somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরব মরুর বুকে জীবিকার সন্ধানে যাওয়া পলিমাটির দেশ বঙ্গ ব-দ্বীপের কর্মঠ ছেলেদের নিয়ে কিছু কথা

১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৪ মে ২০২৫ থেকে ২৪ জুন ২০২৫, গত এই একটি মাস পবিত্র হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদীনায় অবস্থান করেছিলাম। প্রথমে গিয়েছিলাম রাসুল (সাঃ) এর শহর মদীনা শরীফে। সেখানে ৮ দিন অবস্থান করার পর চলে এসেছিলাম আজিজিয়া শহরে। আজিজিয়া থেকেই ০৫ জুন ২০২৫ তারিখে হজ্জের অবশ্যপালনীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালনের উদ্দেশ্যে মিনায় চলে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আরাফাত এবং মুযদালিফায় অবস্থান করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করেছিলাম। সেসব অবশ্যপালনীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালনের পর মক্কা শরীফে এসে হারাম শরীফের নিকট একটি হোটেলে উঠেছিলাম। মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে, মক্কায় হারাম শরীফে এবং আজিজিয়ায় আমাদের হোটেলের নিকটস্থ একটি মাসজিদে ওয়াক্তিয়া নামাযগুলো পড়তাম। সেই মাসজিদটির নাম আমি এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। হোটেল থেকে সেখানে পায়ে হেঁটে যেতে ৭/৮ মিনিট সময় লাগতো।

মদীনায় আমাদের হোটেল থেকে বের হয়ে মাসজিদে নবুবীর দিকে একেবারে সোজা চার শ’ গজের মত হেঁটে গেলে আমরা পৌঁছে যেতাম ৩১৬ নং গেইটে। এই নম্বরটি আমাদের সবার জন্য (বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য) ছিল একটি আরাধ্য নম্বর। দলে বলে একসাথে গেলেও, এত জনমানুষের সমুদ্রে আমরা খড়কুটোর ন্যায় ভেসে পৃথক হয়ে যেতাম। তখন পথ খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল এই গেইট নং ৩১৬ খুঁজে বের করা। সেটা আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিতে বা স্মরণশক্তিতে খুঁজে পাওয়া প্রথম প্রথম সম্ভব হতো না। এমতাবস্থায় আমাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতো মরুর বুকে জীবিকার সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে আসা কর্মঠ ছেলেরা। তারা কাঠফাটা রোদে দিন দিনান্তে পরিচ্চছনতার কাজ করে যেত। তাদের মুখ দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম ওরা আমাদের স্বদেশী, আমাদের মুখ দেখেও ওরা বুঝতো আমরা ওদের স্বদেশী। হারিয়ে যাওয়া পথের সন্ধান খোঁজার জন্য ওরাই ছিল আমাদের ফার্স্ট চয়েস। ওরাও সবসময় উদগ্রীব থাকতো পথ ভোলা পথিককে, বিশেষ করে স্বদেশী আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য। সেই “গেইট নং ৩১৬” একেবারে মুখস্থ করে রেখেছিলাম। সেলফোনেও সেই গেইটের একটি ছবি তুলে রেখেছিলাম, যেন প্রয়োজনবোধে আরবী ভাষাভাষী পুলিশকেও সেই গেইটের ছবি দেখিয়ে সাহায্য কামনা করা যায়। অবশ্য সেটা হতো একেবারে লাস্ট এফোর্ট। ২/৩ দিনের মধ্যেই অবশ্য সেই গেইটের পথটি আমাদের সবার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখন কারও সাহায্য ছাড়াই সকলে একা একা যাওয়া আসা করতে পারতাম।

