা দেশে বিদেশে থিতু হয়েছে। এমসিসি প্রিন্সিপালের বাসার পেছনের সীমানা দেয়াল থেকে তার বাড়ি প্রস্তর নিক্ষেপ দূরত্বে অবস্থিত। তার প্রসঙ্গটা টানলাম এ কারণে যে আমরা কলেজের কোন অনুষ্ঠানে গেলেই সে খবর পেয়ে ফোন করে অস্থির করে তোলে তার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য। গত বছরের পিকনিক দিবসেও সে অনেকবার ফোন করেছিল, কিন্তু সময়াভাবে আমরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারি নি। শেষ গিয়েছিলাম ২০১২ এর রি-ইউনিয়নের সময়। সে সময় আমাদের ব্যাচমেট কে, এম, আ্লী মুনীর রানা (২২৮) বেঁচে ছিল। তার মাস দুয়েক পরেই রানা প্রয়াত হয়। সেবারে তার উন্মুক্ত উঠোনে বসে আমরা ভাবীর জ্বাল দেয়া পালিত গরুর দুধ পান করে এবং আনুষঙ্গিক আতিথেয়তায় তৃপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। এবারে আর তার অনুরোধ আমরা ফেলতে পারলাম না। আমরা কয়েকজন বন্ধু ও ভাবিরা তার নতুন বাসায় ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে আসলাম। ভাবি আমাদেরকে গাছের ফল ফলাদি ও দুধ দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।

ফিরে আসাঃ
মাগরিবের ঠিক আগে আগে আমরা কলেজ ত্যাগ করলাম। ফেরার সময় সাভার হয়ে ফিরে এসেছি। মিরপুরে প্রবেশের আগে পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই এসেছি। মিরপুরের পর থেকে কিছুটা জ্যাম পেয়েছি, তবে তা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এবারের পিকনিকটা আমার কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ আমার চার বছরের নাতি আরহাম কলেজের বিশাল মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খুব মজা পেয়েছে, যে মাঠে একদা তার বাবা ও দাদাও ছুটোছুটি করতো। আয়োজকদের আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই শিশুদের চাহিদার প্রতি খেয়াল রেখে তাদের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অনেকগুলো গেম-পয়েন্ট প্রস্তুত করার জন্য। সেসব খেলার সরঞ্জামাদি ওদেরকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। মঞ্চে গান গাওয়া এবং ইন্সট্রুমেন্ট প্লে করা প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি সুন্দর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থিত সুধীজনকে আনন্দ দেয়ার জন্য। পর্দার সামনে ও আড়ালে থেকে যারা দিনরাত পরিশ্রম করে এ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তদারক করে আমাদেরকে এক সফল পিকনিক উপহার দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য থ্রী চিয়ার্স!


ঢাকা
০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ২০১৪


Mr. Najmul Ahsan aka Nizam Bhai, our Chemistry teacher and a renowned cricketer of the late sixties. He is the only living member of the pioneer faculty of the College.
Ma Sha Allah, He is 81 years old now and physically more fit than many of his pupils.
May Allah SWT grant him Hayat e Tayyeba and extend his life!


আনন্দে উচ্ছল।


আমার সময়ের হাউজ বেয়ারার দেওয়ান আব্দুর রউফ ওরফে 'রউফ ভাই'।

আমার সময়ের আরেকজন হাউজ বেয়ারার প্রয়াত 'রহমান ভাই' এর ছেলে নজরুল ইসলাম। বর্তমানে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত।


আমার জীবনের প্রথম ব্যাংক, যেখানে ব্যক্তিগত একাউন্ট পরিচালনার ক, খ, গ শিখেছিলাম। তিন মাসের পকেট মানি হিসেবে পঞ্চাশ টাকা জমা রাখতে হতো এবং সেখান থেকে তুলে তুলে প্রয়োজনে খরচ করতে পারতাম।


একটি কোলাহলমুক্ত নীরব এলাকা, যেখানে তখনও সময় কাটাতে ভালোবাসতাম, এখন গেলেও...।


ফুটবল প্রিয় একটি শিশু।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:৩০
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×