somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্ন ছড়ানো মাধবী রাতের গান

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাধবী রাত, মায়াবী চাঁদ....
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রাত দশটা বার।


"তন্দ্রাহারা নয়ন ও আমার...এই মাধবী রাতে...
তারার কুসুম হয়ে চায় স্বপ্ন ছড়াতে...!"
এই গানটা যখন প্রথম শুনি, তখন আমি সম্ভবতঃ নবম কি দশম শ্রেণীর ছাত্র, সেটা ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা। গানটা তখন অত্যধিক জনপ্রিয় হয়েছিল এবং বোধকরি সে জন্যেই রেডিওটা 'অন' করলেই কোন না কোন স্টেশন থেকে এ গানটি শোনা যেত। গানটির শিল্পী ছিলেন হাসিনা মমতাজ, গীতিকার মাসুদ করিম এবং সুরকার সমর দাস। তখনকার শিল্পীদের মধ্যে হাসিনা মমতাজ তুলনামূলকভাবে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে উচ্চশিক্ষা অর্জন করছিলেন। গানটি তখন রেডিওতে এতই বাজানো হতো যে শ্রোতাদের অনেকেই হাল্কা রসিকতার সাথে বলাবলি করতো যে শিল্পীর সাথে নিশ্চয়ই রেডিওর লোকজনের ভালো খাতির রয়েছে, নইলে এত ঘন ঘন বাজানো হবে কেন! যারা এসব বলতো, তারাও অবশ্যই জানতো যে মিষ্টি কথা, মন ভোলানো সুর আর শিল্পীর চর্চিত, পরিশীলিত সুকণ্ঠ ও নিখুঁত পরিবেশনার কারণেই গানটি এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল।

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বেতার এর যে কয়টি স্টেশন ছিল, তার প্রত্যেকটির 'অনুরোধের আসরে' এ গানটির জন্য প্রচুর অনুরোধ আসতো এবং তাই এ গানটি বাজানো হতোই। একটানা বহু বছর ধরে এ গানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। গানটি আমার ভালো লাগতো মূলতঃ এর রোমান্টিক লিরিক্সের জন্য, বিশেষ করে শুরুর এবং শেষের চরণগুলোর জন্যঃ

"তন্দ্রাহারা নয়ন ও আমার...এই মাধবী রাতে...
তারার কুসুম হয়ে চায় স্বপ্ন ছড়াতে...!"

--- এবং

"হৃদয়েরও এই কলতান...নেই কভু এর অবসান...!
বনেরও পাখিরা তাই চায়, ছন্দ ঝরাতে...!"

এই গুণী শিল্পী প্রয়াত হয়েছেন গত ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ তারিখে, আজ থেকে মাত্র ছয় দিন আগে, ৭৮ বছর বয়সে। গত কয়দিন ধরে বিভিন্ন লিঙ্ক ধরে তার এই তুমুল জনপ্রিয় গানটি ক্রমাগত শুনছি, আর অতীতের সেই দিনগুলোর কথা ভাবছি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি পার হয়ে গেছে, এখনও এ গানটি শুনলে মনের মধ্যে কয়েকটি স্মৃতির কথা ভেসে আসেঃ

১। ছাত্র থাকা কালে আমি ৮ ডাউন 'নর্থ বেঙ্গল মেল' ট্রেনে করে রংপুর থেকে ঢাকায় আসতাম। রাত আটটার দিকে ট্রেনটা তিস্তামুখ ঘাটে পৌঁছতো। চরের পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্টীমার থেকে কখনো অর্ধ কিঃমিঃ আবার কখনো এক কিঃমিঃ এর মত দূরে ট্রেনটি থেমে যেত। এই পথটুকু যাত্রীদের গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে পায়ে হেঁটে স্টীমারে উঠতে হতো। হাঁটা পথের পাশে গজিয়ে উঠতো বহু খাবারের দোকান, তার মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল 'কলিমুদ্দিনের হোটেল'। এ ছাড়াও থাকতো খাঁটি দুধ দিয়ে বানানো গরম চা, বিস্কুট ইত্যাদির দোকান। আমি সাধারণতঃ স্টীমারেই খেতাম, তাই এসব হোটেলে তেমন খাওয়া হতো না। ব্যাগ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যাবার সময় কোন না কোন দোকান থেকে ভেসে আসতো "তন্দ্রাহারা নয়ন ও আমার...এই মাধবী রাতে..."! এই চলন্ত পদযাত্রায় নিজেকে একজন অভিযাত্রিক মনে হতো, আর রেডিওতে ভেসে আসা ক্রমশঃ স্তিমিত হতে থাকা এই গানটিকে মনে হতো কোন এক দূর দ্বীপবাসিনীর গাওয়া সেরেনাদ (serenade)। স্টীমারে উঠেও শুনি একই গান, এমনকি ওপাড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছানোর পরে ফিরতি হাঁটা পথে চলার সময়েও সেই একই গান! ওসব ক্ষুদ্র দোকানগুলোতে তখনও কোন ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। যা শুনতাম, তার সবই ছিল রেডিও থেকে ভেসে আসা গান। জনপ্রিয়তার কারণে একেক সময়ে একেক স্টেশন থেকে গানটি বেজে চলতো।

২। ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার সময় যেতাম ১১ আপ 'দ্রুতযান এক্সপ্রেস' ট্রেন যোগে। সাত সকালে রওনা দিয়ে রাত দশটা এগারটার দিকে বাড়ির নিকটস্থ স্টেশনে নামতাম। মফস্বলের ছোট্ট স্টেশন, হাটের দিন ছাড়া অন্যান্যদিন সন্ধ্যার পরে পরেই চারিপাশ নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যেত; কিন্তু ট্রেন আসার সময় হলে আবার সরগরম হয়ে উঠতো। চা পিয়াসী যাত্রীদেরকে চা পরিবেশনের জন্য প্লাটফর্মের বাইরের দোকানের চুলোগুলোতে আগুন আবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠতো, ক্ষুধার্ত যাত্রীদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ডিম পরাটা ভাজা হতো। তার সাথে যাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য তখনকার দিনের একমাত্র বিনোদন রেডিও 'অন' করা হতো। আর 'অন' করার সাথে সাথে কিংবা কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা যেত সেই গান, "তন্দ্রাহারা নয়ন ও আমার..."! গান শুনতে শুনতে গানের মিষ্টি আমেজ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরতাম, তারার কুসুম হয়ে স্বপ্ন ছড়াতে চাওয়া কোন অদেখা নয়ন যুগলের কথা ভাবতে ভাবতে।

৩। আমাদের বাড়ির পঞ্চাশ গজের মত দক্ষিণ দিয়ে চলে গিয়েছিল তখনকার দিনের 'ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা'। আর দেড় কিঃমিঃ এর মত উত্তর দিয়ে পূবে-পশ্চিমে চলে গিয়েছিল 'বেঙ্গল-ডুয়ার্স রেলওয়ে'র লাইন, যা দিয়ে চলাচল করতো লালমনিরহাট থেকে বুড়িমারি পর্যন্ত লোকাল ট্রেন, পরের দিকে মেল ট্রেনও। রাত দশটা এগারটার দিকে একটি ট্রেন সেই পথে লালমনিরহাট থেকে বুড়িমারি যেত এবং আমিও ঐ ট্রেনটাতে করেই বাড়িতে আসতাম বলে আগেই উল্লেখ করেছি। মফস্বলে দশটা-এগারটা অনেক রাত, আর শীতের রাত হলে তো কথাই নেই। আমি বিছানায় শোয়ার পর সেই ট্রেনটা যেত; আমি বিছানায় শুয়ে শুয়েই ট্রেনের কয়লার ইঞ্জিনের হুইসেল এবং বগীর চাকার ঘরঘর আওয়াজ কান পেতে শুনতাম। পরবর্তীতে অবশ্য ডিজেল ইঞ্জিন যোগ হয়েছিল, যার আওয়াজকে হুইসেল না বলে ভেঁপু বলাই শ্রেয়ঃ। ট্রেন চলে যাবার আধ ঘণ্টা পর সেই 'ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা'য় শোনা যেত পথচারী যাত্রীদের পায়ের আওয়াজ। কোন কোন সময় তাদের সাথে যোগ হতো সদ্য সমাপ্ত হাট থেকে বাড়ি ফেরা পসারির দল। তাদের কারও কারও হাতে থাকতো 'অন করা' রেডিও, যেটা থেকে কানে ভেসে আসতো সেই একই গান, "তন্দ্রাহারা নয়ন ও আমার..."! কেমন একটা মায়াবী আমেজ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। স্বপ্ন দেখানোয় এ গানের কোন জুড়ি ছিল না।

"বাতাসেরও ফাল্গুনী গান...দেয় মুছে সব অভিমান...
সুরের কাকলি তাই চায়, কন্ঠে জড়াতে..."
.....

"তনু মন এই রাত,কেন যে মুখর এতো জানিনা...
এই গান এই সুর, কেন যে মধুর এতো জানিনা..."

আমারও জানা ছিল না, আমিও জানতাম না। শুধু জানতাম, গানটির কোমল অনুরণন মানসে মননে রেখাপাত করে যেত, যেমন করে বেলাভূমির ভেজা মাটিতে বিচরণ করা পাখিরা তাদের পায়ের রেখাঙ্কিত ছাপ রেখে যায়। পরবর্তী ঢেউ এসে সে ছাপ মুছে না দেয়া পর্যন্ত রয়ে যায়!

লিখতে বসেছিলাম প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে, তার গান নিয়ে। লিখা হয়ে গেল অনেকটা নিজের স্মৃতিকথা! সঙ্গীত ও স্মৃতি গোপনে একের সাথে অপরের গাঁটছড়া বেঁধে নেয়। মানুষ সঙ্গীত ভালোবাসে শুধু কথা ও সুরের জন্যেই নয়, তার সাথে আঁকড়ে থাকা স্মৃতির জন্যেও। সঙ্গীত ভালো লাগলে মানুষ তার সাথে সংশ্লিষ্ট স্মৃতিকে জড়িয়ে রাখে, স্মৃতি ভালো লাগলে মানুষ তাকে সংশ্লিষ্ট সঙ্গীতের আশ্রয়ে রাখে। সদ্য প্রয়াত এই গুণী শিল্পীর মাগফিরাত কামনা করছি। পরপারে তিনি শান্তিতে থাকুন, আর তার গানের মাধ্যমে দীর্ঘকাল তার ভক্তদের হৃদয়ে, স্মরণে ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকুন!

ঢাকা
১১ ফাল্গুন ১৪৩০
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ৯২৯

(গান তো শোনাতে পারবো না, তাই ফাল্গুনের রাতে আমার তোলা পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদের কিছু ছবি দিলাম, আর শিল্পীর গানের একটা ভিডিও লিঙ্কঃ
https://www.youtube.com/watch?v=YKHvHqbJtiE)





মাধবী রাত, মায়াবী চাঁদ....
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রাত দশটা পাঁচ।


মাধবী রাত, মায়াবী চাঁদ....
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রাত দশটা সাত।


মাধবী রাত, মায়াবী চাঁদ....
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রাত আটটা আটাশ।


মাধবী রাত, মায়াবী চাঁদ....
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রাত আটটা আটাশ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:২৪
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×