মাসজিদে নবুবীতে যেমন “গেইট নং ৩১৬”, মক্কার হারাম শরীফে তেমনি ‘গেইট নং ৭৯’ এবং ‘পাবলিক ওয়াশরুম নং ৬’ ছিল জনসমুদ্রের মাঝে আমাদের বাতিঘর। আমাদের অবস্থান থেকে কা’বা শরীফে প্রবেশের সহজতম পথ ছিল ‘গেইট নং ৭৯’। আবার ইবাদত শেষে ফিরে আসার সময় আমাদের দিক নির্দেশক ছিল ‘ওয়াশরুম নং ৬’। তুলনামূলকভাবে মদীনার চেয়ে মক্কা শরীফে পথ খুঁজে পাওয়া কঠিনতর ছিল। তবে এখানেও আমাদেরকে অকাতরে সাহায্য করেছেন আমাদের দেশের সেই সব ছেলেপুলেরা। তবে এ প্রসঙ্গে ভারতের মুর্শিদাবাদ এবং কোলকাতা থেকে আগত কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কথা না বললে ওদের প্রতি অবিচার করা হবে। ওরাও আমাদের দেশের ছেলেদের চাইতে কম সহায়ক ছিলনা। প্রথমে আমাদের স্বদেশী ভেবে ওদের সাথে সরাসরি বাংলায় প্রশ্ন করতাম, ওরাও বাংলায়ই পথ বুঝিয়ে দিত। কথাবার্তার সময় অবশ্য ওরা বলে দিত ওরা ভারতীয়, বাংলাদেশি নয়। তবে এর কারণে উভয়পক্ষের কারও কথা বোঝার ব্যাপারে কোন ব্যত্যয় ঘটতো না। জান্নাতুল বাকি যেয়ারত করে ফেরার সময় একদিন আমাকে মুর্শিদাবাদের একটি ছেলে খুব সুন্দর করে পথ বাৎলে দিয়েছিল। হারাম শরীফেও দুই একদিন ওদের সাহায্য নিয়েছি। স্বদেশী বিদেশি ওদের সকলের এই পরার্থবোধক, নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য আমরা হাজ্জীরা সামষ্টিকভাবে ওদের কাছে কৃতজ্ঞ। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন ওদেরকে এ সৎকর্মের জন্য উত্তম বিনিময় দান করুন!

গত ১৫ জুন ২০২৫ তারিখে আমরা তায়েফ নগরীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। নানা কারণে এ শহরটি একটি ঐতিহাসিক শহর। হজ্জ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালন শেষে ততদিনে আমার ছেলে সহ কয়েকজন সহযাত্রী দেশে ফিরে এসেছিলেন, ফলে আমাদের দলটি কিছুটা হাল্কা হয়ে গিয়েছিল। দুটো মাইক্রোবাস ভাড়া করে আমরা তায়েফ গিয়েছিলাম। সময়টা গ্রীষ্মকাল ছিল বিধায় সেখানে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনের আলো অনেকক্ষণ পেয়েছিলাম, তবে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলের একটি মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম, পথের পাশে “লুক আউট পয়েন্ট” এ শত শত দর্শনার্থীদের আনন্দজোয়ার দূর থেকে একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী মনযোগ সহকারে দেখছে। তবে সে কোন মাসজিদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিল না, ছিল পথের এবং পথ সংলগ্ন ভূমির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। দর্শনার্থীদের কেউ তখন উটের পিঠে, কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্যেরা শুধুই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি তার কাছে গিয়ে একটু আলাপ পাড়লাম। থাকা, খাওয়া বেতন ইত্যাদি নিয়ে কোন সমস্যা আছে কিনা, তা জিজ্ঞাসা করলাম। সে প্রথমে একটু আড়ষ্ট ছিল, কিন্তু পরে মন খুলে কথা বলে। ময়মনসিংহের মধুপুর এলাকায় তার বাড়ি, বাড়িতে মা জীবিত আছেন। এখানে উপার্জন করে দেশে মাকে টাকো পাঠানোয় কোন সমস্যা হয় না বলে সে জানালো। আমি যখন তাকে বললাম যে তার এলাকায় আমি বহুবার গিয়েছি, তখন এটা শুনে তার উৎসাহ অনেকটা বেড়ে গেল।

ফেরার পথে ‘মিক্বাত’ হিসেবে গণ্য একটি মাসজিদে আমরা পরিচ্ছন্ন হয়ে এহরাম পরিধান করে পুনরায় হারাম শরীফের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। এ যাবত যত জায়গায় আমি পথ খুঁজে পাবার জন্য কিংবা অন্য কোন জ্ঞাতব্য বিষয় জানার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সাহায্য কামনা করেছি, তাদের মধ্যে সাহায্যের জন্য সবচেয়ে বেশি স্বতঃস্ফূ্র্তভাবে এগিয়ে আসতে দেখেছি তায়েফ থেকে ফেরার পথে দেখা এই মাসজিদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। ওদের মধ্যে একজন আমাকে এহরাম পরিধানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সহায়তা করেছিল। মাসজিদটির নাম কার্নে মানাযিল। এটি একটি মিক্বাত মাসজিদ।


ঢাকা
১৩ অগাস্ট ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৭৮৪





সুমনের সাথে তোলা ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৯:৫৩
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×