
০৫ নভেম্বর ২০২৫, সকাল ০৬-০২
আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল রাজধানী ঢাকায়, ষাটের দশকের প্রথম দিকে। শৈশব এবং কৈশোরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রতিবছর না হলেও দুই এক বছর পর পর আমাদের দাদাবাড়ি-নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। দুই বাড়ির মাঝখানের দূরত্ব ১০/১২ কি.মি.। আমার দাদাবাড়ির ঠিক উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল ‘বিন্যাগাড়ির বিল’। সে সময়ে বিলটিতে নানা দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসে বাসা বাঁধতো। দূর দূরান্ত থেকে শিকারিরা আসতো পাখি শিকার করতে। বর্ষাকালে বিলটি কানায় কানায় জলে ভরা থাকতো। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলেই বিলের জলে ভেসে আসা ছোট ছোট মাছ ধরা যেত। যারা মাছ শিকারে পটু ছিল, তারা বের হতো মধ্যরাতে, হাতে হ্যাচাক বাতি এবং মাছ ধরার নানা সরঞ্জামাদি নিয়ে। কালের পরিক্রমায় সেই বিস্তীর্ণ বিলটির বুকে আজ বহু দালান কোঠা দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃ্তি ও পরিবেশের প্রতি আমরা কতটা বৈরী হতে পারি, তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসেবে।
বিলের উত্তর পাশ ঘেঁষে পূবে-পশ্চিমে চলে গেছে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলপথ। দেশভাগের আগে এই রেলপথটি “বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে” বা BDR নামে পরিচিত ছিল। বিলটি যখন জলে ভরা থাকতো, তখন রেলগাড়ি চলাচলের সময় এক ধরণের শব্দ হতো। আবার শীতকালে যখন বিলটি প্রায় শুকনো থাকতো, তখন শব্দটা অন্য ধরনের হতো। চব্বিশ ঘণ্টায় লাইনটি দিয়ে দিনে দুটি ট্রেন চলতো, রাতে দুটি। মাঝে মাঝে মালবাহী ট্রেনও চলতো। আবার দিনে ট্রেন চলার আওয়াজ এক ধরণের হতো, রাতের বেলায় অন্যরকম। বিশেষ করে খুব ভোরে ফজরের ওয়াক্ত শুরুর আগে আগে একটি ট্রেন যেত, সেটার শব্দটা ছিল একেবারেই অন্য রকমের। সেই ট্রেনের চালক অনেক দূর থেকে লম্বা কুউউউউ হুইসেল দিতে দিতে আসতো। যেতও লম্বা হুইসেল দিয়ে। উল্লেখ্য যে তখন ট্রেনগুলো চলতো ভোঁশ ভোঁশ করা কয়লার কালো স্টীম ইঞ্জিন দিয়ে। ডিজেল চালিত ইঞ্জিন এসেছিল আরও অনেক পরে। ষাটের দশকের শেষের দিকে ভেঁপু বাজানো হলদে রঙের ডিজেল ইঞ্জিনগুলো দেশে আমদানী করা হয়। প্রথমে সেগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে চলে, পরে আসে উত্তরাঞ্চলেও।
আমার দাদাবাড়ির দক্ষিণ দিক দিয়ে পূবে-পশ্চিমে চলে গেছে একটি প্রশস্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। সেই রাস্তাটি দিয়ে মহিশষখোঁচা ইউনিয়ন ও গোবর্ধন অতিক্রম করে তিস্তা নদী নৌকায় পার হয়ে হারাগাছ দিয়ে রংপুর শহরে যাওয়া যেত। এখন অন্য দিক দিয়ে ভালো পাকা রাস্তা হয়ে যাবার কারণে সেই রাস্তাটি আর কেউ তেমন ব্যবহার করে না। প্রতিটি ট্রেন যাওয়া আসার প্রায় আধ ঘণ্টা পরে সেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটি দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসা যাত্রীগণ জোর গলায় আলাপ করতে করতে পশ্চিম দিকে চলে যেত। রাতের বেলায় আমি বিছানায় শুয়ে তাদের সেই আলাপচারিতা শুনতে পেতাম। রাত দশটার আর ভোর রাতের ট্রেনের যাত্রীরা অনেক সময় গান গাইতে গাইতে হেঁটে যেতেন। কথিত আছে, গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে যাবার সময় অনেক মানুষ ভয়ে গান ধরতেন। আমাদের বাড়ির অদূরে পূর্বদিকে ছিল একটি অতি প্রাচীন বটগাছ। সেই গাছের নিচে ছিল একটি শ্মশানঘাট। সুনিবিড় গাছপালায় ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঐ এলাকাটা অতিক্রম করার সময় দিনের বেলায়ও গা ছমছম করতো।
ছোটবেলায় ট্রেনের যাওয়া আসার শব্দ শুনলে আমি দৌড়ে গিয়ে বিলের দক্ষিণ পাশে দাঁড়াতাম। বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপারে পিলপিল করে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা যাত্রীদেরকে দেখে মনে অনেক ভাবনার উদয় হতো। রাত আটটার দিকে সকালে পশ্চিমে যাওয়া একটি ট্রেন পূবের পথে ফিরে আসতো। শব্দ শুনতে পেলে সেটাকেও দেখার জন্য অন্ধকার রাতে চুপিচুপি বিলের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াতাম। রাত হলে ট্রেনের কামরাগুলোতে বাতি জ্বলতো। দূর থেকে তখন কামরাগুলোকে ছোট ছোট খেলনা গাড়ির মত মনে হতো। ম্যাচবক্সের মত চলমান সেই আলোকোজ্জ্বল খেলনাগুলোকে দেখে মনে প্রভূত আনন্দ পেতাম। ট্রেন চলে যাবার পর আবার আঁধার হাতড়িয়ে জোনাকি দেখতে দেখতে বাড়ির উঠোনে ফিরে আসতাম।
সে সময়ে রেলওয়ে স্টেশন থেকে নিজ নিজ গৃহে যাবার উদ্দেশ্যে পুরুষদের জন্য একমাত্র বাহন ছিল বাইসাইকেল, অথবা পদব্রজে গমন। কদাচিৎ দুই একজন ধনী লোককে দেখা যেত গ্রামের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে মটর সাইকেল চালিয়ে যেতে। ওরা ছিল শহর থেকে আসা আগন্তুক, ওরা গ্রামে থাকতো না। অবস্থাপন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদের জন্য বাহন ছিল গরু অথবা মহিষের গাড়ি। সেসব গাড়ির ছই এর সম্মুখ ও পেছনভাগ শাড়ি অথবা চাদর দিয়ে ঢাকা থাকতো, যেন বাহিরের কেউ ভেতরের যাত্রীদেরকে দেখতে না পায়। মহিলাদের গাড়িতে শিশুরাও স্থান পেত। কোন মহিলা যখন “নাইওর” শেষ করে শশুড়বাড়ি ফেরত যেত, প্রায়শঃ তারা করুণ সুরে বিলাপ করতে করতে যেত। তাদের সেই বিলাপের সুর আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যেত।
আজ সকালে হাঁটার পথে কিছুটা পথ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’র নিচ দিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেছে কমলাপুর-বিমানবন্দর রেলপথ। হঠাৎ একটি ট্রেন বিমানবন্দরের দিক থেকে এসে দ্রুতবেগে কমলাপুরের দিকে চলে গেল। আমি ট্রেনের শেষ বগিটা না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম। দুই একটা দুরন্ত বালক ট্রেনের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে নৃত্যের ভঙ্গিমা করছিল। নিচে পড়ে যাবার কোন ভয় ওদের মনে ছিল না। বয়সটাই ওদেরকে সে (দুঃ)সাহস যুগিয়েছে। ভয়কে জয় করে ওরা উল্লাসে মেতে ওঠে। আমি পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম। সামান্য পথ হাঁটতেই আবার একটা ট্রেনের ভেঁপু শুনতে পেলাম। এবারে দেখতে পেলাম, অপরদিক থেকে একটি ট্রেন বিমানবন্দরের দিকে দ্রুতবেগে ধাবমান। একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করবো বলে পকেট থেকে সেলফোনটা বের করতে করতে সেটাও ফ্রেমের বাইরে চলে গেল। তবে আমি জানি সকালের এই সময়টাতে ঢাকা থেকে বহির্গামী এবং ঢাকার বাইরে থেকে অন্তঃমুখী বহু ট্রেন ৫/১০ মিনিট পরপর যাওয়া আসা করতেই থাকে। তাই আমি ফুটপাথ ছেড়ে একটু ভেতরের দিকে সুবিধামত জায়গায় সেলফোন ক্যামেরাটি হাতে রেডী রেখে বসে পড়লাম। ঠিকই, পাঁচ মিনিটের মাথায় একটি নয়, দু’দিক থেকে পরপর দু’টি ট্রেন এসে একে অপরকে পাশ কাটিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে চলে গেল। আমি সেই বিরল দৃশ্যটির একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করে রাখলাম।
আমাদের এখানে যারা নিয়মিত হাঁটাহাটি করেন, তাদের মধ্যে আমার কিছু পরিচিত মুখ খেয়াল করেছেন যে আমি চলন্ত ট্রেন যেতে দেখলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, ট্রেনের ছবি তুলি। আজ সকালে তেমন একজন পরিচিত মুখ আমাকে দেখে নিজেও থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ট্রেনটি চলে যাবার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী দেখি এবং কিসের ছবি তুলি। গত পরশুদিনও একজন জ্যেষ্ঠ কলীগ এবং বড়ভাই একই প্রশ্ন করেছিলেন। উভয়ের কাছে আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ছোটবেলা থেকেই আমার চলন্ত ট্রেন দেখতে ভালো লাগতো, এখনও লাগে। তাই আমি এখনও চলমান ট্রেন যেতে দেখলে একটু তাকিয়ে দেখি, সম্ভব হলে ছবিও তুলি। তাদেরকে আমি কি করে বুঝাই, একটি চলন্ত ট্রেনের দৃশ্য অথবা শব্দ আমাকে কী দিয়ে যায়, অথবা আমার কাছ থেকে কী নিয়ে যায়!
গতির পিছু ধাওয়া করার সাধ্য আমার নেই।
মনটা পিছু নেয়, তাই গতিময় কিছু দেখলেই!
পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম। মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ডের একটি চলমান দৃশ্য মনের পর্দায় নানা রকমের ফ্ল্যাশব্যাক প্রক্ষেপণ করে চললো। সেসব দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে প্রাতঃরাশ শেষে ভাবলাম, লিখেই ফেলি না কেন সেসব ফ্ল্যাশব্যাকের কথাগুলো!
উপরের প্রথম পাঁচটি অনুচ্ছেদে সেসব কথাই বলে ফেললাম।
জীবন এগিয়ে যায়,
স্মৃতি ছুটে চলে পিছে।
মানুষ ফিরে ফিরে চায়,
ফেরার চেষ্টায় মিছে।
রেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া
ধায় না সম্মুখপানে,
পেছনেই তার নোয়া
ইঞ্জিন ধায় সামনে।
ঢাকা
২০ কার্ত্তিক ১৪৩২
০৫ নভেম্বর ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ১০৩৫

০৫ নভেম্বর ২০২৫, সকাল ০৬-৪৩।

রেললাইনের অপর পার্শ্বে Radisson হোটেলের শীর্ষ অংশ দেখা যাচ্ছে।
০৫ নভেম্বর ২০২৫, সকাল ০৬-৫০
চলন্ত দুটি ট্রেনের ভিডিও ক্লিপটা আপলোড করতে পারলাম না বলে দুঃখিত; কারণ কিভাবে তা আপলোড করতে হয়, সে জ্ঞানটুকু আমার নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


